গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আমাদের নোনাজলহাওয়াময় ছোট, তুচ্ছ, মলিন শহরে স্মরণযোগ্য এমন এক আলোড়ন এসেছিল আজো যার গায়ে ধুলো-ময়লা জমেনি। এই ঘটনা নিশ্চিত কালের প্রহার সহে বহু বহু বছর বেঁচে থাকবে। আমরা তখন যারা কিশোর ছিলাম, এখন বয়সী, তাঁদের স্মৃতির প্রতি আঁশে আঁশে ওই অতীত বৃত্তান্তকাল পাড়ি দিয়েও সজীব। আমি বারবার চেষ্টা করেও তেজোপূর্ণ জাগরণের ভাষণ রাখা স্বভূমির ওই মানবকে পুরো ধরতে পারিনি। মনে হয় বিরাজমান নিরেট বাস্তবতার মধ্য থেকে উঠে আসা সময়ের কালজ্ঞ এই নির্ভীক নায়কের সঞ্জীবনী প্রভাব এতই আয়ুষ্মান যে, মাথার সমস্ত ঘিলু ব্যয় করেও ধরা যাবে না। তাই ইতিহাসের কেন্দ্রীয় নক্ষত্রকে নিয়ে একই আখ্যান সংশোধন করে বারবার লিখতে হচ্ছে। হয়তো তাঁর কোনো পৌনঃপুন্য আছে।
আমরা কিছু হলেও বুঝতে পারতাম নিষ্ক্রিয়তা ভাঙার আগে এলাকার বাসিন্দাদের মনে ভরপুর ছিল অস্থির উদ্বেগ। আটপৌরে জীবনের যে সাধারণ জন তাঁদের সরস টাটকা চেহারা ও শহরের শ্রীবৃদ্ধি কোথাও দেখা যেত না। কখনো কারো স্বরে কলহের গরম যোগ হলে এবং তা ছড়িয়ে পড়লে তখুনি ত্রাসে ছিন্নভিন্ন হতো জনের জটলা। নদীর দুপাড়-লাগোয়া লোকালয়ের খারাপ খবর হঠাৎ হঠাৎ উড়ে এলে শহরটা দুঃখে বুজে যেত। কেবল হুমকি শুনেই মেরুদ- হারিয়ে চৌদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে হাতের মুঠোয় প্রাণ ধরে অন্ধকারে গায়েব হয়েছে সনাতন পুরুষ। আমরা যারা বয়সে বালক, তখনো ঘটনার ভেতর-বার বোঝাপড়ার জন্য সম্পূর্ণ বোধ-বিবেচনায় প্রস্ত্তত হয়নি বলে যা কিছু নতুন তা নিয়ে খুবই মাতোয়ারা হই। আমাদের মন কোনো কিছুতেই তাই স্থায়ী নয়।
কদিন ধরে শহরের কোলের পাশের নিস্তরঙ্গ নদীর ওপর দিয়ে একটু একটু উত্তরে বাতাস আসছে। আমরা টের পাই আগামী শীতের আভাস। শীত আসছে শীত আসছে, ভেবে, শীতকালীন সবজির মতো আমরা সজীব হয়ে উঠি। প্রতিদিন বিকেলে আকাশে উড়বে ঘুড়ি আর ঘুড়ি, হাওয়ায় হাওয়ায় ফুর্তি। অদম্য দৃশ্যটা চোখের সামনে রেখে আমরা চলে আসি পুরনো কোর্ট মসজিদ, এপাশে আদ্দি আমলের চুন-সুরকির মোক্তার বার, তার মাঝখানের এক ফালি জমিনে হাওয়ায় ডালপালার নৃত্য দেখানো একটা পেয়ারাগাছের পাশে গোলপাতার দোচালার কাছে। এখানে মন্টু ধোপা আর তাঁর প্রৌঢ় বাবা কানাই ধোপা, আমাদের প্রিয় দাদু তাঁদের নড়বড়ে আবাস। দাদুর ঘুড়ি ওড়ানোর শখ বয়সকালেও হারিয়ে যায়নি। দেখো, কী আমুদে মানুষ, তিনিও অনাগত ঘুড়ির মৌসুম আগাম টের পেয়েছেন। হাঁটু অবধি পরনের ধুতি গুটিয়ে তিনি মাঞ্জা প্রস্ত্তত নিয়ে মনোযোগী। গোল চোখজোড়া তুলে আমাদের দেখতেই তাঁর চোপসানো চোয়ালে আলো চলে আসে। রঙিন কাগজ কেটে দাদু ঘুড়ি নিজেই তৈরি করেন। ভোকাট্টা লড়াইয়ে হাত তাঁর বয়সের মতো পাকা। প্যাঁচ দিয়ে অন্যের ঘুড়ি কেটে যখন তিনি উলস্নাস করেন, বয়স লাফিয়ে লাফিয়ে তাঁর কমে আসে। আমাদের জোরালো কণ্ঠের দেদার জয়ের আনন্দ দাদুর লাটাই-সুতো ছুঁয়ে ওপরে উঠে যায়। ঘুড়ির লড়াই আরো দেখার উদ্দেশ্যে দাদুকে প্ররোচিত করতে তাঁর বাহাদুরি আমরা উঁচু রবে প্রচার করি। দাদু লাটাই থেকে সুতো ছেড়ে পাশের উড়ন্ত ঘুড়িকে ধরতে তৎপর হন। শেষ বিকেলের পড়ন্ত কুসুম রোদ তখন ফুরিয়ে আসছে। – ‘কী রে, হাওয়া ঘুরছে না!’ দাদুর স্বরে হাওয়া ঘোরার উচ্চারণ মনে হলো খানিক মরমি। আমরা না বুঝে পরস্পর মুখ-চাওয়াচাওয়ি করি।
ধীরে ধীরে পরিপ্রেক্ষিত ঘেরাও করে নির্দয় শীত। দেখা যায়, চরপড়া ঠান্ডা-কাতর ভৈরবের বুকের ওপর ঝুলন্ত গাঢ় কুয়াশা। লোকালয়ের অলিগলি, সদর রাস্তা, বাজারে ধুলো ও ছেঁড়া কাগজের বেজায় ওড়াউড়ি। কর্তাদের দেখভালের অভাবে ফ্যাকাশে শহর আরো অনুজ্জ্বল ও দুঃখিত। লাল ইটের কোর্ট এলাকার শতবর্ষী বটগাছের নিচের নেড়া ঘাসশূন্য জায়গায় এখন আর বানর, ভালুকের খেলা দেখা যায় না। ডুগডুগির আওয়াজ নেই। আনন্দবঞ্চিত মনমরা এই আমরা জেলখানা রোডের পুকুরপাড়ের মলিন দেয়ালের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে বিষাদ বিকেল অযথা খরচ করি। কখনো শো শুরুর আগে অনাথ বাতাসে সিনেমা হলের গান ভেসে আসে। লতা-গীতা-হেমন্ত-সন্ধ্যার প্রতিদিনের দিললাগি কণ্ঠের প্রভাব কিছুতেই মনে ক্রিয়া করে না। লাইট হলে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, উত্তম-সুচিত্রার হারানো সুর দেখার জন্য কোনো ফুলস্ন টান নেই। আমাদের ভেতরের চিকন-মোটা-মিহি সব অনুভব বুঝি শুকিয়ে গেছে। পুকুরের পুবপাশে ব্রিটিশ আমলের তৈরি মজবুত গাঁথুনির ম্যাকফারসন লাইব্রেরি, দক্ষিণে গানবাজনা, নাটক, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য অম্বি^কাচরণ লাহা ক্লাব। মাঝখানে শানের মাঠে অফিসার ও শহরের গণ্যমান্যদের সঙ্গে এসডিও সাহেব বিকেলে লন টেনিস খেলেন। এখানে সাহেবদের ঘামে ভেজা শরীর, হাফপ্যান্টের নিচের সাদা পা-জোড়া ও তাঁদের ফুর্তি দেখার জন্য রোজ কিছু কৌতূহলী জড়ো হয়। এসডিও সাহেবের পরিচ্ছন্ন বাংলো-লাগোয়া বড় বেলগাছের নিচে পাকা ফল খোঁজাখুঁজির সময় একাধিকবার গার্ডের ধমক খেয়েছি। আমাদের তাই জাঁক-দেখানো হামবড়া সাহেবমাত্রই ঘোর অপছন্দ। একবার উড়ে আসা একটা টেনিস বল জাগন্ত রাগ মেটাতে পুকুরের মধ্যজলে ছুড়ে ফেলে দৌড়ে আমরা অদৃশ্য হই।
স্কুল বন্ধের সুযোগে হিমধরা বিষণ্ণ এক দুপুরে উদ্দেশ্যশূন্য হাঁটাহাঁটির কালে দেখি, কানাই দাদুর ঝুনো মাথায় ঝাঁকাভর্তি জামা-কাপড়, এগুলো ধোঁয়ার জন্য বারোয়ারি পার্কের পুকুরের দিকে যেতে যেতে আমাদের এক টুকরো সরস হাসি তিনি ছুড়ে দিয়েছেন। আমরা সময় খরচের টানে দাদুর পেছনে পা ঘুরাই। -‘দিন আসতিছে। বুঝিছো তোমরা’, গোপন কোনো রহস্য কণ্ঠে বলে, ঠান্ডায় কাবু কৃষ্ণচূড়া গাছের ওপর তিনি নজর ফেলেন। আমাদের কাঁচা দৃষ্টি কেবল রাতে ট্রেজারির ম্যাড়ম্যাড়ে আলো দেওয়া ঘষা কাচের ল্যাম্পপোস্ট অবধি যায়। ওদিক থেকে নতুন কোনো ইশারা কি দেখা যাচ্ছে? আমাদের বোধে সামান্য কিছুও ধরা পড়ে না। দাদু তাঁর পুরনো ঘোলা চোখে দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন, অথচ আমরা পাচ্ছি না ভেবে আমাদের বয়সকে দায়ী করি। হ্যাঁ, বাতাসে মিষ্টি মিষ্টি মাদকতা। সহসা পৌষের নবান্নের ঘ্রাণ পাই। নদীর ওপারের পাড়াগাঁ থেকে নৌকায় শহরে নতুন ধানের চাল আসছে। ডিঙি নৌকা এসে ভিড়বে নদীর পাড়ে জমিদার আমলের কমলকুমারীর ঘাটে। ঘাটের সামনে উঁচু গেট – সেই কবেকার পুরনো গাঁথুনির পলেস্তারা খসা ক্ষয়াটে ইটের গা থেকে লাল লাল গুঁড়ো ঝরে। গেটের খোড়লের ভেতরে বাড়ন্ত বটচারা অনাবৃত সরু শেকড় দেখাতে দেখাতে পাতা দুলিয়ে যেন ইঙ্গিত করে – এবার খুব শীত পড়বে। আমরা দেখেছি, বয়স্ক মানুষজনও নিকটের অসুবিধা নিয়ে বলাবলি করেন – সামনে মাঘ, এবারের শীত কঠিন।
অকস্মাৎ ভৈরবের কোলের অনুন্নত ও ধূসর শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় দারুণ উৎসবের মতো ছড়িয়ে পড়ে প্রাণপূর্ণ উত্তেজনা। সাতবাসি পামন্তা চৌদ্দোবাসি তেঁতুল-খাওয়া জীবনের অসুখ ক্রমশ মুছে যায়। ঘাড় গুঁজে দিন গুজরান করা নির্জীব দক্ষিণের বাঙাল শরীর ঝাড়া দিয়ে যেন জেগে ওঠে। নিষ্ক্রিয় হাত-পা বুঝি খুঁজে পায় শংকাহরণ শক্তি। মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়ে – প্রেসিডেন্ট পদে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারে প্রাক্তন গভর্নর আজম খান এলাকার উপেক্ষিত দীনদের সামনে আসছেন। এমন সমাচার ফিসফিস স্বরে, পরে দীর্ঘ দমন-পীড়নে ঘায়েল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আইয়ুববিরোধী আলোচনা মুসলিম লীগারদের থোড়াই কেয়ার না-করে প্রকাশ্যেই ছড়িয়ে দেন। আমাদের স্মরণে আছে, হরিসভা রোডে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সমাবেশ মুসলিম লীগের গুণ্ডারা পিটিয়ে গুঁড়ো করে দেয়। দেখেছি, মেইন রোডের তেমাথায় দিনে-দুপুরে যুবক আওয়ামী নেতার ওপর পেটোয়া বাহিনীর হাতের যথেচ্ছ সুখ করে নিতে। অজিয়র রহমান তাঁর ভদ্র শরীরে নয়টা সেলাই নিয়ে হাসপাতালের বেডে কষ্টে কাতরাতে থাকলে শহরের বিবেক দুঃখে গলে যায়। বুদ্ধিমানদের মুখে শোনা, মুসলিম লীগ নেতা মোজাম্মেল হোসেন আইয়ুব সরকার থেকে যে তমঘা-এ -খিদমত খেতাব পান তা এই গরম গরম সেবার কারণে। লীগের দুর্ধর্ষ পাণ্ডা ইসহাক মিয়াকে হাটবাজার, দোকানপাটে চাঁদাবাজির জন্য আড়ালে সবাই তাকে রাক্ষস নামে জানত।
আচানক বাজারমুখী রাস্তার মোড়ের দক্ষিণ পাশে অনেক দিনের বসানো পুরনো যে-টিউবওয়েলটা, ভোর থাকতে আশপাশের খাটুয়ে মানুষ কলস-বালতি ভরে পানের ফ্রি জল নেয়, তার পেছনে সুভাষবাবুর রেস্টুরেন্টের টিনের ছাউনি, এর ওপরে আমরা ঝুলতে দেখি গোলাপ ফুল মার্কার ঢাউস ব্যানার। গোলাপ সঙ্গে নিয়ে ব্যানারে উর্দি পরা হুকুমতে পাকিস্তানের শার্দূল নেতা আইয়ুব খান শোভা পাচ্ছেন। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে লাল চোখের পেশিবাজরা এখানে ঘুরঘুর করতে করতে ব্যানারে সমেন্তাষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। ভাবখানা, এই শহরের সরকারবিরোধী আহাম্মকরা চমৎকার ব্যানারের মর্যাদা বলো, গৌরব বলো কী বুঝবে!
আমরা জানি, গড়পড়তা মানুষ এড়িয়ে চলা স্বভাবের কোনো কোনো অবস্থাপন্নের সামনের বাগানে গোলাপগাছ আছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার উদ্দেশে এই গোলাপগাছ উঁচু শক্তপোক্ত বেড়া ঘেরাও দিয়ে রাখা। আমরা বিদ্যুৎশূন্য শহরের দোকানপাটে, ঘরে ঘরে, যে-কোনো আশ্রয়ে কেরোসিনের ল্যাম্প আর হারিকেন জ্বালানোর কষ্ট প্রতি রাতে ভোগ করি। সামান্য হলদে এই আলো অন্ধকারকে শাসন করতে পারে না। তবু প্রয়োজনীয় আলোর জন্য হারিকেন ছাড়া কোনো উপায় নেই। অতএব, হারিকেন আমাদের আপন মার্কা। আমরা হারিকেন মার্কা হারিকেন মার্কা সেস্নাগান তুলে শহরের রাস্তায় রাস্তায় স্বর মোটা করে ফেলি। অলিগলি, আনাচ-কানাচ, বিভিন্ন মহলস্নায়, ছোট-বড় মোটা-চিকন গাছগাছালির ফাঁক-ফোকর ছাড়িয়ে মিলিত কণ্ঠের আওয়াজ পৌঁছে যায় চারপাশে। সম্ভবত শহরের এমন জাগরণ শহরতলি, কাছাকাছি লোকালয়, নদীর ওপারের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর পাড়ি দিয়ে ভাঙা-মচকানো মানুষের মনেও প্রবেশ করেছে। নচেৎ শহর জুড়ে এত মানুষ কেন?
আমাদের শহর থেকে আচার্য প্রফুলস্নচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় কলেজ খুব দূরে নয় – হেঁটে গেলে আধঘণ্টার পথ। প্রধান রাস্তা ও কয়েকটা মোড় ঘুরে গেলে ছিমছাম ঘাসময় সবুজ ভর্তি কলেজের বড় মাঠ। এখানেই আজম খানের বিরাট জনসভা হবে শুনে আমরা লক্ষ করি, রাস্তায় বাদাম ও শনপাপড়ির হকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। রাস্তার পাশের ও চায়ের ছাপরায় মুখের পাশে মুখ। সবাই কথায় মশগুল। এতদিন ভয়ভীতি, হুংকার, লাঠিপেটার আশংকায় বেচারা মানুষ ছিল ছত্রখান, যে-যার ঘরসংসার, জীবন-জীবিকার কাজের নামে মনোযোগী যেন কিছুতেই কারো কোনো আগ্রহ বা অংশ নেই। এখন সবাই যেন জোয়ারে ভাসছেন। আমরা বাদামের খোসা ভাঙতে ভাঙতে বড়দের মুখ পড়ি। হারিকেন মার্কার লোক অনেক দেখে আমাদের মনে অপরিসীম আনন্দ হয়।
শেষাবধি আমাদের প্রতীক্ষার অবসান হয়। টুকরো টুকরো সমেন্তাষ ও পুলকের মধ্যে চমৎকার এক দিনে কায়েদে আযমের বোন ফাতেমা জিন্নাহর হারিকেন মার্কার জনসভায় বক্তৃতা দিতে আজম খান আসেন। আমাদের ছবি ছাড়া ফাতেমা জিন্নাহকে দেখার আদৌ সুযোগ নেই। জেনেছি, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সালোয়ার-কামিজ পরা শিক্ষিতা নারী, অবাঙালি, উর্দু বা পাঞ্জাবি ভাষায় হিসাব করে বাতচিৎ করেন। মফস্বলের কোনো কোনো উকিল, স্কুল-কলেজের মাস্টার স্বীয় বিদ্যার গুণে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর জয় মানে আইয়ুবের লৌহকঠিন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মোক্ষম জবাব। শুনে, সাতেপাঁচে নেই এমন মানুষও তা সমর্থন করেন। হারিকেন মার্কার পক্ষাবলম্বন তাহলে ঠিক এবং ফাতেমা জিন্নাহ নিজেদের ঘরের নারী মেনে আমাদের উৎসাহ ও কণ্ঠের তোলপাড় বেড়ে যায়।
শহরের অপ্রশস্ত রাস্তার দুপাশে সরব কৌতূহলী মানুষ লাইন করে দাঁড়ায়। ঘরের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসা আগ্রহী মহিলাদের মেইন রোডের কোর্ট এলাকা পর্যন্ত দাঁড়ানোর ব্যবস্থায় পুরুষরা সম্মতি দেন। তাঁরা আজম খানের উদ্দেশে হাতের ডালি থেকে ফুল ছুড়ে দেবে। রাস্তার পাশে বহুজনের দোতলা বাড়ি নেই, তাতে কী, অনেকে অনুমতির অপেক্ষা না করে আশপাশের বাড়ির বারান্দা, ছাদ দখল করে আজম খানের যাত্রা দেখতে নিচে তন্নতন্ন নজর ফেলে রাখেন। ও মা, খানসাহেব কী জ্বালানো দুধের ঘন সরের তৈরি! সম্ভবত ফেরেশতা বা দেবতারা নিজেদের কোলে আদরযত্নে তাঁকে বড় করেছেন। সামান্য টোকা পড়লেও তাঁর চামড়া থেকে বুঝি রক্ত ফুটে বেরোবে। গরমে তাঁর মাখনশরীরও গলে যেতে পারে। সি-পেস্নন ভৈরবের জলে এসে নামে। ভেতর থেকে বেরিয়ে স্পিডবোটে চড়ে ডাকবাংলোর ঘাট হয়ে তিনি খোলা একটা জিপে উঠে দাঁড়ান। মুহুর্মুহু জিন্দাবাদে এলাকা কাঁপতে থাকে। টকটকে হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা হাত নাড়তে নাড়তে আমাদের দৃষ্টির পিপাসা মিটিয়ে আয়োজিত সমাবেশের উত্তর এলাকায় চলে যান।
আহা, আমরা যদি তাড়াতাড়ি বড় হতে পারতাম! বড় হওয়ার অতীব আকুলতা বুকে নিয়ে জেলখানার পুকুরপাড়ের উদ্দেশে আড্ডার জন্য রওনা দিয়েছি, তখুনি পেছন থেকে উড়ে আসে কানাইদাদুর ডাক। তিনি তাঁর সঙ্গে উলটো যাত্রার ইশারা দেন। তেমাথার মোড়ে টানানো গোলাপফুল মার্কা ব্যানারের দিকে তিনি আঙুল তুলে ধরেন। – ‘কিছু দেহিস তোরা’ বলে, তিনি জোরালো নজরে লক্ষ করতে বলেন। দেখি, ব্যানারের আইয়ুব খানের নাকে ও মোটা গোঁফের ওপর পাখির সাদা বিষ্ঠা। আনন্দে তখুনি আমাদের ধেই ধেই নাচতে ইচ্ছে করে। আইয়ুব খান অপবিত্র। তাকে কাক বা কবুতর ময়লা করেছে। এমন তাক-লাগানো ঘটনার চাপে হাসি উড়িয়ে দিতে না দিতেই চারপাশ থেকে দ্রম্নত অঘটনের ঘূর্ণি এসে মুখ আমাদের নিভিয়ে দেয়। রাস্তার মানুষ যেন পালিয়ে চলেছে। দোকানপাটের ঝাপ পড়ে। ব্যাপার কী? জানা গেল, রেলরোডের দিকে সাধনার তেমাথা মোড়ে ইসহাক মোলস্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগের ভয়ংকর বলিষ্ঠ গুন্ডারা হারিকেন মার্কার দুজন সক্রিয় কর্মীকে অকাতরে পিটিয়েছে। রক্তাক্ত শরীরের চিকিৎসার জন্য এখন তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। শহরের ওই অঞ্চল বন্ধ। আশ্চর্য, শহরময় অপার শান্তি বিরাজ করছে – এমন মনোভাবে পুলিশ দেখি আরামে পায়চারি করছে। তাঁরা সন্তুষ্টচিত্তে পানের পিক ফেলে লাল করে চলেছে রাস্তার পিঠ। তাহলে হাওয়ায় পাওয়া কথাই ঠিক যে, মুসলিম লীগাররা পুলিশের মনোযোগ কিনে তাঁদের কার্টন কার্টন সিগারেট দিয়ে প্রীতিসূচক দানেও ধন্য করেছে।
নির্দিষ্ট দিনে এক মেঘলা সকাল থেকে বিকেল অবধি বড় অভাবনীয় নির্বাচন হলো। আমরা না হয় কিশোর, বেশিরভাগ বয়োজ্যেষ্ঠরও লেশমাত্র ধারণা ছিল না – আগে থেকেই নির্বাচিত পুরনো চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কেবল ভোটার। তাঁরাই ভোট প্রদানের অধিকারী। বেসিক ডেমোক্র্যাসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের নামে যে-নির্বাচন হলো তার সঙ্গে জনমতের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ছিল চরম ভাঁওতা। তাহলে নির্বাচন নিয়ে জনগণ এত মাতোয়ারা হলো কেন? আমরাই বা স্কুল ফাঁকি দিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে হাতে পুরনো একটা হারিকেন উঁচিয়ে রাস্তা-ঘাট-পাড়া কেন মাথায় তুলতে গেলাম! জানা গেল, মুসলিম লীগের অঢেল অর্থ ঢেলে জেলস্না চেহারার মেম্বার-চেয়ারম্যানদের খরিদ করার অপকর্মের কাহিনি। এসব ভ্রষ্ট চরিত্রের ভোটার জনপ্রতিনিধি এক ব্যান্ডের রেডিও তাহলে কোত্থেকে পেয়েছে। প্রায় প্রকাশ্যেই ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের নামে আদান-প্রদানের মহোৎসব। আমরা তো মুখ থেকেই জেনেছি, মানুষ গোলাপ ফুল মার্কার সঙ্গে নেই, তাঁরা আইয়ুবের পতন কামনা করে – তাহলে?
ভোটে হারিকেন মার্কা হেরে গেলে অনেকে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলার ত্রাসে শহর ছেড়ে উধাও হন। নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে মুসলিম লীগাররা শহরে জঙ্গি মিছিল নিয়ে কোনো কোনো দোকান ভেঙে নিজেদের বিজয় জাহির করে। ডাকবাংলোর সামনের এক রেস্টুরেন্টে বসে এক আওয়ামী লীগ নেতা চা পান করছিলেন, তাঁর ওপর এনএসএফ গুণ্ডারা মনের সুখে হাত গরম করে। শোনা গেল, নদীর ওপারের দশমহল এলাকার মিছিল-মিটিং-নির্বাচন থেকে দূরে থাকা নির্দোষ সংখ্যালঘুদের অনেকে ঘর-জমি ফেলে শুধু প্রাণ নিয়ে পালিয়েছেন। চারপাশে ভীতির এক আবহাওয়া শাঁই শাঁই ছড়িয়ে যায়। পথেঘাটে মানুষ কমে আসে – তাদের কপাল জুড়ে ভাঁজ। রাতে ট্রেজারির ল্যাম্পপোস্টের আলো মনে হয় আরো অস্পষ্ট। টেনিস কোর্ট ফাঁকা। সরকারি সাহেবরা ঘন ঘন জরুরি সভায় বসেন। থানার পুলিশরা দৌড়চালে অলিগলি পাহারা দেয়। শহরের তেল-সুপারি-কাপড়সহ বড় হিন্দু ব্যবসায়ীদের অনেকে হিন্দুস্তানের এজেন্ট – এমন অভিযোগে আটক হলে তাঁদের আত্মীয় ও কর্মচারীদের কাঁদতে কাঁদতে মেরুদ- গলে যায়।
শহর নিষ্প্রাণ। মানুষের কোনো কিছুতেই উৎসাহ নেই – জীবনীশক্তি বুঝি ক্রমশ ক্ষীণ। ক্ষুণ্ণ, অপ্রসন্ন বিভিন্ন কালো মুখে স্থির দৃষ্টি ধরে আমরা কারণ খুঁজে পাই না। জোয়ার-ভাটার টানে ভৈরবের স্রোত এলো-গেলো, জল ঘোলা হলো, তাহলে জীবনযাপনের সুসময় থেকে আমরা সত্যি সত্যি কি বঞ্চিত থেকে যাব! এমন বিরুদ্ধ সময় যখন জমাট হতে যাচ্ছে, সহসা কানে এলো মাইকের জোরালো আওয়াজ – পূর্ববাংলা শ্মশান কেন আইয়ুবশাহী জবাব চাই। সামরিক জামন্তা নিপাত যাক। রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। আমাদের মাথা পুনর্বার জোরালোভাবে সাড়া দেয়। দ্রম্নত বধিরতার মোচন হয়। মানুষ এগিয়ে যায় মানুষের পাশে। এ-কথা অমোঘ সত্য, প্রয়োজনীয় কাগজ উৎপাদন হচ্ছে এই ভূখ– অথচ বাঙালি কিনছে বাড়তি দামে। এখানের ক্ষেত-খামারে পাট উৎপাদন যথেচ্ছ, সোনালি আঁশ রফতানি বাবদ উপার্জিত অর্থে ধনী হচ্ছে খান-পাঞ্জাবি। পূর্ববাংলার টাকায় পশ্চিমের ইট-পাটকেল-বালি-পাথরের অযোগ্য প্রান্তরে তৈরি হচ্ছে রাজকীয় মহল ও রাজধানী – অবশ্যই এই চরম বৈষম্যের আশু অবসান দরকার। মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সমস্বরে আওয়াজ তোলে – চলো স্টেডিয়ামের মাঠে। ন্যারোগেজ রেললাইন পার হয়ে ওপারে চলো, আমরা বজ্রকণ্ঠের ভাষণ শুনব। এক সাহসী বাঙালির বক্তৃতা শুনব। অনেক জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার এই নেতা দ্রম্নত মানুষের মনে আগুন জ্বেলে দিচ্ছেন। সত্যি তো, বহুদিন প্রাণের ভাষায় বলা আমরা কারো ভাষণ শুনি না। প্রতিবাদ, প্রতিরোধে অবশ্যই এবার জীবনের উত্থান হবে। মুসলিম লীগের গুন্ডাপান্ডাদের হুংকার উপেক্ষা করে চঞ্চল মানুষের ঢলে আমরাও মিশে যাই। আজ আমাদের প্রিয়জন ফতুয়া গায়ে কানাইদাদুর শরীরের জোড়ে জোড়ে যেন তুমুল জোশ। আধা পথ যেতেই শুনতে পাই, স্টেডিয়ামের গেট নাকি মানুষ ভেঙে ফেলেছে। পায়ের পাশে পা, কাঁধের পাশে কাঁধ রেখে দ্রম্নত পূর্ণ হয়ে আসছে মাঠের সীমানা।
দুপাশে ঠাসা পুরনো বসতঘরের জংধরা টিনের ছাউনি আর দোকানপাটের সারি। ফালি ফালি খাবারের দোকানের সামনের বাতাস ধোঁয়া ও পোড়া তেলের ঝাঁজালো গন্ধে ভারী। নদীর ওপারের খেয়া পার হয়ে আগেভাগে যাঁরা অভুক্ত এসেছেন জনসভা ধরার জন্য তাঁরা শিঙাড়া-পুরি-রুটি-পরোটা যেন গিলে খাচ্ছেন। রেলরোডের টুটাফাটা রাস্তা ধরে আমরা প্রায় টগবগ ছুটছি। শহরের এই পুরনো অংশে কালেভদ্রেও আসা হয় না। স্টেডিয়ামে নিয়মিত খেলাধুলা নেই, খেলোয়াড়রাও প্র্যাকটিস করে না, পরিত্যক্ত পড়ে থাকতে থাকতে দেয়াল শ্যাওলাধরা, মাঠময় উলুঘাস। আজ জনসভার হাজার হাজার মানুষ ধারণ করে স্টেডিয়াম ধন্য। বাউন্ডারির ওপাশের গাছপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাইকের নিনাদ উড়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে বাইরের চরাচর। মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, মোটা গোঁফের দীর্ঘদেহী এমন বাঙালি পুরুষ সচরাচর দেখা যায় না। এ কী ব্যতিক্রমী স্বরের উৎসাহক প্রতাপ। তিনি পাকিস্তানের নিকৃষ্ট ঘোর অপশাসন, সামরিক সরকারের শোষণ, পূর্ববাংলার খাদ্য, ধনসম্পদ লুটের অন্যায় বিষয়ে আমাদের ভাষায় আমাদের কথাই বলছেন। আমরা কখনো বিস্তারিত এমন অভিযোগ শুনিনি। মানুষের হাড়-পেশি-নখে কেউ এমন উদ্দীপনা আগে এনে দেয়নি। কানাইদাদু বুঝি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন – এমন ঘোরের মধ্যে থেকে নিজস্ব উচ্চারণ পেয়ে যান। – ‘দিন আইছেরে, এই হতিছে নেতা, আগামীর নেতা। আমি দেখতি পারতিছি’ বলে, হাজার হাজার মাথা-পা-শরীরের জড়াজড়ি, নিশ্বাস উপেক্ষা করে সামনে যেতে তিনি মরিয়া। দাদুর পেছন ধরে আমরাও দুচোখ ধন্য করে নিতে সাধ্যমতো ভিড় ভাঙতে থাকি। আমাদের ঠেলাঠেলির কারণে এক যুবক বিরক্ত কণ্ঠে তেড়ে ওঠে – ‘এহান থাকেই তো ভাষণ শোনা যাতিছে, আবার সামনে ক্যান?’ দাদুর তৃপ্ত মোলায়েম স্বর – ‘বাবা, রাজদর্শন পুণ্যির কাজ। কত কাল পরে উনি মানষির কথা কচ্ছেন। এ তো আমাগো ফরিদপুরের লোক। ব্রিটিশ থাইকে আজ অব্দি কত্ত কাল দেখিছি, আমার বয়স কয় উনি হবেন এই দেশের আসল রাজা।’ বুড়ো মানুষকে দয়া করে বা তাঁর কথায় ভিন্ন কোনো মানে আছে ভেবে সামনের মানুষ জায়গা করে দিলে রাজদর্শনের পুণ্যের ভাগ নিতে আমরাও দাদুর পেছন পেছন এগিয়ে যাই।