আচমকা কার ডাকে চটকা ঘুম ভাঙতে অজয়ের খরচ হয়ে গেল অনেকটা দুপুর। চোখ কুঁচকে কচি করে তাকাতেই – গাছপালা এক আকাশ রোদ্দুর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল দুচোখে। দৃষ্টির আড়মোড়া ছাড়াতে নিল একটু সময়। তারপর আসেত্ম আসেত্ম নজরের পাট ভাঙতে ভাঙতে ওপর দিকে তাকাতে লক্ষ শিশু-মেঘ কোলে নিয়ে অপেক্ষায় এক বিশাল জননী-আকাশ। অক্টোপাস ডালপালা বিছিয়ে সেই নীলাভ মাকে ধরে রেখেছে অশ্বত্থ গাছটা। আকাশ ভাসিয়ে বাতাস, ব্যাপক সুনামি রোদ্দুর ঠেকিয়ে গাছ নিঃশব্দ কোমল প্রহরী। তারই ছায়া নিকানো চাতালে নিশ্চিমেত্ম ঘুমিয়ে অজয়।
ঘোর কাটতে দৃষ্টি একটু ফিল্টার হতে খেয়াল করল, এক্কেবারে কাছে দাঁড়িয়ে দুলাল। তা’লে ডাকছে সে-ই। সাইকেলে বসে প্যাডেলে এক পা। কোঁচানো ভ্রম্ন, কপালে গিলে মেরে অবাক, এ-সময় তুই এখানে ঘুমচ্ছিস? শরীর খারাপ?
না না, কাটিয়ে দিতে চাইল অজয়।
সাইকেলের হ্যান্ডেলে ভারী ব্যাগগুলো গোছাতে গোছাতে কথা গুছিয়ে নিল দুলাল, না মানে, এভাবে তো তোকে দেখি না। এখন তোর বাগেশ্বর থাকার কথা। কোনোদিন আমার দেরি হলে তুই কাজ সেরে ফেরার পথে দেখা। তখন আমাকে উলটো দিকে আসতে দেখে দেরি হওয়ার জন্য দাঁত কেলিয়ে হাসবি। অথচ আজ এক্কেবারে কাজের লাথি মেরে এখানে চিৎপাত হয়ে? সত্যি করে বল তো এর ব্যাকগ্রাউন্ডে কী ধান্দা?
জানে, সব জানে। এ-সময় তার কোথায় থাকার কথা। কোন অঞ্চলে অর্ডার নেওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঘুম তা জানে না। জানে না কোথায় তার দোষ। জানতে হলে নিজেকে ঘুমের কাছে বন্ধক রাখলেই উত্তর পরিষ্কার। প্রত্যেক ঘুমের স্বভাবের মধ্যে দারুণ মিল। পেটের সঙ্গে যেমন খিদের। জেগে থাকলে যত ভাষাভাষীর তফাৎ। ঘুমিয়ে পড়লে একটাই ভাষা। দুলালকে কাটিয়ে দিতে ও বলল, কাল রাতে এলাকায় কারেন্ট ছিল না। তাই ক্লামিত্ম শরীর ঝাঁপিয়ে নামতে জাগিয়ে রাখতে পারিনি নিজেকে।
অজয়ের কথা থেকে ‘ক্লামিত্ম’ শব্দটা খুঁটে নিয়ে মোচড় মেরে উচ্চারণ করল দুলাল। ঠোট বেঁকিয়ে হাসল, ঘুম থাক, কাজ যাক। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো শ্রম ছেঁটে দেওয়া অনেক সহজ। তা বেশ ভালো। এখন কথা হচ্ছে কাজ কামাই করে পুষিয়ে নিচ্ছিস ঘুম। কিন্তু কাজ পোষাবি কী করে?
ডাহা সত্যি কথা। না মানার কোনো জায়গা নেই। অথচ নিজেই হোপলেস হলেও হেল্পলেস। এই যে অনেকক্ষণ ধরে তিনি আসবো আসবো করছিলেন। এ-পথ দিয়ে যেতে যেতে নজরে পড়ল বাঁধানো চাতাল ওপরে ডালপালা বিছিয়ে সবুজ রঙের পেন্ট মেরে অনেক কষ্টে রোদের সুনামি আটকের অপেক্ষায়। অথচ ফাঁকা চাতাল। কেউ ইজ্জত দিচ্ছে না। সব গেছি চায় ফল, ফুল ভরিয়ে চায় উজাড় করে কল্পতরু হতে। অতিথি কই! ভোগ করার মতো উপভোক্তা চাই। এদিকে যেতে যেতে একলা পথে তাকে পেয়ে যেতেই ব্যস। আদর করে টেনে নিল কোলে। পাতা বিছানায় প্রকৃতির ডেকোরেশন। সাইকেল পাশে দাঁড় করিয়ে রেস্ট নিতে গিয়েই চোখের পাতায় ম্যাগনেট। প্রতিশোধ নিল গতকালের রাত। একটু কাত হতে খিদেয় চোঁ-চোঁ করা ঘুম এইবার দুপুরে চেটেপুটে খেয়ে নিল তাকেই। অথচ শরীর নিংড়ে এই সময়টা খরচ করার কথা ছিল অন্য কাজে। ক্লামিত্ম আমায় ক্ষমা করো।
কথা রাখা যায়নি। ঘুমের আর দোষ কী। কেউ কথা রাখে না। তবু বেশিক্ষণ নয়। ঘুমপাড়ানি মাসির কাছে নিজেকে বন্ধক রেখেছে। ব্যস্ত আকাশ। মাথার ওপর লক্ষ পাতার কচি কচি বাতাস। তার নিচে অজয় নিশ্চিন্ত, চাতালের কোলে প্রকৃতির শেল্টারে। তখনই ডাক দুলালের। এদিকে ঘুমের কারণ জানতে চাইছে আবার। কী করে বোঝাবে যে প্রতিমুহূর্তে এক একটা গরস করে ঘুমের খিদে মেটাতে দারুণ ব্যস্ত। এসব ভাবনার ব্যাখ্যার কি আর ছাল-ছাবেলি বোঝানো যায় ঠিকঠাক! খাটুনির মাঝখানে তবু কথা বলা যায়। কিন্তু ঘুমের খিদে মেটানো ব্যস্ততার মাঝখানে উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগই পাওয়া যায় না।
এ আবার কেমন ধরনের উলটো কথা! পালটে লোকে পাগল বদনামে কুলকুচিতে ভরিয়ে দেবে দোকান বাজার চারদিক। পেছন থেকে প্যাক মারবে ছেলে-ছোকরা। রাস্তায় দেখলেই পিছু নেবে বাচ্চার দল। ব্যবসায় জ্বলবে লালবাতির ঝাড়লণ্ঠন। তার চেয়ে হালকা কারণ দেখিয়ে পলকাভাবে ফুটিয়ে দেওয়া ভালো। ও তাই করল। চলেও যাচ্ছিল দুলাল। সাইকেলে প্যাডেল মারতে গিয়ে কি দেখে থামল হঠাৎ, আরে ব্যস, সাইকেলের চেনের সঙ্গে নিজের হাত বেঁধে ঘুমোচ্ছিস? খ্যাঁচা কলটা করেছিস ভালোই। তা তালা-চাবি মারাটা বাদ দিলি কেন?
জীবনটা এত ‘কেন’ আর ‘না’-তে ভরা যে সব ‘কেন’র জবাব দেওয়া যায় না। আমার জীবনে না মানে নেগেটিভ।
ওরে আমার বাপজান, কোথায় ছিলি এদ্দিন! তুই আমাদের পথ ছেড়ে অনেক ওপরে অ্যারোপেস্নন লেভেলে পৌঁছে কথা বলছিস। একটা সাধারণ কথা জিজ্ঞাসা করছি মাত্র। তুই জমি ছেড়ে চলে গেলি আকাশে। ঘুড়ির মতো তোকে হাপ্তা মেরেও ধরা যাবে না।
এছাড়া করার কী আছে। শোয়া অবস্থায় হাসার চেষ্টা করল অজয়, যদি চুরি হয়ে যায় সাইকেল!
সেই জন্য তোকে ছোট্ট করে জ্ঞান মেরে তালা-চাবি মারার কথা বললাম। এদিকে চুরি না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে, আবার অন্যদিকে তোকে ধরে রাখা যাবে আমাদের মধ্যে। অথচ না ঘুমালে এসবের কোনো লক করার ঝামেলা ছিল না। তবু তোর ঘুমোনো চাই। যাই হোক, তোর ঘুম তোর কাছে থাক। আমি এবার নয় দুয়ে এগারো হয়ে যাই। পারলে বাজার ধর তাড়াতাড়ি।
দুলালের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল এক বেগদা। নিজে ওইদিকেই তো যাচ্ছিল। মাঝরাস্তায় আটকে দিলো মাইলস্টোনের মতো হালকা আলো-ছায়ায় প্রজেক্ট করা চাতাল, ফুরফুরে বাতাস আর মিহি ঘুম। ওই যে বলে গেল যার যার ঘুম তার নিজের কাছে। ব্যবসার মালপত্তরের মতো ঘুমও নিজস্ব সম্পত্তি।
ঠেকনা মারা কথা হলেও ভালো উপদেশ। দুলালের কী দায় পড়েছিল তাকে ডাকার। এই সামান্য ব্যবসায় চলে নিজের ও মায়ের। ও একটু ঝুঁকে চেইন থেকে ছাড়িয়ে নিল হাত। ছাড়াতে গিয়ে ফিকে হাসি গুঁড়িয়ে গেল ভেতরে। চুরির হাত থেকে সাইকেল বাঁচাতে নিজেই ধরা পড়েছিল এই অশ্বত্থতলায় এতক্ষণ। কিছুদিন আগে নামি এক দোকানে ধরাপড়া চোরকে শেকল বেঁধে রাখতে দেখেছিল। নিজের মনে ভেবে বসল, চেইন আর শেকলের মধ্যে কি কোনো তফাৎ আছে! চোর আর ডাকাতের মধ্যে যেমন তফাৎ! যেমন ফারাক পৌরপিতা এবং সাংসদের মধ্যে! হয়তো তাই। পরক্ষণেই আবার ভাবনার মোড় পালটে ফিরে এলো নিজের গ–তে। হাতে এতক্ষণ বাঁধা চেইন মিথ্যে নয়। ঘুমের জন্য চোরের দায় ধরা পড়েছে কর্মের কাছে। ব্যবসার কাছে অপরাদ্ধ।
কী আর করা যাবে। প্রকৃতির মতো অবাধ্য শরীর। মাঝে মাঝে এমন মাদারী খেলা দেখায়! দেহের মালিকের নিয়ম মেনে শরীর রানিংয়ে থাকে না। চারপাশ তাকিয়ে রোদের ঝাঁজ বোঝার চেষ্টা করল। ঘাড় কাত করে দেখে নিল দুলাল ফুটে গেছে কিনা। তারপর আলস্যের খোসা ছাড়িয়ে উঠে বসতেই থামল একটু। আচমকা মনে পড়ে গেল নিজের বিসুখের ব্যাপারটা। রোজ আড়মোড়া ভাঙা চাউনিতে দেখে নেয় অন্তত একবার। আগে ভুলে যেত প্রায়ই। এদামিত্ম অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে রাতের দীর্ঘ ব্রিজ দুরন্ত গতিতে পেরিয়ে আলোর পৃথিবীতে পৌঁছলে খুলে যায় স্বপনের ঢাকনা।
যদিও দুপুর এখন। তবু ঘুমের কাছে তার খিদের ধার মেটাতে হলো এই অসময়। তাড়াতাড়ি উঠে জামার বোতাম খুলল। সাবধানে বেশ ভয় ভয় নিজের বুক-পেট দেখল। জামা তুলে পিঠের না দেখা জায়গা যতটা দেখা যায়। নাহ্, কোথাও কোনো দাগ নেই। বেশ খুশিতে নেমে এলো চাতাল থেকে। সাইকেলে বসে ভারী ব্যাগগুলো গুছিয়ে পা রাখল প্যাডেলে। অকারণ সময় খরচ হয়ে গেলেও একটা খুচরো দুপুর বড় পয়া। এখন নিশ্চিমেত্ম ভাবনায় ধরে নিতে পারে, কোনো অত্যাচারের ঘটনা ঘটেনি কোথাও।
দুই
গরমের সময় সকাল সকাল মালপত্তর নিয়ে রোদের হালকা আঁচে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়া অজয়ের অভ্যাস। বেলা বাড়লে চড়বে রোদের রেগুলেটর। তবু যতটা আগে বাজার ধরা যায়। তার মধ্যে একফালি দুপুরে একফাঁকে ঘরে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে নিতে কোনো অসুবিধে নেই। পথের দূরত্ব প্যাডেলে ছোট করলে বাসের ভাড়া গোনার জন্য পকেট হাতড়ানোর চিন্তা নেই। নেই পয়সার খুচরো ঝামেলা। সবটাই ফোকটাই। কখনো ভালো অর্ডার ডেলিভারি অন্য জায়গায় পেলে ঘরে ফেরা হয় না। দুপুরটা দূরের হয় যায়। তখন সেখানকার দোকানে
রুটি-ঘুগনি পেঁদিয়ে পার পেয়ে যায় খালি পেটের জন্য ভরা খিদের কাছে।
ঘুসিকলের কাছে এসে প্যাডেল আর ব্রেকের ভাব ভালোবাসা করিয়ে থামল এখানে। তিনটে দোকানে মাল দিতে হবে। আগে কত দূরে দূরে মাল দিতে যেত। ব্যবসা এখন চাঙ্গা নেই তেমন। এ-লাইনে ছেলে ভিড়েছে অনেক। ঝামেলা হটাতে অলিখিত ভাগাভাগি হয়েছে এরিয়া। অঞ্চল পেরিয়ে দূরে গেলে কারো চোখে পড়লে ব্যস, খামোকা ব্যাগের ইজ্জত ধরে টানাটানি। ছোট হলেও ব্যবসার যতটুকু মানসম্মান এই ব্যাগে। এখন রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে চারদিকে ছড়িয়ে আছে শুধু কাকুরা। একটা সময় যেমন ছিল মামারা। এখন তেমন সম্বোধনে সবাই কাকা। তাই এরিয়া ছেড়ে অন্যদিকে চলে গেলে মুশকিল। কমবয়সী কোনো ভাইপোর নজরে এলে মারবে সাইকেলের পাছায় লাঠি। ভাগ, ভাগ কাকু ভাগ …
একটা জিনিস অজয় লক্ষ করেছে, তার বেলাতে যেন বাড়াবাড়ি অনেকটা বেশি। রাস্তাঘাটে ছেয়ে আছে এত্ত এত্ত ভাই আর ভাইপোর দল। তাকে দেখতে পেলে কোথা থেকে যে জুটে যায় সব! আর দেখতে পেলেই ইয়ার্কি মারার চ্যাংড়া ইচ্ছা সুড়সুড়িয়ে ওঠে। রাস্তায় কারো মুখোমুখি হলে সৌজন্যের হাসি হাসলে সে এগিয়ে আসে কাছে, আমায় দেখে হাসলে কেন?
… চিনি তাই।
… আমি তো ঠিক …
এখন অজয় পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে হাসে না। রামগরুড়ের ছানার মতো হাসতে যেন মানা। কিন্তু নিজে না হাসলে কী হবে, তার উপস্থিতি হাসায়। নামধাম যতজন না জানে তার চেয়ে চেনামুখের কীর্তন করে সবাই। কখনো অসহ্য লাগলেও বিরক্তির দাম দেয় না কেউ। কিছু করার নেই। তাকে ছাঁচে ফেলে নিয়েছে পাবলিক। কোথাও দেখতে পেলে হালকা করে একটু চেটে দিয়ে যাবেই। দুঃখ দুঃখ নজরে লক্ষ করেছে, তাকে কাছে পেলে সবাই কেমন অক্সিজেন পেয়ে যায়। মাঝেমধ্যে রাগ হয় বেশ, যেন সে গাছ। সবার জন্য অক্সিজেন বিলোতে এসেছে।
হরিসাধন হাই স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে অজয়। পড়াশোনায় তেমন কিছু না হলেও তবু চলছিল ভেলপুরির চাকা লাগানো গাড়ির মতো। কিন্তু চৈত্রে পাতা-খসা-প্রকৃতির মরশুমে খসে গেল একটা পাতা। আচমকা বাবার মৃত্যু। রাত দীর্ঘ হলো সংসারে। সূর্য ওঠে অন্য বাড়ির ছাদে। এদিকে মাথা কামাইয়ের পর পাকাপাকি স্কুল কামাই। অভাবের নিম্নচাপে ছিটকে গেল ক্লাস নাইন। চটজলদি কোনো রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। দোকানে দোকানে মাল ফেরি করা বাপ কা বেটার পথ ধরলো শেষে। তাকে না চিনলেও দুদিকের চাকায় অদ্ভুত দুরঙের বাবার সাইকেলটা চেনে সবাই। বাবা তার হাত ধরে ব্যবসার জায়গাগুলো চিনিয়ে যেতে পারেনি। এভাবেই ডাবল কালার ট্রেডমার্ক হয়ে নিজে দোকানের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। স্কুলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও কেশব স্যারের কাছ থেকে তদ্দিনে মানুষের শরীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেনের খেলার কায়দাটা শেখা হয়ে গেছে অজয়ের।
যে-তিনটে দোকানে মাল দেওয়ার অর্ডার ছিল, সেগুলো ঠিক ঠিক দিয়ে অন্যদিকে যাওয়ার মুখে চা খেতে ইচ্ছে করল। পরক্ষণে খেয়াল পড়ল, সাইকেলটাকে আগে হাওয়া খাওয়াতে হবে। বাবার হাত-ফেরত সাইকেল বলে কথা। এদামিত্ম হাওয়া খাওয়া খিদেটা বেড়েছে একটু। যদিও এর মধ্যে অনেক কিছু পালটাতে হয়েছে। বসাতে হয়েছে সাইকেলের স্ট্যান্ড। তবু তো বাবার জিনিস। প্রথমে ও রাস্তা পেরিয়ে গেল ওপারে। সাইকেলের দোকানের সামনে সবে দাঁড়িয়েছে। অমনি পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, অজয়কে ঠেসে হাওয়া ভরে দাও।
শুনলেন তো? এই কথার ধরন। শুধু দেখতে পেলে হলো একবার। ছ্যাবলামির চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে শিশুকে কাছে পাওয়ার মতো আদরের ভঙ্গিতে একটু চটকে দেওয়া। তাতে কিছু যায়-আসে না। এভাবেই অভ্যাসের মজমত ঢালাই। কোনো প্রতিবাদ না করে সাইকেলে হাওয়া ভরে বেরিয়ে এলো লোকটাকে পাশ কাটিয়ে। চায়ের ইচ্ছে এবার বেশ চাপছে। ভাবনায় ছিল আগে খাওয়া। পরে সাইকেলে হাওয়া ভরা। ব্যাপারটা উলটে যেতে সময়ের হেরফেরে ফোকটাই মজা লুটে নিল এক কোয়ার্টার পাউন্ড ভদ্রলোক।
চেনা দোকানে চায়ের অর্ডার দিলো অজয়। বাইরে বেঞ্চে বেসে কোমর ছাড়িয়ে নিতে খেয়াল করল, পাশে লোকটির হাতে কাগজের খবর। তখনই ধাক্কা মেরে ঘুম থেকে তোলার মতো মাথায় ঘাই মারল কাল রাতে স্বপ্নের ফিলার। খানিকটা কাছে সরে ঝাড়ি মেরে হেডিংগুলো পড়ার চেষ্টা করল। নাহ্, ঠিক জুতসই হচ্ছে না। নিজের হাতে না খেলে যেমন তৃপ্তি হয় না। তেমনি খবর হজম হয় না নিজের হাতে নিয়ে না পড়লে। একটু যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল। জানার, শুধু জানার বড় ইচ্ছে। কাল কী এমন ঘটেছে যে তার ঘুমের সুযোগে সেই স্বপ্ন এসেছে নিঃশব্দে। কাগজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের শরীরের পাতায় চোখ রাখল। একটু ঝুঁকে ফুঁ দিয়ে জামা ফুলিয়ে সন্তর্পণে দেখে নিল অদৃশ্য মারের দাগ। তারপর ধৈর্যকে আপন রিজার্ভারে ধরে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল, দাদা, বড় কোনো খবর আছে?
লোকটি আড়চোখে তাকাল, বড় মানে? রাজ্যের, নাকি রাজধানীর? বা বিশ্বের?
বোঝো ঠেলা। কী করে বোঝাবে এখন! বেশ অস্বস্তির দাবার চালে পড়ে গেল। কাগজ তো আর কেড়ে নেওয়া যায় না। ইস্, একটা সোজাসাপ্টা উত্তর ব্রেনে ক্লিক করে আনতে পারছে না কিছুতেই! মানানসই একটা শব্দ শিক্ষার ঝোলা ঘেঁটে বের করতে ক্লাস এইট বিদ্যে যথেষ্ট। কিন্তু ভাষায় বোঝাবে তার জীবনের দুঃস্বপ্নের উপসর্গ আসছে ফ্রি গিফটের মতো। কাগজের সঙ্গে তার যোগাযোগ চায়ের দোকান বা সেলুনে। কোনো দিন সময় না হলে মনে হয় কী যেন একটা কাজ বাকি আছে। গোটা একটা দিনের কোথায় ফাঁক থেকে গেছে। গাছপালার সঙ্গে একটু সময় কাটাতে বাগানে বা পার্কে বেড়ানোর মতো পড়াশোনার সঙ্গে কিছুক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে নিজের মতো সময় কাটানো। ভালো লাগে, বেশ ভালো লাগে, নানা বিষয়ের মধ্যে কাগজে সাঁতার কাটা। দিনের বেশিরভাগ সময় যে-ধরনের লোকদের সঙ্গে ওঠাবসা আর তাদের কথায় কথায় মুখ দিয়ে একশ ডিগ্রিতে খিস্তির লু বয়ে যায়। এটাই রোজনামচা। অথচ নিজের মুখ দিয়ে কখনো বের হয় না খারাপ ভাষা। আলজিবে আটকায়। পড়ার অভ্যাসে কাগজের বুড়ি ছুঁয়ে যায় অন্তত একবার। হয় এখানে, নয় অন্য কোনো দোকানে। অথচ এটুকু সময় পেরিয়ে গেলেও একটা ভদ্র-সভ্য শব্দ কী করে আটকে গেল ওই ভদ্রলোকটিকে বোঝানোর মুহূর্তে! নিজের ওপর রাগ উগরে দিতে আচমকা ভাবনায় ডিম পড়ল আটপৌরে শব্দটি। আর তখুনি অনেকটা সহজ হয়ে ও ঘাড় ফেরাল, হ্যাঁ যা বলছিলাম, কাগজে আছে কি মারাত্মক কোনো ঘটনা? যার জন্য অনেক মানুষের সর্বনাশ হয়েছে? তেমন কোনো সাংঘাতিক বা নির্মম ঘটনা?
একসঙ্গে অনেকগুলো বোঝাতে পারার মতো শব্দ উগরে দিয়ে বেশ তৃপ্তি পেল অজয়। বেঞ্চের ওধারে বসা লোকটি নিরুত্তর। ভেতরের পাতা ওলটাতে ব্যস্ত। এতক্ষণে চা দিয়ে গেছে। গস্নাস হাতে নিয়ে চুমুক মারতে ও অবাক। লোকটি কাগজ এগিয়ে দিচ্ছে তার দিকে। ও ছোঁ মেরে টেনে নিল। চায়ের সঙ্গে টায়ের মতো এখন দু-হাতের মুঠোয় অনেক খবরের ভাঁজ। একটুও সময় নষ্ট না করে খবরে নিজেকে মুড়ে আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল। যেভাবে হোক তাকে জানতে হবে, কোন ঘটনার বদলা নিতে তার ওপর অদৃশ্য সন্ত্রাস চালায় দুষ্কৃতি স্বপ্ন।
তিন
সন্ধে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে প্রকৃতির চাবিটা তুলে দেয় রাত্রির হাতে। রাত্রি অন্ধকার ছড়াতে ছড়াতে ডিউটিতে আসে নিঃশব্দে। প্রতিদিন নির্ভুল সময়ে। অন্ধকারে বেশ মাখো মাখো হলেও ডিউটিতে নির্দিষ্ট কোনো ধরাছাড়া সময় নেই অজয়ের। ঘরের বাইরে পা রেখে সাইকেলে চাপলেই ডিউটি শুরু। আবার অন্যভাবে যতক্ষণ জেগে থাকা ততক্ষণ যেন দিন। গোটা জীবনে এক ছিটে ন্যানো সুখের মতো রাত বড্ড ছোট। তার মধ্যে প্রয়োজন হলে সে ঠিক আসবে নিঃশব্দে। অদৃশ্য চাবুকে তোলপাড় করে দেবে ব্যথাহীন শরীর। রেখে যায় এক খামচা অস্বস্তির শাস্তি। কিন্তু কেন! ‘রাত কত হইলো’র মতো উত্তর মেলে না। তার ঘুমের সুযোগ নিয়ে কে আসে। জানে না। ফুটে ওঠে না কোনো প্রতিচ্ছবি। ঘুমের মধ্যে বলা কথা যেমন জড়িয়ে যায়। বোঝা যায় না পরিষ্কার। তেমন অস্পষ্ট সেই অবয়ব। শুধু টের পায় অনুভবে। অথচ কী তীব্র। ঘুম ভাঙলে অদ্ভুতভাবে সমুদ্রের মতো শরীরের চরাচর থেকে রোদ্দুরের ঢেউ ফিরিয়ে নেয় সেই ব্যথা।
হঠাৎ এসব ভাবনা এলো কেন! একফালি দুঃস্বপ্ন কালবৈশাখি ঝড়ের মতো ধুলোয় কিচকিচিয়ে দিলো তাকে এই উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়। সে ভাবতেই চায় না। তবু চলে আসে কাশির বেগের মতো আচমকা। কাজের সময় এখন। ডিউটি ইজ ডিউটি। সাইকেলটা রেডি করে এগোতে যেতেই পেছন থেকে জামায় টান। কে রে? সাইকেলে ওঠার সময় উঁচুতে ডান পা তোলা অবস্থায় কষিয়ে চোয়ালে লাঠি ঝেড়ে দিত অন্য কেউ হলে। কিন্তু অজয় শেখেনি কাউকে মারতে। পারে না খিস্তির পিচকারিতে ভরিয়ে দিতে। আলজিবের ফিল্টারে আটক যায়। বাধ্য হয়ে থামতেই পেছনে শিবু। কিছু বলার আগে প্রশ্নের বড়শিতে গেঁথে নিল তাকে, তোকে দেখিনি কদিন?
– দুদিন আসিনি এদিকে।
আমি আবার কম যাই ওদিকে। দূর থেকে দেখে মনে হলো, তাই চলে এলাম। তোকে নয়, তোর বাহনকে দেখে। দুদিকের চাকায় দুরঙের সাইকেল আমার ডজনখানেক পূর্বপুরুষ দেখেনি। চট করে ঝেপে দিয়ে কেউ পালালে মুশকিল বেশি আসান কম।
হাসবার ভাব করল অজয়। এই সামান্য কথা বলার জন্য কি পেছন থেকে টান দিয়েছে জামায়! নাকি তাকে হাতের কাছে পেয়ে একটু চাটার ইচ্ছে! কে জানে। ভাবনায় সন্দেহ ফাটিয়ে নিতে ও খেয়াল করল সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখেছে শিবু, কী যেন একটা বলব বলব ভাবছিলাম। বলার আগেই তোর বাই-কালার সাইকেল প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে গেল সেই কথা। যা-হোক, এখন কাজকামের কথা বল, বছর শেষের দিকে প্রায়। মালপত্তর বেশি করে তুলে রাখ। সিগারেট, বিড়ি, পান মশলা সব দাম বাড়ল বলে। টান শুরু হয়ে গেছে বাজারে।
তাহলে বাজারের টান বোঝানোর জন্য কি তার জামায় টান দিয়েছিল শিবু! এবার সত্যিই হাসল। তারপর ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল গলায় বলল, আমি ওইসব মাল বেচি না।
– কেন মার্জিন তো খারাপ থাকে না পেটিতে।
– তুই অন্যভাবে ব্যাপারটা নিবি না। আসলে আমি যা খাই না তা বেচি না।
– যাহ্ তেরি, তার সঙ্গে কী সম্পর্ক? নিজের খাওয়া, না খাওয়ার সঙ্গে ব্যবসার কি রিস্তা?
– সবকিছু বলে বোঝানো যায় না। নিজের পছন্দমতো গুছিয়ে নিয়েছি ব্যবসা। আমার এই লাইনে আসার শুরু থেকে এক পলিসি।
– অ, তুই আবার এ-যুগের এক পিস যুধিষ্ঠির। সবকিছু ঘুরিয়ে কথা বলা অভ্যাস। এজন্য লোকে তোকে মুরগি করে। একটা কথা বুদ্ধিতে শান দিয়ে বল, যারা মদ বিক্রি করে তারা কি সবাই মাতাল? নাকি মদ খাওয়া মানেই মাতাল হয়ে যাওয়া?
– অত বুঝি না। ম-া-মিঠাইয়ের কারবার ময়রাই জানে। যুক্তির কথা আমি ঠিকঠাক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে পারি না হয়তো।
– বোঝানোর দরকার নেই। আপনি বুঝলে বাপের নাম। একটা ডায়ালগ তাবিজে লক করে রাখ, আপ রুচি খানা পর রুচি বেচনা।
বেশি কথার জটে না জড়িয়ে সাইকেল এগিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে অজয় খেয়াল করল কেশব মাস্টার হেঁটে যাচ্ছেন রাস্তার ওপার দিয়ে। পেছন ফিরে দেখে নিল একবার। অনেকটা দূরে চলে গেছে শিবু। সেদিকে তাকিয়ে এমনি এমনি মনে হলো এই লাইনে কে বেশি পুরনো! খেয়াল নেই। তবে যেই হোক, একটা কথা মানতেই হবে, ব্যবসার সঙ্গে কথা বলার দারুণ মাথামাখি সম্পর্ক। সেদিক দিয়ে তার থেকে অনেক বেশি এগিয়ে শিবু।
মাস্টারমশাইকে ধরতে এপার থেকে রাস্তার ওপার। তবু একটু সময় লাগল। যেন সেই ক্লাস এইটের মাইলস্টোন থেকে ছুটে আসতে সময় বেশি নিয়ে নিল সামান্য। রাস্তা পেরিয়ে স্যারের মুখোমুখি হতেই ও চেনাতে চাইল নিজেকে, কেমন আছেন?
অরে তুই! স্কুলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক চুকে গেলেও চুকে যায়নি মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। দেখা হলে তাকে প্রণাম করে, নিঃশব্দে প্রমাণ করা, সে-ও ছিল একদিন তার ছাত্র। সবাই কোনো-না-কোনো কারণে কারো কাছে সমর্পণ করে নিজেকে। একটু শেয়ার করা, অনেকটা হালকা হওয়া। এটা ও ভালো জানে, স্বপ্ন না দেখার কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট হয় না। কিন্তু সেদিন সবকিছু বলে অনেকটা হালকা হয়েছিল অন্তত। অন্য কোনো বন্ধুকে বলতে গেলে দারুণ রিস্ক। আজগুবি পেট গরমের স্বপ্ন ধরে নিয়ে সবাই পেয়ে যাবে তাকে খেপানোর বাড়তি একটা ইস্যু। সেদিক দিয়ে মাস্টারমশাই সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
এখন সেই নিশ্চিন্ত গাছের মুখোমুখি অজয়। সামান্য ভালোলাগা খুঁটে নিতে গিয়ে শুনল মাস্টারমশাই তাকে বলছে, তোর এই কাজে রোদে রোদে ঘুরতে হয় প্রচুর? তার চাইতে একটা কারখানায় ঢুকে গেলে অনেক নিশ্চিন্ত।
শুনে ও মনে মনে বলল, আমারও একটা কারখানা আছে স্যার। এ এক বড় অদ্ভুত অন্য ধরনের। কারখানা চলে রাতে। উৎপাদন হয়। কিন্তু বেচা যায় না। রোদ, বৃষ্টি, বাতাসের মতো তৈরি করে শ্রমিক
প্রকৃতি। বিনা পয়সায় চলে প্রক্রিয়া। নদী হাওয়া গাছের সঙ্গে মানুষের যেমন ফোকটাই লেনাদেনা। স্বপ্নের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্কের মতো। আমার বেঁচে থাকাটাই আলাদা। দিনের বেলা খাটুনির ফাঁকে ঢুলুঢুলু ঘুমের গ্যাটিস। রাতে ঘুমের মাঝখানে স্বপ্নের গ্যাটিস।
একটি ব্যাপারে আমার খুব অবাক লাগে। রাগ হয় নিজের ওপর। সবাই স্বপ্ন দেখে অনেক ধরনের। এটাই স্বাভাবিক। আর আমার বেলায় যত অস্বাভাবিক! যখনি দেখব একই স্বপ্ন? এর আগেপিছে কী কারণ আমি বুঝি না। আন্দাজ করতে পারি না। অস্পষ্ট তার অবয়ব। কারণটাও ধরতে পারি না ঠিক। হয়তো প্রতিশোধ।
স্যার গম্ভীর হলেন, ধরতে না পারলেও কারণ একটা অবশ্যই আছে! তবে একই স্বপ্ন শুধু দেখে, এরকম শুনিনি কখনো।
– এই বুঝতে না পাড়ার রহস্য নিজের কাছে এক বিরাট অপরাধ যেন।
চার
বাইকালারের সাইকেলে অজয়। মিইয়ে যাওয়া দুপুরের ফাটল চুঁইয়ে মনে হচ্ছে কোথা থেকে উঠে আসছে এক বান্ডিল আওয়াজের জট। আন্দাজে কী লক্ষ করে জোরে প্যাডেল মারতে দুচাকার আলাদা রং মিলেমিশে একাকার। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে জগতের ছুটন্ত চাকায় পড়লেই সবাই এক। থমকালেই স্বতন্ত্র পরিচয়। থমকে গেলেই দুদিকের চাকায় আলাদা রঙের মতো ফুটে ওঠে নিজস্ব রূপ, চরিত্র। কিন্তু দুপুরে টান ধরেছে পেটে। রান্নাঘরে আছে ভাত। ঝুড়িচাপা এক থালা খিদে। ঘরের বাইরে বসে আছে ভুলো। সেই শরৎ চাটুজ্জের আমল থেকে একইভাবে বাড়ির মালিকের অপেক্ষায়।
আওয়াজের দিকটা পাত্তা না দিলেও খিদের বায়না মেটাতে রোজ ফিরতে হয় এই পথে। এমনিতে মন মন্দা। কারণ বাজার খারাপ। দেখা যাক সন্ধের পরে বাড়তি অর্ডার ধরা যায় যদি। কে যেন বলেছিল যদির কথা নদীতে। তার জীবনে কোনো নদী নেই। আছে স্বপ্ন। আর আছে তাপ্পিমারা ভাবনা। ভাবনায় দুঃস্বপ্নের ফোকাস। সাইকেলে ভাবনাকে ক্যারি করে নিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল করল সামনে দাঁড়িয়ে শিবু। তাকে দেখে হাসছে, খবর কী?
– কী আর বলব খবর। দেশের খবর কাগজে, আমাদের খবর বাজারে। তবে ভেবে দেখলাম তোর কথা ঠিক।
– আমি বেঠিক কিছু বলিনি। বছরের শেষ, মাল সোজা ধরে রাখতে বলেছি। সাপ্টা হিসাব। বলতে বলতে গোঁফে আঙুল বুলিয়ে নিল শিবু, পুরুষকে ধরে রাখতে বউ, মালপত্র ধরে রাখতে চাই টাকা। যাই হোক, আমি এখন ফুটে যাই। ওবেলা তোকে দেব অন্য একটা গাছপাকা পস্ন্যান। হাইফাই লেভেলে যাকে বলে, টিপস।
শিবু চলে গেলে মনটা কেমন তুবড়ে গেল অজয়ের। শিবু বেশ মজবুত ব্যবসাদারের মতো কথা বলে। বউ আর টাকা … উদাহরণ দিয়ে যে-দুটো বিষয় তুলনা দিয়ে গেল তার কোনোটা নেই। মাস্টারমশাই ঠিকই বলেছেন, তোর নামের অর্থ একদিকে যেমন … অনাদিকাল থেকে বর্তমান। জন্মরোহিত। তেমনি অন্যদিকে অজগাঁয়ের সরল মানুষ হিসেবেও বোঝায়। সত্যিই তাই। গলি থেকে রাস্তা, তাকে পেয়ে গেলে কোথা থেকে সব পয়মালগুলো জুটে যায় ভনভনিয়ে। কেবল সুযোগের অপেক্ষা। অথচ মনের দিক থেকে মেনে নেওয়ার কোনো ডিসকাউন্ট দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবু সম্মানের সুতোর রিল আলগা হতে হতে মাঝরাস্তায় সবার সামনে কখন নিজেই ভোকাট্টা।
রাস্তার এপার থেকে ওপারে গিয়ে সাইকেলে চাপতে যেতেই কে যেন ডাকল। ঘাড় ফেরাতে দুলাল। কী হলো?
– তোর কথা ভাবছিলাম। এটাই তোর ফেরার সময় কিনা। তাই দেখা হলে ভালো হয়, হলোও তাই – যা-হোক, তোর কাছে দুশো টাকা হবে?
– হবে।
– রাতে দেখা হলে মিটিয়ে দেব। আমাদের কারবারের একটা ভাইরাল ফিভার। চারটে আধা তো আটটা পুরো ধার। মাঝে মাঝে অবস্থার পেছন এমন হলদে হয়ে যায়। আগে পাজামা পরতাম। ঢিলে হয়ে যাওয়ার মারাত্মক চান্স। টাকা এগিয়ে দিতে দিতে হাসল অজয়, সময় পালটেছে, এখন আমরা ধরেছি প্যান্ট। প্যান্টকে ধরেছে বেল্ট। ধুতি পরলে কবে খুলে যেত কাছা। সবই মার্কেটের আশীর্বাদ। বলতে বলতে দুলাল প্যাডেলে পা রাখলে উলটোদিকের রাস্তা ধরল অজয়। সঙ্গছাড়া হতে আবার একা। একার মধ্যে ফাঁকা হতে হতে ঢুকে পড়ছে সেই আওয়াজ। রোজ কোথায় কত কী যে হচ্ছে। সাইকেল যত জোর চলছে চাকায় রাস্তা গোটাচ্ছে তত। চাকায় গোটাতে গোটাতে রাস্তা ছোট হলে বাড়ছে আওয়াজ। ছোট-বড় অনেক কণ্ঠস্বরের ডানায় ঠাসা চিৎকার। হোক, তাতে কিছু আসে-যায় না। এদিকে বেলা গড়াচ্ছে দুপুরের গা-গতরে। ওই কেওয়াসের কারণ জানার কোনো আগ্রহ নেই। অথচ ওইদিকের পথ ধরলে কাছাকাছি হয় নিজস্ব ঠিকানা। দুটো ঘর, রান্নাঘর, একচিলতে বারান্দা। বাবার তৈরি দেড় কাঠা জমিতে এসব আগলে ফুলটাইম ফ্রি সার্ভিস হোল্ডার মা।
এই অবস্থায় ঝুড়িঢাকা বাড়া খিদের বুড়ি ছুঁতে কে ঘুরপথে যেতে চায়। তাছাড়া সে কোনো অন্যায় করেনি বা পাওনাদারের ভয়ে অলিগলি দিয়ে কেটে পড়বে। উলটে তার কাছ থেকে খানিক আগে কড়কড়ে দুটো একশ টাকার নোট ধার নিয়ে গেল দুলাল। জোরে সাইকেল চালিয়ে রাস্তার মোড় ঘুরতে এতক্ষণ যে চিৎকারের ফুলকি ছিল অদৃশ্য, সেই গ্যাঞ্জাম আছড়ে পড়ল ওর দুচোখে।
পাঁচ
রাস্তা জুড়ে এত লোক যে সাইকেল থেকে নামতে বাধ্য হয় অজয়। ভ্রম্ন কুঁচকে ব্যাপারটা মেপে নিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করল। উত্তর পেল না। এত লোক! মারমুখী পাবলিকের রোষ, কে কার কথা শোনে। অবাধ্য চিৎকার কয়েকজনকে পাশ কাটিয়ে একটু ডজ করে গলিয়ে দিলো নিজেকে। অনেক মাথার ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি কাটাতে চমকে উঠল। একটা ল্যাম্পপোস্টে দুজনকে বেঁধে মারছে অনেকে। এলোপাতাড়ি মারের তোড়ে বিক্ষত দুটো মাঝবয়সী পুরুষ। এরা কি দুষ্কৃতি? রোজ এই শব্দের ব্যবহার এত বেশি হচ্ছে যে, ওই নামের এক বিশেষ আন্ডারওয়ার্ল্ড জাতি যেন বর্তমান। এখন তাদেরই দু-পিস ধরা পড়ে গেছে আচমকা। ওদের শরীরে মার পড়েনি এমন জায়গা খুঁজে বের করা মুশকিল। এটাই তো নিয়ম। ভুলভাল জায়গায় এলোপাতাড়ি মারই ক্রিমিনাল প্যাঁদানোর নির্ভুল ব্যাকরণ। কিন্তু ওর অনভ্যস্ত চোখে এই রক্তমাখা গোটা দৃশ্য আচমকা ঝাপটা মারতে গুলিয়ে উঠল শরীর। জমাট ভিড়ের মধ্যিখানে এমন একটা লাইভ টেলিকাস্ট চলছে ভাবতে পারেনি। ক্লোজ সার্কিট দৃশ্য হজম করতে নিজেই কেমন ঝিম মেরে স্থির। খানিকটা সামলে নিয়ে লোককে একদম লো ডেসিবেলে জিজ্ঞেস করতে কোনো উত্তর এলো না। ভ্রম্ন কুঁচকে দেখে নিল শুধু। অবজ্ঞার চাউনিতে তাকে এমনভাবে মেপে নিল যেন – মারের ট্রিটমেন্ট চলছে কখন থেকে আর রোগী দেখতে এসেছে এই অবেলায়!
সারা মহল্লা জানে। অথচ সে কিছু জানে না, কী করে বোঝাবে! যদিও এই মারের পেছনে তার জানা-না-জানায় কিছু যায়-আসে না। কিন্তু এই ব্যাপক মার খাবার পেছনে মারাত্মক কোনো কারণ আছে, এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর সেটাই জানতে আচমকা ঢুকেপড়া এই গণপিটুনির মুক্তমঞ্চে। এবং অবশ্যই ও অবাক! জনগণের হাত উজাড় করা মারের প্রণামী দেখে বেশ বুঝতে পারছে একটাও মার বাইরে পড়েনি। পাবলিকের মার দুনিয়ার বার।
চারপাশে তাকিয়ে একটা বছরপাঁচেকের বাচ্চার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সবাই যেমন ছোট্ট হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ভঙ্গিতে অজয় ইশারায় ওই দুজনকে দেখাল। বাচ্চাটি কী বুঝল কে জানে। একদম পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে এক মুঠো ধুলো কুড়িয়ে ছুড়ে দিলো ওই লোক দুটোর দিকে। পৌঁছল না। অতটা না যাওয়াই স্বাভাবিক। এমন একটা কুচ্ছিত উত্তেজনার মধ্যে তুলতুলে দৃশ্য দশ সেকেন্ডের বোল তুলে দিলো দৃষ্টিতে। কিছুই বোঝে না সে অপরাধের মানে। সকাল থেকে দেখতে দেখতে ওর ভেতরে তৈরি হয়েছে পুঁচকে পুঁচকে আক্রোশ। মুঠোয় ভরা এক হাত কচি ধুলো ছুড়ে দিয়ে যতটা পৌঁছয়, ততটা ওর প্রতিবাদের দূরত্ব। সীমাহীন কচি পরিতৃপ্তি।
কিন্তু এত পাবলিক ধোলাইয়ের কারণ তো জানা হচ্ছে না! জায়গা ছেড়ে আরেকটু এগিয়ে এক কিশোরের পাশে দাঁড়াল। তার হাতে একটা ঢিল। সবাই কিছু না কিছু খুচরো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি! সত্যি বেশ অবাক লাগছে! এত চেনা জায়গা, পরিচিত রাস্তা। জানা লেন, বাই লেন। তারই যাতায়াতের মাপে এমন একটা ঘটনার অ্যাকশন চলছে, তার কিছুই সে টের পায়নি। এধার দিয়ে সকালে আসা হয়নি। কাছাকাছি বাজারে নতুন কয়েকটা দোকান ধরতে পাকা কথা বলার দরকার ছিল। দাম ঠিক করতে সময়ের দামটা খরচ হয়ে গেল বেশি। এদিকে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে দুপুরকে ছোট করতে এই শর্টকাট রাস্তা। ভাগ্যিস! না হলে এমন একটা ঘটনার সাক্ষী থাকাই হতো না। খবর পেত অবশ্যই। তবে জানাটা অনেক পিছিয়ে যেত। অন্তত খবরের কাগজ তো আছে। কোনো সেলুন
অথবা চায়ের দোকানে বসে ছানবিন করবে। এত খোঁজার কারণ একটা রাত। রাতের অপেক্ষায় ঘুম। ঘুমের টার্গেট স্বপ্ন। এক মুহূর্তের জন্য ভাবনায় ঝাপ্টা মারতে কেঁপে উঠল অজয়। উদ্বাস্ত্ত ভাবনাকে
মাথা থেকে হঠাতে ও কিশোরের কাঁধে রাখলো হাত। একটু ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, কেসটা কী?
তার দিকে না তাকিয়ে ওর রুক্ষ জবাব, পাড়ার একটা মেয়েকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এর আগে পাশের পাড়া থেকে দুজন হাওয়া। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেলেও পাত্তা নেই তাদের।
তারপর? অজয়ের গলায় বিস্ময়।
ভালো কাজ পাইয়ে দেওয়ার টোপ ওপাড়ার দুটো মেয়ে খেয়েছিল। কিন্তু এই মেয়েটি গিলতে পারেনি। জানিয়ে দিতে হইহল্লা। দলে চার-পাঁচজন ছিল। তার বেশিও হতে পারে। এই দুজন ধরা পড়েছে, বাকিগুলো পালিয়েছে।
সায় দিলো অজয়, তা ঠিক। জাল ফেললে কী সব মাছ ধরা পড়ে! এই দুজন হবে আমাদের ক্রিমিনাল অ্যাসেটস।
কিশোরের চোখে সন্দেহ। চোখে-মুখে আবহাওয়া পূর্বাভাসের বিরক্তি। সে ওদের দিকে আঙুল তুলল, এত মার খাচ্ছে তবু কোথায় বাড়ি জানা যাচ্ছে না। এক একবার বলছে এক একটা জায়গার নাম। এদের জীবনের প্রত্যেকটা ভাঁজ টপ-সিক্রেট।
সেই জন্য বলছি, হাতে গরম পাতে পাওয়া এই দুজন আমাদের সম্পদ। এদের থেকে জানতে হবে গোপন খবর। এমনভাবে অজয় কথার চাল দিচ্ছে যেন অভিজ্ঞতায় ঠাসা তার পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির শরীর। অথচ তার অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠার প্রকাশ্য রহস্য দৈনিক কাগজে মোড়া। কখনো টেলিভশনে দেখা অপরাধীর মুড়ো। কখনো পুলিশ ভ্যানে ওঠা অথবা আদালত চত্বরে নিয়ে আসা ক্যামেরার ফ্লাশে ঝলসে ওঠা মুখের ভগ্নাংশ। এমন লোকের সামনাসামনি হওয়া তার এই প্রথম। নাগালের মধ্যে এমন সুযোগ ক্যাচ ধরে বল ফেলে দেওয়া কি যায়! নাকি চলে যাওয়া যায় পাশ কাটিয়ে! দু-চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।
ওর ভাবনায় ছেলেটি দেশলাই জ্বালিয়ে দিলো আবার, ছাড়া নেই। শুধু এদের জন্য সকাল থেকে কারো খাওয়া হয়নি ঠিকমতো।
হবে কী করে! ভেতরে টেনশন, বাইরে ফিকশন।
অথচ ওদের কোনো খিদের ব্যাপার নেই।
থাকবে না তো, বেশ উত্তেজিত হয়ে সায় দিলো অজয়, এখন সবকিছু উলটো হয়ে পালটে গেছে। বহু প্রচলিত জনশ্রম্নতি এখন উলটো পুরাণ, পিঠে খেলে পেটে যায়।
ছয়
অজয় বেশ বুঝতে পারছে পরিস্থিতির আরকে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ। নরমগরম কথায় দুপুর গড়িয়ে গেলেও এই পরিবেশে সে হয়ে উঠেছে উত্তেজিত। এদের মধ্যে ভিড়ে গিয়ে এখন আর মনে হচ্ছে না নিজেকে বাইরের লোক। কারণ তারও আছে গোপন আক্রোশ। শুধু জানে না কার ওপর। চলতে-ফিরতে, উঠতে-নামতে মাথার মধ্যে হন্ট করে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই অনুভূতি ফিরে আসছে বারবার। আপনমনে বলল, আবার ঘটে গেল একটা ঘটনা। তার মানে ফুল ফর্মে তৈরি একটা রাত। রাত মানে অন্ধকারের খোলস ভেঙে উঠে আসবে স্বপ্ন। এক্সক্লুসিভ ফর অজয়। স্বপ্ন চিরে বেরিয়ে আসবে অদৃশ এক শক্তি। ঘটে যাওয়া অসামাজিক কাজের বদলা নিতে শরীরের এরিনাতে এটাই কি স্বপ্নের ডিউটি!
ভাবনায় মেসেজগুলো ফুটে উঠতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল অজয়। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিল একবার। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির কথাগুলো লাট খাচ্ছে মাথায়। কপালে অনেক রাতের দুঃস্বপ্নের ভাঁজ। উদাসীন ফুরসতে কখনো মনে হয়, দিন আপন, রাত পর। অথচ নির্ভয়া বা কামদুনি কা- ঘটাতে রাত বা দিনের দরকার হয় না। তবু মনে হয়। এই মনে হওয়াটাই জীবনজুড়ে বিরাট চ্যাপ্টার। এসব বলবে কাকে? কে বিশ্বাস করবে? কাকে বোঝাবে এত প্রশ্নবোধক চিহ্নের ভার বইতে হচ্ছে তাকে। জানে, কেশব স্যার একমাত্র জানেন।
ও চারপাশ তাকাল। প্রথমে যে লোকটির কাছ থেকে ঘটনার কারণ জানতে চেয়েছিল, সে কোথায়! উলটে প্রশ্ন করার অপরাধে তাকেই মাপছিল বারবার। যাকগে। কিন্তু সেই বাচ্চা মেয়েটি! তাকে বড় প্রয়োজন। ছোট্ট হাতে কচি কচি ধুলো ছুড়ে সে মিটিয়ে নিচ্ছিল অবুঝ আক্রোশ। ছড়িয়ে দিয়েছে নীরব প্রতিবাদ।
ব্যাপক কেওয়াসের মাঝখানে আপন ভাবনাকে খুব দ্রম্নত প্রাপ্তবয়স্ক করে তুলতে একটুও সময় নিল না। ভেতরের উত্তেজনাকে শানিয়ে নিতে ও কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, ওই হারিয়ে যাওয়া মহিলারা কতদিন বেপাত্তা?
কোনো উত্তর দিলো না কিশোর। সবকিছুর ঠিকঠিক জবাবের অবস্থান না হতেই পারে। কখনো প্রশ্নের আগে তৈরি হয়ে যায় উত্তর। ওই মহিলাদের হাপিস হওয়ার ব্যাপারে ও খোঁজ নিচ্ছে এই মাত্র। অথচ অনেক আগে ওদের টার্গেট করার সময় থেকে রেডি হয়ে গেছে উত্তর।
সেই উত্তরের খোঁজে এন্ট্রি নিতে গেলে যেমন কোনো প্রসঙ্গ ধরে কথার খাল কাটতে হয়। কিছু কমন প্রশ্নের সেটআপ মাথায় স্টোর করা থাকে। তারই দু-একটা স্যাম্পল পরিস্থিতি বুঝে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু এখন অবস্থা যে পিকআপ ফর্মে আছে, সেখানে সবার মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়াটাই বিরাট অ্যাচিভমেন্ট। কিশোরকে পাশ কাটিয়ে ও এগিয়ে গেল। খানিকটা ধাক্কা সামলে এক্কেবারে দুই মূর্তিমানের মুখোমুখি। এ তো বিরাট ব্যাপার। মারের উন্নয়ন প্রকল্প। এই ধরনের উন্নত মানের প্যাঁদানোর কর্মযজ্ঞে শামিল না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে অজয়। আগে কোথাও দেখেছে! মনে হচ্ছে না। এরা অচেনা হয় সাধারণত। যেমন কোনো অচেনা ব্যক্তি হঠাৎ করে উপকার করলে মনে হয় বেশ চেনা চেনা। অথচ কিছুতেই মনে পড়ে না কোথায় দেখেছে। অচেনা হলে বেশি সুবিধে। মন ভরিয়ে হাতের সুখ করা যায়। কিন্তু অজয় অভ্যস্ত নয় অনেক কিছুতে।
সত্যি কথা অপ্রিয় হলেও প্রয়োজনে বলে ফেলায় সবাই ব্যঙ্গ করে বলে, যুধিষ্ঠিরের সেলফি। অকারণে লোকের খোরাক হয় শুধু। তাতে কিছু এসে-যায় না অবশ্য। কিন্তু অন্যদিকে চাপা আনমনা দুঃখ। নিজের অপছন্দের কোনো ব্যাপারে ভাবনায় প্রতিবাদ
থাকলেও হয়ে উঠতে পারে না প্রতিবাদী। কাগজের পাতায় ছাপা ছবিতে ব্যানার নিয়ে হেঁটে যাওয়া মিছিলে খুঁজে পায় না নিজেকে। খুঁজে না পাওয়া মানে তো সারাজীবনের মতো হারিয়ে যাওয়া নয়। কোথাও-না-কোথাও প্রতিবাদের বীজ লুকোনো থাকে ইচ্ছের গর্ভগৃহে।
কপালের দুধারে রগ দুটোর টেম্পারেচার চড়ছে ক্রমশ। উত্তপ্ত হলকার কাছে নতজানু হওয়ার কোনো মানে নেই। আচমকা দৌড়ে গেল কাছে। ওদিকে পেছন থেকে তাকে উৎসাহিত করার চিৎকার। নানা মাপের আওয়াজের ফোকর দিয়ে ভেসে আসছে পাবলিকের ফুল বয়েল্ড গালাগাল। দুকান গরম। ও স্পর্ধিত হয়ে উঠল। যার সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ঘটনায় তারই ওপর কেন চলবে পাপের উটকো প্রতিশোধ? কেউ বুঝবে না, বিশ্বাস করানো যাবে না। কী এক অদ্ভুত দায়।
প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় মানুষ যেমন ধ্বংস হয়, তেমনি মানুষের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকৃতি। মানুষের অপরাধের দায় কি পড়ে অন্যজনের গায়ে! জানে না, জানার কোনো সুযোগ নেই হরিসাধন হাই স্কুলের এইট পর্যন্ত পড়া অজয়ের। তার ওপর রাগ মেটানোর এ কেমন তরিকা প্রকৃতির! সে তো মানুষের প্রতিনিধি নয়। বহুদূর স্বপ্নের ওপার থেকে মাথায় ভেসে আসছে অশ্বখুরের নালের আওয়াজ। সেই শব্দে কেমন এক ঘোরের মোশানে কোমর থেকে বেল্ট খুলে চেপে ধরল মুঠোয়। জেগে থাকা অবস্থায় স্বপ্ন মিথ্যে হলেও ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের চেয়ে বড় সত্য তো হয় না।
আপন স্বভাব প্রতিকূল হলেও মন খারাপের কোনো জায়গা নেই। শেষ ধৈর্যের একটা বর্ডার লাইন থাকে। আর এটাও দীর্ঘদিনের সহ্যের বহিঃপ্রকাশ। সাপের বিষের মতো বেল্টের ফণায় জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দিতে চেষ্টা করল অমানব জমিনে।