হঠাৎ আমাদের কথাগুলো খইয়ের দানার মতো ফুটতে লাগলো। উৎসাহের আতিশয্যে সেগুলো দুজনের উষ্ণ মুখগহবরের ভেতর থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে থাকলো টেবিলের দুপাশে। অনেকটা ফটফট ফটাশ আওয়াজ তুলে। আমাদের মনের ওপর কথাগুলোর প্রভাব ছিল এমনই সশব্দ, দারুণ উত্তেজনাকর। আমরা দুজন টেবিলের দুদিকে বসে ছিলাম।অনেকদিন পর এমন অন্তরঙ্গ আলাপের সুযোগ পেয়ে আমরা উভয়েই বেশ প্রগলভ হয়ে উঠলাম। পরস্পরের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে জমে থাকা বিবিধ রস ও রঙের গল্প এবং গসিপের গুঞ্জন বলতে ও শুনতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। কেননা, দুজনের হাতেই সময় সামান্য, কিন্তু কথা অনিঃশেষ।যখন শান্তার রুমে ঢুকি, দেখি, এই শীতের মৌসুমেও এসি কুড়ি ডিগ্রি তাপমাত্রায় দিয়ে রাখা। ছোট্ট রুমটায় মোটামুটি সাইবেরিয়া নেমে এসেছে।‘কী ব্যাপার, এই শীতেও এসি চালিয়ে রাখছো?’‘হ্যাঁ, আপা, একবার বন্ধ করি আর একটু গরম লাগলেই চালু করি।’ বলে শান্তা স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি ছুড়ে দেয়।শান্তাকে যা বলি না, আমার নিজের অফিসেও একই অবস্থা। কিছুতেই অফিস স্টাফদের শেখাতে পারি না, দরকার না থাকলে লাইট-ফ্যান-এসি বন্ধ করে রাখতে। ব্যক্তিগতভাবে, এই অভ্যাস ভালো রপ্ত করতে পেরেছি। স্ব-শিক্ষার সচেতন প্রয়োগে। কিন্তু আশপাশের লোকজনের সঙ্গে পেরে উঠি না। গৃহের চিত্রও আলাদা কিছু নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে প্রত্যেকের ভূমিকার কথা যদি একটু বলে বোঝানো যেতো!‘আপা, আপনার জন্য বসে ছিলাম। একসঙ্গে খাবো বলে।’ বলতে বলতে শান্তা দুহাত পেছনদিকে নিয়ে কিছুটা ঝুলে আসা চুলের ঝুঁটিটা শক্ত করে টেনে দেয়। আমি এর ফাঁকে দেখে ফেলি, শাড়ির সঙ্গে বেমানান যে-বস্নাউজটা সে পরেছে সেটার অবস্থা সঙ্গিন। জায়গায় জায়গায় ফেঁসে গেছে। অনেকবার ব্যবহারজনিত ধোয়ার কারণে রংচটা, হতশ্রী দশা। তুলনামূলকভাবে নতুন শাড়িটার সঙ্গে যাচ্ছে না একদম। শাড়ি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, অ্যান্ডি বা তসর সিল্কের বলেই হয়তো বস্নাউজের এই করুণ হাল।
স্পষ্টতই, নিয়ম অনুসারে পরার পরে ড্রাই ক্লিন করেনি। খরচ কমাতে বাড়িতে ধুয়েছে আর তাই এমন অবস্থা। কিন্তু, মনে হচ্ছে, এতে ওর কোনো বিকার নেই।‘আপার শাড়িটা কী সুন্দর! কোথা থেকে কেনেন এসব!’ শান্তার কথায় আমি ওর অফিসরুমে ফিরে আসি। এতক্ষণ ওকে কেন্দ্র করে আমার ভাবনা আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছিল। এ-কারণে মনে করতে পারছি না, ও কি ঠিক এমনটাই বলেছিল, নাকি অন্য কিছু।সন্দেহের কারণ, বাধ্য না হলে অন্যের প্রশংসা শান্তার মুখে খুব একটা আসে না। বরং এর বিপরীতটাই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এমন যদি হয়, কারো ব্যাপারে রসালো গল্পের কোনোরকম সুযোগ আছে বা উপলক্ষ ঘটেছে, সেরকম কিছু নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে নাকিসুরে কথা বলতে সে ভীষণ পছন্দ করে। দীর্ঘদিনের নিরীক্ষণ থেকে এই ধারণা পাকাপোক্ত হয়েছে। শাড়ির প্রশংসা করলো না আমার গোছানো স্বভাবের, সেটা খানিকটা সময় নিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম।‘কী সুন্দর ম্যাচ করে সব পরেছেন? এমনকি রুবির আংটিটাও … আর আমি এতো ডিজঅর্গানাইজড … দেখেন না, বস্নাউজটাও ঠিকমতো ম্যাচ করে পরে আসতে পারিনি।’শান্তার এসব কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল, তিন-চার মাস আগে আরেকটা সভায় যখন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেদিন ওর পরনের সালোয়ার-কামিজ দেখে আমি হতাশ হয়েছিলাম। যতটা না ওর অদ্ভুত পছন্দের কারণে, তার চেয়ে এই ভেবে যে, অফিসে এত সিনিয়র হয়ে যাওয়ার পরও এভাবে জুনিয়রদের মতো পোশাক পরে আসায়।এই এক বিতর্কের ইস্যু তৈরি হয়েছে। শাড়ি বনাম সালোয়ার-কামিজ। ব্যাপার নাকি সচিবালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। পক্ষ-বিপক্ষ নানা যুক্তি দিয়ে যার যার অবস্থান তুলে ধরছে এবং সেই অনুযায়ী পোশাক পরে চলছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রত্যেকের সেই স্বাধীনতা আছে।আমি অবশ্য সচেতনভাবে বিতর্ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আর বাস্তবতাও অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারি না। তাই যেটা হলে ভালো হয় আর যা নিজের পছন্দের সঙ্গে যায়, তাই করি। তাই পরি। শাড়ির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি বেশ। সবই অভ্যাসের ব্যাপার। সঙ্গে স্বাতন্ত্র্যের কথাও এসে যায়। এই বিষয়টা একেবারে আমার নিজস্ব। তাই শাড়ি পরতে পারা নিয়ে আলাদা গর্ববোধ আছে। যারা শরীরে জড়াবার সময় বারো হাত কাপড়ের প্রতি সুবিচার করে, তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা-ভালোলাগা কাজ করে।অন্যদিকে, যারা যে-কোনো অজুহাত দাঁড় করিয়ে শাড়ি না পরার পক্ষে যুক্তি দেখাতে চান, তাদের বলি : এ-ব্যাপারে আপনার সদিচ্ছাই যথেষ্ট। দরকার মতো আপনি ঠিকই পরছেন। তার মানে আপনার খুব একটা সমস্যা হয় না। এখনই শান্তিনিকেতনের মতো বিধি জারি করে বাধ্যতামূলক করা হোক, আপনার
দ্বিমত-অমত করার কোনো অবকাশই থাকবে না। আপনি তখন নিয়ম মানতে বাধ্য। যেহেতু, এখনো তেমন কিছু চালু হয়নি, আপনি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন।আমার এসব কথা শুনলে শাড়ি পরতে না-চাওয়ার দল মনঃক্ষুণ্ণ হবে, সন্দেহ নেই। হোক, আমি আমার ব্যক্তিগত মতামত জানালাম। গণতান্ত্রিক সমাজে আমার সেই অধিকার আছে। যেমন আছে তাদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার এবং শাড়ি না পরতে চাওয়ার অধিকার।আমি এটাও ভুলে যাই না, একসময় শাড়ি পরতে আমার ভেতরেও কেমন অনীহা ছিল। প্রথম যেখানে চাকরি করতাম, সেখানে আমি ছিলাম বয়সে সবার চেয়ে ছোট। অবিবাহিত তরুণী। বাকি মহিলা সহকর্মীরা একে বয়সে বড়, বিবাহিতও বটে। প্রায়ই তারা আমাকে শাড়ি পরার জন্য উপদেশ দিতেন। এতে নাকি, আরো অনেক কিছুর সঙ্গে, অফিস স্টাফদের ম্যানেজ করা সহজ হয়।একদিন মরিয়ম আপা বললো, ‘আমিও শুরুতে তোমার মতো এসব সালোয়ার-কামিজ পরে আসতাম। মাত্র ভার্সিটি ছেড়ে বিয়ে করছি। অফিসে পরে আসার মতো শাড়িও তেমন নেই। আর যাই হোক, বিয়ের কাতান-জামদানি পরে তো আর অফিস করা যায় না। ও মা, অফিসের হারামজাদা স্টাফগুলা এত শয়তান, দুয়েকটা ছাড়া বেশিরভাগই দেখলে সালামটা পর্যন্ত দেয় না। কয়েকজন তো আপাও ডাকছে। কয়দিন আর এসব সহ্য করা যায়। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো, রীতিমতো কান্না পেতো। বাসায় ফিরে নতুন বরের সঙ্গে অযথা খিটমিট করতাম। আসলে কারণটাও তো ধরতে পারিনি। পরে আমার বর বললো, অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে। আমাদের মধ্যে হোসনে আরা আপা ছিলেন সিনিয়র। তিনিই পরামর্শ দিলেন শাড়ি পরে আসতে। দেখলাম, তার কথায় সত্যি সত্যি কাজ হয়েছে। এরপর থেকে কেউ এমন সমস্যার কথা বললে আমিও একই পরামর্শ দিই। জীবন থেকে নেওয়া, ভাই। তুমিও পরো। পরতে পরতে দেখবা অভ্যাস হয়ে গেছে। আর, যত যাই বলো, বাঙালি মেয়েকে শাড়িতেই ভালো মানায়।’মরিয়ম আপা আরো অনেক গল্প শুনিয়েছিল তার প্রথমদিকের শাড়ি পরা নিয়ে। আমি ভদ্রমেয়ের মতো চুপচাপ শুনে গেছি। তেমন কোনো মন্তব্য করেছিলাম বলে মনে নেই। কারণ, সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার তা আমি মনে মনে নিয়েই রেখেছিলাম, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সরাসরি নির্দেশনা ছাড়া আমার ভাই নড়ন-চড়ন নাই। আমি আমার সুবিধামতো পোশাক পরবো। এর অন্যথা হচ্ছে না। যতদিন ওই অফিসে ছিলাম, তাই করেছি।শাড়ি পরার কঠিন অভ্যাসটা রপ্ত করলাম, যখন আমি আগের চাকরিটা ছেড়ে একটা নামকরা বেসরকারি কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দিলাম। ওখানে মহিলা শিক্ষকদের শাড়ি পরা বাধ্যতামূলক ছিল। প্রথম যেদিন অধ্যক্ষের কক্ষে গেলাম নিয়োগপত্র হাতে, কিছুটা সংকোচ আর গুটিসুটি ভাব নিয়ে, ভদ্রমহিলার প্রথম কথাই ছিল : আমাদের পরিবারে স্বাগতম। কিন্তু সালোয়ার-কামিজ পরে আসা যাবে না।অধ্যক্ষের কথায় যা বোঝার বুঝে গেলাম। আরো বুঝলাম, এবার আর রক্ষা নেই। ঠেলার নাম বাবাজি কথার মর্মার্থ হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। কোনো শাড়ি ছিল না আমার আলমারিতে। ওইদিন কলেজে যোগ দেওয়ার পরে বিকেলে নিউমার্কেটে গিয়ে অল্প কয়টা শাড়ি কিনে আনলাম। আপাতত চালাবার জন্য। তারপর শাড়ি কেনা নিয়মিতভাবে শুরু হলো।কয়েকদিনের মধ্যে জেনেছিলাম, ওই কলেজে মাত্র একজন শিক্ষকের সালোয়ার-কামিজ পরে আসার অনুমতি আছে। তাও ডাক্তারি পরামর্শে। একটা দুর্ঘটনায় তার ডান গোড়ালিতে সমস্যা হয়েছিল। শাড়ি পরে আমরা পাঁচতলা ভবনের ওপর-নিচ করতাম। যাক, কথা আর না বাড়াই। যারা শাড়ি পরে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই এমন নানা শুরুর গল্প আছে। আমার শুরু অনেক ছোটবেলায়। সে-গল্প আরেক দিন, অন্য কোথাও।আসলেই আজ শান্তার শাড়ির সঙ্গে বস্নাউজটা একদমই যায়নি। হালকা নীল রঙের তসর সিল্কের শাড়ির সঙ্গে সে পরেছে হালকা পেঁয়াজরঙা বস্নাউজ। দেখার চেষ্টা করলাম, শাড়ির কোথাও পেঁয়াজ রঙের ছিটেফোঁটা আছে কিনা। না, নেই। ব্যাপারটা সে তার মতো করে ব্যাখ্যা করলো। বরাবর যেমন করে থাকে, একটা ন্যাকা ন্যাকা নকল ভঙ্গিমায়। মাঝে মাঝে দেখতে বা শুনতে ভালোই লাগে। সবসময় নয়। কারণ, ওর এই ন্যাকামোটা আমি ধরতে পারি।‘ভাবছিলাম, আজকে সবকিছু ঠিকঠাক করে পরে আসবো; কিন্তু গতকাল সকাল থেকে বলতে গেলে সারাদিন হসপিটালে ছিলাম। আম্মাকে নিয়ে। রাতে বাইরে একটা ডিনার ছিল। সকালে উঠে কাপড় পরতে গিয়ে দেখি, কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছি না। আর আপনি তো, মাশাআল্লাহ, সবকিছু কী সুন্দর ম্যাচ করে পরে আসছেন? কী গোছানো আপনি! কীভাবে যে পারেন।’
আমি শান্তার কথায় হালকা একটু হাসি। এ ছাড়া, করার মতো আর তেমন কিছু পাই না। তারপরও দু-একটা কথা বলি। বলতে হয় তাই।‘হ্যাঁ, আমি তো আগের রাতেই সবকিছু গুছিয়ে রাখি। আর এক্সেসরিজগুলো ব্যাগে থাকে। অনেক সময় সকালের তাড়াহুড়ায় বাসা থেকে পরে আসতে পারি না। তখন গাড়িতে আসতে আসতে রাস্তায় পরে ফেলি।’আমি জানি, আমার এসব কথায় শান্তার কিচ্ছু যাবে-আসবে না। অসংখ্যবার একইরকম পরিস্থিতিতে আমাদের ভেতরে একই ধরনের বাক্যবিনিময় হয়েছে। আমরা দুজনেই জানি আমাদের কথাগুলো কেমন হবে। আমি আমার মতন রয়ে গেছি। শান্তাও আছে তার খেয়ালখুশি ও নিজস্ব রুচিমাফিক। আমি এটাও জানি, ভবিষ্যতেও সে তার মতো একইরকম থাকবে। এটাই বরং স্বাভাবিক।প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তার নিজের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী চলে, সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের ব্যাপারে কোনো ঘাটতি পূরণের ইচ্ছাটাও স্বতঃপ্রণোদিত হতে হয়। কারো পরামর্শ বা উপদেশে কোনো কাজ হয় না, যতক্ষণ তাড়াটা নিজের ভেতর থেকে উৎসারিত না হয়।শান্তাকে আমি দেখছি গত চৌদ্দো বছর ধরে। এর মধ্যে কত কিছু ঘটে গেল ওর জীবনে। তেমন কিছুই টের পেলাম না ওর বাহ্যিক কোনো আচরণে বা কথায়। এমনকি ওর প্রথম বিয়ের খবরটা পেলাম যখন বিষয়টার ইতোমধ্যে দফারফা হয়ে গেছে। মানে বিচ্ছেদপর্ব সমাপ্ত। এমন নয় যে, শান্তার সঙ্গে আমার যাকে বলে খুব দহরম-মহরম। হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু আমার সঙ্গে ওর কথা বলার ধরনটা এমন আন্তরিক মনে হতো যে, আমি সবসময় প্রতারিত হতাম। মনেই থাকতো না যে, ওর সঙ্গে দীর্ঘদিন আমার সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না।এবারো আমাদের দেখা হলো ছ-বছরের বেশি সময় পরে। এই সময়টায় মাঝে মাঝে অনেকদিন পরপর টেলিফোনে সামান্য কথা হয়েছে। কিছু ই-মেইল দেওয়া-নেওয়া হয়েছে। ভাইবারেও অল্প যোগাযোগ ছিল। ব্যস, এতটুকুই। কিন্তু যেভাবে আমরা কথা বলি তাতে আমাদের এই লম্বা যোগাযোগহীনতার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।দুর্বলতাটা আমার দিক থেকেই বেশি বলে আমার সন্দেহ। কারণ, আমি সত্যিই ওর এই নাকি-ঢংয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা দারুণ উপভোগ করি। বলা যায় পুরোমাত্রায়। কোনো জিনিস আমাকে সঠিকভাবে আকর্ষণ না করলে আমি তাতে খুব একটা মুগ্ধ বা চমকিত হই না। শান্তার কথা আমাকে প্রলুব্ধ করে ওর আরো কথা শুনতে। সমস্যা একটাই : অনেকদিন পরপর আমাদের দেখা হয়। হয় ওর অফিসে, না হয় আমার অফিসে। প্রতিবারই আমাদের বলতে থাকা কথা অসমাপ্ত থেকে যায়। ফোন বেজে ওঠে। ওপাশ থেকে বস কাজের খবর/অগ্রগতি নেওয়ার ভান করে। আমাদের রসালো বা তিক্ত আলোচনায় ছেদ পড়ে। আমরা সামনের বার দেখা হলে আবার আড্ডা হবে বলে দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিই।
আজ আমি শান্তার অফিসে এসেছিলাম একটা কাজে। এসে দেখি, ওদের নতুন অফিসভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে নিচে বিশাল জটলা। সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী হাজির। চারদিকে ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে। মন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা। মন্ত্রী এলেই ফিতা কেটে শুভ কাজের উদ্বোধন।কী আর করা। মূল গেটেই গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। ভিড় ঠেলে সামনে কীভাবে এগোবো ভাবছি। এখন ভেতরে গেলে ডেস্কে কাউকে পাওয়া যাবে কিনা সেটাও চিন্তা করছি। এর মধ্যেই কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি শান্তা।‘আরে, শান্তা যে!’‘সালমা আপা, কেমন আছেন? কত্তদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হলো!’‘হ্যাঁ, অনেকদিন পর। তুমি তো আর এলেই না আমার ওখানে।’‘আর লজ্জা দেবেন না, আপা। কিছুতেই কাজ শেষ করতে পারি না। এর মধ্যে গত সপ্তাহে নেপাল গেলাম একটা মিটিংয়ে। চারদিন ছিলাম না। এসে দেখি, আরো ফাইল জমে গেছে। থাক এসব কথা। আপনার কথা বলেন।’‘এই চলছে একইরকম। তোমাদের তো মনে হয় সবাই এখানে। আমি একটা কাজে এসেছিলাম।’‘হুম, সবাই এখানে। এখন কাউকে ভেতরে পাবেন বলে মনে হয় না। আপনিও থাকেন। পরে আমার রুমে গিয়ে গল্প করবোনে। অনেক গল্প জমে আছে।’শান্তার এই নিমন্ত্রণ ভীষণ প্রলুব্ধ করে। কাজ শেষ হয়ে গেলে ঠিকই হয়তো একবার ঢুঁ মারতাম। এখন এই সরাসরি আহবান মনের ইচ্ছাটাকে আরো খানিকটা উস্কে দিলো। যেহেতু অফিসের সবাই এখন বাইরে, আমি বরং শান্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস আলোচনায় নিমগ্ন হওয়াটাই শ্রেয় মনে করলাম। আমাদের আলোচনার বিষয় যথারীতি শাড়িতে গিয়ে ঠেকলো।বাজারে যে-কথা চালু আছে, মেয়েদের মাথা এক জায়গায় জড়ো হলেই অধিকাংশ সময় তাদের গল্পের বিষয়বস্ত্ত শাড়ি আর গহনায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ডালপালা মেলতে মেলতে সাংসারিক জটিলতা থেকে বৈশ্বিক কূটনীতি পর্যন্ত গড়ায়। আমার অভিজ্ঞতা প্রচলিত এই ধারণাকে সমর্থন না করে পারে না। আমিও মাঝে মাঝে এমন আড্ডার অংশীদার হয়ে যাই কিনা।‘সাদা-লাল শাড়িটাতে আপনাকে খুব ব্রাইট লাগছে।’ শান্তার তৈলাক্ত উক্তি।আমি স্মিত হাসি, কারণ এরকম অবস্থায় বেশিরভাগ সময় কিছু বলার থাকে না। উত্তরে আমারও অনুরূপ কিছু বলা প্রয়োজন।‘তোমাকেও চমৎকার দেখাচ্ছে সবসময়ের মতো।’ এরকমটা বলা যায়; কিন্তু আমার বলা হয় না।কোনো কিছু মন থেকে ভালো না লাগলে আমি নিখাদ প্রশংসা করতে পারি না। এটা আমার একটা বড় সমস্যা বলেই মনে হয়। অথচ, এতদিনে জেনেছি, জীবনে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে গেলে অভিনয় কতটা কাজে দেয়! কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় অভিনয়টাই আজ পর্যন্ত ঠিকঠাক শেখা হয়ে উঠলো না। সে-কারণে অনেক জায়গাতেই আমি বেমানান, অদক্ষ,অনাকাঙিক্ষত।
এই অভিনয়ের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন অবধারিতভাবে আমার শারমীন আপার কথা মনে পড়ে। কী চমৎকার করেই না এই কৌশল তিনি রপ্ত করেছেন! যতবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, অথবা আমি তাকে দেখেছি কাউকে দেখার পর অভিবাদন করতে, তার মুখ থেকে সেই একই মেকি সুরে মধু বর্ষণ, সেই প্রায় একই ভাষায় স্ত্ততি ছড়ানো : ‘কী যে সুন্দর লাগছে তোকে/ তোমাকে/ আপনাকে!’ অথবা, অনেকদিন পর দেখা হলে, ‘ইশ, কত্তদিন পর দেখা হলো! কী যে মিস করি আমাদের সেই চা-শিঙাড়ার দিনগুলো!’আর তারপর এই সুমিষ্টভাষিণী শান্তা। যতবারই আমরা পরস্পরের মুখোমুখি হই, প্রায় প্রতিবার আমার উদ্দেশে তার অনিবার্য সম্ভাষণ :‘কী সুন্দর টিপটপ সবকিছু আপনার! আর আমার অবস্থা দেখেন!’শব্দগুলো ঠিক এরকম থাকে না; কিন্তু অর্থ এমন। শান্তা তার অবস্থা দেখার আহবান করার আগেই আমি তা দেখে ফেলি। তারও আগে দেখি তার মিষ্টি মুখখানা। আর শুনতে থাকি বিশেষভাবে আয়ত্ত করা এক আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় তার বলতে থাকা কথা। বুঝতে পারি, আমার জায়গায় একজন পুরুষ হলে তার দশা কেমন নাজুক হতে পারে। আরো বুঝতে পারি, শান্তা তার এই ক্যারিশম্যাটিক কোয়ালিটি সম্পর্কে শতকরা একশত ভাগ সচেতন।
কিন্তু আজ আমার মনে একটা দুরভিসন্ধি ছিল। কিছুদিন আগে গুজবটা, সত্যি-মিথ্যা জানি না, শোনার পর থেকেই ভেবে রেখেছি, এরপর শান্তার সঙ্গে দেখা হলেই তার কাছে ঘটনাটা সম্পর্কে জানতে চাইবো। এটাকে দুরভিসন্ধি বলা ঠিক হলো কিনা জানি না। ব্যাপারটা এমন যে, কথাটা আমার মুখ থেকে শুনলে শান্তার ভালো নাও লাগতে পারে। আমার এমনটাই মনে হয়েছে। যেহেতু, অন্যদের নিয়ে কথা বললেও আমরা নিজেদের বিষয়ে খুব একটা কিছু বলি না। যেন আমরা ধোয়া তুলসীপাতা। অথচ, আত্মসমালোচনাটা খুব জরুরি। সবচেয়ে ভালো হয়, যাদের সঙ্গে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক তাদের কাছ থেকেই নিজেদের ভুলত্রুটি নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া।নতুন ভবন উদ্বোধনের ফিতা-কাটা কাজ যখন শেষ হলো, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি শান্তা একটু দূরে সরে গিয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলছে। ওর অফিসের একজন পুরুষ সহকর্মী। আমি শান্তার মুখের দিকে তাকাই। যথারীতি তার পরিচিত কায়দায় ঘাড়টা বাঁয়ে সামান্য কাত করে মুখটা কিছুটা সামনে বাড়িয়ে। খুব মনোযোগী হয়ে কথা শুনছে। তার মুখ বাড়িয়ে দেওয়ার ঢংটা দেখে মনে মনে হাসি পেল। যেন অনেকটা চুমু খাওয়ার জন্য গালটা এগিয়ে দেওয়া। এত কাছে মুখ নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলা আমাকে দিয়ে হবে না।কিন্তু আমাদের মিনমিন আওয়াজের কথায় কখন যে ছন্দপতন ঘটেছিল, সেটা আর মনে করতে পারলাম না। সম্ভবত যখন মাওলানা সাহেব মোনাজাতের জন্য হাত তুলেছিল। আর আমরা মহিলারাও যখন সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শাড়ির আঁচলটা টেনে নিয়ে যার যার মাথা ঢাকার চেষ্টা করেছিলাম। সেই ফাঁকে শান্তা আমার কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। হয়তো, সে ধরে নিয়েছিল, খানিক পরে আমাদের তো আবার দেখা হচ্ছেই।হলোও তাই। ঘণ্টা দেড়েক বাদে কাজ সেরে আমি যখন শান্তার রুমে ঢুকলাম, তখন সেখানে, আগেই বলেছি, সাইবেরিয়ার হিম। তবে সবসময়ের মতো এবারো তার উষ্ণ আতিথেয়তায় সেই হিম হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বেশি সময় নিল না। শান্তা জানালো, উদ্বোধন অনুষ্ঠানের নাস্তার প্যাকেট নিয়ে সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। একসঙ্গে খাবে বলে। আমি তার এই আন্তরিকতায় বরাবরের মতো গলে মোম হয়ে গেলাম।‘আরে, না, না, তুমি খেয়ে নাও। আমি নিচ থেকে খেয়ে আসছি।’শান্তার পীড়াপীড়িতে একটা নিমকির অর্ধেকটা নিলাম। তারপর যথারীতি সে আমার শাড়ি নিয়ে পরলো।‘আপা, শাড়িটা খুব সুন্দর। কটন, না?’‘হ্যাঁ, রঙ-এর শাড়ি। আগেও কয়েকবার পরেছি।’‘তাই? দেখে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। একদম ক্রিসপলেস। অথচ সুতি শাড়ির এই এক অসুবিধা। একবার পরলেই বারোটা বেজে যায়। আয়রন করার ঝামেলায় আমার তো কটন শাড়ি পরাই হয় না, কিন্তু আপনি কী সুন্দর করে পরছেন!’বুঝলাম, শান্তার এই শাড়ি-সংগীত মাঝপথে না থামালে চলতেই থাকবে। কিন্তু আজকে যা বলবো বলে ভেবে এসেছিলাম, তা কি সত্যিই আমি তাকে বলতে পারবো? যত যাই হোক, মেয়েটাকে তো আমি পছন্দ করি। দোষে-গুণে মানুষ। আমিও তাই। আর যে-বিষয়টা নিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করতে চাই তাতে ওর কোনো ভূমিকাও নেই। শুধু শুধু বেচারী কষ্ট পাবে। ওর মিষ্টিমুখটা হঠাৎ অন্ধকারে ঢেকে গেলে আমিও কম কষ্ট পাবো না। থাক, এবার না। সামনের বার বলবো। একটু প্রস্ত্ততি নিয়ে বলবো, যাতে আমার মুখ থেকে কথাটা শুনে ওর প্রতিক্রিয়াটা খুব বেশি তীব্র না হয়।আমরা কথা বলতে বলতেই ইমরান ঘরে ঢুকলো। ইমরান শান্তার স্বামী। একটা বেসরকারি ব্যাংকে আছে। আমাদের কথায় কিছুটা ছেদ পড়লো। সে অবশ্য বেশিক্ষণ থাকলো না। কী একটা কাগজ নিতে এসেছিল। সেটা নিয়ে চলেও গেল। কিন্তু আমি শান্তাকে যে-কথাটা বলতে গিয়েও সেদিনের জন্য নিজেকে সংবরণ করেছিলাম তাতে আবার নতুন করে ঢেউ উঠলো।কিছুদিন আগে আমাদের দুজনেরই পরিচিত একজন আমাকে বলেছিল, ইমরানকে নাকি ইদানীং একটা মেয়ের সঙ্গে প্রায়ই দেখা যায়। ঘুরেফিরে শহরের কয়েকটা নামকরা কফিশপে অথবা কিছু বড় শপিংমলে। সেদিন বসুন্ধরা শপিংমলের ‘মনে রেখো’ নামের শাড়ির দোকানে ওদের দুজনকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেছে। ওই পরিচিতজনের চোখের সামনেই। অন্যদিকে ছিল বলে ইমরান তাকে খেয়াল করতে পারেনি। কিন্তু পরিচিতজনের ভাষ্য, লক্ষণ সুবিধার নয়। আর ইমরানেরও যে পেস্নবয় মার্কা সুনাম! সম্ভবত শান্তা এসবের কিছুই জানে না।আচ্ছা, আমি কি সত্যি সত্যি শান্তার কাছে ওই কথাটা জানতে চাইতে পারবো? আগামীবার যখন আমাদের দেখা হবে, যখন অনিবার্য নিয়ম মেনে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্ত্ত এর-ওর ঘরের খবর, নারী আর নরের খবর নিতে নিতে শাড়িতে গিয়ে আটকাবে তখন কি আমি শান্তাকে জিজ্ঞাসা করবো যে, সে জানে কিনা ইমরান সেদিন তার বাহুলগ্না হয়ে থাকা তরুণীটির জন্য একটি বিয়ের বেনারসি কিনেছিল?