” বউমা,ও বউমা!!”
“জ্বী আম্মা বলেন”
“আমার মাথাটা খুব ধরেছে একটু তেল লাগিয়ে দাও তো”
” আম্মা,রান্না তো শেষ হয়নি”
” কি বলো? এতো সময় লাগে রান্না করতে? এখনই তো পলাশ বাড়িতে আসবে,যাও যাও রান্না শেষ করো”
” আচ্ছা আম্মা,আমি রান্নাটা শেষ করে আসছি”
“হু”
মাথা ব্যথা তেমন একটা নয়,তবুও পলাশকে ফিরতে দেখে সাহেরা খাতুন দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বললেন,
“উফফ রে,,মাথাটা মনে হয় এবার ছিঁড়েই যাবে,বয়স হয়ছে বাপু।একটু সেবা যত্ন পামু কই?” তাৎক্ষনিক পলাশ দৌড়ে গিয়ে বললো,,
” কি হয়ছে মা? কোথায় ব্যাথা?”
” সকাল থেকেই মাথা ব্যাথা রে বাজান,বৌমারে বললাম একটু তেল লাগিয়ে দিতে তা তার নাকি সময় নাই,একা বেচারী তো সবদিক সামলে উঠতে পারে না”
” বাকী সব চুলোয় যাক,আমার মা অসুস্থ, আর ওর এতো কিসের কাজ?”
” থাক বাবা,চিল্লাপাল্লা করিস না,পরের মাইয়া কি আর সব বুঝে?” হাঁকছেড়ে লাবন্যকে ডাকে পলাশ।ছুটে আসে লাবন্য।
” তোমাকে মা তেল লাগিয়ে দিতে বলছে দাওনি কেন?” মাথা নিঁচু করে লাবন্য বললো,,
” রান্না শেষ হলে দিবো বলেছিলাম”
” রাখো তোমার রান্না,আমার মায়ের খেয়াল রাখবা আগে”
“আচ্ছা”
” বাজান একটা কথা কমু?”
” কও মা”
” বুঝোস তো বয়স হয়ছে, কাজকর্ম তেমন করতে পারি না,আমার মনে হয় বৌমা এজন্য একটু রাগ হয়”
” সে কি? লাবন্য রাগ হবে কেন?”
” না, ভাবতে পারে তারে দিয়াই সব করায়।সেইজন্য তো কয়,, বুড়ির বয়স হয়ছে মরে না কেন”
কথাটা বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সাহেরা খাতুন।রক্তচক্ষু নিয়ে পলাশ বললো,,
” লাবন্যের এতো সাহস, ও তোমারে এ কথা বলে?”
” না বলে নাই,,তবে বয়স তো হয়ছে,,টুকটাক সবই বুঝি”
সেদিন অকথ্য ভাষায় লাবন্যকে প্রহার করেছিলো পলাশ।আর ঘরের কোণে মিটিমিটি হেসেছিলো সাহেরা খাতুন।তার মনে একটায় খুশি,, ” তার ছেলে আগের মতোই আছে” সকালের খাবার খেয়ে যখন পলাশ কাজে চলে গেলো, হঠাৎ সাহেরা খাতুনের মুখ থেকে রক্ত বের হতে লাগলো হকচকিয়ে গেলো লাবন্য ও সাহেরা খাতুন,চিৎকার করে সাহেরা খাতুন বলতে লাগলেন,, ” ওরে মুখপুরী,আমার ছেলে আমার কথা শুনে বলে সিদ্ধান্ত নিলি, আমারে প্রানে মেরে ফেলবি? বিষ কইত্তে আনছিস” চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে লাবন্যের,কি হচ্ছে তা সে কিছুই জানে না।গ্রামের সবাই যখন চেঁচামেচিতে বাড়ির উঠোনে উপস্থিত, তখন ভীড় ঠেলে সরোয়ার ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে বললেন,,” দেখি সরেন মিয়া রা,আমারে দেখতে দেন” কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষন করে বললেন,, ” কোথায় শুনছো,,বিষ খাইলে মুখ দিয়া রক্ত আসে? দাঁতের গোড়া থিক্কা রক্ত পড়ে,আর তুমি কও বউ বিষ দিছে? সেদিনও মুখের ওপর শাশুড়িকে কিছু বলেনি লাবন্য। নিয়মিত স্বামী ও শাশুড়ির প্রহার শুনেই দিনকাটে লাবন্যের।চোখের জলে বালিশ ভেজালেও মনের কোণে একটায় আশা,,
” একদিন সব বদলাবে,তার শাশুড়িও তাকে ভালোবাসবে” দিন যায় দিন আসে,,সুখের মুখ আর দেখা হয় না।তিনবেলা খাবারের কমতি না থাকলেও মনের শান্তি ছিলো না লাবণ্যের। হঠাৎ একদিন সাহেরা খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়লেন।অসুস্থতা চরম পর্যায়ে চলে যাওয়ায় পলাশের বোনদেরও খবর দেওয়া হলো। মৃত্যুসজ্জায় যখন পলাশেরা বোনেরা মায়ের জন্য আকুতি মিনতি করে কাঁদছে তখনও সাহেরা খাতুন ব্যাকুল হয়ে কিছু খুঁজে চলেছেন বলে মনে হচ্ছে।পলাশ সহ তার বাকী চারবোনেরা মায়ের সামনে গিয়ে কথা বললেও সাহেরা খাতুনের অস্থিরতা কমছে না।পাশের বাড়ির একজন বৃদ্ধা বললেন,,বৌমারে দেখতে চায় মনে হয়।পলাশের বোনেরা রেগে গিয়ে বলে,,
” ওই মাইয়ারে কেনো দেখবে? সারাজীবন আমার মা’রে তো কম কষ্ট দেয় নাই।এখন মরণের আগে ওরে আনতে হইবো এইখানে” দরজার আড়ালে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে লাবন্য।ছোট বেলায় নিজের মা’কে হারিয়ে সে মামীর কাছে বড় হয়েছে।মায়ের আদর কেমন হয়,তা সে জানে না।শাশুড়ি তাকে যতই প্রহার করুক,সে সবসময় মন থেকে ভালোবেসে গেছে সাহেরা খাতুনকে।কখনও খারাপ ব্যাবহার তো দূরে থাক,আড়চোখে দেখেনি পর্যন্ত শাশুড়িকে।অতঃপর পলাশের অনুরোধে লাবন্যকে সাহেরা খাতুনের পাশে এনে বসানো হয়।তখনই সাহেরা খাতুনের চোখ বেয়ে দু’ফোটা জল বেয়ে পড়ে।লাবন্যের হাতে হাত রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সাহেরা খাতুন।বাড়ির পাশেই শায়িত করা হয় তাকে।
শুক্রবার ভোর রাত,, তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেই ফজর হওয়ার অপেক্ষা করছে লাবন্য।পাশেই পলাশ ঘুমাচ্ছে। আজান হতেই লাবন্য পলাশকে ডেকে একসাথে সালাত আদায় করলো। সালাত শেষে লাবন্য বললো,, “মায়ের কবরটা জিয়ারত করবা আজ?” সম্মতি জানিয়ে দুজনে মিলে কবর জিয়ারত করে আসলো।ঘরে ফিরে পলাশ বললো,, ” তোমার সাথে তো মা কত খারাপ আচরণ করছে, আমিও করেছি,কখনও বিরক্ত হওনি কেনো? আর এখনো তুমি আমার মা’কে কতটা ভালোবাসো,,কেনো?”
” আমি জন্মের পর মায়ের ভালোবাসা পাইনি,মনে প্রানে তোমার মা’কে মা বলে জেনেছি।হয়তো সে আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিলো না।এটা আমারই দোষ,আমি কেনো তার মনের মতো হতে পারলাম না? মনে হতো,,একদিন আমি মায়ের মনের মতো হয়ে উঠবো,মায়ের ভালোবাসা পাবো,কিন্তু সে আশা আর পূর্ণ হলো না।” পলাশের চোখে পানি,বললো,,
” আমি ভাগ্যবান লাবণ্য, তোমার মতো কাউকে পেয়ে”
” একদমই না,আমি ভাগ্যবতী,তুমি আল্লাহকে আমাকে এরকম একটা পরিবার দিয়েছেন,মায়ের সাহচর্য দিয়েছেন।”
নৈতিক শিক্ষা: কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে এবং ধৈর্য্য ধারন করলে,এর প্রতিদান অবশ্যই কোনো একদিন পাওয়া যায়।দুনিয়ার সবথেকে সহজ কাজ অন্যের কাধে দোষ চাপানো,,অথচ নিজেদের ভুল আমরা কেউ দেখি না।শাশুড়ি এটা করলো,ওটা করলো বলা সহজ,,ভেবে দেখুন আপনি কি করেন?
গল্পের বিষয়:
গল্প