অপ্রেম

যখন মেঘলা আকাশ ঝকঝকে দুপুরকে ঝুপ করে ধূসর করে ফেলে, তখন খুব উত্তম-সুচিত্রার কথা মনে হয়। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে ঠিক উত্তম-সুচিত্রা নয়, মনটা আসলে খুব নস্টালজিয়ায় ছেয়ে যায়। এখন থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগে সেই নববইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের এরকম দুপুরগুলোতে নানি ভিসিয়ারে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতে বসতেন। তখন তো আর ইউটিউব, নেটফ্লিক্স ছিল না; আর ইন্টারনেট বলতে ছিল কিছু ই-মেইলের চালাচালি। তাও কালেভদ্রে। সে-সময় জানালা বলতে আমরা বুঝতাম বরফিকাটা লোহার গ্রিলের সত্যিকারের জানালা – কম্পিউটারের উইন্ডো নয়। সে-জানালাগুলো দিয়ে দেখা যেত আকাশ নয়তো পাশের বাড়ি। সেসব দিন তো এখন জাদুঘরে। সেই নববইয়ের দশক থেকেই আকাশ-সংস্কৃতির হাঁটিহাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু। সে-সময় থেকে ডিশ অ্যান্টেনার রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছিল। মধ্যবিত্তের ঘরের প্রধান বিনোদন ভিসিয়ার আর টেপরেকর্ডার। বড় রাস্তাগুলোর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো দোকানগুলোর মধ্যে অন্তত একটা থাকত ভিডিও বা অডিও ক্যাসেটের। নানির আগ্রহ ছিল শুধু উত্তম-সুচিত্রার ছবিতে। হারানো সুরঅগ্নিপরীক্ষাবিপাশাইন্দ্রাণীসপ্তপদী এই কয়টা সিনেমার ভিডিও ক্যাসেট আমাদের বাসায় ছিল। ঘুরেফিরে নানি তা-ই দেখতেন। তাও আবার মেঘলা দিনে। সেদিন যদি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না থাকত বা অন্য কোনো কারণে আমি বাসায় থাকতাম তবে ভিসিয়ার চালিয়ে দেওয়ার জন্য আমার ডাক পড়ত। প্রায়ই দেখা যেত ছবি চালিয়ে দিয়ে আমিও নানির পাশে বসে পড়ছি। তাতে যোগ দিত বুলি। সে আমাদের জন্য সরষের তেল, কাঁচামরিচ আর ধনেপাতা দিয়ে মুড়ি-চানাচুর মেখে নিয়ে আসত। সে ছিল তৃতীয় দর্শক। বুলি অনেকদিন ধরে আমাদের বাসায় কাজ করত। আম্মা ওকে খুব ভালোবাসতেন। বুলির যদি জ্বর হতো, তখন আম্মা নিজের হাতে ভাত মাখিয়ে ওকে খাইয়ে দিতেন। কিন্তু কেন জানি আমি বুলিকে খুব বকাবকি করতাম। তখন মনে হতো বাসার কাজের বুয়াকে বকাবকি করাই স্বাভাবিক।যে নিজে আমি রান্নার ‘র’ও জানি না, সেই আমি প্রতিদিন বুলির হাতের সুস্বাদু মাছের দোপিঁয়াজা খেতে খেতে গজগজ করছি ‘তুমি বড্ড বেশি তেল আর পেঁয়াজ খরচ করো।’ আম্মা মাঝেমধ্যে মিষ্টি করে আমাকে বোঝাতেন – ‘ওরা গরিব মানুষ। এমনিতেই নানা কারণে ওদের অনেক মন খারাপ থাকে। ওদের সঙ্গে আর বেশি খারাপ ব্যবহার করতে নেই।’ তখন মনে হতো আম্মার থেকে সংসার আমি অনেক বেশি ভালো বুঝি। বাসার কাজের মানুষদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করলে তো ওরা মাথায় উঠে যাবে। আসলে সে-সময় মানুষটা আমি আসলেই অনেক খারাপ ছিলাম। অকারণেই অনেকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে গেছি। তার একজন হলো তন্ময়। তবে তন্ময়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ না করেও উপায় ছিল না। আমার সন্দেহ হতো সে বোধহয় আমার প্রেমে পড়েছে। মেয়েদের কিছু ব্যাপারে সহজাত সতর্কতা থাকে। তার প্রতি আমার রু্ক্ষতা ছিল এক অর্থে জানিয়ে দেওয়া যে, শুধু শুধু আমার অপেক্ষায় থেকে কোনো লাভ নেই। সে কোনোদিনই আমার প্রেমিক হতে পারবে না। আমি মানুষটা অন্যদিকে একটু খারাপ হলেও এদিক থেকে সৎ। এরকম নীরব প্রেমিকদের কষ্ট পাওয়া দেখতে ভালো লাগত না। তাদের কেন ঝুলিয়ে রাখব? প্রশ্নই আসে না। কিন্তু কেউ শখ করে কষ্ট পেতে চাইলে সেখানে আমার করার কী থাকতে পারে? তন্ময়ের ধৈর্য অনেক। শেষ পর্যন্ত সে আমার জীবনে গেঁথে গেছে। বিশেষ করে মেঘলা আকাশ আর ধূসর দুপুরে। সেই বিশ-পঁচিশ বছর আগে এরকম সময়টাতে নানির সঙ্গে বসে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখতাম। এরকম এক দুপুরে হঠাৎ করেই ঝড়ো হাওয়ার মতো কাকভেজা হয়ে তন্ময় বাসায় এসে ঢোকে। বুলি এক দৌড়ে একটা তোয়ালে আনতে ছোটে। বাসার সবাই জানত আমার প্রতি তন্ময়ের নীরব ভালোবাসার কথা। বুলি অবশ্য মনে করত একদিন সত্যি সত্যিই তন্ময়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। সামনের বাড়ির গৃহকর্মীকে সে একদিন এ-কথা বলেওছিল। এ-কান সে-কান হয়ে একদিন সে-গুজব আমার কাছে পৌঁছে যায়। বুলির ওপর আমার অকারণ রাগের এটাও একটা কারণ হতে পারে। তোয়ালে দিয়ে তন্ময়ের মাথা মোছা নিয়ে বুলি যখন অতিরিক্ত ন্যাকামি দেখাচ্ছিল, তখন আমি হঠাৎ করেই উত্তমকুমার আর তন্ময়ের মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য খুঁজে পাই। সেই থেকে দুপুরের মেঘলা আকাশ মানেই উত্তম-সুচিত্রা আর উত্তমকুমার মানেই তন্ময়। সবকিছু মিলেমিশে একাকার। এমনকি এই মাঝবয়সেও। মাঝের এই দীর্ঘ সময়টির মধ্যে নানি মারা গেছেন, বুলি গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে অনেক আগেই উধাও হয়ে গেছে। আর তন্ময়?

দুই

গ্রীষ্মে মাঝেমধ্যে পারদের সেলসিয়াসের মাত্রা এমন লাফিয়ে উঠত যে, আমরা মজা করে বলতাম চুলোর আর দরকার নেই, রাস্তার ওপর সসপ্যান রেখে তাতেই একটা ডিম পোচ করা যাবে। সেরকমই এক ডিম-পোচ দুপুরে হঠাৎ শুনি কলিংবেলের আওয়াজ। দরজা খুলে দেখি তন্ময়। তার হাতে ছিল সমরেশ মজুমদারের কালবেলা আর একটি বেলফুলের মালা। সে জানত বেলফুল আমার খুব পছন্দের। উত্তরা থেকে মগবাজার – পথটা কম দূরত্বের নয়! এটাই সাধারণ ভদ্রতা হতো যে, আমি তাকে বাসার ভেতর আসতে বলব, বসতে বলব, কিছুক্ষণ গল্প করব – অথচ এসবের ধার ধারলাম না। সেদিন খুব নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলাম। ঠিকই তার দেওয়া উপহার গ্রহণ করেছিলাম – বিনিময়ে তাকে আমি দরজা থেকে সোজা বিদায় করে দিলাম। অথচ ঝাঁঝাঁ রোদ্দুর মাথায় বয়ে ছেলেটা এতটা পথ এসেছিল আমাকে একটু দেখবে এই আশায়! অস্বীকার করব না, তন্ময়ের এরকম ভালোবাসার প্রকাশ ভেতরে ভেতরে আমাকে বেশ পুলকিত করত; কিন্তু প্রকাশ্যে আমি তার সঙ্গে খুবই অমার্জিত ব্যবহার করতাম। এখন আমি সেসব ঘটনার জন্য অনেকটাই অনুতপ্ত। অবশ্য অনুতপ্ত এজন্য নয় যে, কেন তন্ময়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালাম না – বরং এজন্য যে, আমি তখন কেন এত অমার্জিত ছিলাম? অবশ্য আমরা মেয়েরা সে-বয়সটাতে ইচ্ছা করেই ছেলেদের সঙ্গে অনেক অভদ্র আচরণ করতাম। বিশেষ করে কেউ যদি প্রেমে পড়ে যায় তার সঙ্গে। মধ্যবিত্ত সমাজ এমনিতেই মেয়েদের নামে কুৎসা রটানোর জন্য ওত পেতে থাকে। তন্ময়ের সঙ্গে একটুখানি হেসে হেসে কথা বললাম আর অমনি রটে যাবে যে, ছেলেটাকে আমি নাকে দড়ি দিয়ে নাচাচ্ছি। এজন্য বেশি বেশি করে তন্ময়কে এড়িয়ে যেতাম। আমাদের তেমন দেখা হতো না, কথা হতো না, তারপরও ছেলেটা কীভাবে যেন আমাদের পরিবারের সঙ্গে মিশে গেল। ওর আববা আর আমার আম্মার দেশের বাড়ি একই গ্রামে। গার্মেন্টসের ব্যবসায় ওর আববা বেশ নাম করেছে। আম্মার খুব পছন্দ ছিল তন্ময়কে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার প্রেম হলো ওয়াসীর সঙ্গে। এমন নয় যে, মাঝেমধ্যে ওর প্রতি আমার কোনো প্রেমবোধ হয়নি, হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার ওয়াসীর সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যায়। এ-ঘটনার পরপর তন্ময় কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। পরে শুনেছিলাম সে-সময়টায় সে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একসময় ডেঙ্গু বাধিয়ে ঢাকায় ফেরে। তাও আবার যেই-সেই ডেঙ্গু নয়। এক চিকিৎসক ওর অচেতন অবস্থা থেকে ফেরার আশা হিসেবে সবাইকে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করেন। খবর শুনে আমি একছুটে হাসপাতালে চলে আসি। সঙ্গে ওয়াসীও ছিল।

তিন

আগেও বলেছি তন্ময়ের জন্য মাঝেমধ্যে আমার একটু একটু প্রেমবোধ হতো। এজন্য আমরা বন্ধু হতে পারিনি। তারপরও বলব তার সঙ্গে আমার একটা নাম-না-জানা সম্পর্ক ছিল। অনেকটা বেলফুলের সুরভির মতো। ওয়াসীর সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার পর তন্ময় তো পারত আমার নামে কুৎসা রটাতে, আমাকে ঘৃণা করতে – কিন্তু সে তা করেনি। বরং ওর কাছের বন্ধুরা যখন আমার ওপর খুব রাগ করেছিল, তখনো আমার প্রতি ছিল ওর পূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ। বিনিময়ে আমিও তাকে শ্রদ্ধা করতে শিখলাম। সেবার হাসপাতালে অচেতন তন্ময়ের মাথার কাছে বসে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আশপাশে ওর আত্মীয়রা কোরআন শরিফ পড়ছিল। জানি না তারা কী ভাবছিল কিন্তু আমি বারবার তন্ময়কে অনুরোধ করলাম ওকে ফিরে আসার জন্য। অচেতন তন্ময় অচেতনই থেকে গেল, আর আমি ফিরে এলাম একবুক হাহাকার নিয়ে। দুদিন পরেই আমার সেই হাহাকার উল্লাসধ্বনিতে পরিণত হলো – তন্ময়ের জ্ঞান ফিরেছে। সে ফিরে এলো। ফিরে আসা তন্ময়কে নিয়ে বন্ধুরা কম দুষ্টুমি করত না। তারা ওকে খেপাতে লাগল এই বলে যে, আমার কারণেই মরতে বসা আবার আমার কারণেই বেঁচে ওঠা। আমার অবশ্য এ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না, এজন্য নয় যে, তখন আমি ওয়াসীর প্রেমে বিভোর, বরং এজন্য যে, বেলফুলের সুরভি নিয়ে তখন আর ভাবছিলাম না। কিন্তু জীবন তো আর সরল অঙ্কের মতো সবসময় সরলরৈখিক গতি মেনে চলে না। কঠিন সময়ে জীবনে কখনো কখনো খাপছাড়া জটিল হিসাবের অঙ্ক কষতে হয়। সেরকমই এক কঠিন সময়ে তন্ময়ের সঙ্গে আমার প্রায় বিয়ে হতে গিয়েছিল।

চার

ওয়াসীর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের কার্ড বিলি হয়েছে। ওয়াসী আর আমি বিদেশ যাব লেখাপড়া করতে। তবে দুজন আমেরিকার দুটি ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়েছিলাম। তন্ময় তখন ওর বাবার ব্যবসা দেখতে শুরু করেছে। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। হঠাৎ একদিন খবর এলো, ওয়াসীর পরিবার আমাদের কাছে আসবাবপত্র যৌতুক চাচ্ছে। খবরটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াসীকে ফোন করলাম। বললাম, ‘এটা হতে পারে না।’ জানি না আমাদের মধ্যে আর কী কথা হয়েছিল। রাতের বেলা আমাদের একসঙ্গে গায়েহলুদের অনুষ্ঠানও হলো। তন্ময় খুব মজার মজার প্যারোডি গান বানিয়েছিল। বন্ধু-বান্ধবীরা ওয়াসীকে আচ্ছামতো পচিয়েছিল। গানশেষে নাচ হলো। মনে আছে কিছুক্ষণের জন্য তন্ময়ের সঙ্গে আমি নেচেও ছিলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর দুই পরিবারের মধ্যে খুব ঝগড়া বেধে গেল। পরেরদিন ভোরে তখনো আমাদের পরিবারে বিয়ের আয়োজন চলছিল। কিন্তু ওয়াসীদের পরিবার থেকে খবর এলো ওরা আর বরযাত্রী হয়ে আসছে না। বিয়ে বাতিল। সমস্যা শুধু দেনমোহর আর যৌতুক নিয়ে নয়, আমার চরিত্র নিয়েও ওদের অনেক সন্দেহ আছে। আমি নাকি একাধিক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি। অধিক শোকে পাথর কথাটার মর্মার্থ সেদিন বুঝেছিলাম। তারপরও নিজের মান-অপমান ভুলে বারবার ওয়াসীকে ফোন করছিলাম। ওপারে সে নিরুত্তর। আর আরেকদিকে তন্ময়ের বাবা আম্মাকে ফোন করলেন। জীবনের সেই বিধ্বংসী-মুহূর্তে দুই পরিবার থেকে তন্ময়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হলো; কিন্তু আমি বেঁকে বসলাম। সবাই মিলে আমাদের দুজনকে তন্ময়ের গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। এই প্রথম তন্ময়ের সঙ্গে আমি এক গাড়িতে। পেছনে সবাই যখন আমাদের বিদায় দিচ্ছিল, তখন তারা প্রায় নিশ্চিন্ত ছিল যে, আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে। জীবনে সেই একটিবারের মতো আমি নিজেও তা চাচ্ছিলাম। রাস্তার দুপাশটা আমার পরিচিত। ওয়াসীর সঙ্গে অনেকবার এ-পথ দিয়ে অভিসারে বেরিয়েছিলাম। চালকের আসনে তন্ময় নিবিষ্টমনে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পথে।

পাঁচ

সিমেন্ট-বাঁধানো লম্বা পথ অনেকদূর চলে গেছে। দৃষ্টিসীমার বাইরে। পথের পাশে হিজল-তমাল বরই-জারুল গাছের ছন্দোবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা। ওয়াসী খুব গাছদের নাম জানত। একটার পর একটা নাম সে বলে যেতে পারত। সব বিষয়ে ছেলেটার খুব জ্ঞান ছিল। ওর এই বিষয়টি আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। হায়! জ্ঞান! মুগ্ধতা! ওয়াসী কী করে পারল এমন করতে! চারপাশে চাপ চাপ কষ্ট। কেউ যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে একশতলা বিল্ডিং থেকে ফেলে দিলো। ক্রমশ তলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি। আবার ওদিকে অন্ননালি ঠিকরে একরাশ ঘৃণা উপচে উঠছে।

‘তুমি ঠিক আছো? ওপাশের বেঞ্চটাতে একটু বসবে?’

পাশে থাকা তন্ময়ের কথা আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। ওর কণ্ঠস্বর আমাকে ভরসা জোগাল। মনে হলো এই মানুষটাই বুঝবে আমার এখন কেমন লাগছে। হাহাকারের মতো বলে উঠলাম, ‘ওয়াসী আমার সঙ্গে কেন এমন করল? কেন? সেটা কি ওর পরিবারের কাছে ভালো ছেলে থাকার জন্য? নাকি আমি তার কাছে পুরনো হয়ে গিয়েছিলাম? সে কি সম্পর্ক থেকে বেরোবার জন্য একটা পথ খুঁজছিল? তাহলে কেন তা আমাদের বিয়ের দিন? আমি কী এমন করেছিলাম ওর সঙ্গে যে, এত বড় ক্ষতি সে আমার করতে পারল? এখন আমি লোককে মুখ দেখাব কী করে?’

‘কোনটা তোমার বেশি খারাপ লাগছে? তোমাদের বিয়েটা হচ্ছে না সেটা, নাকি লোকে কী ভাববে এই অপমানবোধ?’

পড়ন্তশীল আমি হঠাৎ যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তন্ময়কে আমার সবসময়ই খুব ছেলেমানুষ মনে হতো। মনে হতো আমার মনের গভীরতা সে কখনো বুঝতে পারবে না। অথচ এখন কত সহজে সে আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। এ-ঘটনার আগে আমার জীবনে তেমন কোনো ব্যর্থতার স্বাদ ছিল না। জানতাম না যে, এক ব্যর্থতার মধ্যে অনেক রকম অনুভূতি লুকিয়ে থাকে। না-পাওয়ার যন্ত্রণা, অপমান, অনিশ্চয়তা, অসম্মান, সমালোচনা…। আমি ব্যর্থ! ব্যর্থ হলে মানুষ কেমন আচরণ করে? ‘আমার একদমই কিছু ভালো লাগছে না। আমি সবকিছু থেকে অনেকদূরে চলে যেতে চাই।’

‘যাবেই তো। তোমার প্লেনের ফ্লাইট ঠিক আছে। ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন ঠিক আছে। তোমাকে কে আটকাচ্ছে?’

তাই তো! ভুলেই গিয়েছিলাম যে, কদিন পর আমি এমনিতেই দেশ ছাড়ছি। সবার থেকে দূরে চলে যেতে পারব। কিন্তু নিজের থেকে? এই ব্যর্থতার অনুভূতি বইব কী করে?

‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, ওয়াসী আমার সঙ্গে এমন করতে পারে!’ ঘুরেফিরে আমার চিন্তাভাবনাগুলো বারবার একই জায়গায় চলে আসছে।

‘নিজের জন্যই তোমার অতীত থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’

‘কীভাবে?’

‘নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এজন্য একটু সময়ের প্রয়োজন।’

হঠাৎ মনে পড়ল তন্ময়ের সঙ্গে এখানে আমি কেন এসেছিলাম। তন্ময়ের জন্য আমার একটু-আধটু প্রেমবোধ হয়েছিল; কিন্তু কখনো ওর সঙ্গে আমি সংসার করছি তা ভাবতে পারি না। আর এ-মুহূর্তে তো নয়ই। যে-কষ্ট আমাকে ওয়াসী দিয়েছে সেই একই কষ্ট তো আবার আমাকে তন্ময়কে দিতে হবে। নাকি সে আগে থেকেই এই কষ্ট বহন করে চলছে?

‘বাসার সবাই ভাবছে, আজকে আমাদের বিয়ে হবে। অথচ আমাদের জীবনের লক্ষ্য আলাদা। আমি জানি তুমি দেশে ব্যবসা করবে। অথচ আমি সবসময়ই প্রবাস-জীবনের কথা ভেবে এসেছি, হায়ার ডিগ্রি, চাকরির সুবিধার কথা ভেবে।’

‘দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া থাকলে এটি কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমার বন্ধুর বড়ভাই জাফরভাই আর সুমি ভাবির এরকম অবস্থা ছিল। তারা আমার দেখা একটি অত্যন্ত সুখী দম্পতি।’

‘আমি এখন এর জন্য প্রস্তুত নই।’ কী সহজে কথাটা বলে ফেলতে পারলাম! ওয়াসীও নিশ্চয় ঠিক এমন সহজভাবেই আমাকে ওর জীবন থেকে বাদ দিতে পেরেছিল, যার জীবনে আমার কোনো গুরুত্ব নেই তাকেই আমি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে ব্যর্থ ভাবতে শুরু করেছি! ‘তন্ময় তোমার জীবনে আমাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কষ্ট পেও না।’

‘আমার কথা ভেবে মনের মধ্যে কোনো চাপ তৈরি করো না। আমি তো অনেক আগেই নিজেকে বুঝিয়েছি তুমি আমাকে চাও না। কষ্ট যা পাওয়ার তা আগেই পেয়ে গেছি। আর তোমার পরিবারের সবাই বিষয়টি বুঝবে।’

‘তুমি আমার সঙ্গে এখানে আসতে চাইলে কেন?’

‘যদি কোনো কারণে আমাকে তোমার প্রয়োজন হয়। বিয়ে করতে চাইলে বিয়ে করতে পারো। তা যদি না চাও কাঁধ বাড়িয়ে দিতে পারি। সেখানে মাথা রেখে কিছুক্ষণ কাঁদতে পারো।’

তন্ময়ের কথার ভঙ্গিতে খুব হাসি পেল। ‘ধ্যাৎ, নিজেকে অত সস্তা করে ফেলো না।’

‘তুমি খুব দামি। তোমার পাশে এলে এমনিতেই নিজেকে খুব সস্তা মনে হয়।’ ‘তোমরা ছেলেরা শুধু শুধু এসব কথা বলে আমাদের মাথা নষ্ট করো। তারপর সময়মতো দশতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দাও। ওসব দামটাম আসল বাজারে গেলে সব উড়ে যায়।’

‘তুমি ভুল ছেলেকে ভালোবেসেছিলে।’

‘ভাগ্যিস তা বেসেছিলাম। তাই তো সময়মতো শিক্ষাটা পেলাম।’ অনেকটা চিন্তাভাবনা না করেই কথাটা বলে ফেলার পর দেখলাম মনের ভেতরের গুমোট কষ্টটা খুব ধীরে ধীরে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, তন্ময় ঠিকই বলেছে। সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। একদিন আসবে, যখন আমার আর এই কষ্টটা থাকবে না। তাহলে তন্ময়কেও এখন কিছুটা আনন্দময় সময় উপহার দিই না কেন?

‘সুদিপার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তুমি একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছিলে। সেদিন আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। খুব অল্প সময়ের জন্য।’

‘তখন যদি তোমাকে প্রপোজ করতাম তাহলে আমার সঙ্গে পার্টটাইম একটা প্রেম করতে?’

‘না। এজন্য দেখো না তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুত্বটাও এড়িয়ে গেছি।’

‘ডেঙ্গু হয়ে যখন প্রায় মরতে বসেছিলাম, তখন তো ঠিকই হসপিটালে গিয়ে আমাকে জাগিয়ে এলে। জানো, তখন তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। স্বপ্নটা ছিল এরকম যে, থোকা থোকা মেঘের মধ্যে প্লেন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ল্যান্ড দেখতে পারছি না, ফুয়েল শেষ, প্লেন প্রায় ক্র্যাশ করার মতো অবস্থা। তখন হঠাৎ চোখের সামনে তোমার চেহারাটা ভেসে উঠল। মনে হলো শুধু আর একটিবার তোমাকে দেখার জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে হবে। এরপর সত্যি সত্যিই বেঁচে গেলাম।’

‘শুনে খুশি হলাম যে, কখনো তোমার উপকারে লেগেছিলাম।’

‘প্রেমের অনেক শক্তি।’

‘কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা তো কখনো প্রেমের ছিল না।’

‘তাহলে বলতে হয়, অপ্রেমের অনেক শক্তি।’

‘এটা ভালো বলেছ। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের একটা নাম দেওয়া দরকার ছিল। অপ্রেমের সম্পর্ক। নামটা খুব সুন্দর। ওয়াসীর সঙ্গে সম্পর্কটা কখনো অপ্রেমের হবে না। ওকে আমি এখন ঘৃণা করছি। একসময় ভুলে যাব। কিন্তু তোমার সঙ্গে চিরজীবনই সম্পর্কটা অপ্রেমের থেকে যাবে।’

‘এ-সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?’

‘এ-সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের কোনো যোগাযোগও থাকবে না। শুধু জানব, কোথাও না কোথাও তুমি আছো, যার থেকে জেনেছি কীভাবে জীবনের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হয়।’

‘কিংবা মরতে বসলে বেঁচে ওঠার প্রেরণা পাওয়া যায়।’

‘অপ্রেমের অনেক শক্তি, অনেক উপকারিতা। লোকে তাহলে প্রেমে ব্যর্থ হলে এত খেপে ওঠে কেন? মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারে, আঘাত করে, খুন করে – কত কী!’

‘এক দার্শনিকের প্রেমে পড়লে তা হলেই না অপ্রেমের শক্তি বোঝা যায়। সবার ভাগ্যে তো আর তা হয়ে ওঠে না।’

‘তোমরা ছেলেরা সুযোগ পেলে বড্ড বেশি মেয়ে পটাও তারপর…’

‘দশতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিই।’

দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠি। আমাদের কারো ফিরে যাওয়ার অত তাড়া নেই। সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। একসময় আমাদের পথ ফুরিয়ে যায়; কিন্তু আমাদের কথা শেষ হয় না। ফিরতে হবে বলে একসময় ফিরে আসি। জীবনে সেবারই আমাদের অপ্রেমের সম্পর্ক প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছিল। আবার এটাই ছিল শেষ।

ছয়

এরপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছি, নিজের সংসার হয়েছে। মাঝেমধ্যে তন্ময়ের কথা মনে পড়ে। মেঘলা দুপুর, উত্তমকুমার, নানি, বুলি, ভেজা তোয়ালে, সরষের তেলমাখা মুড়ির সঙ্গে খুব অলক্ষে সে জড়িয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি তাকে মনে পড়ে যখন কোনো কিছুতে ব্যর্থ হই। ব্যর্থতার শক্তি, অপ্রেমের শক্তি সবকিছু মিলেমিশে একটা টনিকের কাজ করে। পড়ে গেলে আবার উঠে দাঁড়াতে পারি। পত্রিকা খুলে যখন ব্যর্থ প্রেমিকদের জিঘাংসা আর প্রতিহিংসার ঘটনা পড়ি, তখন খুব ইচ্ছা করে ওদের ব্যর্থতা আর অপ্রেমের মিশেলে তৈরি টনিকের গল্প শোনাই। কেন জানি মনে হয়, এ-গল্প শোনালেই ওরা সব ওদের মতো করে তন্ময় হয়ে যাবে। তন্ময় হতে পারা মানে জিতে যাওয়া। কারণ এত বছর পরও আমি তন্ময়কে নিয়ে গল্প লিখতে বসেছি। অথচ ওয়াসীকে এখন আর ভুল করেও মনে পড়ে না। নিরবচ্ছিন্ন সুখ, নিরবচ্ছিন্ন প্রেম আর ভালোলাগা একটি অলীক ধারণা। ঠিক যেমনটি নিরবচ্ছিন্ন সূর্যের আলো একটি ভয়ংকর ধারণা। আমাদের জীবনে রাতের অন্ধকারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ক্রমাগত প্রেমময় মুহূর্তগুলো কি আমাদের ক্লান্ত করে ফেলে না? তাই জীবনে অপ্রেমপর্বও এত স্নিগ্ধ! ঠিক জোছনারাতের মতো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত