ভরসা

ভরসা
– ভাইয়া তোর জন্য যে মা পাত্রী দেখছে জানিস তুই? রিয়ার কথা টা আমার কান অবধি গেছে ঠিকই কিন্তু আমি কোনো জ্ববাব দিলাম না।
– অনু আপু জানে? ভাইয়া তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি। রিয়ার কথার জ্ববাব না দিয়ে শার্ট টা হাতে নিয়ে বের হয়ে আসলাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাসায় খুব একটা থাকা হয়না। তবে আজকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা ও দেইনি। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধার পর বাসায় ফিরলাম।
– কিরে রাহাত সারাদিন নাওয়াখাওয়া ছেড়ে কই ছিলি? ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে আজকে এক জায়গায় যাবো।
– মা তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
– হুম তোর সব কথা শুনবো, আগে হাত মুখ ধুয়ে আয় আমি খেতে দিচ্ছি।
– মা তুমি জানো আমি কি বলতে চাচ্ছি। কেনো এড়িয়ে যাচ্ছো।
– এড়িয়ে যাবো কেন? তবে তুই নিশ্চই জানিস আমি তোর জন্য মেয়ে দেখতেছি। আল্লাহর রহমতে ভালো একটা চাকরী পেয়েছিস এখন একটা লক্ষিমন্তর মেয়ে ঘরে আনার পালা।
– মা অনু খারাপ কোন দিক দিয়ে?
– শোন রাহাত ভালো মন্দ আমি তোর থেকে শিখতে যাবো না। ও মেয়ে বয়স তো কম হয়নি, ধরতে গেলে বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে কোন কালে। আমি এমন কোনো মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দেবো না।
– মা খেতে আয় আমি খাবার দিচ্ছি, কথাটা বলে মা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত। লাঞ্চের সময় ফোন আসলো অনুর।
– খেয়েছ?
– না খাবো ।
– আচ্ছা খেয়ে ফোন দিও।
– অনু….
– হুম কিছু বলবে?
– আচ্ছা পরে ফোন দিচ্ছি।
খেতে ইচ্ছা করছেনা আর। আচ্ছা অনু কে আমি কিভাবে জানাবো যে মা চাচ্ছেনা আমি ওকে বিয়ে করি। আচ্ছা অনু কি ভেঙে পরবে? না ওকে আমি কষ্ট দেয়ার কথা ভাবছি বা কিভাবে!
– হ্যালো অনু বিকালে আমি কাজ শেষ করে তোমার অফিসের সামনে আসব তোমায় ড্রপ করতে।
– হঠাত?
– কেন আসতে পারিনা?
– হুম। আচ্ছা এসো। অনুকে নিয়ে ধানমন্ডি লেকে আসছি। আসার পর থেকে কোনো কথা নেই দুজনের।
– রাহাত তুমি কি কোনো চিন্তায় আছো?
– না মানে….
– বলে ফেলো। এই মেয়েটার মাঝে অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে, কন্ঠের একটু উনিশবিশ হলেই বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে।
– না কিছুনা। আচ্ছা তুমি কি ঘুমাও না রাতে? চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।
– আজকে চোখে পড়লো?
– কি?
– না বললাম ঘুমাই তো। এম্নিতেই হয়ত এমন লাগছে। চলো আজকে উঠি মা আবার চিন্তা করবে এখনো ফিরলাম না।
অনুর হাত টা ধরতেই আমার কেন যেন খুব কান্না পেয়ে গেলো। ইচ্ছা করছে অনুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদি। কিন্তু ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। কোনো রকম নিজেকে সামলে নিলাম। অনুর কনিষ্ঠা আঙুল আমার আঙুল ছুঁয়ে আছে। সময় টা যদি বেধে রাখা যেতো তবে আমি এই সময় গুলো তে অনন্তকাল পাড়ি দিতে পারতাম।
অনুকে বাসা অব্ধি ছেড়ে আমি আর রিক্সা নিলাম না হাটতেছি আপন মনে। চিন্তাগুলো যেন একে একে মাথায় হুমরি খেয়ে পড়ছে। আচ্ছা মা তো একসময় অনু কে খুব পছন্দ করত। তাহলে এখন কেন ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করে না? অনুর বয়স বেড়েছে তাই!!
হ্যা বয়সের ছাপ টা হয়ত ওর চেহারায় পরেছে ঠিকই কিন্তু ওর মন, ওর ভালোবাসা দায়িত্ব তো লেশমাত্র কমেনি।
এই মেয়েকে আমি ধোকা দিবো কিভাবে? এই সেই মেয়ে যে আমার জন্য ডজন ডজন ভালো সম্মন্ধ রিজেক্ট করেছে। আমায় ভরসা করে বিশ্বাস করে এখনো আমার পথ চেয়ে আছে। কতবার বলেছিলাম, অনু আমার তো পড়াশুনা শেষ হয়নি, তারপরে ভালো চাকরী পাবো কি পাবো না। তুমি তো ততদিনে বুড়ি হয়ে যাবে অপেক্ষা করতে করতে। জ্ববাবে অনু প্রতিবার একই কথা বলেছে, “কেন বুড়ি কে বিয়ে করতে তখন বোধহয় তোমার আপত্তি থাকবে?” আমি তখন ওর চোখে খুঁজে পেতাম একরাশ ভালোবাসা বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। অনু বলত, এতো চিন্তা কিসের গো। তুমি আমি তো একসাথে পড়াশুনা শেষ করব তারপর দুজনে চাকরী করব, দেখবে দিব্বি চলে যাচ্ছে।
পড়াশুনা শেষ করলাম দুজনেই। তবে আমার আগে অনুর চাকরী হয়ে গেলো খুব ভালো একটা কোম্পানি তে।
তারপরেও অনুকে বললাম অনু এখন তো তুমি বাবা মার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নাও আর কত বলো।
আমি জানতাম বিয়ে নিয়ে অনুর সাথে ওর বাবা মার প্রায়ই ঝগড়া হত। অনু ওর বাবার থেকে এ পর্যন্ত কম কথা শোনেনি কোনো একসময় মার ও খেয়েছিল। তবুও অনুকে কিছুতে রাজি করাতে পারেনি। এখন মেয়ে নিজের ইচ্ছায় বয়স বাড়িয়েছে বিয়ে করেনি। বাবা মা এখন ওর দায়িত্ব ওর উপর ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্য এখন অনুর বাবা অনুর সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে না। এসব আমাকে অনু বলেনি। এসব জানতে পেরেছি অনুর ছোট চাচাতো ভাই অয়নের থেকে।
আমি অনেকবার অনুকে জোড় ও করেছিলাম ততবার মেয়েটা রাগ করে আমার সাথে কথা বলত না। যেদিন দেখা হত সেদিন আমার বুকে মুখ গুজে সে কি কান্না করত। তার পর ধীরেধীরে আমিও আর অনুকে কিছু বলিনা। আমি হয়ত অনুকে ঠিকই বলতাম বিয়ে করতে কিন্তু এ কথা বলতে আমার বুক টা কেঁপে উঠত বারবার। হাত পা বলহীন অসাড় হয়ে যেতো। এই অনু এপর্যন্ত আমার জন্য কম সেক্রিফাইজ করেনি। কতদিন কথা বলতাম না কাজের চাপে, দেখা করতে পারতাম না। কিন্তু কখনো রাগ করত না। কিন্তু আমি বুঝতাম ওর ও অভিমান হয় তবে আমি কাছে গেলে ও সব বুঝে যায়। অনুকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে যে কখন বাসার কাছে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।
– কিরে রাহাত আজকে দেড়ি হলো যে।
– কাজ ছিলো মা।
– তোর যে আর কি কাজ থাকতে পারে সে আমার জানা।
এই কুলক্ষী মেয়ে টা আমার ছেলের জীবন থেকে না যাওয়া পর্যন্ত শান্তি মিলবে না।
– এসব কি বলছ মা।
– ঠিকই বলেছি। নিজের তো বিয়ে শাদী হলো না, এখন আমার ছেলেটার ঘাড়ে চেপে বসে আছে।
আমি মায়ের কথায় আর কোনো জ্ববাব না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আমি জানি মা আরো কিছুক্ষণ অনুকে নিয়ে এসব আজেবাজে কথা বলেই যাবো। আচ্ছা আমাদের সমাজ টা এমন কেন? একটা ছেলে পড়াশুনা করে চাকরী পেতে পেতে ৩০-৩৫ বছর বয়স হয়ে যায়। তখন সে বিয়ের উপযুক্ত তাও অনেকের কাছে বিয়ের বয়স হয়ইনি। অথচ একই ভাবে একটা মেয়ে পড়াশুনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে নাকি তার বিয়ের বয়স পার হয়ে বুড়ি হয়ে যায়। সে নাকি তখন বিয়ের পাত্রী হিসেবে অযোগ্য। কেন এতো বৈষম্য?
না আমি মা কে ভালোবাসি সম্মান করি বলে মার দাবি মেনে নেবো তা কেন হবে? আমার নিজের কমিটমেন্ট এর ও তো একটা জায়গা রয়েছে। যে মেয়েটা আমাকে ভরসা করে, বিশ্বাস করে নিজের পরিবারের সাথে এত দিন লড়াই করে গেছে আজ আমি আমার পরিবারের কথা ভেবে তার প্রতি অন্যায় করতে পারিনা। মা এখন বুঝতেছে না কিন্তু কোনো একসময় ঠিকই বুঝবে। মা’র ধারনা পাল্টাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে একটা টিনেজ মেয়ের তুলনায় ৩০-৩২ বছরের মেয়ে সংসারের প্রতি বেশি দায়িত্বশীল হয়ে থাকে। কারন তারা বাস্তবতা থেকে অনেক কিছু শিখেছে। আর আসল কথা বয়স কোনো মেটার না, দুজন মানুষের সম্পর্ক বিশ্বাস ভালোবাসা তাদের সম্পর্ক কে এগিয়ে নিয়ে যায়। অনেক কষ্টেসৃষ্টে মাকে রাজি করাতে পেরেছি। হয়ত মা অনুকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেনা। তবে আমার বিশ্বাস অনু একদিন ঠিকই মায়ের মন জয় করে নিতে পারবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত