টলোমলো জলভরা চোখে যাতনা বাদলকে তার দৃষ্টির অস্বচ্ছ আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারে না। তার দৃষ্টির সামনে বাদলের মুখাবয়ব দেহাঙ্গিক ভেঙে ভেঙে যেতে থাকে। বাতাসের ধীরগতির প্রসারণে ছোট ছোট ঢেউয়ে ভরা জলাধারের উড়াল পাখির ভেসে থাকা অস্বচ্ছ প্রচ্ছায়ার মতো লাগে বাদলের ছায়া ছায়া ছবি। ‘উড়াল পাখিই তো।’ অশ্রম্ন ফোঁটার ভার সামলাতে গিয়ে অভিমানী হয় যাতনা। তাকে তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, এই পাঁচ-সাত বছর তুমি কীভাবে আড়াল হয়ে রইলে … খোঁজখবর না নিয়ে?
তার জলভরা চোখের সামান্য দূরত্বে বাদল দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে যাতনা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তার চোখে জমতে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল সরিয়ে সে বাদলের চেহারা-আদলটা দেখবে কি? যে-মুখম-লের চতুর্সীমা ধরে একসময় সে চেয়ে থাকতো অনেকক্ষণ। লুকিয়ে-ছাপিয়ে-পালিয়ে তারা দেখা করতো আজীজ শেখের খড়ের গাদার নিরিবিলি পাড়ায়। তারা লুকোচুরি খেলতো এক খড়ের গাদার অবস্থান থেকে অন্যটাতে। দৌড়ে দৌড়ে। তারা একে অপরকে ছাপিয়ে হারিয়ে যেতো পালা করে। আবার হারিয়ে ফেলে খুঁজে পাওয়ার উচ্ছ্বাস-আনন্দে তারা আত্মহারা হয়ে উঠতো। থাকতো নিমগ্ন হয়ে। তখন তারা স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রী। তখন যাতনা কৈশোরের দ্বারপ্রামেত্ম দাঁড়িয়ে আর বাদল প্রথম যৌবনে। যাতনা ক্লাস সেভেনে ও বাদল নাইনে পড়তো। আর তারা স্বপ্ন দেখতো, একে অপরের ছায়াসঙ্গী হবে। তাদের ছায়া-স্বপ্ন … একে অপরকে পাওয়ার দুরন্ত নেশার ঘোর থেকে তারা বেরোতে পারেনি। বেরোতে চায়ওনি। সেইসব উচ্ছল দিনগুলোতে।
যাতনা জলভরা চোখে বাদলের ভাঙা টুকরো টুকরো ছবি দেখে নীরব-নিরিবিলি হয়ে যায়। তার মুখে কোনো রা নেই। সব কথা যেন ফুরিয়ে গেছে তার। তার ভাবলেশহীন দেহরেখায় জমেছে রাজ্যের অবসাদ। নিজের প্রতি করুণা। বাদল কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায় ভেতরে-ভেতরে কুঁকড়ে যেতে থাকলেও সে সহজ হয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকে।
যাতনার কাঁখে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি একসময় কঁকিয়ে ওঠে। হাত-পা নাড়ে। দুধের শিশু। তার প্রয়োজন তো একটাই। মার কোল ঘেঁষে দুধের উৎস খোঁজা। মার মুখভঙ্গিতে সেই অবসাদ। খানিকটা বেদনাও। ততক্ষণে হাঁটতে শেখা আরেকটি মেয়ে যাতনার পা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বাদলের দিকে। যেন শিশুটি তাকে চেনে। তার হাবভাব তেমনি।
বাদলের মনে পড়ে, তাদের কৈশোর-যৌবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা আজীজ শেখের খড়গাদার সত্মূপে লুকিয়ে-পালিয়ে ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে একে অপরের আহ্লাদ-আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে বরাবর যাতনাই বিমর্ষ স্বরে বকে যেতো, ‘জানো বাদল … মা কী বলেন?’
‘না … বলো।’
‘বলেন … যাতনা নামের মাইয়াগোর জীবন বড় কষ্টের অয়।’
‘কী রকম কষ্ট?’
‘তা-তো কইতে পারতাম না।’ তবে এর অর্থ দুঃখ-যন্ত্রণা।
‘তা-অইলে এমন অলক্ষুইন্না নাম রাখলো যে।’
‘হ রাখছে … কারণ আগে থেইক্কা কষ্টের বোঝা বইয়া বেড়ালেই না কষ্ট আর কষ্ট মনে অইত না।’
যাতনার মুখে এমনি ধারার কথোপকথনে বাদল চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নিত। পরে একসময় সেও বলতো, ‘জানো যাতনা বাদল-এর অর্থও যে খুব একটা ভালো না।’
যাতনা কৌতূহলী হয়, ‘তা কেমন?’
‘এর অর্থ … মেঘ, বৃষ্টি, দুর্দিন।’
এটুকু শুনে সেদিন যাতনা একেবারে চুপটি মেরে গিয়েছিল। বাদল নানা ধরনের রংঢংয়ের কথা বলে তাকে আর স্বাভাবিক করতে পারেনি সেদিন। তাকে পারেনি হাসাতে।
কিশোরগঞ্জের অখ্যাত, ছোট্ট এক গ্রাম। নাম তারাফুলের গাঁও।
বৃষ্টি-বাদলা না থাকলে সময়-সময় এর আকাশে এত তারা ফুটে থাকে যে, এর দুপাশ দিয়ে নেমে আসা পরিসর ধরেও ঝলমলে তারার বাতি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। স্বল্পপরিসরে দেখতে গেলে তখন মনে হয়, বিসত্মৃত কোনো সান্ধ্য বাগানজুড়ে ফুটে আছে সতেজ বাহারি সব সন্ধ্যামালতী। এ-এলাকার বানার নদীর ছড়া হয়ে নরসুন্দার শাখা এসে কয়েক লাইনে বিছিয়ে আছে তারাফুল গাঁওয়ে। এই নদীর কোথাও কোথাও গভীরতা থাকলেও জায়গায় জায়গায় এর হাঁটুজল। সেখানে সারাদিন ছোট ছেলেমেয়েরা ডুবিয়ে ডুবিয়ে দিন কাটিয়ে দেয়। আরো খানিকটা সীমিত অস্বচ্ছ জলে ভেসে বেড়ায় হাঁসের পাল। ছড়ার জলের এদিক-সেদিক থেকে ক্যাঁৎ-ক্যাঁৎ শব্দ করে উড়ে বসে সরাইল-বেলে হাঁসও। জলাশয় ছাড়িয়ে পুরো গাঁও গাছগাছালি ভরা ঘন সবুজ। দাঁড়িয়ে আছে তাল-সুপারি-নারিকেলের ঝাড়।
তারাফুল গাঁওয়ের কিশোরগঞ্জ ধরে প্রবেশপথ মাত্র একটি। তাও দু-জায়গায় বাধা। প্রথমটায় গাঁওয়ের মানুষ লুঙ্গি খানিকটা গুছিয়ে সহজে পেরিয়ে যায়। দ্বিতীয়টি একটি ছোট্ট কালভার্ট। কেউ কেউ বলে ব্রিটিশ আমলের। এটার জায়গায় জায়গায় ছোট বড় চিড়ল-ফাটা দেখা দিয়েছে। কাজেই এ-পথে সচরাচর যান্ত্রিক যানবাহন আসা-যাওয়া করে না। বড়জোর রিকশা বা সাইকেল চলে মাঝেমধ্যে।
১৯৭১-এর মার্চের পর প্রায় তিন মাস এ-পথে পাকসেনারা এগোয়নি তেমন। শুধু কিশোরগঞ্জ ধরে নরসিংদীর দিকে ইতস্তত মহড়া দিয়েছে। নিরীহ মানুষ মেরেছে অনেক।
পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের কাছে তথ্য ছিল, তারাফুল গাঁও এলাকা ধরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাত-বিরাতে চলাচল করে। বিশ্রাম নেয়। পাক সেনাদল দু-একবার সেই গাঁয়ে কনভয় নিয়ে হানা দেওয়ার চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারেনি। স্থলপথে কিছু বাধার অনিশ্চয়তা। সরু জলভরা পথ ও দুর্বল কালভার্ট তাদের অসুবিধায় ফেলে রেখেছিল অনেক দিন।
তারাফুল গাঁওয়ে সেদিন সকালটার তেমন কোনো বিশিষ্টতা ছিল না। ছোট-বড় গাছগাছালির মাথা ডিঙিয়ে গতানুগতিক সূর্যচ্ছটা ছড়ার জলে পড়ে চিকচিক করছিল। বইছিল শিরশিরে ঠান্ডা হালকা বাতাস। বাদলদের বাপ-চাচাদের তিন ঘরে চিতই পিঠা তৈরির আয়োজন চলছিল। এর প্রধান উদ্যোক্তা বাদলের মা। চাচিরাও এগিয়ে এসেছে বাদলদের উঠানে। তাঁরা হাতে হাতে পিঠা বিলি করছে। সঙ্গে ঘরের পুরনো দানাদার আখের গুড়।
সময়টা জুনের মাঝামাঝি। এদিকে পাকসেনারা ভোররাতে গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ-লরিসহ সারি ধরে বেরিয়ে তারাফুল গাঁও ও এর উত্তর-পুবের দরিয়াকান্দা ও বেলেঘাটা গ্রামসহ ঘিরে বসে ছিল। ঘাপটি মেরে। সকালে সূর্য উঠে গেলে তারা দলপতির নির্দেশ শুনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ‘ইধার মুক্তি আর মালাউনকা বাচ্চায় ভার গিয়া। সাবকো মারো … জ্বালা দো সাব্কা ঘার। লাড়কি লোগকো ছিন লও।’ এতে সায় দেয় রাজাকার তরীক মুন্সীও। তার চেলাচামু-ারা। বন্দুক-মেশিনগানের দিগ্বিদিক গুলি ছুড়তে ছুড়তে পাকবাহিনী চড়াও হয়ে ঢুকে পড়তে থাকে গ্রামের ভেতর। নদীনালা, বিল-ঝিল, খাল পার হয়ে।
গ্রামের লোকজনের বুঝতে সময় লাগেনি। তারা দৌড়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে পাকসেনাদের নজরের সীমানায় পড়ে গুলি খেয়ে মরতে থাকে। আর অনেকে খালের, ছড়ার গর্তে, জলাজংলার-বনজঙ্গলের এদিক-সেদিক ছুটে বাঁচার চেষ্টা করে। পিঠা ফেলে ছুটতে থাকে বাদল, তার পড়শি বন্ধু গৌরাঙ্গ। একসময় গুলি খেয়ে চিৎকার করে পড়ে যায় সে। তাকে ধরার ফুরসত হয়নি বাদলের। সে দৌড়াতে থাকে প্রাণপণে। কোনদিকে তা সে বলতে পারবে না। তার সঙ্গে ছুটছে অনেকেই। গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েও যাচ্ছে কেউ কেউ। সেখানে একজন আরেকজনকে হাতে টেনে সাহায্য করার অবস্থা নেই কারো।
দুপুরের সূর্য মাথা বরাবর উঠে এলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ততক্ষণে বাদল টের পায় গোলাগুলির শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে চলেছে। সে আর দৌড়াতে পারে না। নির্জন এক রাস্তার ধারে বসে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে বনের ভেতর ঢুকে যায়। একসময় অন্ধকার এক গর্তে আছড়ে পড়ে সে টের পায় এটি পারিবারিক কোনো গোরস্তান হবে হয়তো। এর সামান্য দূরে বাঁশের বেড়া দেওয়া একটা কাঁচা কবরও তার চোখে পড়ে।
পুরনো কবরের গর্ত থেকে তখন ওঠার আর ক্ষমতা নেই বাদলের। চিকা-ইঁদুরের উৎকট গন্ধে ভরা, অন্ধকার কবরের গর্তে পড়ে থেকে সে ঘনঘন শ্বাস নেয়। গরমে ঘামে। শরীরে তার সামান্যতম শক্তিও নেই তখন। যেন এখনই দম বন্ধ হয়ে যাবে তার। সে পড়ে থাকে সেখানেই।
সন্ধ্যার আগেভাগে আধো-অন্ধকারে বাদল হামাগুড়ি দিয়ে গর্ত থেকে বের হয়। ততক্ষণে তেষ্টায় তার বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
কিছু দূরে একটা কুপি-সলতের আলো দেখে সেদিকে এগোয় সে। নির্জীব-নিঃশব্দে। কাছে গেলে বাদল দেখতে পায় এক বৃদ্ধা চাটাই বিছিয়ে একটা কী করছে। বৃদ্ধাও আধো-অন্ধকারে তাকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়। বাদল হাতের ইশারায় তাকে অভয় দেয়। পানি চায় দু-হাত তুলে। বৃদ্ধা তার পাশে রাখা পানিভরা লোটা এগিয়ে দিলে বাদল ঢক্ঢক্ করে পানি গিলে অনেকটা বেচেত হয়ে বারান্দায় বিছানো চাটাইয়ে কাত হয়ে পড়ে যায়। … ‘আর পারছি না।’
বুড়িও ভীতসন্ত্রস্ত হয়।
‘তুমি বাবা বেলেঘাটা গ্রামের দিকেরথন আইছো?’
বাদলের গলায় তখন কথা বলার শক্তি নেই। সে কতক্ষণ কাত হয়ে পড়ে থেকে বলার চেষ্টা করে ‘হাঁ … গো আমি ওইদিকেরওই মানুষ … সারাদিন নিজের জান লইয়া দৌড়াইছি।’
তখন তার চেতনাশক্তি খানিকটা ফিরে আসে। গৌরাঙ্গ তো তার সামনেই গুলি খেয়ে পড়ে গেল। তখন বাবা-মার কথা মনে পড়ে তার। এক লাফে উঠে বসে সে। মাটির লেপা বারান্দা থেকে নেমে সে উলটো পথে তার গ্রামের দিকে দ্রুত হাঁটা দেয়। কখনো দ্রুত হেঁটে কখনো খানিক দৌড়ে এগোয় সে। গ্রামে পৌঁছুতে তার কতটা সময় লেগেছে বাদল বলতে পারবে না। সে দেখে, তারাফুল গাঁওয়ের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে এখন কয়েকটা হারিকেন-কুপির আলো জ্বলছে। সেদিকে সে তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়ে দেখে সারি সারি গুলি খাওয়া মৃতদেহ পড়ে আছে। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের হেকিম মাস্টারের তদারকিতে স্কুল প্রাঙ্গণে সেগুলো কবরস্থ করার প্রস্ত্ততি চলছে। সেখানে তার ছোটচাচার সঙ্গে দেখা। চাচা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।
‘বাপধন আমগোর যে সব গেছেগা। সব মারা পড়ছে। রইলাম শুধু তুই আর আমি। তোমার চাচি আর দুই পরিবারের ছোট বাচ্চা-কাচ্চা কয়েকজন।’
বাদলও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদে …। হেকিম মাস্টার ভরা গলায় ডাক ছাড়েন, ‘আপনারা যারা এহানে আছেন … সবাই হাত লাগান, পুকুরঘাটে কবর খোঁড়া প্রায় শেষ। মৌলানা সাব আইতাছে … জানাজায় শরিক হন সবাই। দোয়া করেন …।’
রাতের অন্ধকার কেটে ভোরের আলো দেখা দিলে কোনো রকমে এখানকার কবর দেওয়ার পর্ব শেষ হয়। বাদল তার
বাবা-মার কবরের পায়ের কাছে বসে ছিল। তার চোখে জল নেই। তা যেন শুকিয়ে গেছে।
ছোটচাচা এসে বাদলের মাথায় হাত রাখেন।
‘চল … বাড়ির দিকে চল। তাও তো আধপোড়া …। যামু কই?’
তখন বাদলের যাতনার কথা মনে পড়ে। সে উঠে দাঁড়ায়।
‘কাকা আমি একটু দরিয়াকান্দা অইয়া আই।’ চাচা তাকে বাধা দেয় না।
বাদল দ্রুত হাঁটে। সে দূর থেকে দেখে যাতনার ঘরবাড়িও পোড়া-পোড়া। সে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। সেই বাড়ির এক কামলা-মুনি জাবু এগিয়ে আসে খানিক। সে যাতনা-বাদলের অন্তরঙ্গতার কথা খানিকটা জানতো। সে চোখের জল ছেড়ে দিয়ে জানায়, ‘ভাইজান এই গেরামের অনেক মাইয়াগোর লগে যাতনারেও দইরা লইয়া গেছে পাকসেনারা। তাগোর বাড়িঘরও শেষ। যাতনার বাবা-মা গাছের ছায়ার অন্ধকার গোবরের টালে পইরা থাইক্কা বাঁচছে। তারাও আধমরা। তাদের যে যাতনা নাই।’
বাদল দৌড়ে আধপোড়া যাতনাদের বাড়িতে ঢুকে তাদের আহাজারি শোনে … ‘বাবারে … আমগোর আদরের ধন মাইয়াডারে যে পাকসেনারা লইয়া গেছেগা … যাতনারে আমরা কই পাই … বাবারে-মারে …। আমরা বাঁইচা গিয়াও মরা …।’
যাতনার মা মাটিতে কপাল ঠোকে …। নির্জীব বাদল দাঁড়িয়ে থাকে। তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে নামতে থাকে।
বাদলের তখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। হাতে দুচোখ চেপে ধরে যাতনাদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে। তার চোখের সামনে শুধু অন্ধকার। সে তাদের বাড়ি ছেড়ে এসে এক জঙ্গলা-ঝোপের পাশে বসে পড়ে সশব্দে কাঁদতে থাকে। ‘বাবারে … মারে … তোমরা আমারে কোথায় রাইক্কা গেলা? গেছে যাতনাও … কোথায় কে জানে? তাদের আমি এ-জীবনে আর যে পাইতাম না কোনোদিন … আমি এখন কই যাই। … কী যে করি?’
ভেজা মাটিতে বসে পড়ে অঝোরধারায় কেঁদে চলে বাদল। এ-কান্নার শেষই-বা কোথায় এখন তার জানা নেই।
তখন কাঁধে আলতো হাতের ছোঁয়ায় সে ফিরে দেখে ছোটচাচা তার পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁরও চোখে জল।
‘চল বাড়ি চল … আধপোড়া বাড়িঘর। থাকার মধ্যে আমাদের আছে ওইটুকুই। সেদিকে চাইলে কষ্ট আরো বাড়ে।’
রাত বাড়ে। চাচি তাদের রাতের খাবার দেয়। ডাল-ভাত। চাচা খেতে খেতে বাদলের পিঠে আদরের হাত বুলায়। চাচি চোখের জল লুকায়।
‘আমি ভাবছি, এ-সময়ে তোমার গ্রামে না থাহাই ভালো। তরুণ-যুবকদের ওপর পাকবাহিনীর যত রাগ … এর ওপরে আছে পাকবাহিনীর দোসর তরীক মুন্সী ও তার সাগরেদদের দল। তারা গৈ-গেরামের সব খবরাখবর, সত্যমিথ্যা পৌঁছাইয়া দেয় ক্যান্টনমেন্টে। তুমি এ এলাকা ছেড়ে চলে যাও কয়েকদিনের জন্য। পরে সুবিধা বুইঝা …।’ ঠিক হয়, বাদল তার মেজোমামার ওখানে চলে যাবে। ঢাকার আমিনবাজারে মামার ইট-বালির ব্যবসা আছে।
বাদল নিজে কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। চাচার নির্দেশ মেনে নেয়। দরিয়াকান্দার বাজারে বাসস্ট্যান্ড থেকে সকালের প্রথম ছাড়া মিনিবাসে চড়ে প্রথমে গাবতলী, পরে বাস ধরে আমিনবাজার। চাচার দেওয়া ঠিকানা খুঁজে মামাকে পেতে বাদলের তেমন অসুবিধা হয়নি। মামা মিনহাজ ছোটচাচার চিঠি পড়ে চিন্তিত হন। তিনি চোখের জল ছেড়ে দেন। ‘তাইলে বাবা তুমি এতিম … তোমার কেউ নাই। আমার বোন বদরুন নাই কেমনে অয়।’
দোকানের এক কর্মচারীকে দিয়ে বাদলকে তার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। মামি বাদলকে পেয়ে কেঁদে ফেলেন। ‘আমাকে তোমার
মামা ফোন করছিল। বড় বদনসিব তোমার বাবা … সব একসঙ্গে মা-বাবা, বাড়িঘর সব …।’ মামি আঁচলে মুখ ঢাকেন।
সপ্তাহখানেক পরে, সকালে মামা নাশতা খেতে খেতে বাদলকে জানায়, ‘আমি কয়েকদিন থনে ভাবছিলাম তুমি তোমার বংশের একমাত্র বাতি, তোমারে বাঁচানো দরকার। যেভাবেই হোক। দেশে থাকলে … বলা তো যায় না। চারিদিকে যেভাবে মানুষ মরছে … পাখির ঝাঁকের মতো। পাকিস্তানি সেনারা দিন দিন খ্যাপাটে অইয়া উঠছে। ভিতরে-বর্ডারে তারাও মাইর খাইতাছে কম না।’
মামি কী বলতে গিয়ে আঁচলে চোখ চেপে ধরেন।
‘গত দুই দিন দইরা আমি আমার বন্ধু আফজলের সাথে এ নিয়ে কথা কইতাছিলাম। সে দেশ থেকে চামড়া রফতানি করে। এই সূত্রে তার বিদেশি জাহাজ কোম্পানির সাথে ওঠাবসা।’
একটু থেমে মামা জানালো, ‘আফজল বললো এক জাহাজ কোম্পানি ডেক-ওয়ার্কার চাইছে বেশ কিছু। তবে তাদের অনেক দিন দেশে ফেরা অইত না।’
বাদল মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মামার কথাগুলো। মামার শেষের কথাটার প্রতি সে মনোযোগ দেয়। দেশে ফেরা যাবে না অনেক দিন। সে দেশে ফিরতেও চায় না। ফিরবে কার জন্য? তার বাবা-মা-যাতনা কেউই তো নাই। না আছে বাড়িঘর …?
বাদল মামার এই প্রস্তাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মামা বলেন, ‘এহানে বন্দর কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে কিছু টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপার আছে। হেইডা দেহা যাইবো, সময় অইলে।’
এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে মামা কিছু জামা-কাপড় কিনে দিয়ে বাদলকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এক কন্ট্রাক্টরের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসেন ঢাকায়।
শ্রীলংকান এক সমুদ্রগামী জাহাজে চড়ে বাদলের মনে হলো, এটাই ভালো। বছরের পর বছর সে ভাইসা বেড়াইবো জনমানবহীন সাগরজলে। তার মানুষের মধ্যে ফেরার ইচ্ছাও আর নাই। যাইবোগা দূর থেইক্কা আরো দূরে। জলে ভাসমান কচুরিপানার মতো।
পাঁচ-সাত বছর পর বাদলের জাহাজ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে থেমে প্রথমবারের মতো তাকে বাইরে অর্থাৎ বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আগে এই জলযান যে এ-বন্দরে মাল খালাস করতে ভেড়েনি তা নয়। দু-তিনবার ভিড়েছে। তবে তাদের নামার অনুমতি দেয়নি। এ নিয়ে বাঙালি খালাসিরা নানা ওজর-আপত্তি তুললেও বাদলের এতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। তার ভাবখানা এমন যে, জীবন একবার সীমানাহীন জলের সীমানায় সঁপেছি তো সঁপেছি কোনো স্থলভাগে নামার কি আছে? নামবেই-বা কার জন্য। তার বাড়ি নেই, ঘর নেই, মা নেই, বাবা নেই, নেই যাতনাও। যাতনা প্রসঙ্গ আসতেই বাদলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাদের পুবপাড়ার আজীজ শেখের খড়ের ঢিবি ও সমান্তরাল মসৃণ সবুজ ঘাসের বিস্তারের কথা। সেখানে তারা দুজন লুকিয়ে একজন আরেকজনকে খুঁজে, গোল্লাছুট খেলে কত-না বেলা কাটিয়েছে।
তার জীবনের এসব খুঁটিনাটি তাকে বিভ্রান্ত-বিষণ্ণ করলে সে চোখমুখ ধুয়ে কাজে ডুবে যেতো। জাহাজের ডেকে কাজের
কি অভাব হয়। সে কাজে ডুবে যেতো চোখমুখ বুজে। এই জাহাজ কত দেশে না নোঙর করতো এর কি অন্ত আছে। সেই
বন্দর-নগর ঘুরে-ফিরে দেখার জন্য জাহাজ কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে অনুমতি দিলে কর্মীরা একপলকে বেরিয়ে যেতো। কত শহর,
হাট-বাজার-কেনাকাটা, একেক দেশে একেক ধরনের চেহারা বৈশিষ্ট্যের। নানা ভাষার কথা, কত কি-না দেখার থাকে সেসব জায়গায়। এসব কোনো কিছু এই দীর্ঘ সময়ের সমুদ্রযাত্রার নানা উপলক্ষ বাদলকে আকর্ষণ করেনি কোনোদিন। সে তখন জাহাজ ছেড়ে না বেরিয়ে নিজের কিউবিকলে ঘুমিয়ে পড়ে থেকে সময় কাটিয়ে দিয়েছে। তার অনীহার পেছনে যে উপলব্ধি কাজ করেছে তা হলো, যার কিছুই নাই … না আছে মা-বাবা, ঘরবাড়ি, না আছে তার প্রিয়তমা যাতনা, সেখানে অন্য দেশ, অন্য মানুষের চালচলন, দর্শনীয় স্থান দেখে কি আর হবে এ-জীবনে। তার ঠিকানা যে এখন শুধু সাগরজলের অথই বিস্তার। সশব্দ ঢেউয়ের পর ঢেউ।
জাহাজে তাদের ওপরওয়ালা বস তাকে জানায়, ‘বাদল তুমি তো অনেকদিন থেকে এ জাহাজে কাজ করছো … দেশে যাওনি। এবার তোমাকে পনেরো দিনের জায়গায় বিশ দিন ছুটি দিলাম। বাড়ি থেকে ঘুরে আসো।’
বাদল কী একটা বলার চেষ্টা করতে না করতে তাদের সুপারভাইজার ততক্ষণে অন্যত্র চলে গেছে।
বাদলকে অগত্যা জাহাজ ছেড়ে বের হতে হয়। চট্টগ্রাম শহরের দিকে এগোতে এগোতে তার আমিনবাজারে মামা-মামির কথা মনে পড়ে। বাদল রাতের চট্টগ্রাম-ঢাকা কোচ সার্ভিসের বাসে করে ঢাকায়, সেখান থেকে স্কুটারে আমিনবাজারে। বাদল মামার দোকান নির্দিষ্ট করে পেতে খানিকটা সময় নেয়। ভাগিনাকে পেয়ে মামা তাকে বুকে চেপে ধরেন।
‘কী রে বেডা ওই যে যুদ্ধের সময় দেশ ছাড়লি আর খবর নাই। খবর দিতে অয় না?’
বাদল কিছু বলতে পারে না। তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে নামে শুধু।
মামা তাকে বাড়িতে দিয়ে আসে। মামির ওই একই প্রশ্ন, ‘ওই যে গেলা, বছরের পর বছর গড়াইল তোমার দেহা নাই।’
দিন কয়েক পেরিয়ে গেলে মামা বাদলকে জিজ্ঞেস করে, ‘ছুটি তোমার কয় দিনের … বাড়ি যাইবা কবে?’
বাদল ভাঙা ভাঙা উত্তর দেয়।
‘ছুটি মাত্র কয়েক দিনের। এই কয়দিন এহানে কাটাইয়া আবার যামুগা।’
মামা ঘোর আপত্তি তোলেন।
‘এইডা কেমনে অয়, তোমার ভিটাবাড়ি, চাচা-চাচিরা আছে না! নিজের ভিটাবাড়ি হাইট্টা-পাড়াইয়া আইলেও ভালো লাগবো … যেহানে তোমার জন্ম …। মা-বাবার কবরটাও তো দেখতে অয়। একটু পরিষ্কার-টরিষ্কার কইরা … পারলে ইটা দিয়া পাড় বাইন্দা দিলে …।’
বাদল চমকে ওঠে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়। সেই কালদিনের কথা … পাকসেনা রাজাকারদের তা-বলীলার দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে প্রাণ নিয়ে দৌড়াচ্ছে … পাশে গৌরাঙ্গ গুলি খেয়ে পড়ে গেল … তাকে ধরারও ফুরসত হলো না। এরপর ঘুটঘুটে মধ্যরাতের অন্ধকার ধরে ছোটা … ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফেরা … বাড়ি তখন ছাইভস্ম।
বাবা-মা মৃত-বিকৃত।
বাদল সাবধান হয়। সে যে সেই তারাফুলের গাঁওয়ে আর যেতে চায় না। তাই না তার সমুদ্রযাত্রা। যেখান থেকে এসবের কিছুই দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় পানি আর পানি। কূল-কিনারাহীন। কোনো গ্রামগঞ্জের নিশানা নাই। সেই তো ভালো। বাদলের চোখের কোনায় জল জমে। সে এক ঠাঁয় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মামা-মামির সামনে।
দিনদুই পরে মামি-মামা একরকম জোর করেই বাদলকে
তার গ্রামে পাঠায়। ‘যাও কয়েকটা দিন গুইরা আইয়ো … নিজের
গৈ-গেরামের বাতাস লাগলে তো গা-গতর ভালো লাগে। নিজের ভিটেমাটি পারাইয়া আইলেও তো কিছুটা অইলেও তো মনডা শান্ত অয়। বাপ-দাদার চিহ্নি।’
অগত্যা দ্বিতীয় দিনের মাথায় দুপুরের দিকে গাবতলী থেকে কিশোরগঞ্জের বাস ধরে বাদল। সন্ধ্যার আগেভাগে দরিয়াকান্দা বাজারের বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়ে। অনেক কষ্টের মধ্যে বাদল অনুভব করে তার গৈ-গেরামের শিরশিরে ঠান্ডা সান্ধ্যবাতাস। নদী-বিল-ছড়ার সোঁদা সোঁদা শ্যাওলা-কচুরিপানার নেশা ধরা হালকা গন্ধ। এই গ্রামীণ হাওয়া-সোঁদা গন্ধ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এই তো তার গ্রামের এলাকা। অতিপরিচিত এই এলাকার চৌহদ্দি। সে বাজার ছাড়িয়ে হাঁটাপথে
ছড়ার জলে পা ভিজিয়ে কালভার্ট পেরিয়ে তার ভিটেতে এসে
দাঁড়ায়। আধো অন্ধকারে ছোটচাচার বাড়ির ভেতরে গিয়ে দাঁড়ায়। চাচি কিছুটা একটা অবিশ্বাস্য আন্দাজ করে ঘর থেকে হারিকেন নিয়ে বের হন। বাদল আসবে তারা এই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পাঁচ-সাত বছর হয়ে গেল, তার কোনো খোঁজখবর নাই। তারা শুধু জানেন, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সে এক বড় জলযানে চড়ে হারিয়ে গেছে। এর পরে তার আর কোনো খোঁজখবর জোগাড় করতে পারেনি কেউ। না চাচারা, না মামারা।
কম্পমান ছোটচাচি হারিকেন নিয়ে এসে তার মুখবরাবর দাঁড়ান। ‘এ কী। এ যে আমগোর বাদল। দেখো … দেখো … তোমরা দেখো।’
চাচা ঘরেই ছিলেন। বেরিয়ে আসেন। কাছে এসে অবাক হন, ‘এও কী সম্ভব। হেই দিনও তোমার মেজোমামারে আমি নানান মন্দচারী করছি – তোমার এহানে পাডাইছিলাম, কয়দিন তারে বিপদমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে। গৈ-গেরামে পাকিস্তানি সেনারা যা শুরু করছে … কওয়ার কতা না। হেই সুযোগে তুমি তারে পাডাইছ সাত সমুদ্দুর … হেহান থাইক্কা কি কেউ ফেরত আইয়ে কোনোদিন?’
ছোটচাচা বাদলকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। ‘যাক বাবা তোমারে যে ফিরা পাইছি … বংশের বাতি।’
পরদিন চাচা বাদলের হাত ধরে হাঁটতে বের হন। ‘গৈ-গেরাম, নিজেদের ভিটেমাটিতে হাঁটলেও ভালো লাগবে। চিনা গেরামের নদী বাওয়া বাতাস, ঠান্ডা ভিজা মাটি। বনাঞ্চলের সোঁদা-ফুল-ফলের গন্ধ সব মিলাইয়া …।’
চাচার কথাগুলো বাদল মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তার তখন মনে হতে থাকে, চাচা যেন ঠিকই বলছে। বহুদিন পর এ-গন্ধ তাকেও খানিক মাতাল করে।
তারা হাঁটতে হাঁটতে প্রাইমারি স্কুলপাড়ার দিকে এগোতে থাকে। চাচা বলে চলেন। গলা তার ভার হয়ে আসে। ‘হেকিম মাস্টার লোকটা ভালো। হেই হত্যাকা–র পর যেদিন তোমার বাপ-চাচারা সব মারা গেল হেই মানুষটাই ভোররাতের অন্ধকারে শহীদদের কবরস্থ করার ব্যবস্থা করছিল।’
তারা স্কুল প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ায়। স্কুল প্রাঙ্গণের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে পাঁচ ইঞ্চির ইটের বেড় দেওয়া। চাচা বলে চলেন, ‘এহানোই তোমার বাপ-চাচা আরো অনেকের কবর অইছিল হেদিন। হেকিম মাস্টার ওই গাঁয়ের দশজনার সাহায্যে এই ওয়াল দিছেন। সাইনবোর্ড লাগাইছেন।’
বাদল লক্ষ করে ইট-বাঁধানো চৌহদ্দির পর কোনায় স্মৃতিফলক লাগানো। তাতে লেখা, ‘তারাফুল গাঁওয়ের ১৯৭১-এর শহীদানদের কবর।’
চাচা বিমর্ষ হয়ে আবার বলে যান, ‘এই স্মৃতিফলকটা কে জানি মাঝে মাঝে ফালাইয়া দেয়। আমরা জানি, হেই হত্যাকা–র দেশি দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এই কীর্তিগুলো তাদের।’
বাদলের যথেষ্ট রাগ হয়। তবে সে মুখ ফুটে কিছু বলে না। নিজেকে সামলে রাখে। চাচা মাসগ্রেইভের এদিক-সেদিকে আনমনে ইতস্তত খানিকটা হেঁটে বাদলের গা-ঘেঁষে এসে দাঁড়ান।
‘সব ওই নসিব … এরপরও কত লোক বাইচ্চা রইল। রইলো না শুধু …।’ কথা শেষ করতে পারেন না চাচা। খানিকটা সময় এভাবে থেকে বাদলকে বলেন, ‘তুই বাড়ি যা। আমি আইতাছি বাজার অইয়া। সকাল সকাল গেলে বিলের-নদীর তাজা মাছটা পাওয়া যায়। দেরি অইলে আর তেমন থাহে না।’
চাচা চলে যান।
বাদল কবরস্থানের দেয়ালে রাখা হাত সরিয়ে এদিক-সেদিক হাঁটে। সূর্য তখনো তেমন তেজি হয়ে ওঠেনি। দূরের ক্ষীণ জলাধারে পড়ে তা চকচক করছে। সোনা রঙের হয়ে। বাদলের একে একে অতীতের নানা কথা মনে পড়তে থাকে। আর তার চারপাশের অশেষ শূন্যতায় সে ভাসতে থাকে। যেন অথই সাগরজলে ভাসতে ভাসতে সে অনেক কিছু দেখে, আবার দেখেও না। সব আবছা-আবছা, অস্বচ্ছ হয়ে সীমাহীন দুঃস্বপ্নের মতো অন্ধকার তাকে গ্রাস করে ফেলতে থাকে। তার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সে সাবধানে পা ফেলে। দিগ্বিদিক এগোতে চায়। আর তখন সে শুনতে পায় কে যেন একজন বলছে ‘বাদল কাহা না … এতো দিনে কইতনে?’
বাদল চোখ মেলে। সে দেখে তার সামনে যে-দাঁড়িয়ে তাকে সে চেনে। সে পালটা প্রশ্ন করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। ‘বাদল কাহা আমি যাতনাদের বাড়ির মানুষ জাবু। যাতনা বাড়ি আইছে।’
‘কী?’ আঁতকে ওঠে বাদল। ‘কী কইতাছ তুমি?’
‘হ্যাঁ ঠিকওই কইতাছি। যাতনা বাড়ি আইছে। চলেন দেখবেন।’
‘আরে! … কী বলে সে না মারা গেছে? পাকিস্তানি সেনারা তারে …।’
‘হ কতা ঠিকওই। তবে রাজাকার তরীকত মুন্সী তারে শেষমেশ টান মাইরা লরিভরা মাইয়াপান থেইক্কা ছিনাইয়া রাখছিল তার কাছে।’
‘কী বলে?’ বাদল ধানভরা ক্ষেতের মধ্য দিয়ে উদ্ভ্রামেত্মর মতো ছুটতে থাকে।
বাদল যাতনাদের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে … চিৎকার করে ডাকে, ‘যা-ত-না আমি আছি। বাইচ্চা আছি। … তুমি কই … হুনলাম …।’
যাতনাও ঝটপট শিশুকে কোলে নিয়ে ভেজানো ঘরের দরজা খুলে বের হয়। বাদলকে দেখে প্রথমটায় তার জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে দরজার চৌকাঠ ধরে নিজেকে সামলে রাখে। অন্য হাতে তার শিশু। সে চেয়ে থাকে বাদলের দিকে। এক দৃষ্টিতে। ততক্ষণে চোখ তার টলোমলো জলে ভরে গেছে।
জলভরা চোখে যাতনা বাদলকে দেখতে চায়। প্রাণভরে দেখতে চায়। দেখতে চায় সেই উচ্ছল যৌবন দিনের তার ঘনিষ্ঠতম প্রিয় মানুষটাকে। কিন্তু সে তা পেরে ওঠে না। এতোক্ষণ যাতনা তার টলোমলো চোখের জল ধরে রাখার চেষ্টা করেছে, তা সে আর পারে না। বিষাদের অশ্রম্ন সে ঝরঝরিয়ে ছেড়ে দেয়। আজ বাদলকে কিছু বলার কিছু শোনার যে সময় হয়েছে তার। কোলের শিশুটিকে শান্ত করার চেষ্টা করে সে বলে যায়, ‘জানো বাদল আজ আমার এই কলঙ্কিত সন্তানদুটি না থাকলে এক্ষুনি আমি তোমার হাত ধইরা উইড়া পালাইয়া যাইতাম। হয়তো-বা আকাশের ত্রিসীমানায়। নয়তো সাগরের অতলামেত্মর তলদেশে, যেখান থেইক্কা আর কেউ কোনোদিন আমাগোরে খুঁইজ্জা পাইতো না।’ ততক্ষণে তার প্রথম সন্তান খেলতে খেলতে কোত্থেকে ছুটে আসে। সে মার পা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
এবার বাদলের অশ্রম্নধারা বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে চোখ তার লাল হয়ে উঠতে থাকে। কাঁপা-কাঁপা হাত বাড়িয়ে সে যাতনার দিকে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে যাতনার কোলের শিশুকে সে নিজের কোলে টেনে নেয়। বড়ছেলেটার মাথায় হাত রাখে। ভরা কম্পমান বলিষ্ঠ কণ্ঠে সে বলে যায়, ‘কোন ঘরের, কোন পিতার সন্তান এরা তা আমার আজ জানার দরকার নেই। আমি শুধু জানি, এই নির্বোধ শিশুরা তোমার সন্তান। তোমার দেহেরই একান্ত এক অংশ। অন্য কারো নয়। আর তুমি আমার।’
যাতনা বাদলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে অসহায়ের মতো চেয়ে থেকে খানিক এগিয়ে বাদলের কাছাকাছি হয়।
‘সত্যিই বলছো বাদল?’
‘হ্যাঁ … এক্কেবারে সত্য।’
‘এই পোড়া কপালে আমাদের এতো দুঃখ লেখা আছিল। কিন্তু … কিন্তু আমি যে এখন তরীকত মুন্সীর স্ত্রী … দ্বিতীয় স্ত্রী।’
বাদলের কণ্ঠ বলিষ্ঠ শোনায়, ‘না, তুমি আর কারো কিছু নও। এখন শুধু তুমি আমার। আমার … আমার।’
যাতনা ভীত হয়। ‘কিন্তু মুন্সী লোকটা যে বড় ভয়ংকর … বড় ঘৃণ্য চরিত্রের মানুষ। সে পারে না এমন কাজ যে …।’
‘হউক-না ভয়ংকর … যত ভয়ংকরই হোক আমি রুইখ্যা দাঁড়াইলাম। আইজ দাঁড়াইয়া পড়ার সময় অইছে।’
একটু থেমে আবার সে বলে, ‘যাতনা আমি আইজ একা নই। আমরা এহন অনেকজন। তুমি আমি, তোমার দুই সন্তান। নিষ্পাপ শিশুরাও প্রবল এক শক্তি। ভালোবাসার শক্তির যে ক্ষয় নাই।’
ততক্ষণে যাতনা-বাদল একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অঝোরধারায় কাঁদতে থাকে।