স্ত্রীসত্ত্বা

স্ত্রীসত্ত্বা
স্ত্রীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে এনির বাসায় এসেছি। আজকে সারাদিন এনির বাসায় থাকব,রাতে পার্টি করব।আমার স্ত্রী তার বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে। গেলে যাবে! আমার কি?? অসহ্য লাগে এই মেয়েটাকে! আমার স্ত্রী তরু।একদম ই ক্ষ্যাত একজন! তেমন একটা শিক্ষিত না। অনার্স শেষ করেছে। চাকরি করার মত সে এত স্মার্ট না। সারাদিন ধরে সে বুয়াদের মত কাজ করে যাবে এটাই তার স্বপ্ন! বাচ্চাদের ন্যাকড়া ধোয়া, রান্না করা, আমার বাবা-মা এর সেবাযত্ন করা, আমার লুংগি, আন্ডারওয়ার ধোয়া ছাড়া আর একটি কোন গঠনমূলক কাজ সে করতে পারেনা। রাত করে বাসায় ফিরে শুনি, বুয়ার বিল, কাগজের বিল, ডিসের বিল, বাসার কারেন্টের বিল, বাজারের খরচ,, মা-বাবা এর ঔষধের খরচ – এসবের হিসাব নিয়ে একটা বিশ্রী ছেড়া খাতা নিয়ে এসে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে! উফফফ জাস্ট অসহ্য!!
আমার বন্ধুবান্ধবদের স্ত্রী, স্মার্ট, শিক্ষিত, চাকুরীজীবি। তারা অফিস করে, পার্টি করে, ট্যুরে যায়, ফেসবুক ব্যবহার করে, ব্লগার, শপিং করে, যথেষ্ট ফ্যাশন সচেতন। তাদের সাথে ওয়াইন কিংবা বিয়ার খেতে অস্বস্তি হয়না, অথচ আমার স্ত্রীর সামনে বিয়ার খেতে গেলে মনে হয় আম্মার সামনে বিয়ার খাচ্ছি, সে তাকায়ই এমন ভাবে! ও সে মদ ডাকে!! ইজ দিজ এ জোক?? মানুষের স্ত্রীর সাথে পারফিউমের একটা মিষ্টি গন্ধ থাকে, পাশে বসলেই ভালো লাগে। আমার স্ত্রীর সামনে বসলেই অসহ্য লাগে, কারণ সে একটা মেক্সি অথবা ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে সারাদিন রান্না করবে না হয় ঘর মুছবে না হলে বাথরুম ধুয়ে আসবে, আমার একদম অসহ্য লাগে!! আচ্ছা মানুষের স্ত্রী এত ভালো লাগে কেন? আমার স্ত্রী এমন কেন???
এইজন্য আমার এনিকে পছন্দ। ও যদি সিংগেল পারসন তাও ভালো লাগে ওকে খুব।ও জানে আমার স্ত্রীর প্রতি আমি অখুশি। আসলে ও আমার যন্ত্রণা টা বোঝে। আমাকে সে প্রপার টাইম দেয়। আর তরু??? সে একটা টোটালি গৃহিণী মহিলা!! অসহ্য লাগে!!! এই অসহ্য মহিলাকে ডিভোর্স দিয়ে আমি এনিকে বিয়ে করব।এনি স্মার্ট মেয়ে। আশা করি আমার সংসারের হাল ধরবে ভালো করে। মূলকথা, তরুর চেয়ে অনেক ভালো ভাবে। রাত ২টা বিশ। আমরা ৮ জন মিলে পার্টি করছি এনির বাসায়। এনিকে সুন্দর লাগসে বেশ। হাল্কা ফিনফিনে একটা কুর্তি পড়েছে। ও যদিও খুব মাতাল অবস্থায় আছে। আমি খুব অস্থির হয়ে আছি। কেন জানি পার্টিতে উপস্থিত হয়েও মনোযোগ দিতে পারছিনা।হুট করে আমার ফোন বাজল। আমার বাসার নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ফোন টা ধরলাম। ফোনের ওপাশ থেকে আমার মেয়ে তুনির গলা। খুবই ক্লান্ত ও কাতর গলা।
-ও বাবা!
-কি হয়েছে মা?
-মা কোথায়? আমার ভয় করছে।
-ওমা?? দাদি কোথায় তোমার?? এত রাতে জেগে আছো কেন??
-বাবা, দাদীন আমার পাশে। আমার মা লাগবে, তুমি কোথায়! আমার ক্ষিদে পেয়েছি! ও বাবা মা কোথায় চলে গেল!
ভয়ংকর রকমের মেজাজ খারাপ করতে যাচ্ছিলাম তরুর উপর পরে হুট করে মনে পড়ল, আমি আজ সকালে তরু কে বের করে দিয়েছি। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল একদম। বললাম আজকে ফিরবনা। মহিলা এসে ঘ্যানঘ্যান করছে
-আজকে বাসায় থাকো প্লিজ।তুনির খুব জ্বর। আমি একা সামাল দিতে পারবনা, সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখাতে হবে ওকে।
আজকে যাবেনা কোথাও। আরেহ কেমন কথা এসব?? আমি কি মেইড ঘরের?? অফিস থেকে কোথাও যেতে পারবনা.? প্রতিদিন মহিলাটা কিছুনা কিছু একটা বলবেই!। বেশি ঘ্যানঘ্যান করছে দেখে চায়ের কাপ নিয়ে ঢিল ছুড়ছি। চি ৎকার করে বললাম
– তোমার ত কোন কাজ নাই এসব কাজ ছাড়া তুমি করো ফালতু!! আমার বন্ধুদেরকে কথা দিয়েছি।তোমার মত বেকার বসে থাকিনা বাসায়। চাকরি করি।রোজগার করি। অফিস থেকে এসে এসব প্যাচাল ভালো লাগে নাহ।প্লিজ আমাকে মুক্তি দাওও। বাপের বাড়ি যাওও।সেখানে গিয়ে কৃতিত্ব দেখাও। আমার সংসারে এসব দেখাবেনা।
– কী? এটা কি আমার সংসার না?
-না। বাসা আমার, সংসার আমার। তোমার এত অধিকার আসে কোথা থেকে?? আমি ঘরে কর্তা, যা বলব তাই।
-আর আমি ত তোমার সংসারে খেটে মরি।
-কে মরতে বলে??তোমার এসব কাজ অন্য কোন ঝি এসেও করে দিবে। এত বড় কিছু করো না তুমি!!
-কী বলছো এসব! মাথা ঠিক আছে?
-জাস্ট শাট আপ এন্ড গেট লষ্ট!!
-কি?
-হ্যাঁ, আমার বাসা থেকে এখন বের হও। আনকালচারড ওমেন!!তরু ঘন্টা খানেক এর মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেল বাসা থেকে। যাক!! ষ্টুপিড!! ফোনের ওপাশ থেকে আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে এলো আমার। আমি তুনিকে বললাম
-বাবুই, দাদিকে ফোন টা দাও ত মা
– এই নাও।
– আম্মা?
-কিরে? আইজা আইবি না? বউরে বাইর কইরা দিলি! মাইয়াটার কি বেদম জ্বর! মাইয়াডা সন্ধ্যাতন কানতেসে!!
-আম্মা, এত কথা কইওনা, তোমার বউ এর কি কোন দায় নাই?? ও গেসে ক্যান??
– ও যায়নাই বদপুলা! তুই বাইর কইরা দিছোস!!আমি মানা করছিলাম যে বউয়ের লগে এমন করিছ না, মাইয়া টা সারাদিন আমাদের জন্য খাটাখাটনি করে।
-আম্মা থামো তো!! সারাদিন বউ বউ!! ক্ষ্যাত মাইয়া একটা!
– ও ক্ষ্যাত মাইয়া বইল্লাই তোর মত বদপুলার মায়েরে বাপেরে এতদিন দেইখা রাখছে! আর তুই এক শিক্ষিত ইসমার্ট হইছস,লায়ক হইয়া অসুস্থ মাইয়ার খবর টাও জানোস না! কথাটা খুব গায়ে লাগল। ফোন রেখে রেডি হচ্ছি বাসায় যাব। এনি রুমে এসে বলল,
-চলে যাও কেন?
-এনি, আমার মেয়েটা খুব সিক!
-তো?? তোমার বউ কে বলো টেক কেয়ার করতে!
-ও বাসায় নেই।
-ও মাই গড! সেও কি তোমার মত??
-কি?
-এখন যেতে পারবেনা। আজকে সারারাত তুমি আমাকে দিবে বলে কথা দিয়েছো
-এনি আমি সরি, কিন্তু আমার মেয়ে….
– প্লিজ, রাবিশ কথা বলো না, এই একটা পেইনফুল মেয়ের জন্য আমি তোমাকে হাতছাড়া করতে চাইনা
– এনি, ও আমার মেয়ে!! ও বিয়ের পরে তোমার ও মেয়ে হবে!!
– কি? অসম্ভব! কোথার না কোথার মেয়ে,সে আমার! ইম্পসিবল!! আমি ত আমার কাছে রাখবনা!
– তুমি নেশার ঘোরে আছ!!
– নো! নেভার। আই এম প্রেজেন্ট, তোমার জন্য একটা ই শর্ত, মেয়ে নিয়ে আমার কাছে গছাতে আসবেনা।তুমি একলা আসবে। আর মেয়েটাকে কোন অর্ফানেজে দিয়ে আসবে অর তোমার ব্লাডি ওয়াইফের কাছে রেখে আসবে!!
-আর ইউ ম্যাড!! টোটালি সিক ওমেন!
আমি এনিকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। বাইক টা স্টার্ট দিলাম।একটা মুহুর্তের জন্য নিজেকে এত স্বার্থপর মনে হচ্ছে। তরু এত আবেদনময়ী না হলেও সে একটা স্ত্রী এইমুহুর্তে মনে হচ্ছে। আমাদের বিয়ের ৭বছরে সে আজ অব্দি আমাকে একটা গালি দিয়ে দেখেনি। আমার ঘর, আমার মা আমার বাবা, আমার সন্তান কোন কিছু নিয়ে আমার এই বিবাহিত সাত বছরে ভাবতে হয়নি। আজকে আমি এই সেলফিশ এনির জন্য ওর সকল রকমের কন্ট্রিবিউশন ভুলে ওকেই বলেছি বের হয়ে যেতে!! বাসায় ফিরতে ফিরতে ৩টা ৪০. ফিরেই দেখি তরু তুনিকে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। মা বাবা ঘুমোচ্ছে। আমি খুব স্বস্তি বোধ করছি। আমি বারান্দায় গিয়ে বসলাম। তরু তুনিকে ঘুম পাড়িয়ে এসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।।আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। তরু বলল
-আমি যেহেতু অনার্স শেষ করেছি। চাইলেই একটা চাকরি করতে পারতাম।অনেকেই আছে যারা ঘর ও করে আবার অফিস! কিন্তু বিয়ে র পরে তোমার সংসারে আসার পরে মনে হয়েছিল আমি দুটো সামলাতে পারবনা।যদি কখনও পারি তবে ঘরের বাইরে ব্যস্ত হব কিন্তু আপাতত সংসার টা কে বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেই। এইজন্য আমি গৃহিণী পেশাটা বেছে নিয়েছি। মা হয়েছি। বউমা হয়েছি। তোমার যে আমার ঘামের গন্ধের চেয়ে অন্য মেয়েদের পারফিউম বেশি ভালো লাগে তা আমি জানি, জানতাম।বলিনি কখনও। কারণ এটা আমার জন্য একটা লজ্জার!! তাই ব্যাপার টা ছেড়ে দিয়েছি। আজকে আমি মা কিংবা বউমা না হলে পারফিউম দিয়ে ঘুরতাম। কিন্তু আমি তোমার আমাকে দেয়া সংসার টার দায়িত্ব নিয়েছি।বললে না, বাসাটা তোমার? বাসাটা আমার। বিয়ের পরে এই বাসায় সবকিছু সাজানো থেকে গোছানো সব আমি করেছি,তার দায়িত্ব নিয়েছি, তাই এই সংসার টা আমার।
তুমি অন্যমেয়ের পারফিউম পছন্দ করার মত অন্যায় করতে পারো কিন্তু আমার বিবেক তোমার সাথে অন্য একজন পুরুষের তুলনা করতে বাধা দেয়। তাই করিনি। আমি মনে মনে প্রেমিকা কিন্তু বাস্তবে একজন মা, তোমার বাবা-মা এর বউমা সাথে তোমার স্ত্রী। তাই সবসময় প্রেমিকা সুলভ আচরণ আমাকে মানায়না। এসব ভেবে যদি মন থেকে ভালবাসতে পারো, আমার ভেতরের স্ত্রী সত্ত্বা কে যদি মেনে নিতে পারো তবেই তোমার সাথে এক ছাদের নিচে থাকার কথা আবার ভাববো। এখন আর ভাবতে চাইছিনা। মেয়ের জ্বর কমেছে কিন্তু আবার আসবে। ডাক্তার দেখিয়ে নিও কাল্কে। তরুকে বললাম
– আমার সাথে থাকা যায়না?
-যায়, তবে ক্ষমা করা যায়না! ভালোবাসা যায়না!
তরু চলে গেল ঘরে আমি অসহায় হয়ে বসে রইলাম! স্ত্রী থাকলেও কেন স্ত্রীসত্ত্বাকে মেনে নিতে পারলাম না এতবছর এর জন্য অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে!! সংসার টা আসলে একরকমের প্রেম যদি তা দুজন আবিস্কার করতে পারে তবে! যে পারে না এটা আবিষ্কার করতে সে আমার মত হয়ত অপরাধী আর অসুখী রয়ে যায়।আর এ পারে সে ই তার ঘরের দেয়ালে একটা পারফেক্ট ফ্যামিলি ফটো টানাতে পারে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত