স্বপ্ন আর অনটন এ-দুইয়ের দ্বৈরথে স্বপ্নটা বারবার হোঁচট খেলেও ধনেখালীর বাজারে সাহস করে ছোটখাটো একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান শেষমেশ দিয়েই বসে তমিজ আলী। এ-জলার দেশে ফসলি ভুঁইয়ের বড়ই অভাব; ক্ষেত-গেরস্তির কাজ তাই সবার কাছেই এক অলীক স্বপ্ন। তবে বাজারের মাঝবরাবর শুয়ে থাকা মেটে রাস্তার দু-ধারে জংলা ছাপার শাড়ির একহারা পাড়ের মতো মাথা উঁচু করে সার সার দাঁড়িয়ে আছে নানান কৃত্য-পেশার মনিহারি দোকান। সেখান থেকে ঠুকঠাক, টুংটাং, ঘর্ঘর এমন নানান বিচিত্র আওয়াজ তুলে তমিজের মতো ইছাপুরের মানুষগুলো প্রতিদিন তাদের জীবন টেনে নিত কঠোর কসরতে। দিনশেষে নিঃশেষ হওয়া শক্তিটুকু নিয়ে বাড়ি ফেরার আগে তমিজ আলী, অঞ্জন স্যাকরা কিংবা রঞ্জন মাস্টারের মতো মানুষগুলোর দেখা মিলত ভানুলাল ময়রার দোকানে।
সেজে-ওঠা খুপরি দোকানঘরগুলোতে জোনাকির মতো টিমটিমে বাতি জ্বলে তাদের কোনোরকম টিকে থাকাকে যখন পরিহাস করে যেত, তখনই কাজহীন মাটির শরীরগুলো জলের তা-ব দেখে জলার দেশের গালগল্প নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ত আর অসহায়ের মতো চারদিকে চেয়ে চেয়ে জলের নাচন দেখত। তমিজ জানে, সংসারে অভাব বাড়ন্ত হলে তাদের অধ্যবসায় বাড়ে; আবার ওদিকে মানানসই সংগতির সঙ্গে দিনামেত্ম সৌখিন আলস্যও মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ায় কখনো কখনো। এসব ভেবেই তমিজের নিজেরও কাজেকামে ঠিক মন বসে না আজকাল। সবাই যেখানে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে সাঁই-সাঁই ঘুরে বেড়ায়, সেখানে সরলসিধে সাইকেলমিস্ত্রি তমিজের কী-ই বা দাম আছে? কিংবা, টিনের ছাপরাতোলা তার ওই লজ্ঝড়ে সারাইয়ের দোকানটির! অনিশ্চয়তার ঘোলাজলে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে তবু তার অস্থিরতায় দিন কাটে।
সাইকেলমিস্ত্রি তমিজের নেশা ছিল অন্যখানে, অন্য জগতে। সেই জগতের স্মৃতিগন্ধ বুকে নিয়ে তার যেন সুখের কমতি ছিল না। জলের মিস্ত্রি তমিজ আলী তাই অতীত সেই জলজীবনের ছবি এঁকে এঁকে আকাশের দিকে মুখ করে উদাসীন হয়। ওই যে, আকাশের ওধারে বসে যে মগ্ন কারিগর ইছাপুরের মানুষগুলোর বাঁচামরা দেখে যাচ্ছেন তমিজ তবু তার দিকেই মুখ উঁচিয়ে বিরাট আশায় তাকিয়ে থাকে দিনরাত। আর সেখান থেকেই আষাঢ়-শাওন (শ্রাবণ) কিংবা কার্তিকের দিনে দ্রিমিদ্রিমি করে মহাপ্রলয়ের মতো মস্ত হুংকার ওঠে। ইছাপুরের নরম ডাঙা ডুবিয়ে-ভাসিয়ে খড়কুটোর মতো তিনি ভাসিয়ে রাখেন মানুষগুলোকে; আর শেষে তার মতো করে সাজিয়ে তোলেন দিগন্তব্যাপী এক নিপুণ জলজীবন; দিনরাত … রাতদিন … ছলাৎ ছলাৎ … ছলছল … ছপছপ …। ইছাপুরের ভাসমান মানুষগুলোর সঙ্গে তমিজও তখন আসেত্ম আসেত্ম ভেসে ভেসে তার সুদীর্ঘ সংসারজগৎ সাজিয়ে তোলে।
বেহুলা। ধনেখালীর একচিলতে বাজারের কাছে পেঁচানো নদীটা ভীষণ জলসোহাগী। উত্তর থেকে নেচে-ধেয়ে হঠাৎ দক্ষিণে এসে প্রথম সাক্ষাৎ পেয়েছে তমিজের দোকানটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উঁচু বাঁধ রাস্তার সমান্তরালে উঁকি দেওয়া ঘরবাড়ির ভেতরে ফিতার মতো কোনোরকম টিকে ছিল বাজারটা। অথচ তমিজ ভেবেই পায় না, কেন এমন হলো? সারাইয়ের দোকানটা থেকে যে যৎসামান্য রোজগার হয় তা দিয়েই কোনোমতে চলে যায় তমিজ আর তার বউ রাবেয়ার সংসার। কিন্তু বেহুলার হঠাৎ ফুঁসে ওঠা দেখে তার আশংকা হয়, শেষ পর্যন্ত দোকানটা টিকে থাকবে তো?
কাজশেষে ঘরে ফেরার আগে এসব নিয়ে সেদিন দুপুরেও কথা হচ্ছিল ভানুলালের নিমকির দোকানে। মাথার ওপর চোখ টাটিয়ে বসে আছে আস্ত সূর্যটা। দোকানের হাতবিশেক পেছনেই কদিন ধরে গোত্তা খাচ্ছে ঘোলাটে জলের ঢেউ; একটা বিরাট মাটির চাঙর ঝুপ করে সেদিন নদীতে খসে পড়লে শঙ্কিত তমিজ জিনিসপত্র গুছিয়ে দোকানের ঝাঁপি টানে।
রাস্তার ওধারের ভানুলালের দোকানের সামনে দুপুরের ভিড় কিছুটা থিতিয়ে এসেছিল। ভানু তখন দোকানের ক্যাশে বসা। ঠিক তখনই চিমিত্মত মুখে তার সামনে চৌপায়া টুল টেনে নিয়ে তমিজ বলে – বুঝলি ভানু, দুকানটা মনে হয় আর টিকপি না। বেহুলার জল ইবার অ্যামুন করি ফুঁসছি ক্যানে বল দিকিনি? ইবার তো ত্যামুন বাদল হয়নিকো। তবু ক্যানে …
আরে তমিজালি ভাই, ব্যাপারখানা বুঝলে না মোটে? বাদল লাগে নাকি বেহুলার গতর ফুঁসতি? ও অ্যামনি অ্যামনি ফুলে ওঠে। তাছাড়া শুনিচি বেবাক নদীরই একটা কানেকশন থাকে। তাই হয়িচে। উজানে একবার বিষ্টি হলি সেই ঢল এই ইখানে মানে ধনেখালীর বাজারের কাছেও তো চইলি আসপি। সরকার কি আর খামাখা বাঁধ দিয়িচে ইখানে?
তা, তুর কথাখান একিবারে ফেইলবার নয়রে ভানু। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা। দুই বছর আগেও তো একবার অ্যামুন হলো। বিষ্টি-বাদলা কিসসু ন্যাই। তাও চাইরদিক অথই জলের নীল সমুদ্দুর।
তুমার চাইর বছরের ছেইলিডা কী যেন নাম … আহা, ওই বছরই তো … কথা শেষ হয় না ভানুলালের। তার আগেই কেমন আনমনা হয়ে যায় তমিজ। খানিক আগের দোকানের পেছনে ঝুপঝাপ করে মাটি ধসার আওয়াজ এবার তার বুকে হতে থাকে। এ অনন্ত জলাভূমের ঢেউভাঙা শব্দ তমিজের বুকে বুঝি তখন সশব্দে আছড়ে পড়ে। কী ভাবছে সে কে জানে? দুই বছর আগের বেহুলার সে রুদ্রমূর্তি, নাকি ছেলের নিষ্পাপ মুখখানা, তা ঠিক বোঝা গেল না। বুকের ভেতরটা সহসা মোচড় দিয়ে উঠলে হঠাৎই একটা ঝিমঝিম অবশলাগা শূন্যভাব তার শরীরজুড়ে নেমে আসে। একমুহূর্ত দেরি না করে এবার উঠে দাঁড়ায় সে।
দুই.
একসময় তমিজ আলীর পিতা-পিতৃব্যর আদি ঠাঁই ছিল ইছাপুর গ্রাম ছাড়িয়ে আরো উত্তরে – উজান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে একেবারে মনোহরগঞ্জের কাছে। সেখান থেকে পাক খেয়ে খেয়ে নদীটা যখন দক্ষিণে ভাটির দিকে আরো মাইল দুয়েক উজিয়ে যায়, ঢেউয়ের টানে একদিন সব চলে যায় বেহুলার পেটে। তখনই নদীটার সঙ্গে সঙ্গে ধনেখালী বাজার হয়ে নদীঘেঁষা এই ইছাপুরে এসেছিল তারা।
বাঁধরাস্তার উঁচু বুক ধরে নদীর উলটোদিকে পলি জমে জমে যেখানে ডহরা জমির জন্ম, সেখানেই আজ তমিজ ভিটি বেঁধেছে। সে অবশ্য একা নয়, সর্বস্বহারানো নদী-ভাঙতি আরো কিছু মানুষের যৌথ জীবনযাপনও এখানে। আর নদীতীরবর্তী বসতে ভাসমান মানুষগুলোর যে-অনিশ্চয়তার জীবন হয়, তমিজেরও ঠিক তেমনি। তবু আশাটুকু বাঁচিয়ে রেখে নদীজীবনের সঙ্গে সহযাত্রী হয়েছে নিজেকে প্রতিদিন অপেক্ষমাণ রেখে। মাছধরা, নাও বাওয়া সবই সে করেছিল জীবিকার তাগিদে; আর শেষে একটা ছোটমতো দোকান দিয়ে থিতু হয়েছিল একদিন।
ইছাপুরের তমিজ এখন অন্য মানুষ। চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে অদ্ভুত ক্ষমতার কারণে। তার নিজ গ্রাম ইছাপুরের মানুষ তো বটেই, অন্যরাও এ নিয়ে একটু আলাদা গর্বই করে বইকি। ব্যাপারটা আসলে গর্ব করারই মতো! একসময় তমিজ যখন মাছ ধরত, হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সে একলা নেমে যেত জলের বুকে; ছিপ না, জাল না, নৌকা না, একদম খালি হাতে ডুব দিয়ে আস্ত মাছ ধরে আনত ডাঙায়। তার এমন কা– চারদিকে রীতিমতো হুলেস্নাড়,
হই-হট্টগোল। সাত পুরুষের সমান দম বুকে নিয়ে এ অদ্ভুত কাজটি করে দেখাত ইছাপুরের এই তমিজ আলী। এ যে জলের নিচে তার কঠিন সাধনার সংসার।
জলের গায়ে বেজে ওঠা সারেঙ্গির সুরের সঙ্গে তমিজ নিজের জীবন বেঁধে নিয়েছিল সংগতের মতো। সে কোনো ডুবারু নয়। তবে ডুবোজলের মানুষের মতো জলেই ছিল তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ, যা তাকে এখন স্মৃতিকাতর করে দেয়। সাইকেল সারাই করে কয় টাকাই আর জোটে? ডুব দিয়ে দিয়ে মাছ ধরার বিশেষ এ-গুণটি তাই নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একসময়। এই তো দুই আশ্বিন আগেও একবার অঞ্জন স্যাকরার দোকানের পেছনে খেয়াঘাটের কাছে ডুব মেরে ধরে এনেছিল মস্ত এক আইড় মাছ। এমনই বড় যে, মাছ দেখে সকলের চোখ কপালেই আটকে রইল।
বিলের বুকে মাছরাঙার ছোঁ মেরে মাছ শিকারের মতোই বড় আশ্চর্য সে-কা-। মাঝে মাঝে এমন হতো, ডুব দিয়ে আছে অনেকক্ষণ। চারদিকে হইচই। ঘটনা কী? তমিজ উঠবে তো? আর যে দেখা নেই তার। সবার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। আর অমনি ভুস করে শুশুকের মতো মাথা তোলে সে। ডাঙায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর এতক্ষণ আটকে রাখা নিশ্বাস এবার বাতাসের গায়ে আছড়ে পড়ে।
মানুষগুলোর জটলা থেকে কত মন্তব্যই না শোনা যেত তখন। রঞ্জন মাস্টারের উদ্বেগভরা কণ্ঠ ভেসে আসত সবার আগে – আরে আরে গেল কই ছেইলিডা? তাই বলে এতক্ষণ? শ্যাষে না আবার দম আটকি ভেইসি ওঠে!
কেউ আবার তখন তাকে শুনিয়ে বলে, পাঁচজনের সুমান দম একসঙ্গে বুকে নিয়ি নেমিছে তমিজ; অত সহজ ব্যাপার নয়, সে দম এত সহজে ফুরোয় নাকি?
তারপর আরো কত যে আলাপ উঠত ঘাটের কাছে বেহুলার তীরে। আরে আরে মুখখান তো দেখাই যায় না … গেল কই সে?
উই তো … উই তো উদিকে। জলে বুড়বুড়ি উঠিছে গো … উঠল বুঝি ইবার!
ঠিক তখনই মুখে বাঁ হাতে ধরা মস্ত কোনো মাছ নিয়ে দেখা মিলত ইছাপুরের তমিজ আলীর। সেবার তিন কেজি ওজনের বিশাল আইড় মাছটা হেডমাস্টারের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, ইডা ইশ্কুলে নিয়ি যান ছার। সববাই মিলি খাবে।
তুই এত কষ্ট করলি তমিজ। মাছখান তুই-ই বাড়ি নিয়ি যা।
না ছার, আমার লাগবি না। আমি ফের ডুব মেইরি ধরবু আরেকটা।
রঞ্জন মাস্টার তিন কেজি ওজনের ছটফটানো আইড় মাছ হাতে নিয়ে মায়ার দৃষ্টিতে তমিজের মুখের দিকে ঈষৎ তাকিয়ে থাকেন। জটলার সকলে হাততালি দিয়ে ওঠে, যেন বেহুলার তীরে সার্কাস চলছে। তমিজের এতেই আনন্দ; খানিকটা গর্বও অনুভব হয় বুকে।
মাত্র এক ঘণ্টারও কম সময়ে তুলে আনা তিন কেজির সে আইড় মাছ বাদেও বাকি দুখানা বোয়াল তুলে দিয়েছিল ভানুলালের হাতে। ডুব দিয়ে মাছ ধরার আনন্দ আর সেই মাছ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে খালি হাতে পরম সুখ নিয়েই ঘরে ফিরেছিল তমিজ।
তিন.
কাজহীন অলস বসে জলের ঘূর্ণির সঙ্গে সঙ্গে পুরনো চিন্তাও পাক দিয়ে ওঠে তমিজের মনে। দুপুরের খানিক পরেই সেদিন সে ফিরছিল বাজার থেকে। ফেরার আগে ভানুলালের দোকানের সামনে অঞ্জন স্যাকরার সঙ্গে দেখা; রঞ্জন মাস্টারের ছোট ভাই অঞ্জন কর্মকার। মাস্টার খবর পাঠিয়েছে একবার যেন দেখা করে তমিজ।
কুনদিকে যাচ্ছ তমিজালি ভাই?
কুথায় আবার? বাড়ির পানেই ছুটছি?
তা, দাদা তুমারে একবার যেতি বলিছে। কী নাকি জরুরি কথা আছে তুমার সঙ্গে। একবার যেও দিকিনি ইশ্কুল ছুটির পরে।
ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে তমিজ ছুটে যায় ইছাপুর হাই ইশ্কুলের হেড স্যার রঞ্জন কর্মকারের কাছে। মাস্টারের সঙ্গে দেখা হতেই প্রশস্ত হাসিতে এগিয়ে আসেন তিনি।
তমিজ তুই তো ইছাপুরের গর্ব রে। একবার যেতি হবে মনোহরগঞ্জ। আমি কথা দিয়িছি। ওখানে বেহুলার যে চওড়া পেটখানায় সবাই যেতি ভয় পায়, মানে ওই বানশির খালে চিয়ারম্যানসাব বাজি ধরিছে।
কীসের বাজি ছার?
পাঁচ গাঁয়ের সকলে তুকে এক নামে চিনে। চারদিকে তুর বেজায় নামডাক। উখানে ডুব দিয়ি একবার মাছ ধরবি।
আমি পারবু না ছার। পরথম ছেইলিডা মরার পর আল্লাহ মুখ তুইলি আরেকবার চেয়িছে। আমার খোকন ম্যালা ছোড।
আরে উখানে তুরে সোনার মেডেল দিবি। আর নগদ ট্যাকা। রাজ্যের কত্ত লোক আইসবে তা দ্যাকতি। কত্তবড় আনন্দের আর গর্বের ব্যাপারখান তুই ইকবার চিন্তা কইরি দ্যাখ দিকিনি। তুই না করিস না তমিজ।
আমি ইকবার ভেইবি দ্যাখবু ছার।
তারপর বাড়ি ফিরে রাবেয়ার সঙ্গে শলাপরামর্শ করে একদিন বাদেই বেরিয়ে পড়ে মনোহরগঞ্জের দিকে। প্রথমে আপত্তি জানালেও তমিজের নামডাক আর গাঁয়ের ইজ্জতের কথা ভেবে শেষে আর নিষেধ করেনি। ওদিকে মনোহরগঞ্জের কথা শুনে প্রথমে কেন জানি মনটা একদম টানছিল না তার। শত হলেও বাপের আদি ভিটা। জলের নেশায় পড়ে থাকলেও মানুষটা সেদিন বারবার পিছু ফিরে চেয়ে ছিল। সেদিনের জন্য নিজেকেই দোষে তমিজ। যদিও মনোহরগঞ্জ থেকে বাজি ধরে তমিজ ফিরে এসেছিল সোনার মেডেল নয়, একটা পিতলের মেডেল গলায় করে আর সঙ্গে নগদ পাঁচ হাজার টাকা।
বাড়ি ফিরেই দেখে আছাড়ি-পিছাড়ি অবস্থা। রাবেয়া উদ্ভ্রামেত্মর মতো হাঁক দিয়ে বেড়াচ্ছে ছেলেটার – ঘর, উঠানময়, বাঁধরাস্তার কাছে সবখানে। চার বছরের ছেলেটা নেই তো নেই – কোত্থাও নেই। তমিজ কেবলই ফিরেছে দূরের বানশির জলা থেকে। শরীরখানা বড্ড দুর্বল হয়ে নেতিয়ে পড়েছে লাউয়ের ডগার মতো। অবুঝ ছেলেটা বাপের অপেক্ষা করে করে নাকি বেহুলার দিকেই ছুটে গিয়েছিল – তারপরই আর খোঁজ নেই।
হুঁশ-দিশ হারিয়ে তমিজ একেবারে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত সাধ্যমতো জলের নিচে হাতড়ে বেড়ায় তার হারিয়ে যাওয়া মানিকের। অনেক খুঁজেও আর হদিস মেলেনি তার।
কতদিন আগের কথা সেগুলো। তবু একবার ভাবলে পিতলের মেডেলখানা তমিজের বুকে অটল পাথরের মতোই চেপে বসে। সেই থেকে সে আর জলে নামে না বা ডুব দেয় না। কিছুতেই না। সাইকেলমিস্ত্রির সামান্য রোজগারেই সন্তুষ্ট হতে চেয়েছিল সে। আর তাই ভানুর দোকানের সামনের ফাঁকা জায়গাটুকুতে টিনের চালা তুলে সাইকেল সারাইয়ের সামান্য দোকান দিয়ে বসেছিল ঠেলাঠেলি করে। এদিকে বছরখানেক সময় পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতে। আজ বেঁচে থাকলে ছেলেটা হয়তো গায়ে-হাত-পায়ে আরেকটু বড় হতো।
তমিজ একা বসে ভাবে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এদিকে নদীটারও ঠিক কী হয়েছে এবার, ভেবে পায় না সে। একবার সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। আবারো কি তবে …? হৃতসর্বস্ব মানুষ হলেও বরাবরই ওর চোখে আশার দমক খেলা করত। ঘরে ঝুলানো বাজি ধরা খেলার সেই পিতলের মেডেলের দিকে তাকিয়ে ছলছল করে ওঠে তার চোখ। অযত্নে ঝুলানো সে মেডেলের গায়ে তার সব হারানোর কথা লেখা থাকে।
চার.
ইছাপুরে এ-বছর তেমন বৃষ্টি হয়নি। মাঝে মাঝে দিগমেত্মর ওধারে দূরে কোথাও যখন ঘন কালো হয়ে অন্ধকার নামে, পাটভাঙা শাড়ির মতো আকাশেরও মন ভাঙে। আর তখন ঝরঝর করে বৃষ্টি নামে সেখানে। কই বৃষ্টি তো এ-ধারে নামে না? তবে জল কি আর আটকে থাকে? ঠিকই জোয়ার-ভাটার স্রোত হয়ে বেহুলার কোল ধরে ফুঁসে ওঠে।
তমিজ আনমনে বসে ভাবে – এবারো ঠিক চারদিকে শুরু হয়ে গেছে বেহুলার আগেকার সেই জলরাজত্ব। বুকসমান জলে ঘর পাহারায় থেকে তমিজ এসব দেখে আর মনে মনে বাজারের ওপর তার দোকানটার কথা ভাবে। বাঁধের উঁচু সড়কের গলা প্রায় ছুঁয়ে নিয়েছে ফুলে-ফুঁসে ওঠা ঘোলাটে জলের বিস্তার। জলের মাদুলি গলায় পেঁচিয়ে কেবল বাতাসের ওপর নাচছে বেহুলা। কী উন্মত্ত তার হুংকার! ওদিকে সাঁই-সাঁই বাতাসে নুয়ে পড়ছে কঞ্চির মতো ঢোলকলমির হ্যাংলা নরম ডালগুলো। রামশালিকের দল উড়ে এসে বসছে তার ওপর। তমিজের মতোই ধু-ধু জলের প্রান্তরে কীসের আশায় যেন তারা বাসা বাঁধছে ঢোলকলমির ডালে। বৃষ্টিধোয়া আকাশের ওপর থেকে ডোমচিলরা চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে কাজহীন তমিজকে দেখে আর দূর থেকে ক্লান্ত স্বরে ডাকে।
তরতর করে জলের থাবা সকালেই গ্রাস করে নিয়েছে পুরো ধনেখালী বাজার – হাঁ হয়ে থাকা মুলি চাটাইয়ের দোকানঘরগুলো, এবাদতঘর, দোকানঘেঁষা কিছু মাটির বসত, এমনকি তমিজের সাইকেল সারাইয়ের অনাবশ্যক দোকানটি পর্যন্ত। ভানুলালের খাজা-নিমকির দোকান, অঞ্জন স্যাকরার স্বর্ণের দোকান কাউকেই রেহাই দেয়নি এ-ছোবল। সবকিছু জলে ভরভর হয়ে এখন বেহুলার গর্ভে।
ইছাপুরকে একপাশ থেকে পেঁচিয়ে ধরায় অসহায় গ্রামটি এখন ভাসছে থইথই বেহুলার বুকে। আর তার মধ্য থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচা ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে শূন্য কলার ভেলা ভাসিয়ে ছেলে-ছোকরারা হুটোপাটি করছিল সদলবলে। কমবয়সী এসব ছেলের দুরন্তপনা দেখে তমিজ শূন্যচোখে হাতড়ে বেড়ায় ধু-ধু জলের মাঠ আর ছেলে বোরহানের গন্ধহীন স্মৃতি। সেই কষ্ট এখনো তার বুকে বিঁধে আছে টোপগেলা বড়শির মতো। একসময় সে-ভাবনায় বাদ সাধে ডং ডং করে বেজে যাওয়া প্রাইমারি ইশ্কুলের ঘণ্টা। ইশ্কুল তো অনেক আগেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কীসের সে-ঘণ্টা? এসব তার মনে বাজছে না তো?
রোদে তাতানো দুপুরে আসলে সতর্কঘণ্টা বাজছে ইশ্কুলের ময়দান থেকে। হু-হু করে জলসীমা বেড়ে যাওয়ায় বানভাসি পরিবারগুলোকে ওখানে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্ত্ততি শুরু হয়েছে আগে থেকেই। বাঁশের বাখারিকাটা জানালার খোঁড়ল দিয়ে ওদিকে একবার নজর দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে তমিজ। আশপাশের জেগে থাকা ঘরগুলো থেকে বিপন্ন মানুষজনকে নিয়ে কিছু কিছু নাও ভিড়ছে ওদিকে। যতদূর চোখ যায় চারদিকে শুধু তমিজের নেশাভরা পরিচিত জলরাজত্ব। ডুব দিয়ে মাছ ধরার নেশা সে ছাড়ান দিয়েছে সেই কবে! তবু শনশন বাতাসে একটা নেশাধরা কামট শ্যাওলা গন্ধ তাড়িয়ে আসে তার দিকে।
রোদপড়া চিকচিকে জলের ওপর কখনো শূন্য কলার ভেলা ভেসে যায় এদিক-ওদিক। লখিন্দরহীন সে-ভেলায় চেপে শূন্য হতবল চোখে হয়তো ভেসে বেড়ায় বানভাসি কেউ। বানভাসি এক জনপদের অন্তহীন আলস্য নিয়ে বেহুলার কোল এভাবে রাতদিন জেগে থাকে আগ্রাসী ক্ষুধার সংজ্ঞা নিরূপণ করে। আর ওদিকে তমিজের মতো অলস বসে আশাহত, ক্লান্ত চোখে জেগে জেগে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা দেখে ইছাপুরের উপায়হীন মানুষগুলো।
পাঁচ.
বানের তোড়ে কারো বাড়ি ভাসছে, কারো বা ভাঙছে ঝুপ করে। সম্পদের চেয়ে প্রাণটাই তো আগে। তাই নামমাত্র সেই তাল-খেজুর আর চটা বাঁশের ছাপরাঘরের মায়া ছেড়ে সবাই উঠে যাচ্ছে উঁচু জায়গার তালাশে। সবাই জানে – শেষটায় সরকারি প্রাইমারি ইশ্কুলের ওই দালানঘরই একমাত্র সম্বল। ইটের কাঠামো বলেই শুধু নামমাত্র দালান, বাকি সবই ঝুরঝুরে। ওদিকে কেউ রাস্তার ধারেই পলিথিন কিংবা ত্রিপল টানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে সংসার, সাজিয়ে নিয়েছে জীবন। হ্যাঁ, সংসারই তো। সাজালেই বা কী? জলের ঘূর্ণিস্রোত চোখ টাটিয়ে আবার পিছু নিয়েছে তাদের। দুর্দশাগ্রস্ত সকল মানুষের একই সঙ্গে চলছে বসবাস, রান্না-খাওয়া এমনকি
গা-গোসল ধোয়া পর্যন্ত।
ধুলোর পৃথিবী জলের পস্নাবনে টইটম্বুর। ইশ্কুলের মাঠে হাঁটুসমান জলে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবী দলের সঙ্গে রঞ্জন মাস্টারের বিরামহীন ছোটাছুটি দেখা যায়। মানবিক সাহায্যার্থে তিনিও অংশ নিয়েছেন প্রথমদিন থেকে। বানের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যে সরকারি লঙ্গরখানা চালু হলেও ত্রাণের অভাবে পুরোদমে কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ওদিকে ইশ্কুলঘরের কপাটভাঙা জানালাগুলোর মতো সারাদিন হাঁ হয়ে থাকে বুড়ো-কচি শিশুগুলোর মুখের হাঁ। ঘাটের মড়া হতে যুবতী-পোয়াতি বউ, গৃহপালিত পশুর সঙ্গে বেহুলাপাড়ের বেওয়ারিশ কুকুরগুলোরও আশ্রয় মিলেছে সেখানে, মায়াহীন এ-খেলায় কেউ আর বাদ নেই এখন। এর মধ্যে প্রাণান্ত চেষ্টা করে হাঁপিয়ে উঠছেন রঞ্জন মাস্টার।
তমিজের ঘরলাগোয়া ঘরটি ছিল ওসমানের – কোমরসমান নিথর জলে কয়েকদিন ধরেই কঁকিয়ে উঠছিল তার পোয়াতি বউটা। সেদিন সন্ধ্যার পর সকিনার হঠাৎ ব্যথা ওঠায় তাকে নিয়ে ওসমান ছোটে ইশ্কুলঘরের দিকে। যাওয়ার আগে বলে যায়, ‘ঘরখান একটু দেখি রাখিস তমিজ। বুড়ি মা ও ঝন্টুকে সাথে নিয়ি যাচ্ছি। সকিনার সব ব্যবস্থা করি রাতেই ফিরি আসবু আমি।’ ঝন্টু ওসমানের সাত বছরের প্রথম সন্তান। ওরই প্রায় সমবয়সী ছিল বোরহান। ঝন্টুর কথা মনে হতেই তমিজ যেন বোবা হয়ে যায়।
পূর্ণগর্ভা সকিনার এখন-তখন অবস্থা। চারদিক ডুবে গিয়ে একসার হওয়ায় তার কোনো গতিক করতে পারেনি ওসমান। ওদিকে ইশ্কুলঘরের আশ্রয়ের দিকে তড়িঘড়ি নিয়ে গেলে কয়েকজন বয়স্ক মেয়েছেলে ময়লা একখানা শাড়ির আড়াল দিয়ে এক কোণে ঢেকে রাখে তাকে। জন্মটাও যে প্রকৃতির নির্মম সত্য, তা অবজ্ঞার শক্তি মানুষের হাতে নেই। সকিনার এখন যন্ত্রণা ওঠারই সময় – সেই নিয়ম ধরে সারা শরীরে ঘাম দিয়ে বারবার খিঁচে উঠছে শরীর। রাবেয়া আর ওসমানের বৃদ্ধ মা একসঙ্গে জড়ো হয়ে আধভেজা কাপড়ে জবুথবু হয়ে একটু শামিত্মর আশায় খোদাকে ডেকে যাচ্ছে ক্রমাগত। রাবেয়া একবার মনে মনে ভাবে, আহা … তমিজ তো এখনো একটা জন্ম দেখার আশায় অপেক্ষা করে আছে কাঙালের মতো। সেই কথা ভেবে সকিনার জন্য সাধ্যমতো সবকিছু করে যায় তারা।
সে-রাতে হঠাৎ ইশ্কুল-দালানের পুবদিক থেকে ভীষণ একটা শোরগোল ওঠে। আগে ওখানে বিশাল একটা পুকুর ছিল, যদিও এখন পুকুর-মাঠ-জলা সবই সমান। শোরগোল শুনে ঘরে বসেই হুঁশ হয় তমিজের। সেই পুকুরপাড়ের আরো দক্ষিণে মোক্তারবাড়ি। আরে তাই তো! পুকুর আর মোক্তারবাড়ির মাঝামাঝি কোথাও থেকেই এ-আওয়াজ আসছে। কয়েকদিন থেকে সে-পথ ধরে পিঁপড়ার সারির মতো মানুষ ভিড়ছিল ইশ্কুলের দিকে। জলের বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদিগমেত্মর সব অন্ধকার জমাট বেঁধেছে সেখানে। বিদ্যুৎ নেই। বিচ্ছিন্ন হারিকেন, কুপি আর টর্চের আলো ছিন্নভিন্ন হয়ে কেবল জ্বলে উঠছে আর নিভছে বারবার। হালকা ঢেউয়ের হাত ধরে বাতাসের গায়ে খানখান হয়ে ভাঙছে মানুষের আর্ত কণ্ঠস্বর। হঠাৎ হঠাৎ ঝুপঝাপ আওয়াজও আসছে জলে দাপানোর।
দশ বা বারোজনের বহর নিয়ে একটা নাও ডুবেছে সেখানে। সবই প্রায় ছেলে-ছোকরার দল। ওতে মোক্তারবাড়ির কয়েকটা ছেলের সঙ্গে ওসমানের ছোট্ট ছেলে ঝন্টুও নাকি ছিল। লঙ্গরখানার এমন হালচালের ভেতরে সকিনাকে নিয়ে সবার ব্যস্ত হওয়ার ফাঁকে ঝন্টু কখন ওদিকে গেল কেউ খেয়াল করতে পারেনি। ইছাপুর হাই ইশ্কুলের অগণিত কণ্ঠস্বর শুধু তখন ‘তমিজ’, ‘তমিজ’ বলে ডাকতে থাকে। তমিজের ডাক পড়েছে আবার। তাই শুনে মুহূর্তে ওসমান নাও নিয়ে ছুটে আসে তমিজের কাছে। বেহুলার জল এসে, হাওয়া এসে, পরিচিত আওয়াজ এসে আরেকবার তমিজের ধ্যান ভাঙায়; তমিজ, ও তমিজ … ইবার একবার আয় ইদিকে। এ ইশ্কুলপানে …। একটা চালচুলোহীন আহাজারির মতো সংঘবদ্ধ বিলাপ জলতরঙ্গের সুর নিয়ে বারবার বাজতেই থাকে ডাঙাহীন সে-জলের প্রান্তরে।
ঘরের চালের কাছে শূন্যে বাঁধা কাঠের ঝুলানো মাচান থেকে ঝুপ করে জলে নামে তমিজ। তার শরীরের রক্ত সচল হয় অনেকদিন পরে। বুকসমান জল ঠেলে ওসমানের ডিঙি নিয়ে সে হইচই অনুসরণ করে চলে, ঠিক নাওটা যেখানে ডোবে।
ইশ্কুলের সে-পুকুরপাড় ধরে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা নারকেল আর বুড়ো বটের অবস্থান দেখে জলে ডুব মারে কয়েকজন। অন্ধকারের মধ্যেও টিমটিমে কুপি হাতে যার যতখানি সাধ্য আলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকে তারা; কিন্তু অমন দম কার আছে যে জলের গায়ে হাতড়ে বেড়াবে? অনেকদিন পর অভিমান ভেঙেছে তমিজের। জলের নেশাও যে খুব করে পেয়ে বসেছে তাকে। মাছ ধরার সেই পুরনো নেশা নাকি ছেলে বোরহানকে খুঁজে পাওয়ার নেশা, তা সে জানে না। জলের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে চলে যায় পাতালের আরো নিচে, আরো গভীরে কোথাও। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওসমান, মোক্তারবাড়ির মাধবসহ আরো কয়েকজন ঠিক তুলে আনে দু-তিনজনকে। তবে নিখোঁজ থেকে যায় ঝন্টু আর সন্তোষ মালাকারের ছেলে গগন। ততক্ষণে সবাই উঠে এলেও তমিজ ঠিক ডুব দিয়ে জলেই পড়ে থাকে।
ইশ্কুলমাঠের চত্বরসহ এখানে-ওখানে খ- খ- আহাজারি আর ঝুপঝাপ আওয়াজ চলছে তখনো। এ ঘোর বিপদলগ্নেই লঙ্গরখানার হই-হট্টগোল ফুঁড়ে ভেসে আসে এক কচি গলার কান্না। সকিনার গর্ভের অন্ধকার থেকে আলোয় এলো নয় মাস ডুবে থাকা তাদের দ্বিতীয় সন্তান। রাবেয়া বুকে ধরে রয়েছে ওসমান-সকিনার সদ্যোজাত পুত্রসন্তানকে। অন্ধকারে ইশ্কুলের বারান্দায় ছপছপ করে পা ফেলে রাবেয়া এগিয়ে আসে সামনের জলময় বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। বাইরের চেঁচামেচি লঙ্গরখানার বিচিত্র আওয়াজের মধ্যে একেবারে মিশে গিয়েছিল তখন।
কাঠের মূর্তির মতো রাবেয়া সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্পলক … অনেকক্ষণ। তাকে ঘিরে থাকে লঙ্গরখানার অনিশ্চয়তায় সংসারপাতা অগণ্য আশাহত মুখ। তাদের চোখেমুখে আনন্দ-হাসি-কান্নার ছবি নাকি অনিশ্চিত চাপা শংকা লেপটে ছিল সে-উত্তর জানা নেই কারো। তবু ঘোর অন্ধকারের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে রাবেয়া ফিসফিস করে বলে, ‘আমার সোয়ামির বুকে আছে সাত মানুষের সুমান রাইজ্যের দোম। তোমরা দেইখো, ঝন্টুকে নিয়ি সে ঠিক উইঠি আসপি।’