বিয়ের সাতদিনের মাথায় স্বামীর জন্য বাসর সাজাচ্ছি।হ্যাঁ আজ আমার স্বামীর বাসর।তবে আমার সাথে নয়, আজকেই বিয়ে করে আনা ওনার দ্বিতীয় বউয়ের সাথে।ওরা বাইরেই বসে বিয়ের পরের সকল রীতি পালন করছে। বাসর সাজানোর দায়িত্বটা আমাকে কেউ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়নি। আমি নিজে থেকেই বলেছিলাম ওনার বাসর আমি সাজিয়ে দেব।
আমি রিসা।আমার বয়স বেশি নয়। বলতে গেলে বড়জোর ১৬ কি ১৭ হবে হয়তো। এবার ক্লাস টেনে উঠেছি। তবে ক্লাস টেন শেষ করার মতো ভাগ্য আমার ছিলোনা। তাই বিয়ে হয়ে গেল।একটা মেয়ে কখনই চাইবে না পড়াশুনা,খেলা,আড্ডা, বন্ধুত্ব এসব কিছু করার সময়ে বিয়ে করতে। আমিও চাইনি। কিন্তু আমার চাওয়া না চাওয়াতে তো বাড়ির মানুষের ধ্যান নেই। গরীব ঘরের মেয়ে আমি। তাই বোধ হয় এমন দশা আমার। আমার নিজের মা নেই। তবে সৎ মা আছেন। তিনি আমায় ভালোবাসা কম ঘৃনা বেশি করেন। তবুও ওনাকে মা ডাকতে আমার অনেক ভালোলাগে। অন্য কোন সৎ মা হলে হয়তো বয়স ১২ হতে না হতেই বিদায় করে দিত, সেখানে উনি আমায় ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত লালন পালন করেছেন।আমার নিজের মা আমার জন্মের সময়ই মারা গেছেন। মায়ের মারা যাওয়ার কারনটা বাবা আমার ওপরেই চাপান।অবশ্য আমারও তাই মনে হয়।যদি আমি না জন্মাতাম তাহলে মা বেচে থাকত এবং আমায় এসব কষ্ট সহ্য করতে হতোনা। কিন্তু আসলে কি ভাগ্য জিনিসটা খুবই অদ্ভুত। যার ভালো তার সবকিছুতেই ভালো।আর যার খারাপ তার পুরো দুনিয়াটাই খারাপ৷
এইতো দশদিন আগে স্কুল থেকে ফিরে এসে জানতে পারি আমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিষয়টা আমার কাছে খারাপ লাগলেও মেনে নিতে হয়েছিল৷ বাড়ির কারও ওপর দিয়ে কথা বলাটা আমার মতো মেয়েদের শোভা পায়না। আমার সৎ বোনের কাছে জানতে পেরেছিলাম ছেলেটা নাকি সরকারি চাকরি করে। অনেক টাকাপয়সা রোজগার করে। বিনা টাকাপয়সায় বিয়ে করতে চায়। তাই বাবা মা রাজি হয়ে গেছে৷ আমি দেখতে ততোটা সুন্দরী নই।শ্যামলা গায়ের রং।চেহারাটাও তেমন ভালো না। ছেলেটি নাকি দেখতে অনেক ভলো। কথাটি শোনার পর থেকে ভাবতে লাগলাম তাহলে আমায় কেন বিয়ে করতে চাইছেন উনি?।কারও কাছেই এ প্রশ্নের জবাব পেলাম না।তাই বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ের পিড়িতে বসে গেলাম। খুব ভালোভাবেই বিয়েটা হয়ে গেলো। বাবা মাকে ছেরে চলে আসার সময় চোখ দিয়ে জল গড়ালো না। কারনটা হয়তো এটাই, আজকের কষ্টের চেয়েও হাজারও কষ্ট এতোদিন পেয়ে এসেছি ।বাবা,মা,সৎ বোন সবার মুখেই একটা আনন্দ দেখতে পেলাম। আমাকে অবশেষে বিদায় করা হয়েছে এই আনন্দ হয়তো। বাসর রাতে ওনাকে দেখলাম।মাশাআল্লাহ অনেক ভালো দেখতে। ভেবে ছিলাম বাবার বাড়িতে শান্তি পাইনি,কিন্তু অন্তত শশুড়বাড়িতে শান্তি পাব। কিন্তু নাহ।তা আর হলোনা। আমার বিয়ে করা স্বামীকে সালাম করতে গেলেই আমার থেকে দুরে সরে গেলেন।ও বলতে থাকলেন,
-দেখুন,আমি আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাই। আমি আপনাকে আমার পরিবারের চাপে এসে বিয়ে করেছি।আমার কখনোই এ বিয়েতে মত ছিলোনা।আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি এবং তাকেই বিয়ে করবো। আমার কাছে স্ত্রীএর অধিকার চাইতে আসবেন না।আপনাকে আমি সাতদিন পর ডিভোর্স পেপার রেডি করে এনে দিব। আপনি সাইন করে দিবেন।ডিভোর্সে পর আপনি চাইলে এ বাড়িতে থাকতে পারেন,আমি এ বিষয়ে আপত্তি করবোনা।সাতদিনের মাথায় আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করে আনবো। সেদিনই আমাদের ডিভোর্সটা হয়ে যাবে।এখন অনেক রাত হয়েছে। (একটু থেমে)আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি গেস্ট রুমে যাচ্ছি। শুভ রাত্রি।। কথাগুলো শোনার পর আমি আমার মাঝে ছিলাম না।কোন একটা ঘোরের ভেতর ছিলাম।মনে হচ্ছিল সবকিছু মিথ্যা। ঘোর কেটে গেলেই আবার সবঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু আসলে সত্যকে তো পাল্টানো যায়না। সেই রাতটি নির্ঘুম কাটিয়েছিলাম আমি। আমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন জাগছিল, ভাগ্য কি এতোটাও ভালো হয় কারও?যে বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামী ডিভোর্সের ওয়াদা করে ফেল।
-রিসা? কারও ডাকে চমকে উঠলাম।পেছনে তাকিয়ে দেখি উনি ওনার সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
আমার দিকে উনি একটি ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-ডিভোর্স পেপারটা। আমি সাইন করে দিয়েছি। তুমিও সাইনটা করে দাও। আমি একবার ফাইলের দিকে,একবার ওনার দিকে তাকিয়ে ফাইলটা হাতে নিলাম।টেবিলের ওপর থেকে কলমটা নিয়ে ফাইলটা বের করে সাইন করে দিলাম।
একফোটা চোখের জল কাগজের ওপর পড়লো।বুকের মাঝের কষ্টটা বেড়ে গেল।হয়তো এটাই আমার জীবনের কাহিনি। পেছন থেকে জোড়ে চিল্লানোর আওয়াজে ঘুরে তাকালাম। দেখি বাড়ির সবাই এখানে। এরই মাঝে উনি এসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলামনা কি হচ্ছে। সবাই আনন্দভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিজেকে ওনার থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। তবে পারলাম না। উনি আরও শক্ত করে আমায় জরিয়ে ধরলেন। এসব দেখে সবাই মুখ চেপে হাসছেন।ওনার সদ্য বিয়ে করা বউটিও ওনাদের সাথে দারিয়ে এসব দেখে হাসছেন।উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে দু গালে হাত রেখে বললেন,
-কি ভাবছো জান? ওনার এ কথাটি শুনে মনে একটা শান্তির বাতাস বয়ে গেল। তবুও সেটা মুখে প্রকাশ করলাম না।ওনাকে বললাম,
-আমি এখন যাই। আপনারা বিশ্রাম করুন। উনি একটানে আমায় নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
-বিশ্রাম তো করবোই৷ বিয়ে করতে যা ধকল গেছে উফফ বাবা।কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছো?
-আমার যেখানে যাওয়ার কথা, ছাড়ুন আমাকে। কি হচ্ছে টা কি এসব?
-আমি কি পরের বউকে জড়িয়ে ধরেছি যে ছাড়বো?আর শোন আমাদের তো বাসরও হয়নি। ছাড়ার তো কোন কথাই আসে না।
-দেখুন এসব ঠিক নয়।আপনার এবং আমার ডিভোর্স হয়ে গে..(থামিয়ে দিয়ে ওনার দ্বিতীয় বউ বলল)
-ভাবি, তোমার এসব কথা বলা স্বাভাবিক। আসলে ভাবি এসব আমাদের প্লান ছিল(সবাই হেসে দিয়ে) আমি অবাক হয়ে বললাম,
-প্লান?
-হ্যাঁ প্লান,তুমি যে পেপারে সাইন করলে সেটা আসলে রেজিসট্রি পেপার।তোমার সার্টিফিকেটে তোমার বয়স সাতদিন কম ছিলো তাই সেদিন তোমাদের রেজিসট্রিটা বাকি ছিলো। আজ তোমার বয়স আঠেরো পুর্ন হলো।এসব করার জন্যই এতোনাটক করতে হলো।আর হ্যাঁ আমি তোমার জ্বা, সতীন না বুঝলে?আজ তোমার এবল আমার দেওরের বাসর। বলেই সবাই হেসে দিল। এদিকে আমি এসব শুনে অবাকের শীর্ষেে পৌঁছে গেছি। উনি আমায় জরিয়ে ধরে বললেন, ভালোবাসি। কথাটি শুনে চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে গেল।
আজ আমাদের বিয়ের ছয় বছর পূর্ণ হলো। এই ছয় বছরে বাবার বাড়ি থেকে দু একবার বাবা এসেছিল আমায় নিতে। আমিই যাইনি।আমার স্বামীও আমায় যেতে দেননি।আমার আফসোস ও নেই কোন। ওনার মত স্বামী থাকতে জীবনে অন্য কিছু আশা করিনা।এতো ভালোবাসা,এতো আগলে রাখা, এতো খেয়াল করার মতো স্বামী হয়তো খুব কম মানুষেরই ভাগ্যে জোটে। আমাদের একটা মেয়ে আছে চার বছরের। অনেক সুখে আছি আমি। ভাগ্য মনে হয় আমার সাথেই ছিল,আমিই সবসময় ভাগ্যের দোষ দিয়ে এর থেকে দূরে থেকেছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প