গভীর রাত। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। ভেজাকণ্ঠে একটা মেয়ে বলল, গাছটা না কাটলে হয় না? অসাধারণ মিষ্টি সেই গাছের আম। একবার খেলে চিরদিন মনে থাকবে তার স্বাদ। প্লিজ, গাছটা কাটবে না। তোমার মাকে বলো।
কণ্ঠ শুনে মনে হলো, গোধূলির রংমাখা এক তরুণী। তার সঙ্গে অনেক পথ হেঁটেছি।
সকালে উঠে মোবাইলে নম্বরটা খুঁজে পাই না। মুখ ধুতে গিয়ে দেখি বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই। কলার মোচা থেকে একটা কাঠবিড়ালি আমাকে দেখে লাফিয়ে চাচাদের আমগাছে চলে যায়।
ভেজাকণ্ঠ সারাদিন ভিজিয়ে রাখে। সন্ধ্যায় গোধূলির রং দেখে স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। মেয়েটা কে? তাকে চিনি?
দুই
ঘরের কাজ চলছে। মায়ের রোপণ করা তিনটি আমগাছ কাটা হয়ে গেছে আগেই। এর মধ্যে বড় গাছটাও আছে। আমরা বলি ‘বড্ডা গাছ’। এ-গাছের আম ছোট, তবে মধুর চেয়েও মিষ্টি। এমন ধরা ধরে, খেয়ে শেষ করা যায় না।
গাছ বড় হয়ে যাওয়ায় কেউ উঠতে পারে না, তাই আমও পাড়া হয় না। বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে পাকা আম টুপটাপ ঝরে পড়ে। টিনের চালে পড়লে ঝমঝম করে আওয়াজ হয়। মাটিতে পড়লে হালকা ধপধপ শব্দ হয়। রাতে শোয়ার আগে ও ভোরে আম কুড়াতাম আমরা। ছোট খাঁচায় এক খাঁচা আম সহজেই পাওয়া যেত। আমরা খেতাম, পাড়া-পড়শি খেত, পাখিরা খেত আর খেত কাঠবিড়ালি। আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া হতো। তবু শেষ হতো না গাছটার আম।
বাকি দুটি গাছের মধ্যে একটার আম পাকলেও রং সবুজ থাকে। শেষ গাছটা মাঝারি সাইজের। বড় বড় আম, একটু লম্বাটে। দেখলে আদর লাগে। ছোটবেলায় খাওয়া আমৃতির মতো মিষ্টি। সেই গাছের ইতিহাস মধুর, আবার করুণও। গাছটার কথা আমি মনে করতে চাই না।
ছোটকালে বাবা বড় গাছটায় উঠে আম পাড়তেন। আমরা দৌড়ে দৌড়ে কুড়াতাম। এক হাতে ঝুড়িতে রাখতাম, আরেক হাতে ছুলে খাওয়া শুরু করতাম। হাত বেয়ে রস গড়িয়ে পড়ত। বাবা নেই, গাছগুলোও নেই হয়ে গেল। এত বছরের গাছ, শেকড়সহ উপড়ে নিতে লেগেছিল মাত্র তিনদিন।
আমরা তিন ভাই, এক বোন। আপার বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে। এখনো সন্তান হয়নি। বড় গাছে আম ধরলেই বাবা দুষ্টু বালকের মতো বলতেন, অ্যাই।
মা বলত, কী?
ইশারায় গাছটা দেখিয়ে বলতেন, তোঁয়ার নাতিন…
মা ইশারা করত না বলার জন্য। আমরা বুঝে যেতাম, বাবা বলতে চাইছেন, এবার আপার সন্তান হবে।
ঘরের পাশে বড় গাছ রাখা যায় না। তাই না কেটে উপায় ছিল না। কাটার পর থেকে মা কেমন অস্থির। বাবাকে যেন দ্বিতীয়বার হারাল। আমগাছ কাটলে গাছের গা থেকে কস বের হয়। তার শাশুড়ি বলতেন, এটা গাছের কান্না। তার মনও কসের মতো হয়ে গেছে। কী যেন চিন্তা করে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না।
পুকুরের পূর্বপাড়ের রেইন্ট্রিটা এবার কাটতেই হবে। আমরা বলি চাক্কা গাছ, কেউ কেউ ঘুমগাছ আবার কেউ কড়ইগাছও বলে। কোথাও বলে শিশুগাছ। আমি জানতাম না গাছটা বৃষ্টির শব্দ শুনতে পায়। বৃষ্টি আসার আগে তার পাতাগুলো ভাঁজ করে ফেলে। বৃষ্টি এলে পাতায় জমা রাখে। রোদে মেলে দেয় পাতা। জলকণা তখন বাতাসের সঙ্গে উড়ে বেড়ায়।
সেই গাছ কাটতে গিয়ে অদ্ভুত এক লোকের খপ্পরে পড়েছিলাম। লোকটাই আমাকে এ-কথা বলেছে। খলিলদের কাঠ কাটার সময় তাকে প্রথম দেখি। দৈত্যের মতো কুড়াল চালাচ্ছে। মনে হলো প্রাচীনকাল থেকে হেঁটে আসতে আসতে তার মুখ ক্ষয়ে গেছে। লম্বা ফ্যাকাসে দাড়ি, চুলগুলো কয়েক বছরের পুরনো শনের মতো। হাত ও পায়ের আঙুলগুলো একেবারে কুড়ালের ডাঁট। একটা-দুটা নখ পোকায় খাওয়া।
তিন
লোকটা যা করেছিল সে-কথা পরে বলি। ঘটনার শুরু গত ডিসেম্বরে।
মায়ের চিন্তা ছিল সেমিপাকা ঘর করার। দরজা ও চালে শিশুগাছের কাঠ ব্যবহার করবে। গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আইউবভাই পর্যবেক্ষণ করে বলল, গাছটা পেকে গেছে। চেরাইয়ের পর পানিতে ভিজিয়ে রাখবে। দেখবে কেমন শক্ত হয়। সারাজীবন পোকায় ধরবে না।
গাছ কাটার জন্য আইউবভাই একজনকে ঠিক করল। চার হাজার টাকা নেবে। পরদিন সকালে জানায়, গাছ না কেটে লোকটা চলে গেছে।
কেন?
তার পোষাবে না।
কুরিয়ার কোম্পানিতে কাজ করি। চাকরির কারণে শহরে থাকতে হয়, তাই আমিও লোক খুঁজতে পারি না। দিন যায়, ঘরের কাজের পরিকল্পনাও পালটে যায়। বেশিরভাগ আত্মীয়-স্বজন বলল, সেমিপাকা করলে আফসোসের সীমা থাকবে না। দুলাভাই তার বন্ধুকে আনাল। সে অনেকক্ষণ বোঝাল। টাকার সমস্যার কথা জানালে বলল, প্রয়োজনে আমি এক লাখ টাকা দেবো।
আপার শ্বশুরের বন্ধু তাকে বলল, টাকা লাগলে আমি দেবো, তবু সেমিপাকা করতে মানা করো।
শেষমেশ দোতলার ফাউন্ডেশন দিয়ে কাজ শুরু করলাম। এর মধ্যে একদিন উত্তরপাড়ার ফিরোজার জামাই বলল, আমার কাছে খবর আছে।
মাঘের রাত। কুয়াশাও পড়ছে। সকালে লোকটা কাজে চলে যেতে পারে, তাই রাতেই গেলাম। এক বাড়ি পর ছারাং বাড়ি। ওখানে ভাড়া বাসায় থাকে।
ইয়া মোটা গোঁফ। গোঁফের তুলনায় বেঁটে একটা লোক। গাট্টাগোট্টা শরীর। ভাত খাচ্ছিল। ভাতপাত থেকেই উঠে এলো। ফিরোজার জামাই তুই-তোকারি করে মশকরা করছে। কেননা, তাদের বিল্ডিং করার সময় সে দুটি রেইন্ট্রি কেটেছিল। লোকটা হাসতে হাসতে চুষে খেল আঙুলের ভাত।
তার নাম ইউসুফ। চৌমুহনীর দিকে শ্বশুরবাড়ি। নিজের বাড়ি সুয়াবিল। ঠিক হলো, কাল সকালে আসবে।
লোকটা এলো, গাছ দেখল। দূর থেকে ঠিক বোঝা যায় না। মেপে দেখল প্রায় দশ ফুট বেড়। ডালের দিকে তাকিয়ে বলল, বাহ্! এটা যদি সেগুন হতো, স্বর্ণের মতো দাম হতো।
শেষে পাঁচ হাজার টাকায় রফা হয়। সোমবার তারা আসবে। সোমবার চাচাতো ভাইকে নিয়ে এলো। গাছ কাটার জন্য আনা জাহাজের মোটা রশিগুলোর গিঁট খুলল। কাজের জন্য আলাদা করে রাখা কাপড়ও পরল।
উলটে-পালটে দেখার মতো চারপাশ থেকে গাছটা আবার দেখল। কীভাবে কাটা যায়, জলাশয় পার করে রাস্তায় ওঠানো যায় – ভাবছে।
আইউবভাই সাঁকো বেঁধে গাছের টুকরো পার করানোর বুদ্ধি দিলো। মুখ বন্ধ করে, ঠোঁট কামড়ে, দায়ের ধার ও রশি দেখে গাছের বেড় পুনরায় মাপল ইউসুফ। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর মাছরাঙা ছোঁ মেরে পুকুর থেকে মাছ ধরে যেভাবে উড়ে যায়, সেরকম দ্রুত স্বরে বলল, এ-গাছ কেটে কলঘরে নেওয়া যাবে না।
কেন? সবাই একসঙ্গে জানতে চাইল।
গাছের বাকলের দিকে তাকিয়ে ইউসুফ বলে, কতগুলো লোক আছে, করাত দিয়ে গাছ চিরায়। তাদেরকে আনতে হবে। চিরানো ছাড়া এটা নেওয়া যাবে না।
আইউব বলে, নানুপুরের দিকে আছে।
ফিরোজার জামাই জিজ্ঞেস করে, আর কোনো উপায় নাই?
ইউসুফ মাথা নাড়ে।
দেখা যায়, চিরানো ও কাটায় প্রায় পনেরো হাজার টাকা খরচ হবে। এখন ঘরে লাগবে মাত্র তিনটা দরজা। চৌকাঠ হবে গোদাগাছের। এত টাকায় কাটা তাই পোষাবে না।
ঠিক হয়, ইউসুফ গাছটা বেচে দেবে। কিন্তু ডুমুরের ফুল হয়ে হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় সে। ফোন করলেই বলে, ‘বদ্দা, চিন্দে নাই, আঁর খাছে পার্টি আছে।’ তারপর চুপ। কয়েক দিন পর ফোন করলে বলে, ‘পার্টির লয় খথা খৈয়ুম (বলব)।’
এভাবে শীত এলো। পাতা ঝরে পুকুরে ভাসল। বসন্তে ফুটল নতুন পাতা। আইউবভাই ও আমি অনেক খোঁজখবর নিলাম। বেশিরভাগ ক্রেতা মুলায় পাঁচ হাজার টাকা। এর বেশি দাম ওঠে না। তাই অপেক্ষা করি।
চার
শেষ বিকেলে রাস্তার পাশে বসে আছে লম্বা লোকটা। তার নাম জালাল। চোখের পলকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলে দেয়। তাই লোকে তাকে ডাকে আজরাইল। গায়ে গাছের কসের গন্ধ। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
বললাম, গাছটা বেচে দেন।
লোকটা শন-দাড়িতে হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছয় ফুটের মতো লম্বা। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। গাছটা দেখে ভাঙাচোরা মুখ ফেরাল, কত চান?
একটু ভেবে বললাম, পঁচিশ হাজার।
শেষ বিকেলের আলোর মতো মøান কণ্ঠে বলল, দেখব।
তারপর যে লোকটা সন্ধ্যা হয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে, তা কে জানত? তাকে আর দেখি না। আকাশে তার চোখের মতো তারাও ফোটে না। ফোনে কয়েকবার কথা হয়। আমি যেন শুকনা কাঠের সঙ্গে কথা বলি। এক সন্ধ্যায় ফোন করে বলে, একটা কাস্টমার এসেছে। দশ হাজার টাকা দেবে বলল।
আমি কাস্টমারকে আনতে বলি। সে বলে, পার্টি দেখে চলে গেছে। আর আসতে পারবে না।
আরেকটু বাড়তি দিলে ছেড়ে দেব।
না, আর পারবে না।
ঠিক আছে, আরো দেখেন।
কয়েক দিন পর ফোন করলে বলে, সাত হাজার, আট হাজার টাকা মুলায়।
আরেক দিন ফোন করলে বলে, আমি বাড়ি থেকে আসছি। এখন কাটিরহাট।
শহরে যাওয়ার তাড়া আছে। কিছুক্ষণ পর ফোন করি। মোবাইল বন্ধ।
এক বিকেলে লোকটা নিজেই ফোন করে। বলে, আমার কাছ থেকে টিকিট নিয়েছেন, ওগুলো কোথায়?
আপনি কাকে ফোন করেছেন? প্রশ্ন করে নিজের পরিচয় দিলে সে ফোন কেটে দেয়। পরদিন সকালে দেখি রাত তিনটায় ওই নম্বর থেকে মিসড কল এসেছে।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ। স্বাধীনতার দিন। সারাদিন কানে বেজেছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও দেশের গান। একেকটা গান শুনে হৃদয়ে জেগে ওঠে একাত্তর।
রাত সাড়ে দশটার দিকে আজরাইলের নম্বর থেকে ফোন আসে। হ্যালো বলতেই জিজ্ঞেস করে, মিসড কল দিয়েছেন কেন?
আপনার মাথা ঠিক আছে? আমি আপনাকে মিসড কল দিতে যাব কেন? তারপর রেগে বলি, ফালতু।
শুতে শুতে রাত প্রায় দুটো। তিনটার দিকে দেখি ওই নম্বর থেকে ফোন এসেছে। কেটে দিলাম। আবার ফোন। কয়েকবার করার পর ধরে ‘হ্যালো হ্যালো’ করি। কোনো সাড়া নেই।
কিছুক্ষণ পর আবার মিসড কল। একবার, দুবার, তিনবার, চারবার। মোবাইলের রিংটোন অফ করলাম। একটু পর ধরলাম, ধরে চুপ। ওপাশে কোনো কথা নেই। গভীর খাদে কিছু পড়ে যাওয়ার পর যে নিস্তব্ধতা, সে-রকম কয়েক মুহূর্ত, তারপর কেটে দিলো। এরকম বেশ কয়েকবার চলল।
ঘুমে চোখ ভেঙে পড়ছে। কিন্তু লোকটার মিসড কল বেশি বিরক্ত করছে। মনে পড়ল, আগে আমাদের পাড়ায় কাঠ কাটত নাথপাড়ার অশ্বিনীকুমার। তার মতো কেউ পারত না। কাঠ কাটার সময় তার মুখ দিয়ে হশ্বি হশ্বি শব্দ বের হতো। মনে হয় হশ্বি শুনতে শুনতেই লম্বা লোকটা আমাদের এদিকে এসে পড়েছে। সেদিন খলিল বলেছিল, আজরাইলের কুড়ালটা রাক্ষসের দাঁতের মতো ধারালো। যেভাবে বিদ্যুৎ চমকায় সেভাবে তার কুড়াল ঝিলিক দেয়। মুহূর্তেই কাঠ কাটা শেষ। ব্যাটা একটা দৈত্য।
ভাবি, কাল সকালে নাজিরহাট বাজারে যাব। বাজারে স্বপ্ন হোমিও হল নামে নাজিরহাট কলেজের বোটানি স্যারের একটা দোকান আছে। জিজ্ঞেস করব, স্যার, শিশুগাছকে রেইন্ট্রি কেন বলে? ইংরেজরা কেন এ-গাছ রোপণ করেছিল? গাছগুলোর পাতায় কি বেশি জলকণা ও অক্সিজেন জমে?
স্যার হয়তো চট্টগ্রাম নগরীতে রেলের জায়গায় ব্রিটিশদের লাগানো বড় বড় রেইন্ট্রির কথা ভাববেন। তারপর বই খুঁজবেন। বই না পেয়ে বলবেন, আচ্ছা কাল সকালে লাইব্রেরিতে আসিস। পরদিন গিয়ে দেখব, স্যার কলেজে ঢোকার মুখে ফুটে থাকা সূর্যমুখী ফুলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমাকে দেখে হয়তো বলবেন, নিজে বাঁচতে চাইলে গাছকে বাঁচিয়ে রাখবি, বুঝলি?
আমি মাথা নেড়ে দিঘিতে মাছের ঘাই দেখব। তিনি চাঁপা ফুলের দিকে তাকিয়ে বলবেন, তখন আমি ছাত্র। একবার কি হয়েছিল জানিস? ট্রেনে করে বাড়ি যাচ্ছি। ইচ্ছে করে টিকিট কাটিনি। টিটি এলো। বলল, টিকিট দেখান। আমি চুপ করে বসে থাকি। একটু পর বলি, আমার কাছে টাকা নেই, একটা বৃষ্টিগাছ আছে, দেবো?
বৃষ্টিগাছ? ওটা আবার কী?
রেইন্ট্রি। আপনাদের রেলওয়েতে আছে না?
টিটি বলে, গাছ দিয়ে আমি কী করব?
স্যার হাসবেন আর আমার মনে পড়বে, বাড়ির পেছন দিকে অর্থাৎ পশ্চিমে ছোট একটা পুকুর আছে। আমরা বলি বারিছের পুকুর। স্বচ্ছ পানি। দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে বড় একটা রেইন্ট্রি ছিল। তার তলে আমরা ভাত-ছালুন খেলা খেলতাম। আমাদের বাঘা নামে একটা কুকুর ছিল। সে শুধু লাফাত আর গাছের পাতা ছিঁড়তে চাইত। মা বকা দিত, বাঘা, পাতা ছিঁড়িস না। পাতা ছিঁড়লে গাছ ব্যথা পাবে।
তখন বাঘা দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যেত। তার গন্ধ শুঁকত।
ইন্টারের ক্লাসে বোটানি স্যার একবার বলেছিলেন, আমাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক হলো গাছের মতো।
ছোটবেলায় জ্যৈষ্ঠ মাসের রাতে পড়া শেষ হলে দাদি আমাদের নিয়ে বসতেন। কারেন্ট থাকত না। হাতপাখা নেড়ে বলতেন, অনেক দূরে এক দেশ। সেই দেশে ছিল অদ্ভুত এক গাছ। নাম তার বৃষ্টিগাছ। বৃষ্টিগাছে ফুল ধরত। কারো যদি দরকার হতো বৃষ্টির ফুল পেড়ে নিত। দুষ্টু ছেলেরা কী করত জানিস? তারা ঢিল মারত। তখন টুপটুপ করে ঝরে পড়ত বৃষ্টি।
দাদি বলতেন, পৃথিবী একটা গাছ আর মানুষ তার পাতা।
পাঁচ
আজরাইলের নম্বর থেকে পরপর কয়েকটা মিসড কল আসে। মনে হয় তার একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার ঘুম আসছে না। কাছে
থাকা মোবাইলটা নিয়ে দুরুদুরু বুকে ডায়াল থেকে আন্দাজে নম্বর টিপেছে।
সকালে উঠে দেখি পঁচিশটা মিসড কল। স্বপ্নে দেখা সেই মেয়ে আর বড় আমগাছটার কথা মনে পড়ে। গাছেরা সম্ভবত নারীর মতো। ওইদিন কোনো মেয়ে নয়, যেন গাছটিই কথা বলেছিল।
লোকটার প্রতি গত রাতে এমন রাগ হয়েছিল, সামনে পেলে চড় মারতাম। এখন রাগটা পড়ে যায়। নাশতা খেয়ে গাছের কাছে যাই। মেয়েটির ভেজাকণ্ঠ অথবা নিস্তব্ধতা পাতায় রোদ হয়ে হাসছে! বসন্ত এলেই নতুন পাতারা চোখের তারায় নাচন তোলা রহস্যময় তরুণী হয়ে যায়। কী সুন্দর! কী মায়া! আমি সেই মায়ায় পড়ি। আমি হয়তো স্বপ্নের মেয়েটির প্রেমেই পড়ি আর অপেক্ষা করি বৃষ্টির মতো কোনো কিছুর জন্য।
মনে পড়ে, বর্ষায় গভীর রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়লে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। তখন টিনের চালে পড়া বৃষ্টি গুনতাম। এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার ছাড়িয়ে যেত বৃষ্টির ফোঁটা। কয়েক বছর আগে দেখা একটা স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মানুষ হাঁটছে। আমিও হাঁটছি। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি অপরূপ এক তরুণী হয়ে যায়। আমার বাহু জড়িয়ে ধরে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে নছর মালুম ও আমিনা সুন্দরীর কাহিনি।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির সুর মিশিয়ে দাদি নানা কাহিনি বলতেন। নছর মালুমের সমুদ্রযাত্রার কথা শুনে আমারও চলে যেতে ইচ্ছে করত। ছয় বছর তার খোঁজ নেই। আমিনার দৃঢ়তা, বার্মায় এখিন নামে এক মেয়েকে নছরের বিয়ে করা, এখিনের তাকে ছেড়ে যাওয়া এবং পর্তুগিজ দস্যুদের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে নছরের দেশে ফেরার কথা বলতেন।
বলতেন, আমিনার মন ছিল বৃষ্টির মতো। সে স্বামীকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। বৃষ্টি হওয়া ভালো। বৃষ্টিতে লোভ-লালসা, হিংসা ধুয়ে-মুছে যায়। দুনিয়া পরিষ্কার হয়। মানুষ নিজের কাছে ফিরে আসে। তারপর দাদি সুর করে বলতেন, বৃষ্টি এলো বৃষ্টি এলো/ ছেলেমেয়েরা জাগল/ পাড়া-পড়শি জাগল।
দাদি আমাদের ইশারা করতেন। আমরা এক লাফে উঠানে চলে যেতাম। আম কুড়ানোর মতো, শরতের শিউলি ফুল কুড়ানোর মতো বৃষ্টি কুড়াতাম।
ছয়
বৃহস্পতিবার বিকেল। আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি। আগ্রাবাদে ব্যাংকে কাজ ছিল। কাজ শেষ করেই রওনা দিয়েছি।
চট্টগ্রাম শহরটা এখন মলা মাছের ঝাঁকের মতো হয়ে গেছে। গাড়ি আর গাড়ি, রাস্তায় নামলেই বিরক্ত লাগে। মনে হয়, মানুষগুলো সব ইঁদুর হয়ে গেছে। বিড়ালের ভয়ে শুধু দৌড়াচ্ছে। কে কোনদিকে দৌড়াচ্ছে নিজেই জানে না।
অক্সিজেন বাসস্টেশনে এসে বাসে চড়লাম। পশ্চিম পাশে বড় কৃষ্ণচূড়াটা আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রক্তলাল ফুলে রাঙিয়ে দিয়েছে আকাশ। সেই রং মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়ছে কি না জানি না।
দেখলাম, একটা ঝুঁটি শালিক কৃষ্ণচূড়ার পাশ দিয়ে উড়ে গেল। গাছটা দেখে স্বপ্নে দেখা মেয়েটার কথা মনে পড়ে। মেয়েটা যেন গাছের মা। বাবার কথাও মনে পড়ল। বাজারে বাবার চালের দোকান ছিল। এক রাতে দোকান বন্ধ করে আসার সময় আম এনেছিলেন।
মা জিজ্ঞেস করে, এটা কোন জাতের আম?
বাবা হেসে বললেন, মহালদারি।
আমরা তো ঘুমের পাতালপুরিতে ছিলাম। তখন হয়তো যুদ্ধ করছিলাম কোনো রাক্ষসের সঙ্গে। কিংবা দৈত্যদের রানি দিতি এসে আমাদের স্বপ্নগুলো কেড়ে নিয়েছে। হয়তো কাঁদছি। দৈত্যরা দা নিয়ে তাড়া করেছে। দৌড়াতে চাইছি, কিন্তু পারছি না। পা চলছে না। স্বপ্নে প্রায় এ-রকম হয়। মনে হয় কেউ আঠা দিয়ে মাটির সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছে। স্বপ্নের মধ্যে পাকা আমের সুবাস পাই। মা-বাবার একটা-দুটা কথার সুবাসও তাতে মিশে যায়।
সকালে উঠে দেখি, খাটের নিচে রাখা বড় বড় আম। গাঢ় সবুজ তার রং, নিচের দিকে বাঁকানো।
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসি। মুচকি হেসে মা আমগুলো বের করে।
বাবা বাজারে যাওয়ার জন্য শার্ট পরছেন। আমাদের হাসি দেখে বলেন, রাজশাহীর খাঁটি আম।
দুপুরে বাবা ভাত খেতে আসেন। ভাত খাওয়ার পর মা আমগুলো কাটে। কী স্বাদ! ছোট ভাইয়েরা উফ্স উফ্স করে স্বাদটা টেনে নেয়। স্বাদটা যেন অমৃত। বেহেশতের কোনো সুবাস এতে আছে! আমাদের চোখে আশ্চর্য আলো দেখে মায়ের মুখটা আলোময় হয়।
আম খেয়ে আমরা তিন ভাই পাগল হয়ে যাই। হাঁটতে-বসতে কেবল তার স্বাদের কথা বলি। স্বাদটা জিহ্বায়, চোখে-মুখে নিয়ে হাঁটি, স্কুলে যাই। এই স্বাদ তো আবার চাই।
মা আঁটিগুলো যতœ করে রেখেছিল। ঘরের পাশে লাগায়। আমরা সকাল-বিকেল দেখি, কখন পাতা ফুটবে তার অপেক্ষা করি। মায়ের বকাও খাই। মা বলে, এরকম করলে তো মুখ পড়বে। শেষে দেখবি চারা গজাবে না।
নিজেদের সামলে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ রাখি। আঁটির সঙ্গে কথা হয়, মাটির সঙ্গে কথা হয়। মায়ের সঙ্গে যেভাবে কথা বলি, সেভাবে মাটিকে বলি, দেখিস, আঁটিগুলো থেকে যেন সুন্দর চারা গজায়। মাটি হয়তো আমাদের কথা শুনে হাসে।
একদিন পাতা ফোটে। ফুল ফোটার সময় কোনো আওয়াজ হয় কি না জানি না। তবে পাতা ফোটার আওয়াজ আমরা পেয়েছি। এক ভোরে ছোটভাই ধাক্কা দিয়ে আমাদের জাগায়। বলে, পাতা ফুটেছে মনে হয়। আমি শব্দ শুনেছি।
আমি বলি, বিরক্ত করিস না তো।
মেজভাইটা লাটিমের ঘূর্ণির মতো হাসে। বলে, হ্যাঁ, পাটিপাতার বাঁশির মতো আওয়াজ পেয়েছি।
তিনজনেই লাফিয়ে উঠি। গিয়ে দেখি, হ্যাঁ সত্যি! পাতা ফুটেছে। আমাদের সে কি আনন্দ! চিৎকার করে ঘর মাথায় তুলি। চিৎকার শুনে মা বেত নিয়ে তাড়া করে। আমরা হাসি। মা-ও হেসে দেয়।
পাঁচটার মধ্যে তিনটা মরে গিয়েছিল। বনমানুষের মতো কয়েক ফুট লম্বা হয়ে থেমে গিয়েছিল একটা। শেষ পর্যন্ত বড় হয় একটা। গাছটা বড় হতে হতেই বাবার হার্টঅ্যাটাক।
যে-বছর প্রথম আম ধরে, আশ্চর্যের বিষয়, পাঁচটা আমই ধরেছিল। আমরা বড় হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও উচ্ছ্বাস ছিল ছোটদের মতো। চৈত্রের শেষের দিকে মা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল, যাতে কাঠবিড়ালির চোখ না পড়ে। ছোটভাইটা তো দস্যি। গাছে উঠে কাপড় উলটে প্রতিদিন আমগুলো দেখত।
শেষ পর্যন্ত পাঁচটা আমই বড় হয়েছিল। পেকেছেও একসঙ্গে। মা-বাবা আর আমরা তিন ভাই, একটা করে ভাগে পড়েছে। উহ্! আমের স্বাদে বেশ কয়েক বছর পর আমরা আবার পাগল হলাম।
এর পরের কথা ভাবতে ভালো লাগে না। আম খাওয়ার পরদিন ভোরে বাবা চলে গিয়েছিলেন পৃথিবীর অনেক দূরে। মৃত্যুর আগমুহূর্তে কোনো মানুষ হাসে কি না জানা নেই। সেদিন বাবার মুখে একচিলতে হাসি দেখেছিলাম।
এরপর প্রায়ই স্বপ্ন দেখতাম, বাবা মাটি হয়ে গেছে। সেই মাটিতে জন্মেছে একটা গাছ। গাছের পাতাগুলো বাবার চোখের মতো। পাতা কথা বলত। আমি তার কিছুই বুঝতাম না। বুঝতে না পেরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদতাম।
আজ বাড়ি যাওয়ার পথে কেন এত কথা মনে পড়ল? অনেক দিন পর যেন বাবা এসেছেন। মনের মাঝে আর গাছের মাঝে, পাতায় পাতায় বাতাসের মতো বাবার স্পর্শ। মনে মনে জোরে ডাক দিই, বাবা।
গাছেরা কি শুনতে পায়?
ঘরের পাশের মহালদারি গাছটা কাটা পড়েছে বলেই কি আমার মনে সন্ধ্যার রং ধরেছে! এসব ভাবতে ভাবতে স্বপ্নের সেই মেয়েটার কথাও মনে পড়ে। মেয়েটা আসলে কে ছিল? সে কি আমার দাদি? দাদিকে কখনো স্বপ্নে দেখি না। পানের রস-মাখা লাল ঠোঁটের সেই মিষ্টি দাদিই কি এসেছিলেন গাছের কথা বলতে!
মায়ের বিষণ মুখ মনে পড়ে আর আমি বিষণ হই।
কন্ট্রাক্টর বলল, ভাড়া দেন।
আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। তার খুব তাড়া। সবার ভাড়া নিতে হবে। অধৈর্য হয়ে বলল, ও ভাই।
মনে হলো ছেলেটা গাছ হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলছে একটি গাছ। আমি হাসলাম।
সাত
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মা বলল, গাছটা কাটব না।
কেন? অবাক হয়ে জানতে চাই।
মা বলে, গত রাতে স্বপ্নে দেখলাম ইয়া বড় একটা গাছ, প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। হাজার হাজার পাখপাখালি সেখানে খেলা করছে।
আমরা তার চোখে বড় গাছটা দেখতে পাই। একটু পর মা বলে, গাছটা থাকবে। পাখিরা গাছে খেলবে আর গাছের ছায়ায় খেলবে আমার নাতি-পুতিরা।
বৃষ্টিগাছের গল্পটা মনে করিয়ে দিই। জিজ্ঞেস করি, ওরা কি বৃষ্টি পাড়বে?
নাতনিকে জড়িয়ে ধরে মা হাসে। দেখি, তার মুখে গাছের বাকলের মতো রেখা আর চোখে ফুটেছে বৃষ্টিফুল।
বাইরে বেরিয়ে গাছটার দিকে তাকাই। পেছন থেকে জয়নাব দৌড়ে আসে। কান্না কান্না কণ্ঠে চিৎকার দেয়, বাবা।
আমি হাঁটি। নিজেকে আমার গাছ মনে হয়। জয়নাব আমার হাত ধরে। দেখি, মেয়ের চোখে বৃষ্টিফুল ফুটছে। আমার তখন বাবার কথা মনে পড়ে। মনটা হাহাকারে ভরে যায়।