আম্মা

আম্মা
আম্মা বাসা থেকে হুট করে পালিয়ে গেলেন। মাঘ মাসের তের তারিখ। এই তের তারিখ খুব ভোর বেলায় আম্মা হুট করে উধাও হয়ে গেলেন। সকাল দশটা থেকে বিনুর অংক পরীক্ষা। আম্মা যাওয়ার আগে বিনুর জন্য বেগুনের তরকারি রান্না করে গিয়েছেন। গতকাল রাতে বিনু আম্মাকে বেগুনের তরকারি রান্না করতে খুব করে বলেছিল। বেগুনের তরকারি ছাড়াও আব্বা ও আমাদের জন্য মুগ ডাল দিয়ে খিচুড়ি আর শুকনা মরিচের ভর্তা করে টেবিলে রেখে গিয়েছেন।
খুব সকালে বিনু পড়তে বসে। আজও বসল। কী কারণে যেন আম্মাকে ডাকতে গিয়ে দেখে বাসার কোথাও আম্মা নেই। এমনটা আমরা আগে কখনো দেখিনি। কখনো বলতে কখনো দেখিনি। একটু আধটু রাগ করে এত সকালে কখনো আম্মা বাড়ির বাইরে যাননি। আম্মাকে সকালে বাসায় দেখব না এটা কেমন করে হয়। আব্বাও ঘুম থেকে উঠে বাড়ির আশে পাশে দুই এক জায়গায় খোঁজ করল। আম্মা কোথাও নেই। আমার বড় মামার বাসায় খবর পাঠানো হলো। মাইল দুয়েক পর বড় মামার বাসা।
বড় মামার বাসায় খোঁজ নিতে গেল আমার বড় ভাই দিদারুল আলম। আব্বা জোর করে পাঠালেন। এই নিয়ে বড়ো ভাই বেশ বিরক্ত। দিদার ভাইয়ের সকালে খুব দরকারী একটা ক্লাস আছে। রাতদিন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকা দিদার ভাই বাসার কাজ কর্ম খুব একটা করতে পছন্দ করেন না। দিদার ভাই পড়েন ইউনির্ভাসিটিতে। ভীষণ ভালো ছাত্র। মেট্রিকে স্ট্যান্ড করেছেন। ভালো ছাত্র বলে আব্বা আম্মাও তার পড়ালেখায় কোন ব্যাঘাত করেন না। দিদার ভাই আম্মার উপর রাগ করে গজ গজ করতে করতে বড় মামার বাসার দিকে রওনা দিলেন। আমরা সবাই নিশ্চিত ছিলাম আম্মা বড় মামার বাসায়। কিন্তু দিদার ভাই খবর আনল আম্মা সেখানে যাননি। বড় মামার বাসায় নেই শুনে এবার আমরা সব ভাইবোন একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আব্বা কে বেশ অস্তির লাগছে। যদিও তিনি বেশ রাগী মানুষ। সব সময় রাগী রাগী ভাব নিয়ে থাকলেও এখন তিনি বেশ শান্ত। তবে তার চেহারায় অস্তিরতার একটা রেশ পড়েছে।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। আম্মার কোন খোঁজ এখনো পাওয়া গেল না। আমরা চার ভাইবোন এখন ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তামিম কাঁদছে। যদিও সে অল্পতেই কাঁদে। তবে আজকে তার কান্না দেখে আমাদেরও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সকালে বড় ভাই দিদারুল আলম একটু আধটু আম্মার উপর বিরক্ত হলেও এখন বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। চারিদিকে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। ছোট মামাকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি। আমাদের বিশ্বাস ছোট মামা আসলে আম্মার একটা খোঁজ পাওয়া যাবে। ছোট মামা এসে গেলেন সন্ধ্যার আগেই। এসেই বাড়িতে হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। সবাইকে খুব বকাঝকা করছেন। খুব বকা ঝকা। মামা বললেন, এই তোদের সংসারে আমার বোন টা না থাকায় ভালো। তোরা সবাই স্বার্থপর। তোরা সবাই। সারাটা দিন বোনটা আমার এই সংসারের জন্য দাসির মত খেটে গেল। তোরা সব নবাবজাদা হয়ে আমার বোনটার উপর এটা সেটা করে গেলি। আমি সব জানি। সব জানি। একদম ঠিক আছে। তার আরো আগে পালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
ছোট মামা কথাগুলো যে বেশির ভাগ আব্বাকে শোনাচ্ছিলে তা আমরা বুঝতে পারি। আব্বা চুপ করে আছেন। যদিও আম্মা আরো অনেকবার রাগ করে কাউকে কিছু না জানিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন। তবে সেটা ঐ বড় মামার বাসা অবধি। আম্মা বড় মামার বাসায় গিয়ে এমন ভাব করেন যেন কিছুই হয়নি। মামা বাড়ির কেউ বুঝতেই পারে না আম্মা বাড়ি থেকে রাগ করে গিয়েছেন। আর প্রতিবার সন্ধ্যা হলে আম্মা ঠিকই নিজে থেকেই বাসায় ফিরে আসেন। মাঝে মাঝে আমি গিয়ে নিয়ে আসি। অথচ আজ আম্মা কোথায় যে গেল আমরা কেউ জানিনা।
রাত হয়ে আসল। ছোট মামাসহ আমরা সবাই বসে আছি। হঠাৎ ছোট মামা বলে উঠল, এই দিদার চল তো। আমার মনে হয় বুবু একটা জায়গায় থাকতে পারে। আব্বা সাথে যেতে চাইলেন কিন্তু ছোট মামা বলল, ছেলেমেয়েরা বাসায় একা থাকবে আপনি বরং বাসায় থাকেন। দিদার ভাইকে নিয়ে ছোট মামা গেলেন কবরস্থানে। আমাদের বাসা থেকে মাইল খানেক দুরে কবরস্থান। এখানেই নানির কবর। সত্যি সত্যি আম্মাকে সেই কবরস্থানে গিয়ে নানির কবরের পাশে পাওয়া গেল। আম্মা বসে কোরআন তেলওয়াত করছেন।
দিদার ভাই আর ছোট মামার সাথেই বাসায় ফিরলেন আম্মা। আজ আম্মাকে খুব শান্ত আর নরম দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে মানুষের ভেতর ভীষণ একটা পরিবর্তন হয়। আমার মনে হচ্ছে আম্মারও তাই হয়েছে। উনি বসার ঘরে আমাদের সবার সামনে বসলেন। আম্মার চেহারাটা দেখলেই বুঝা যাচ্ছে তার অনেক মন খারাপ। আম্মা হাসি খুশি থাকা মানুষ। আব্বার মত অত গম্ভীর না। সংসারের সব ঝামেলা আম্মা হাসতে হাসতে কেমন করে জানি মিটিয়ে ফেলেন। আজ আম্মার মুখে সেই হাসিটা নেই। আম্মাকে এমন গম্ভীর দেখে আমরা সব ভাইবোনের খুব মন খারাপ হচ্ছে। আমার তো কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি জানি আমার অন্যান্য ভাই বোনদেরও মন খারাপ হচ্ছে। দিদার ভাইয়ের চোখ পানিতে টলমল করছে। একটু পর দিদার ভাই ছোট মামার পাশ থেকে উঠে গিয়ে আম্মার পাশে বসল।
আম্মা পরম মমতা নিয়ে দিদার ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে আদর করতেই দিদার ভাই বাচ্চাদের মত করে হাউমাউ কান্না শুরু করলো। আমাদের সবার বড় দিদার ভাইকে এমন করে কাঁদতে দেখে আমরা সবাই ফুঁপিয়ে উঠলাম। এবার আম্মা একটু করে মুচকি হেসে বললেন, আমার পাগল ছেলেমেয়েগুলো এমন করে কাঁদছে কেন? আব্বা হাতল ভাঙ্গা বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ছোট মামা বলল, কাঁদুক। ছেলেমেয়ে বাপ মায়ের জন্য না কাঁদলে ভেতরে মায়া তৈরী হয় না। বাপ মায়ের জন্য ছেলেমেয়েদের মায়া না থাকলে তো হবে না। আম্মা এবার কিছু একটা বলতে গেলেন। বলতে গিয়ে তার গলা ভারি হয়ে আসল। আমি বুঝতে পারছি আম্মার কান্না আসছে। তিনি কান্না চেপে রাখতে চাইছেন। মানুষ নিজের ভেতর কান্না লুকিয়ে রাখলেও তা চোখে ভেসে উঠে। আম্মা কান্না চেপে রাখলেন না। তিনি এবার কেঁদে উঠলেন। খুব স্বাভাবিক কান্না। মনে হচ্ছে অনেকদিন, অনেকদিন আম্মা এভাবে কাঁদার জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন।
কাঁদতে কাঁদতে আম্মা বললেন, পৃথিবীর সব দোষ বোধহয় মায়ের। এত এত দোষ নিয়ে একটা মা কেমন যে বেঁচে থাকেন তা আমি নিজেকে দেখলেই অবাক হই। আমার আম্মাকেও দেখতাম সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে সংসার করেছেন। কখনো মুখ ফুটে কাউকে বলেননি নিজের কষ্টের কথা, চাওয়া-পাওয়ার কথা। আমি মা হয়ে এখন বুঝতে পারি। সব বুঝতে পারি কেমন করে আমার মা দিনের পর দিন কষ্ট করেছেন। আজ মনে হলো আমার মা-কে একটু দেখে আসি। খুব ইচ্ছে করছিল আম্মার সাথে বসে গল্প করি। এত দোষ, এত কষ্ট, এত অবহেলা নিয়েও মা কেমন করে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করেছেন। কথাগুলো বলে আম্মা একটু চুপ করে গেলেন। আমরা সবাই চুপচাপ। হঠাৎ আম্মা বলে উঠলেন, দিদার তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। স্কুলে খেলতে গিয়ে হাত ভাঙ্গল। আমি কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটাকে নিয়ে হাসপাতাল গেলাম। ব্যান্ডেজ করে বাসায় ফিরলাম। তোদের বাবা অফিস থেকে এসে কিছুই না শুনে সব দোষ দিল আমার উপর। আমার আশকারা পেয়ে নাকি ছেলেটা এমন হয়েছে।
আম্মা এবার একটা জোরে হাসি দিয়ে বলল, অথচ আমার এই ছেলে মেট্রিকে ষ্ট্যান্ড করলো। বাড়িতে লোকজন আসছে দিদার কে দেখতে। তোদের আব্বা হাসিমুখ করে বুক ফুলিয়ে সবার সাথে ছেলের কৃতিত্ব নিয়ে গর্ব করছে। বাড়িতে আত্বীয়-স্বজন এসে ভরে গেল। সেদিন বাড়িতে ভালো খাবার দাবার রান্না হলো। আমি সকাল থেকে সেই রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকলাম। বার বার ইচ্ছে করছিল লোকজন আমার ছেলেকে নিয়ে এতকিছু বলছে তা নিজের কানে গিয়ে শুনি। কেউ আমাকে নিয়ে কিছু বলছে বোধহয়। এমন ভালো ছাত্রের মা আমি। অথচ আমি কিছুই শুনতে পারিনি। আমি ঐ রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকলাম। কী আর করা। তাছাড়া ছেলের হাত ভাঙ্গার জন্য খুব সহজে দোষটা যেমন করে চাপিয়ে দেওয়া যায় কৃতিত্ব কী এমন করে চাপানো যায়? তানিয়া একবার স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সাথে কোথায় যেন গেল। আমি কিছুই জানিনা। অথচ বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ঘটনা জানতে পেরে আমার স্বামী সব দোষ আমার উপর দিল। আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। যার কিছুই আমি জানিনা তার সব দোষ আমার।
এবার আম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সব মায়ের দোষ। মেয়েটা বাসায় ফিরতে দেরি করছে, মায়ের দোষ। ছেলেটা অংকে নাম্বার কম পেল, মায়ের দোষ। বাচ্চার জামা ছিঁড়ে গেল, মায়ের দোষ। বাথরুমের বালতিতে পানি শেষ, মায়ের দোষ। বাচ্চারা খেলতে গিয়ে লাইট ভাঙ্গল, মায়ের দোষ। অভাবের সংসার। রোজ রোজ রুটি আর ভাজি খেতে হয় বাচ্চাদের। রোজ সকালে উঠে এই রুটি খেতে খেতে বাচ্চাদের সব অভিযোগ গিয়ে পড়ে ঐ মায়ের উপর। স্কুলের বেতন দিতে দেরী হচ্ছে, মায়ের দোষ। দিদারের কলম খুঁজে পাচ্ছে না। দিদার এসে আমার সাথে রাগারাগি করে। কেউ নাকি তার শখের কলম চুরি করেছে। তার কলম কেউ নিয়েছে বুঝলাম কিন্তু এতে আমার দোষটা কী?
তারপরও এই দোষ আমার। কেন সে কলম খুঁজে পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এত দোষ নিয়ে আমি কী ছেলেমেয়েগুলো মানুষ করতে পারব?
আম্মা এবার একটু করুণ হাসি দিলেন। আমরা সব ভাইবোন তাকিয়ে আছি আম্মার দিকে। আম্মা কী যেন ভাবছেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার মা-কেও এমন দেখেছি। অন্যের দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে হাসতেন। আমার খুব কষ্ট হত। খুব কষ্ট। আমি কিছু বললে বলতেন,কেউ যদি নিজের দোষ অন্যের উপর দিয়ে খুশি হতে পারে তবে দিক। এতে তোমার ছোট হওয়ার কিছু নেই। বরং অন্যায়ভাবে যে মানুষটা দোষ চাপিয়েছে এখানে তারই অসহায়ত্ব। একদিন ঠিকই সে তার দোষ বুঝতে পারবে।
আম্মা এবার বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, মা হতে হলে বুঝি এমন হতে হয়? আমার মা, তোমাদের মা, তাদের মা, সবার মা-কে দেখি কেমন করে সব দোষ নিজের করে নিয়ে সংসার, ছেলেমেয়েদের বড় করে তুলেন। আমিও বেশ পারছিলাম কিন্তু হঠাৎ কেন যে হাঁপিয়ে উঠলাম বুঝতে পারলাম না। তখন আমার মায়ের চেহারাটা খুব মনে পড়ল। ইচ্ছে করছিল আমার মা-কে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকি। আমার খুব মনে আছে আমার মা মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদতেন। আমরা দেখে ফেললে আম্মা মুচকি হেসে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতেন ধুর কিছুই হয়নি। এমনি এমনি চোখে পানি আসল।
আম্মা চুপ করে বসে আছেন। একদম চুপ। তার চোখ দুটি পানিতে টলমল করছে। আমি নিশ্চিত আমার দাদীও এমন ছিলেন। আর আব্বার নিশ্চয় একটিবার হলেও এই দাদীর কথা মনে পড়েছে। ছোট মামা কাঁদতে কাঁদতে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। ছোট মামা পেছন পেছন আব্বাও। আমি জানি আব্বা কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো তার মায়ের জন্য। হয়তো আমার মায়ের জন্য। আমি, দিদার ভাই, বিনু আর তানিয়া আম্মার পাশে গিয়ে বসে আছি। কেনজানি আমরা সবাই কাঁদছি। আম্মার স্যাঁতস্যাঁতে শাড়ির একটা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে। এই গন্ধ আমার,আমাদের খুব চেনা। খুব চেনা। আম্মা কাছে থাকলে এই গন্ধটা নাকে লাগে। তবে আগে কখনো এমন করে গন্ধটা চেনা হয়নি, জানা হয়নি।
আজ বুঝলাম মায়ের গায়ে লেগে থাকা সামান্য একটু স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধও যে আমাদের সন্তানদের পরম মমতায় স্পর্শ করে থাকে। আমরা কেমন করে এই মা-কে অবহেলা করে চলি!! আমাদের কিঞ্চিৎ অবহেলা, অভিযোগ, অনাদর একজন মায়ের জন্য কতটা কষ্টের তা শুধু ঐ মায়েরা জানে। শুধু একটিবার ভাবি, শুধু একটিবার ভাবি যে, এই মা-ই যে আমাদের পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। শুধু এই পৃথিবীর আলো দেখানোর ঋণটুকু শোধ করার ক্ষমতা যেখানে আমাদের নেই তবে কেমন করে আমরা এই মায়ের অবহেলা করি। পৃথিবীর সকল মা ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকুক।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত