কেয়া, বলছিলাম কি আমি আর তোর আব্বা তো ঈদের পরেই আমেরিকা চলে যাবো। তাই এবারের ঈদটা যদি তুই আমাদের সাথে করতি। বিয়ের পরে কোন ঈদ তো করলিনা আমাদের সাথে। আর যদি বেঁচে থাকি তাহলে আবার কবে আমেরিকা থেকে আসবো, তার তো ঠিক নেই ।
-আম্মা আমারও খুব ইচ্ছা করে তোমাদের সাথে ঈদ করতে। কিন্তু তুমি তো জানো শওকতের মা ,বাবা সারাবছর এই দুই ঈদের অপেক্ষায় থাকেন । ঈদের ছুটি ছাড়া তো গ্রামের বাড়িতে আমাদের যাওয়া হয়না। তাই আমি নিজেও শওকতকে ঈদে বাড়িতে না যাবার কথা বলতে পারিনা।
– আমি তো জানিরে কেয়া। কিন্তু কি বলতো , প্রতিবার তো ঈদের পরে বাসায় আসিস। কিন্তু এবার দেশ থেকে চলে যাচ্ছি তাই মনটা কেমন করছে।
– ঠিক আছে আম্মা। আমি দেখি শওকতের সাথে কথা বলে, ও কি বলে । আচ্ছা আম্মা, রাফিনের স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেছে এবার ফোন রাখো। আমি বিকালে আবার ফোন দিবো। বলেই আমি ফোনের লাইন কেটে দিলাম।
শওকত তাঁর বাবা, মায়ের একমাত্র ছেলে। শওকতের চাকরির জন্য আমাদের ঢাকাতে থাকতে হয়। কত করে আমার শশুর- শাশুড়িকে বলেছি , আমাদের সাথে এসে থাকতে। কিন্তু উনাদের দুইজনই শহরে এসে বেশিদিন থাকতে পারেন না। আমার শাশুড়ি মা খুব সরল মানুষ। আমাকে নিজের মেয়ের মতই আদর করেন। প্রতিদিন ছেলের সাথে কথা হোক বা হোক। আমার সাথে উনার ঠিকই কথা হয়। নাতির জন্য সারাক্ষন উনাদের মন উতলা থাকে।
প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করেন – কেয়া তোরা কবে আসবি ? কিন্তু রাফিনের স্কুলের ছুটি থাকে তো ওর বাবার অফিস খোলা থাকে । আবার মাঝে মাঝে শওকতের অফিস ছুটি হলেও রাফিনের কোচিং থাকে, পরিক্ষা থাকে । তাই ঈদের ছুটি ছাড়া আমাদের গ্রামে যাওয়াই হয়না বলতে গেলে । আর তাছাড়া আমার নিজেরও গ্রামে গেলে খুব ভালোলাগে। আমার দুই ননস আছে । আমাকে খুবই আদর করেন। বাড়িতে গেলে বাড়ির সকলের সাথে হাসি আনন্দে কিভাবে যে ছুটির দিনগুলো কেটে যায় বুঝতেই পারিনা। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা আমাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আমার বড় দুই ভাই আমেরিকায় থাকেন। আগে মাঝে মাঝে আম্মা আর আব্বা দুই তিন মাসের জন্য সেখানে গিয়ে বেড়িয়ে আসতেন। কিন্তু এইবার বড় ভাইয়া বলল, আব্বা আম্মার বয়স হয়েছে। উনারা এখন একা থাকলে চিন্তা হয়। তাই এখন থেকে আমাদের সাথেই আমেরিকাতে এসে থাকবেন।
সেই কথা মতই সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ঈদের পরেই আম্মাদের ফ্লাইটের তারিখ পড়েছে। শওকতকে যদি বলি আমি আমাদের বাসায় ঈদ করতে যাবো , ও হয়তো নিষেধ করবেনা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি আমার শাশুড়ি মা কে কি বলবো ? উনার সাথে কথা হলেই বলি- মা মন খারাপ করবেন না । এইতো আর কয়েকদিন পরেইত ঈদে আমরা বাড়িতে আসছি। সেই সময় ইচ্ছা মত আপনার নাতিকে নিয়ে খেলবেন । বেচারারা অপেক্ষায় আছে। এখন যদি আমি না যাই নিশ্চই খুব কষ্ট পাবেন। আর কোরবানির ঈদে শওকত গেলেই গরু কিনা হয়। যদি শওকত একাও যায় তারপরেও মনের একটা খচখচানি আমার থেকেই যাবে। উনারা তো শুধু ছেলের অপেক্ষায় থাকেন না । নাতির জন্যই এখন আদর বেশি । আমার আম্মা সবসময় বলেন আসলের চেয়ে সুদের জন্য নাকি আদর বেশি থাকে। তেমনি ছেলে মেয়েদের থেকে নাতি – নাতনির জন্য আদর বেশি হয় । রাতে খাবার খেতে বসে শওকত বলল
– কেয়া ঈদের তো আর বেশিদিন নাই । আব্বা আর আম্মার ফ্লাইট তো মনে হয় ঈদের দুইদিন পরেই। শুন ভাবছি ,আমার বাইক কিনার জন্য যে টাকাটা জমিয়েছি সেটা দিয়ে তোমার ভাইয়া ভাবি আর বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনা কাটা করে দিলে কেমন হয় ?
-না, আম্মারা তো অনেক কিছু কিনেছে। তুমি আবার বাইক কিনার টাকা ভাঙতে যাবে কেন শুধু শুধু !
-আহ বুঝনা কেন উনারা উনাদের টা কিনেছেন । সবসময় তো ভাইয়ারা আমাদের জন্য কত কিছু পাঠান । কিন্তু আমরা তো তেমন কিছুই দেইনা কখনো। তাই ভাবলাম এবার যখন টাকা আছে ভালো কিছু কিনে পাঠালে উনারা খুশি হবেন। পরে আবার বাইক কিনার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-গ্রামের সকলের জন্য তো কেনাকাটা করতে হবে । আর গরু কিনার পুরো টাকাটা এবার তুমি দিবে বলেছিলে !!
– ঐ তো বেতন, বোনাস আর জমানো টাকা দিয়ে দুই দিকের টা হয়ে যাবে। কি ব্যাপার বলতো কেয়া তোমার মন খারাপ নাকি ?
-না, না মন খারাপ হবে কেন ? আম্মা বলছিল এবারে উনাদের সাথে ঈদ করতে। কিন্তু আমি আম্মাকে বলেছি এটা হয় না । আমরা না হয় ঈদের পরের দিন চলে আসবো । ঈদের পরের দিন আসলে কি তোমার কোন সমস্যা হবে ? আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ও চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। আমি জানি ঈদের পরের দিন চলে আসলে কেমন দেখায় । কিন্তু কি করবো ! আমার নিজেরও এবার আম্মাদের সাথে ঈদ করতে মন চাইছে। বিয়ে হয়েছে ১২ বছর। কখনো আম্মা আমাকে ঈদ করতে বলে নাই । এবার নিজেই চাইলেন । কি যে করি ! মেয়েদের বড় জ্বালা , স্বামীর দিকও সামলাতে হয় আবার বাবার বাড়ির দিকও সামলাতে হয় । দুইদিন পরে শওকতকে বললাম ট্রেনের টিকিট কাট নাই কেন এখনো ! আর তিনদিন পরেইতো ছুটি শুরু হয়ে যাবে । ও বলল – এবার ট্রেনে যাবো না কেয়া । রেন্টে কার থেকে গাড়ি নিয়ে যাবো । আর শুন আমরা কিন্তু আগামি কালকে রাতেই যাবো ।
-হ্যাঁ কি বলছ ? কোন কেনাকাটা করা হয়নি যে । আর ছুটির তো দেরি আছে ।
-রাফিনের তো স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। আর আমি দুইদিন আগেই ছুটি নিয়ে নিয়েছি এবার।
-কিন্তু রাতে কেন যাবো ?
-ভাবছি নিজেরা গাড়ি নিয়ে গেলে রাত আর দিন কি তাই না ? আমি আর কথা বাড়ালাম না । আমার মনে একটু আশা ছিল, শওকত হয়তো বলবে তাড়াতাড়ি যাচ্ছি যাতে পরের দিন চলে আসতে পারি। কিন্তু ও এরকম কোন কথাই বলল না । এবার সত্যি আমার খুব কান্না পেয়ে গেল । বাথ্রুমে গিয়ে কিছুক্ষন কেঁদে নিলাম। বাথ্রুম থেকে বের হয়ে আম্মাকে ফোন করে বুঝিয়ে বললাম যেন মন খারাপ না করে । ভিডিও কলে সবসময় তো আমাদের কথা হবেই । একদিনের নোটিশে সবকিছু গোছগাছ করতে করতে আমার যান বের হয়ে গেল । বুঝলাম না শওকত তো কখন এমন হটাৎ করে কোন সিদ্ধান্ত নেয় না। এবার যে কি হল !! ঝগড়া হবে ভেবে আমি ও বেশি কথা বাড়ালাম না।
আছরের আজানের পরেই শওকত গাড়ি নিয়ে চলে আসলো। প্রতিবারের মত এবার আমার আর আনন্দ হলোনা । রাফিন খুব খুশি । সারাদিন কাজের জন্য আজকে মা কে ফোন দিতে ভুলেই গেলাম আমি । আমি ফোন না করলে উনি নিজেই করনে । কিন্তু আজকে মা ও ফোন দিলেন না । মনে হয় ছেলের কাছে শুনেছে আমরা আসছি। তাই আর ফোন দেন নাই। গাড়িতে উঠেই সারাদিনের ক্লান্তি আমাকে ভর করল। আমি ঘুমিয়ে গেলাম । কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা । শওকতের ডাকে ঘুম ভাঙল । চারিদিকে অন্ধকার বুঝতে পারলাম না কোথায় এসেছি । শওকত বলল – বাব্বা ! কি ঘুম দিলে তুমি ! আমরা চলে এসেছি । নামো তাড়াতাড়ি । আমি অবাক হয়ে বললাম – কি বলছ ? ঢাকা থেকে নোয়াখালী আসতে তিন – চার ঘণ্টার মত লাগে । আমি এতক্ষন ঘুমিয়েছি !!
-না ম্যাডাম ৩-৪ ঘণ্টা আপনি ঘুমান নাই । আপনি মাত্র দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন। এইসময় রাফিন নানুভাইয়া বলেই চিৎকার করে গাড়ি থেকে নেমে গেল । আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না । ঘটনা কি ! বাহিরে তাকিয়ে দেখি আম্মা আর আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি হতভম্ব হয়ে বসে আছি দেখে শওকত আবার বলল- কি হল তোমাকে কি কোলে করে নামিয়ে আনবো ?
-শওকত আব্বা আম্মা কি আমাদের সাথে দেখা করতে আসছেন ?
-দূর পাগল ! তুমি তোমাদের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছ না ! আমরা গাজিপুরে তোমাদের বাসায় এসেছি । এবার এখানে ঈদ করবো সবাই।
-কি বলছ ! মা, বাবা খুব কষ্ট পাবেন। তুমি না গেলে গরু কে কিনবে ?
-গরু এবার বড় দুলাভাই কিনবে। আমি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। আর এবার দুই আপাও আমাদের বাড়িতে ঈদ করবেন। তাই মা বাবার কাছেও খারাপ লাগবেনা। ভেবে দেখলাম তুমি তো বিয়ের পর থেকে তোমার আব্বা আম্মাকে রেখে আমাদের সাথে ঈদ কর । এবার না হয় আমি আমার বাবা মা কে রেখে তোমার বাড়িতে ঈদ করবো । তোমার খুশির কথা ভেবে । এই কেয়া কাঁদছ কেন !! কি আজব ব্যাপার উনাকে হাসানোর জন্য আমি এত প্ল্যান করলাম আর উনি কিনা কেঁদে কেঁদে সব ভাসিয়ে ফেলছেন ! এটা কোন কথা হল !! আমি আব্বা আম্মার সামনেই শওকতের হাত ধরে বলে ফেললাম – শওকত তুমি এত ভালো কেন !!
গল্পের বিষয়:
গল্প