আমাদের নীচের ফ্ল্যাটে, পাশের ফ্ল্যাটে কুরবানি দেওয়া হয়েছে। গতকাল পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি এসে বললেন, তাদের গরুটা নাকি পঁচানব্বই হাজার হয়েছে। গরু বড়। সেই হিসেবে দাম নাকি কম হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের গরু কিনবেন না? আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, আমাদের বাড়িতে কুরবানি দেওয়া হবে। রাফির বাবা ঈদের দিন বাড়িতে যাবেন। আমরা যাবো না।
তারপর ভাবি ফর্দ শুনালেন, ঈদের মাংস দিয়ে এই করবেন, সেই করবেন, কোন কাবাব কীরকম বানাবেন, কোন স্টাইলে বানাবেন, বাসায় সস এনে রেখেছেন, টকদই ছাড়া নাকি তার মাংস রান্না করতেই ইচ্ছে হয় না ব্লা ব্লা…
ঈদের দিন দুপুরবেলা। রাফির বাবা রুমে শুয়ে আছেন। পাশের ফ্ল্যাট থেকে গরুর মাংস রান্না করার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রাফি সকাল থেকে বলেই চলছে, আজকে গরুর মাংস খাবো। আজকে গরুর মাংস খাবো। জানালা দিয়ে যখন বাইরে ইয়া বড় বড় গরু কাটা দেখছিলো আমার ছয় বছর বয়সী রাফি, তখন কী না খুশি হচ্ছিলো! বারবার ওর বাবাকে ডেকে বলছিলো, এইটা আমাদের গরু না? ওই লাল গরুটা আমাদের না? রাফির বাবাও মাথা ঝাকি দিয়ে বলেছেন, হ্যাঁ এই লাল গরুটা আমাদের।
দুপুর গড়াবে গড়াবে এমন সময় আমি মোরগ বসিয়ে দিলাম চুলায়। আশা করেছিলাম কেউ হয়তো গরুর মাংস এনে দিবে, তখন রান্নায় বসাবো। কিন্তু তেমনটা আর হলো না। যখন পাশের ফ্ল্যাটের মাংস রান্নার ঘ্রাণ নাকে আসছিলো, তখন রাফির কথায় আমি আর ঠিক থাকতে পারিনি। রাফি আমার ওড়না টেনে বলছিলো, মা ঘ্রাণ কোথা থেকে আসছে? আমাদের বাসায় তো এখনও মাংস এলো না? আমি মুচকি হেসে বলেছিলাম, এইতো! রান্না হয়ে যাবে এখনই। তুমি যাও তোমার বাবার সাথে টিভি দেখো। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। কিছু না বুঝেই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম, কেউ হয়তোবা মাংস দিতে এসেছে। ঈদের দিন অযথা কেউ আসার কথাও নয়। দরজা খুললাম। পাশের ফ্ল্যাটের রুকসানা ভাবি। মিষ্টি হাসি দিয়ে ঈদ মোবারক বললেন। আমি বললাম, ভেতরে আসুন।ভাবি বললেন, না না। এই নেন। আপনাকে দিতে ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাই কোথায়? বাসায় নাকি?
রাফির বাবা বাসায় কিন্তু আমি বললাম না উনি বাড়িতে। কুরবানি দিতে গিয়েছেন তো আসতে আসতে বিকাল হয়ে যাবে হয়তোবা। তারপর রুকসানা ভাবি অনেকটা বড় দেখতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এটার ভেতরে মাংস হবে। ভাবি চলে যাওয়ার সাথে সাথেই রাফির বাবা রুম থেকে বের হয়ে ডায়নিং রুমে চলে আসলেন। দেখলাম রাফির বাবার মুখে অনেকটা হাসি দেখা যায়। ব্যাগটা খুললাম। খুলে দেখি একটা মাঝারি সাইজের কাঁঠাল। ভেবেছিলাম এইটায় গরুর মাংস হবে হয়তোবা। হায়রে! মানুষ ফ্রিজ খালি করতে ঈদের দিন ফ্রিজ থেকে বের করে কাঁঠাল দিয়ে যায়।
মন খারাপ হয়ে গেলো আমার। রাফির বাবা কিছুটা লজ্জা পেয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। সবচাইতে বেশি খারাপ লাগলো আমার রাফির জন্য। রাফি এক নাগাড়ে বলছিলো, এইটার ভেতরে কি মাংস আম্মু? একবার আমি বলেওছিলাম, হ্যাঁ বাবা এইটার ভেতরে মাংস। তোমার আন্টি দিয়ে গিয়েছেন। রান্নাঘরে গিয়ে মোরগ বসালাম চুলায়। রান্না হতে হতে দুপুর দুইটা হয়ে গেলো। তারপর টেবিলে এনে খেতে বসলাম একসাথে। জানালা দিয়ে দেখলাম, বাইরে গরীবদের মাঝে মাংস বিলি করা হচ্ছে। শোরগোল অনেকটা। রাফি আর তার বাবা টেবিলে বসেছেন। রাফির চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। টেবিলে বসেই বললো, আম্মু আমাকে গরুর মাংস দেউ। আমি কিছু বলে উঠতে পারলাম না। মোরগের রান রাফির প্লেইটে দিয়ে বললাম, এই নাও বাবা। খেয়ে নাও।
এইটা কী আম্মু? এইটা মোরগের রান। আমি গরুর মাংস খাবো। রাফির আব্বু রাফিকে ধমক দিয়ে বসলেন। শক্ত গলায় বললেন, যা আছে তাই খাও। গরু গরু বলে মেজাজ খারাপ করে রেখেছো সকাল থেকে। রাফির বাবাকে আমি চুপ করতে বললাম। রাফিকে বুঝিয়ে বললাম, মা তো একা, তাই রান্না করতে পারিনি। এখন খেয়ে নাও মোরগ দিয়ে আমার লক্ষ্মী ছেলেটা? না। খাবো না। আগে বলো রাতে গরু রাঁধবে তো? হ্যাঁ বাবা রাঁধবো। এখন খেয়ে নাও? আচ্ছা। রাফি খেয়ে নিলো ভালো ছেলের মতো। রাফির বাবা খেয়ে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলেন। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, রাতে যখন রাফি জিজ্ঞেস করবে গরু কই তখন কী জবাব দিবো আমি?
আমাদের বাসার মালিক দুইটা গরু কুরবানি দিয়েছেন। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি গতকাল এসে বললেন, পঁচানব্বই হাজার দিয়ে গরু কিনেছে। নীচ তলার আপা শুনেছি দুইটা ছাগল কুরবানি করেছেন কুরবানির জন্য। সবাই কুরবানি দিয়েছে শুধু আমরা ছাড়া। আরিফের বাবা একটা আইসক্রিম কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে আছেন। মাসে বেতন পান বিশ হাজার। এই বেতনের টাকায় আমাদের চলতে হয়। মধ্যবিত্ত সমাজে মানিয়ে থাকতে হয় এই ফ্ল্যাট বাসায়। স্টেজ মেইন্টেইন করে চলতে হয় বলে কুরবানি নিয়ে বলতে হয় মিথ্যা কথা। যখন রুকসানা ভাবি বাসায় এসেছিলেন তখন কী অবলীলায় আমি বলেছিলাম, রাফির বাবা বাসায় নেই। তিনি বাড়িতে গিয়েছেন। কুরবানি শেষ করেই বাসায় আসবেন।
সন্ধ্যা হবে হবে। আমার বাসায় ঈদ নেই। যারা গরীব তারা হয়তোবা খুঁজে নিয়ে নিতে পারে। গতকাল কাজের মেয়েটা আমাকে বলে গিয়েছে, ঈদের দিন ও আসতে পারবে না, ঈদের পরের দিন আসবে সে। তার অংশ যেনো আমি রেখে দেই। এখন যদি আগামীকাল সে আসে তাহলে গরুর মাংস কোথা থেকে দিবো? যদিওবা কেউ কিছু দিতো তাহলে সেখান থেকে নিজেদের বলে কিছু দিয়ে দিতাম কাজের মেয়েকে। রাফি আবার এসে বললো, আম্মু গরু রান্না করবে তো? এবার আর কোন জবাব দিলাম না। ঠাশ ঠাশ করে রাফির গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম, এইটা মধ্যবিত্তের ঈদ। আমাদের গরু খেতে হয় না। আমাদের গরু না খাওয়াটাই কুরবানি। এইটাই আমাদের ঈদ।
গল্পের বিষয়:
গল্প