মিস্টার গুডফরচুন

মিস্টার গুডফরচুন
মামা, রিক্সায় উঠার সময় আপনি ৪০ টাকা চেয়েছিলেন। আমার পকেটে ৪০ টাকা নেই। আপনাকে আমি সতেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা দিতে পারবো। পঞ্চাশ পয়সার কয়েন বাজার থেকে উঠে গেলেও এই একটা কয়েন প্রায় বিশ বছর ধরে আমার মানিব্যাগে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে আপনাকে দেয়ার জন্যই এ কয়েনটা এত বছর রয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা বস্তুরই একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে। এ কয়েনের আপাত গন্তব্য আপনি। হাওয়ার বেগে ছুটতে থাকা রিক্সাটা আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই গতি কমতে কমতে রাস্তার বাঁ পাশ ঘেষে থেমে গেল। রিক্সাচালক গামছায় মুখের ঘাম মুছতে মুছতে প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে বলল, অইব না মামা। আমি যামু না। আপনে নাইমা যান। নেমে যাবো? রিক্সাচালক জবাব দিচ্ছে না। অভিমানের সাথে বিরক্তি আর রাগ একত্র হয়ে তার চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমি হেসে বললাম, চলেন মামা। আমাকে ঐ যে সামনের মোড় পর্যন্ত নিয়ে চলেন, ঐখানে রাস্তায় আপনি একটা পাঁচশ টাকার নোট কুড়িয়ে পাবেন। তাইলে তো হলো?
রিক্সাচালক আরও বিরক্ত চোখে একবার তাকিয়ে সামনে ফিরে প্যাডেল চাপতে লাগল। তার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে, ও আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করেনি। করার কথাও না। তবুও প্যাসেঞ্জারকে রিক্সায় তুলে ফেলায় সামনের মোড় অবধি ছেড়ে দিচ্ছে ইথিক্যাল হয়ে। সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের ইথিক্স খুবই শক্ত হয়। তাছাড়া আমার প্রতিশ্রুত ১৭ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে অই অবধি রিক্সায় চড়ানোই যায়। ফুলের দোকানের সারি দেখা যেতে শুরু করেছে। সামনে চেরাগী পাহাড়ের মোড়। সকালবেলা এ জায়গাটা ফুলের বাগান হয়ে পড়ে। যে ব্যক্তি এলাকার নামকরণ করেছেন তিনি হয়তো এ জায়গার নাম নন্দনকানন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো অপ্রত্যাশিত ভুলে পাশের এলাকার নাম নন্দনকানন আর এ এলাকার নাম চেরাগী পাহাড়।
ঢাকায় এ এলাকার মতো কাছাকাছি ধরনের একটা জায়গা আছে। শাহবাগের মোড়। ওখানেও সারি করে ফুলের দোকান আছে কিন্তু ওখানটা এতটা সাজানো না। রাস্তার দু পাশে থরে থরে সাজানো ফুল। একটা ফুলের দোকানে মিথিলাকে দেখতে পেলাম। এখানেই রিক্সা থেকে নেমে গেলে হয়, কিন্তু আমার সামনের মোড় অবধি যেতে হবে। চেরাগী পাহাড় মোড়ে রিক্সা থামতেই রিক্সাচালক এক লাফে সিট থেকে নেমে রাস্তা থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট কুড়িয়ে নিল। লোকটার চোখে-মুখে একইসাথে আনন্দ আর অবিশ্বাস। আমি মুখ প্রশস্ত করে হেসে রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। মানিব্যাগ থেকে বের করে একটা দশ টাকা, একটা পাঁচ টাকা, দু টাকার একটা কয়েন আর পুরানো জরাজীর্ণ একটা পঞ্চাশ পয়সার কয়েন উনার হাতে তুলে দিলাম।
আনন্দিত হলে মানুষের কথা বলার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এ কারণেই ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে কাজ করাতে হলে প্রথমে তাকে কাজের কথা বলা হয় না। তাকে উপহার, টাকা পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করা হয়। তারপরে দেয়া হয় আসল প্রপোজাল। তখন সে ব্যক্তি ‘না’ বলতে পারে না। আমার এক মামা তখন বেশ নামকরা ডাক্তার। মাঝারি আকারের কোনো একটা মেডিকেল এক্সেসরিজ কোম্পানির লোক তার চেম্বারে নতুন এয়ার কন্ডিশনার লাগিয়ে দিয়ে গেল। ডিজিটাল নেমপ্লেট, ঘড়ি, নতুন এক গাদা নোটবুক, মামাতো ভাইয়ের জন্য একটা গেমপ্যাড আর মামীর জন্য একটা অতি দামী শাড়ি উপহার দিয়ে গেল। মামা অবশ্য প্রথমে এসব কিছুই নিতে চাইলো না। কিন্তু শাড়িটা মামীর খুব মনে ধরে গেল।
মুখে অবশ্য কিছু বলল না। কিন্তু মুখ গোমড়া করে রইলো কয়েকদিন। এ শাড়ি আবার দেশের মার্কেটগুলোতে এভেইলেবল না। পিওর হ্যান্ডমেড ওয়ানপিস ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ডেড শাড়ি। বিএমডব্লিও বা অডি যেমন ওয়ান পিস ইন ওয়ার্ল্ড টাইপ গাড়ি তৈরি করে, তারপর সেই এক পিস গাড়ি নিলামে কোনো ধনকুবের কিনে নেয়, এ ব্র্যান্ডও তেমনি একপিস শাড়ি তৈরি করেছে। মামীর মুখশ্রী ফিরিয়ে আনতে মামা সেই শাড়ি নিতে হলো। নিলো যখন একেবারে সবই নিলো। নাচতে নেমে ঘোমটা টানা মিনিংলেস। একদম চকচকে তকতকে একটা চেম্বারে বসে মামার আনন্দও খুব একটা কম ছিল না।
সে আনন্দ স্থায়ী হলো না। কোম্পানি থেকে অফার আসলো মামা যে সরকারি মেডিকেলে দায়িত্বরত তাতে কিছু ইক্যুইপমেন্ট কেনাতে হবে। সম্পূর্ণ খরচের ১০ পারসেন্ট মামার একাউন্টে পৌঁছে যাবে। প্রথমেই একটা গাড়িও উপহার দেয়া হবে। অনেক চেষ্টা করেও মামা না বলতে পারলেন না। সব জানাজানির পর মামা ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেন, জেলও খাটলেন। কেউ হুট করে দুর্নীতিতে রাজি হয় না। নগণ্য কোনো প্রলোভন থেকে শুরু করতে হয়। সে মনে মনে ভাববে, ছোট্ট এটুকু কাজে কার কী ই বা ক্ষতি হবে। এভাবে আস্তে আস্তে একটু একটু করে দুর্নীতিতে টানা লাগে। এটা অবশ্য তেমন কোনো নীতি বিরুদ্ধ কাজ না। কেউ একজন টাকা ফেলে গেছে। এমন লক্ষ লক্ষ লোকের টাকা প্রতিদিন রাস্তায় পড়ে যায়। সে টাকা অন্য কেউ খুঁজে পায়।
রিক্সাচালক গালভর্তি হাসি নিয়ে আমার সতেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা আর পাঁচশ টাকার নোটটা লুঙ্গির গোছে রেখে রিক্সায় উঠে বসে প্যাডেল চেপে সামনে যেতেই এক দিনমজুর ধরনের মহিলাকে মেরে দিল। মহিলা ছিটকে পড়ে যতটা না ব্যথা পেয়েছে, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি আহাজারি করছে। উৎসাহী কয়েকজন মানুষ জড়ো হয়ে গেল। এরমধ্যে অতিউৎসাহী দুয়েকজন রিক্সাচালককে চড় থাপ্পড়ও মারতে শুরু করে দিয়েছে। আমি পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মিথিলাকে ফুলের দোকানেই পাওয়া গেল। ঘটনা শুনে ও বলল, তুমি না ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারো? তা- ও যে মার খাবে, সেটা বলতে পারলে না কেন? আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি -এ কথাটা আংশিক সত্য। আমি ভালো ভবিষ্যৎ বলতে পারি, খারাপটুকু না। এই যে লোকটা পাঁচশ টাকা পাবে, এটা ভালো ভবিষ্যৎ। তারপর রাস্তার লোকের কেলানি খাওয়ায় বাধ্য হয়ে সে মহিলাকে চিকিৎসার খরচ হিসেবে ঐ টাকাটা দিয়ে দেয়া লাগবে, তা খারাপ ভবিষ্যৎ।
আচ্ছা সে বুঝলাম। আমি যে এখানেই আছি, তা কী করে বুঝলে? এটা হলো আমার ভালো ভবিষ্যৎ। আমি হাসলাম। তো আন্দরকিল্লা অবধি রিক্সা নিলে কেন? আমায় এখানে পাবে জানা থাকলে এ অবধি নিলেই পারতে! প্রত্যেকটা বস্তুর মতো প্রত্যেকজন ব্যক্তিরও একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে। সে গন্তব্যটা পাল্টানো অনুচিত। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গন্তব্যকে সম্মান জানাতে হয়! তোমার উদ্ভট কথাবার্তা বন্ধ করো, ফুল কিনতে দাও। ফুলের প্রতি সব বয়সের মেয়েদের একটা আশ্চর্য আকর্ষণ কাজ করে। তরুণীদের সে আকর্ষণ আকাশছোঁয়া। ফুলের দোকানদার একটা টিনএজ চ্যাংড়া ছেলে। সাথে একই বয়সের আরেকটা স্টাফ। ক্যাশে বসে থাকা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, ব্যবসাপাতি কেমন চলে?
দোকানদাররা কখনো মুখে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গি এনে ব্যবসা ভালো চলার কথা বলে না। প্রশ্নটা করা হলে ছেলেটাও উপরের ঠোঁট চেপে অদ্ভুতভাবে হেসে বলবে, এইতো ভাইয়া। চলতেছে কোনো রকম। আমিও হেসে বলবো, লাখ টাকা কামানোর টাইম আসছে। বিগফিশ আসতেছে তোমার দোকানে! আমরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফুলের দোকানের সামনে একটা সাদা কার থামলো। তার মধ্য থেকে কোট-স্যুট পরা একজন লোক বেরিয়ে এলো। আমি আর মিথিলা একটা রিক্সা নিয়ে চট্টেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। আমাদের দেখা করার কথা ছিল আন্দরকিল্লা মোড়ে। আগেই দেখা হয়ে যাওয়ায় চালক রিক্সাভাড়া দশটাকা কম চেয়েছে। মেয়েদের রিক্সাভাড়া নিয়ে দরদাম করতে দেখার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক মন ভালো করার উপাদান থাকে। ধরুণ আপনার মেজাজ খারাপ। আপনার সাথের মেয়েটা রিক্সা ভাড়া করছে।
মামা, চট্টেশ্বরী যাবেন? না, যামু না। মামা, চলেন না! উঠেন। কত নেবেন? ৮০ টাকা দিয়েন। কী বলেন ৮০ টাকা! এখান থেকে এখানে যেতে ৮০ টাকা ভাড়া হয়? ৭০ টাকা চলেন। মামা পঁয়ষট্টি টাকায় যাবেন? চলেন না মামা? এ আলোচনা এক মনে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কখন আপনার মন মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে যাবে -তা টেরই পাবেন না। বুনন। হ্যাঁ মিথি। তোমার সুপারন্যাচারাল পাওয়ার কী বলে? আমার কোনো সৌভাগ্য আছে সামনে? তুমি নিজেই তা জানো। কী জানি? এখন তোমার নতুন একজন মানুষের সাথে দেখা হবে যে তোমার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী হতে পারে। এটা কি ভবিষ্যদ্বাণী? না। এটা তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে!
মিথিলা চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। তিন ধরনের রঙিন অর্কিড হাতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী আমার পাশে রিক্সায় বসে আছে। ওর পরনে একটা ঘি কালারের শাড়ি আর কালো ব্লাউজ। পাত্রপক্ষের সামনে কোনো পাত্রী প্রথমবার যাওয়ার সময় কি ঘি কালারের শাড়ি পরে? প্রথমত এ অ্যারেঞ্জ-ম্যারেজের পাত্রপক্ষ আর কন্যাপক্ষ বলতে এখানে কিছু নেই। বসন্ত তলাপাত্র আর মিথিলা মৈত্রের ফেসবুকিয় প্রেম দু মাসের। বসন্ত বাবু মিথিলার সাথে প্রথম দেখা করতে এলেন বর্ষাকালে। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মিথিলাকে ঐশ্বরীর মতো লাগছে। এ মুহূর্তেই ওর নামে একটা কবিতা লিখে ফেলা যায়, প্রিয়তমা ভোর, কী অধিক জোর তোর প্রেমে! ভাঙার আগেই বিচূর্ণ হয়, ছোঁয়ার আগেই বিলুপ্ত হয় বেনামে! এখন ভোর না। বিকেল। এ কবিতা শুরুর আগেই বাতিল হয়ে গেল।
মিথিলাকে আমি ইদানিং মিথি বলে ডাকি। বিষয়টাতে ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বোধ করে। মিথিলা নামের এক অভিনেত্রীর ব্যক্তিজীবনে কাকে বিয়ে করলো, কাকে তালাক দিলো সে সব ব্যক্তিগত বিষয় সোশ্যাল মিডিয়া বেশ জমজমাট হয়ে পড়েছিল। অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আড্ডাবাজি করতে পছন্দ করা মানুষের আধিক্যের কারণেই ইন্ডিয়ান চ্যানেলের ডেইলি স্যোপ টিভি সিরিয়াল এদেশে এত জনপ্রিয়। অভিনেত্রীর সাথে নামের মিল থাকায় বন্ধুমহলে বেশ ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে হয়েছে ওকে। এরপর থেকে নিজের নাম অপছন্দ করে ও। মিথি। হ্যাঁ। একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করবো? করো! শুরুয় দুটো সর্বনাম, সবশেষটাতে বাজে ভালো। ওটার আবার স পাল্টানো, মাঝে বসে একটা ভালো। বলতে পারবে? মিথিলা না ভেবেই বলল, কী সেটা? ভাবো দেখি? ধুর, মিনিংলেস। ছন্দও মেলেনি! চট্টেশ্বরী মন্দিরের গেটে রিক্সা থেকে নামলাম। মিথিলা সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে চলে গেলো। ওকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করায় দু’শ টাকা বকশিস পেয়েছি। মন্দিরের ভেতর অবধি গেলে পাঁচশ টাকা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়েও কোনো লাভ করতে পারেনি। আমার চাহিদা দু’শতেই মিটে যাবে।
একটা মার্লবোরো এডভান্স আর এক কাপ চা দেন মামা। চায়ের দোকানে ভীড়। অনেকগুলো কাপে একসাথে চা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তার আগে সিগারেট দিয়ে দিলো। বিষয়টার একটা বিজনেস স্ট্র্যাটেজি আছে। সিগারেট হাতে নিলেই আগুন ধরানোর জন্য হাত নিশপিশ করে। চায়ের সিরিয়াল আসতে আসতে সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে যাবে। তারপর চা এলে চায়ের সাথে খাওয়ার জন্য ম্যাক্সিমাম মানুষ দ্বিতীয় সিগারেট কিনে নেয়। ডান কানের উপরে সিগারেট গুঁজে রেখে চায়ের অপেক্ষা করছি। এভাবে সিগারেট সুরক্ষিত রাখার নিয়ম শিখেছিলাম প্রাইমারি স্কুলে থাকা সময়ে। আমি যে অনাথাশ্রমে বড় হয়েছি, তাতে টেবিল চেয়ার খাট বানানোর জন্য কয়েকজন কাঠমিস্ত্রি কাকু আসলেন। আমরা চারপাশে ভীড় করে মুগ্ধ চোখে কাঠের তক্তা ছিলানো দেখছি। একজন কাঠমিস্ত্রি কাকু কানের উপরে বিড়ি গুঁজে রাখলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকু, বিড়ি মুখে না রেখে কানে কেন রাখলে? আর কই রাখমু? কানে রাখলে বিড়ি ভাঙ্গে না!
সেদিন আইডিয়া হলো, আসলেই সত্যি তো, পকেটে রাখার চেয়ে কানে রাখলেই সিগারেট যত্নে থাকে। তারপর কলম, কাঠি কতকিছু দিয়ে এ টেকনিক প্রেক্টিস করে রপ্ত করলাম। মাঝেমধ্যে কান থেকে নামিয়ে সিগারেটের ভঙ্গিতে ঠোঁটে নিয়ে মানসিক সিগারেট খেতাম। মানসিক ধোঁয়া ছাড়তাম বাতাসে। চা এসে গেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দিবসে সিগারেট ধরিয়ে এক চুমুক চা, সাথে এক পাফ ধোঁয়া। কলঙ্কশাহী বাবার বেশ নামডাক শুনছি বেশ কিছুদিন ধরে। শুনেছি উনার ভবিষ্যদ্বাণী করার বিশেষ ক্ষমতা আছে। আমার ভবিষ্যদ্বাণী আর উনার ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য অবশ্য আছে। আমি সবার সৌভাগ্য বলতে পারি, আর উনি পারেন দুর্ভাগ্য, দুর্যোগ আর বিপদের আগাম বার্তা দিতে। যদিও এ ধরনের লাখো লাখো বাবা বিপদের ভবিষ্যতবাণী করার ভড়ং ধরে আছে সারা দেশে। কলঙ্কশাহী বাবার আস্তানা কাছেই। আরেকটা সিগারেট কিনে বাবার আস্তানার দিকে হাঁটতে লাগলাম।
আস্তানায় ঢুকার মুখে পঞ্চাশ টাকা দিতে হলো। মনযোগ দিয়ে চারপাশে দেখে নিচ্ছি এ ধরনের আস্তানার সেটআপ কেমন হতে হয়। ভবিষ্যতে আমিও যদি বুননশাহী বাবার আস্তানা খোলার চিন্তাভাবনা করি, তখন একটা মডেল তো দরকার হবেই! আস্তানার এক জায়গায় চেম্বার করা আছে। চেম্বারের সামনে নারী আর পুরুষের আলাদা লাইন। নারী ভক্তের লাইন পুরুষ ভক্তের তুলনায় আশ্চর্যজনকভাবে বেশি। কোনো জরিপ করে দেখা দরকার নারীদের সমস্যা পুরুষদের সমস্যার চেয়ে বাস্তবেই এতটা বেশি কি না। পুরুষের লাইন ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে বাবা আমাকে সিরিয়ালের আগেই ডেকে নেবে। কাউন্টারে ফকির গোছের একজন ডেটা এন্ট্রি করছে, কী নাম? বন্ধন কুমার চৌধুরী বুনন। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনো নামের মাঝে কুমার ছিল। ভবিষ্যতে যখন বৃদ্ধ হবো, তখনো আশা করি কুমার-ই থাকবে। লোকটা পান চিবানো মুখে গলা খাকড়ি দিয়ে বলল, সিঙগেল নাম? বুনন। বয়স? সাতাশ।
ফাস্ টাইম? নাকি আগেও আইছেন? এই প্রথম। দুই শ টাকা দেন আমার কাছে দু’শ নেই। এক’শ দিচ্ছি? তাইলে বাবার কাছে বওন যাইবো না। দূরে বসতে অইবো। যান, দূরে করে বসেন। আমি দূরে করে বসলাম। বাবা এখনো ভক্তদের সাথে কথোপথন শুরু করেননি। তিনি এখনো ধ্যান করছেন। অন্য বাবাদের মতো নেংটো বা অর্ধনেংটো হয়ে না, বরং বেশ মার্জিতভাবে সাদা লুঙ্গী আর পাঞ্জাবি পরেছেন। লম্বা সাদা চুল দাঁড়িতে উনাকে এতটাই পবিত্র দেখাচ্ছে, আমারও মনের কোথাও বিশ্বাস তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম অর্ধনগ্ন পাতা পরা একটা ময়লা বাবা লাফাবে আর চেঁচামেচি করবে। উনার সাথে কলঙ্কশাহী নামটা যাচ্ছেই না। উনার নাম হওয়া উচিত ছিলো পবীত্রশাহী বাবা।
ওয়াল্টার সামারফোর্ড নামে একজন মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষ বলা হয়। ১৯১৮ সালে লোকটার মাথায় বাজ পড়ে। ৬ বছর পর ১৯২৪ আবার একই ঘটনা ঘটলো। এটুকুতে থেমে গেলে হতো। কিন্তু আরও ৬ বছর পর ১৯৩০ সালে লোকটার মাথায় আবারও বাজ পড়লো। এর ২ বছর পর ১৯৩২ সালে বেচারা মরে গিয়ে ভাবলো যাক, ৬ বছরের ধারাবাহিক ফাঁড়া কেটেছে। কিন্তু না। ১৯৩৬ সালে ওর কবরে বাজ পড়ে সব ওলটপালট হয়ে গেল। এই লোককে ধরে বাবার কাছে আনতে পারলে বেচারার জীবনটা একটু স্বাভাবিক হতো বোধহয়! হঠাৎ মিথিলার কথা মনে এলো। মনে হচ্ছে ও কোনো কারণে কাঁদছে। ভেজা চোখে মন্দিরের গেটেই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এটা কি সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য? দুর্ভাগ্য তো আমার অগ্রীম জানা হয় না!
হঠাৎ কলঙ্ক শাহী বাবা চোখ খুললেন। চোখ খুলেই বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। কিছু বুঝে উঠার আগে এক দৌঁড়ে এসে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দোস্ত? কী খবর তোর? বাবার কণ্ঠে স্বাভাবিক গাম্ভীর্য। তার মুখ নিঃসৃত “দোস্ত, কী খবর?” কথাটাও দরবেশের বাণীর মতো শোনালো। সবাই অবাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আস্তানার চ্যালাচামুন্ডারা শ্বাসরুদ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বাবা নিচু স্বরে বললেন, দোস্ত বুনন, আমি মামুন। ঐ যে অনাথাশ্রমে আমার প্লেটের পটল ভাজি আর তোর প্লেটের আলুভাজি পাল্টাপাল্টি করে ফেলায় আমাদের মারামারি হলো? আরে মামুন!
দোস্ত, কঠিন ফাঁসা ফাঁসছি রে বন্ধু। আমারে বাবা বানিয়ে এরা টাকা কামায়। কোনদিন আমি এদের জন্য পাবলিকের মার খেয়ে মরে যাই! তুই কিছু কর? এতদিন কই ছিলি তুই? আমি ঢাকা গেছিলাম সিনেমায় অভিনয় করার জন্য। এফডিসিতে ছোটখাটো রোল করতাম। সেইখান থেকে ক্যামনে ক্যামনে এসে পড়লাম এইখানে। কী থেকে কী হয়ে গেল! আমরা দ্রুত সামলে নিলাম। বাবা আমাকে দোয়া করে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বলল, আমার এ ভক্ত একদিন জগতশ্রেষ্ঠ হবে! মিথিলা মন্দিরের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ ভেজা। একটু আগে বৃষ্টি থেমেছে। বাতাসে ভেজা আমেজ আছে এখনো। আলো আঁধারিতে মিথিলাকে দেখে বেমানান লাগছে। দেবী থাকবে মন্দিরে। মন্দিরের সিঁড়ির বাইরে রাস্তায় কেন দেবী দাঁড়িয়ে থাকবে?
আমি সামনে এসে বললাম, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো? মিথিলা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দু ঘন্টা! তোমার স্প্রিং সিজন কোথায়? কোথায় সেই বসন্ত বাবু? সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। মন্দিরে বসে কিছুক্ষণ বসন্তের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মনে হলো আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি তো? এ জন্যেই কোনো মহাপুরুষ বলে গেছেন, মেয়েদের অপেক্ষা করাতে নেই। তাতে তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বেচারা স্প্রিং সিজন! উহু। তোমার ধাঁধার উত্তরটা ভাবছিলাম। বুঝলে মহাপুরুষ বাবু? ভেবে পেলে? প্রথম দুটো সর্বনাম হলো- আমি তোমাকে। আর বাকিটা সল্ভ করার অঢেল সময় আছে। আমরা দুজনই হাসলাম। আমি একটা সিগারেট নিলাম। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। মিথিলার ব্যাগে ছাতা আছে কিন্তু ও মেলছে না। দুজন চুপচাপ হাঁটছি।
একটা কাজ করতে পারবে, মিথি? তোমার বাবার কাছে একটা ফোন করতে হবে। বাবাকে ফোন করে কী বলবো? এত কষ্টে যে পাত্রের জন্য তাদেরকে রাজি করালাম, তাকে না করে দিয়ে একটা গাধাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি -এটা বলবো? এই রে, তারপর তোমার পুলিশ কমিশনার বাবা আমাকে ক্রসফায়ারে দেবে। পরদিন সংবাদপত্রগুলোতে কলাম ছাপবে: কলিজা কাটা বন্ধন নামে এক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করার জন্য কোনো জঙ্গলে গোপন আস্তানায় অভিযান চালালে কলিজা কাটা বন্ধন ও তার দল পুলিশের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পরবর্তীতে পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় অন্য সঙ্গীরা পালাতে সক্ষম হলেও কলিজা কাটা বন্ধন ক্রসফায়ারে মারা যায়!
কী সব বুলশিট কথাবার্তা বলো! আমরা দুজনই হাসলাম। হেসে বললাম, তোমার বাবাকে একটা কল করে বলো, মামুন নামে একটা ছেলেকে কলঙ্ক বাবার কোঠায় জিম্মি করে রাখা হয়েছে। ওকে বাঁচাতে হলে আজকে রাতেই ওখানে ফোর্স পাঠিয়ে একশন নিতে হবে। কী বলছো এসব? তুমি দ্রুত কল করো, আমি বাকিটুকু হাঁটতে হাঁটতে বলছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত