পাচঁ টাকা

পাচঁ টাকা
বিয়ের পর এই প্রথম শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছেন মঈনুল মিঞা বউ ময়না সহ। অটো থেকে নেমেই তিনি ঝগড়া বাঁধালেন অটো চালকের সাথে। দুইজন এসেছে বিশ’টাকা ভাড়া কিন্তু মঈনুল মিঞা কিছুতেই বিশ’টাকা দেবেন না অটো চালককে দু’জন যাত্রীর জন্য তাকে পাঁচ টাকা কম নিতেই হবে। অটো চালক ও পাঁচ টাকা কম নিবেন না, এই নিয়ে দশ-পনেরো মিনিট তর্ক চলে একটু পাশে ময়না মাথা নিচু করে দাড়িয়ে সব শুনে। বিয়ের একমাসে তার স্বামীকে যতটা চিনেছে সে তাতে করে পাঁচ টাকা নিয়েই ছাড়বে তিনি। অবশেষে অটো চালক বিরক্ত হয়ে পাঁচটাকার একটা কয়েন মাটিতে ছুড়ে মারেন। মঈনুল মিঞা মনে মনে ভাবেন খুচরা টাকা দিলে আর তার এতো সময় নষ্ট হতো না তর্কেও জড়াতেন না, যাই হোক টাকা তো সে পেয়েই গেলো।
মাটি থেকে পাঁচ টাকার কয়েন টা কুড়িয়ে নিয়ে তিনি এমন এক বিজয়ের হাসি দিলেন মনে হয় সদ্য কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। বাজার থেকে তার শ্বশুরবাড়ি মাইল দুয়েক দূরে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই টুকু পথ বউ সহ হেঁটেই চলে যাবেন। বউ তার এই দুপুরে মাথার উপর সূর্যের প্রখর তাপ নিয়ে বাপের বাড়ি হেঁটে যেতে নারাজ। মঈনুল মিঞা বলেন তার কাছে শুধু এই বাজার থেকে বাড়ি ফিরার টাকা আছে, মোট ত্রিশ টাকা সাথে এনেছেন তিনি পনেরো টাকা আজ অটো ভাড়া দিলেন বাকি পনেরো টাকা যাওয়ার সময় দিবেন। বউ আর কথা না বাড়িয়ে তার সাথে হাঁটা শুরু করলেন, কিছুদুর যাওয়ার পর ময়না স্বামীকে বলে, আচ্ছা বিশ টাকা ভ্যান ভাড়া বাঁচাতে গিয়ে যে আপনার দুইশো টাকার স্যান্ডেল নষ্ট করছেন সে খেয়াল কি রাখছেন। বাহ বউ বাহ, বেশ উপকারি কথাই বলছো উপযুক্ত সময়ে এই না হলে আমার বউ বলে পা’থেকে স্যান্ডেল দু’খানা খুলে হাতের ব্যাগে নিলেন। ব্যাগ ভর্তি করে দুই দুটা বড় বড়ো মিষ্টি কুমড়া নিয়ে যাচ্ছেন শ্বশুর বাড়িতে মঈনুল মিঞা।
হাঁটার সময় ব্যাগের ভার এক হাতে বহন করতে না পারায় একবার ডানহাতে কিছুক্ষণ পরে বামহাতে কিছুসময় কুমড়োর ব্যাগ নিয়ে রাস্তা চলছিলেন। বউকে ও বলেন তাঁর স্যান্ডেল জোরা ব্যাগে দিতে বউ মুখ ভেঙচিয়ে বললো আমি পারবো না এমন কিপ্টেমির কাজ করতে ওসব তোমার কাজ তুমি করো পারলে গাঁয়ের পাঞ্জাবিটাও খুলে রাখো রোদের তাপে ক্ষয় না হয়ে যায় পাছে। পাঞ্জাবীর কথা শুনে মঈনুল মিঞা পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিলেন তাঁর পনেরো টাকা সহিসালামতে আছে কিনা দেখার জন্য। সর্বনাশ তিনি পাঁচ টাকার কয়েনটা খুজে পাচ্ছেননা কোনো পকেটেও, শেষে রাস্তায় দাড়িয়ে পাঞ্জাবী খানা খুলে ভালো ভাবে ঝাড়লেন যদি কোথাও এঁটে থাকে কয়েন টা এই আশায়। কিন্তু পেলেন না,এমন হাহুতাশ শুরু করলেন তিনি, টাকার শোকে মুখ থেকে তার ঠিকঠাক কথা বের হচ্ছে না। ময়না এতো জিজ্ঞেস করছে, এমন অস্থির হলেন কেনো পাঞ্জাবীর ভিতরে কোনো পোকা ঢুকলো নাকি আমাকে বলেন বের করে দিচ্ছি।
মঈনুল মিঞা তখন বলেন আমার টাকা আমার টাকা কই হারাইলো, বউ বলে আরে কতো টাকা? পাঁচ…পাঁচ কথাটা ঠিকভাবে উচ্চারণ না করেই পিছন ফিরে হাঁটা শুরুকরে আবার টাকার সন্ধানে যদি পিছনে আসার পথে কোথাও ফেলে এসেছেন তাহলে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন। মনে মনে আল্লাহ কে স্বরণ করতে থাকেন মঈনুল মিঞা। বউ ভাবে পাঁচশ টাকা হবে মনে হয়, আহারে কিপ্টে বেচারার এতো টাকা গচ্ছা গেলো প্রথম শ্বশুর বাড়ি আসবার পথে। ভালোই হয়েছে আমি এতো করে ফল,মিষ্টি নিতে বললাম প্রথম শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে বলে তাছাড়া আমাদের গ্রামের নিয়ম নতুন জামাই প্রথম শ্বশুর বাড়ি আসলে আশেপাশের দশ/বারো বাড়ি ফল মিষ্টি বিতরণ করা। আমার কথা না শুনে ক্ষেত থেকে বড় বড় দুটো মিষ্টি কুমড়া এনে বললেন এসব নিয়ে আসবেন, আমি না বললেও শুনতেন না জন্য আর কিছু বলি নাই। কিপ্টে মানুষ যা বলে তাই করে। আমার হয়েছে জ্বালা, এ কার ঘরের বউ হয়ে আসলাম আমি ভাবতেই লজ্জায় মাথা হেয় হয়।
ময়না এসব ভাবতে ভাবতেই বিষন্ন মুখ আর ভগ্নহৃদয়ে বউ এর কাছে ফিরে এসে বলতে লাগলেন পাইলাম না রে মায়না পাইলাম না।বউ বলে যা হবার হইছে দুপুর যে গড়িয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি চলেন বাড়িতে যাই। উদাস মনে বউ এর কথায় সায় দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করেন স্বামী। দুপুর দুটো নাগাদ শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছালো মঈনুল মিঞা, বাড়ির সদর দরজার কাছে আসতেই তার নাকে বেশ মসলাযুক্ত ভুনা মাংসের সুগন্ধ লাগে। তিনি ঠিকভাবে বুঝতে পারলেননা এটা কিসের মাংস, আসলে জীবনে হাতে গোনা কয়েকবার মাংস খেয়েছেন তিনি তাই এটা কোন মাংসের সুগন্ধ সেটা বুঝতে না পারা তার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার।
শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করেই শ্বাশুড়ি মায়ের হাতে জামাই মিষ্টি কুমড়ার ব্যাগ টা দিতে দিতে বলেন, আম্মা আমার নিজহাতে চাষ করা মিষ্টি কুমড়া ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ সবজি এ বাড়ির সবার জন্য অনেক পুষ্টিকর খাদ্য এবং ভেজালমুক্ত হবে। ময়না’র মা আয়না বেগম জামাইয়ের কান্ড দেখে অবাক কি বলবেন বুঝতে পারছেন না, আচ্ছা বাবা বলে ব্যাগটা হাতে নিলেন। জামাইয়ের পাশে ময়না মাথা নিচু করে থাকে কোনো কথা বলে না। বাড়ির সকলে সেখানে উপস্থিত নতুন জামাই বিয়ের পর প্রথম এ বাড়িতে এসেছে বলে কথা। ফ্যালফ্যাল করে বড় চোখে সবাই ময়নার বর’কে দেখতে থাকে, ময়না কোনো কথা কয়না তার মনে হয় সবাই এখানে সার্কাস দেখতে জড়ো হয়েছে সে আরো বেশি লজ্জা পেয়ে ছোট বোনকে বলে তোর দুলাভাইকে ঘরের ভিতরে নিয়ে যা।
ছোট শালি দুলাভাইকে ঘরের ভিতরে বসায় পাখার বাতাস দেয়, দুলাভাই ঘরের চারিপাশে মাথা তুলে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব জিনিসপত্র পর্যবেক্ষণ করে। রান্নাঘরে ময়না মা’কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে আর বলে এমন কিপ্টে মানুষ দ্বিতীয়টা আল্লাহর দুনিয়ায় নাই আম্মা। এ কার হাতে তুলে দিলে তোমরা আমায়। আয়না বেগম মেয়ে কে সান্ত্বনা দেয় আর বলে জামাইকে তিনি উচিত শিক্ষা দিয়ে কিপ্টামি ছুটাইবেন এ নিয়ে ময়না যেন কোনো চিন্তা না করে একাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণ তার , ময়না এবার কান্না থামায়। এদিকে নতুন জামাই ঘরে বসে অপেক্ষা করছে কখন মাংস-ভাত খেতে পারবে, এতো গরম পড়ছে কেউ এক গ্লাস শরবত পর্যন্ত দিয়ে গেলো না এখনো আর বউ টাও বা তার কোথায়। ক্ষুধায় যে তার পরাণ জ্বলে, আর অপেক্ষা করতে পারছেনা মঈনুল মিঞা।
আরো কিছুক্ষণ পরে নতুন জামাইয়ের ডাক পড়লো খাওয়ার জন্য, ডাক শুনে মুখের মধ্যে বেশ উজ্জ্বল একটা ভাব আসলো জামাইয়ের। হাত মুখ ধুয়ে জামাই খাওয়ার ঘরে প্রবেশ করলেন আহ্ কতো সব লোভনীয় খাবারের সুগন্ধ তার নাক’টাকে অস্থির করে তুললো এই একটু সময়ের ভিতরে। শ্বাশুড়ি আয়না বেগম বলেন— আসো বাবাজী খেতে বসো এখানে, জামাই বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। শ্বাশুড়ি মা বেশ বড় একটা প্লেট রাখলেন জামাইয়ের সামনে কিন্তু একি ভাত-মাংসের বদলে কতগুলো পান্তাভাত প্লেটে আর একটা পিরিচে লবন,কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ দেখতে পাচ্ছেন মঈনুল মিঞা। আয়না বেগম মনে মনে বেশ খুশি জামাইয়ের অন্ধকার মুখখানা দেখে, যাক তার পরিকল্পনা বুঝি সফল হলো এতেই তার জামাইয়ের উচিত শিক্ষা হবে প্রথম শ্বশুর বাড়িতে মিষ্টি কুমড়া আনার ফলফল হাড়ে হাড়ে বুঝবে।
শ্বাশুড়ি মা বলেন — জামাই বাবা আমাদের অঞ্চলের নিয়ম নতুন জামাই বাড়িতে আসলে যে কয়দিন থাকেবে তাকে প্রতিবেলা এই পান্তা খাওয়ানো, পান্তা ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া যাবে না। এই কথা বলে শ্বাশুড়ি মা জামাইয়ের বিবর্ণ ও বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ আনন্দ পেলেন। যাক বাবা একেবারেই কিপ্টে জামাইকে তিনি শিক্ষা দিতে পারলেন সেই খুশিতে। তখুনি জমাই বেশ পুলকিত স্বরে বলেন ঠিকআছে আম্মা আমার কোনো সমস্যা নাই। তবে আমি যদি শুধু লবন-পান্তা খাই একয়দিন মরিচ,পেঁয়াজ বাদে তাহলে কি যাওয়ার সময় আমাকে তার বিনিময়ে পাঁচ টাকা দিতে পারবেন? শ্বাশুড়ি বেহুঁশ,,
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত