ষাট পেরোনো এক ভদ্রমহিলার সাথে আমি লিভ টুগেদার করছি কিংবা তার সাথে আমার প্রণয়ের সম্পর্ক, এমন অভিযোগ এনে মা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আর শতাব্দী? সে তো চরিত্রহীন, লম্পট এর মতো বেশ কিছু বিশেষণ আমার নামের পাশে বসিয়ে দিয়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ব্লক করে দিয়েছে। মা কিংবা প্রেমিকার এমন অভিযোগের পেছনে শক্ত কারণ যে নেই তা কিন্তু না, তাদের হাতে মোটামুটি শক্ত কারণ আছে অবশ্য। শামীমা জামানের ফ্ল্যাটে আমি সন্ধ্যায় গেলে পরদিন সকালে ফিরি, তাকে নিয়ে সিনেমাতে যাই, তার চেক আপের দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে ব্যস্ত থাকি, আর সেই ব্যস্ততার অজুহাতে মায়ের টেবিলে বেড়ে রাখা ভাত জুড়িয়ে আসলেও বাসায় ফেরা হয় না, শতাব্দীকে নিয়ে বেরোনোর কথা থাকলেও তার ফোন কেটে দেই, শামীমা জামানের অনিয়মিত চেক আপের দায়ে কী কী সমস্যা হতে পারে সেসব নিয়ে ওকে বৃথা লেকচার দেই।
শামীমা জামানের সাথে পরিচয় হয়েছে মাস তিনেক আগেই। ভদ্রমহিলার বয়স ষাট হলেও এখনো ড্রেসের সাথে ম্যাচ করে লিপিস্টিক, ব্যাগ, জুতো কেনেন। আমি গিয়েছিলাম শতাব্দীর জন্য লিপিস্টিক কিনতে। ভদ্রমহিলা সেদিন পাকা সিঁদুরে আমের রঙের মতো শাড়ির সাথে ম্যাচ করে লিপিস্টিক খুঁজছিলেন, তবে তার মন মতো হচ্ছিল না একদমই। শতাব্দীর জন্য কেনা ডার্ক রেড লিপিস্টিক ভদ্রমহিলার দিকে সেদিন বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, এটা ট্রাই করতে পারেন। উনি ট্রাই করলেন, মন মতো হয়েও গেল। ব্যাস, সেদিন ক্যাফে শপে তার দেয়া আতিথ্য থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু।
শামীমা জামানের দুই মেয়ে, দুজনেই লন্ডনে বিয়েশাদি করে ওখানে নিয়ম মেনে অনর্গল ইংরেজি বলে, ইংরেজ খাবার খায় আর বছরে একবার তাদের মাকে হাই হ্যালো বলে। শামীমা জামানও হাসিমুখে মেয়েদের সাথে কথা বলেন বছরে ঐ একবারই। তার প্রচন্ড বুকে ব্যথা ওঠা রাত্তিরের গল্প, তার কোমরের ব্যথার দুর্বিষহ যন্ত্রণার গল্প, তার একাকীত্বের গল্প মেয়েরা জানতে চায় না, তিনিও বলেন না। মোবাইল রেখে আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলেন, ওরা থাকুক রিলাক্সড, খামাখা দুশ্চিন্তার বিষ বাতাসে ছড়িয়ে লাভ কি? তুমি কি বলো সুইটহার্ট? আমি তার ওমন প্রশ্নের জবাব দেই না, জানি উনি নিজেকে বুঝ দিতেই মিছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন আমার দিকে, আমি তাকে পালাতে দেই, উনি পালান চুপিসারে।
শামীমা জামানের স্বামী ছিলেন ব্যাংকার। ভদ্রলোক চল্লিশ পেরোনোর আগেই হার্ট আ্যটাকে ওপারে চলে গেলেন, আর শামীমা জামান সেই থেকে একলা মস্ত বড় নৌকা বাইতে বাইতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আর আমি সেই নৌকার ছোট্ট ফুঁটো দিয়ে আসা পানি ছেচে চলেছি কেবল। নাহ, ভুল বললাম। আমি একা পানি ছেচার কাজ করছি না, সঙ্গে আছেন মোতালেব সাহেব। তিনি আবার কে? বলছি ধীরে শামীমা জামান আমার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে লজ্জিত হয়ে বলল,তোমার প্রেমিকার সাথে সেদিন টিএসসিতে দেখা, সে আমাকে দেখে কপাল কুঁচকে এমন ভাবে তাকালো যেন আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে চোখ দিয়ে৷ ও আমাকে সহ্য করতে পারে না বোধহয়।
-কোনো প্রেমিকার সহ্য করার কথা কি? তার প্রেমিকের পাশে অন্য মেয়ে হাঁটছে, প্রেমিক সেই মেয়ের বাড়িতে প্রায় সময় কাটাচ্ছে এটা কে সহ্য করবে বলো? হা হা, মেয়ে বলছো! বৃদ্ধা বলো, বৃদ্ধা।
-নারীর যতক্ষণ পর্যন্ত গ্ল্যামার আছে, পুরুষকে কাছে টানার আবেদন আছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কিন্তু মেয়েই।
এই! মার খাবে? কাকে কাছে টানলাম আমি?
-কেন! মোতালেব ভাইকে, ভদ্রলোক তো শামীমা বলতে অজ্ঞান, তুমি একটু হাসলেই সে হা করে তোমার হাসি গিলে নেয়৷ আরে ধুর! চাও খাও তো, খালি আবোলতাবোল বলে।
চায়ের কাপে দু চুমুক বসাতেই কলিং বেল টিপল কেউ, মোতালেব সাহেব এসেছে নিশ্চয়ই। শামীমা জামান দরজা খুলতে চলে গেল আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসেই। মোতালেব সাহেব ছিলেন মতিঝিল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, অবসর নিয়েছেন বছর ছয়েক আগেই৷ ভদ্রলোকের দুই মেয়ে, দুজনেই বিয়ে করে যার যার মতো ব্যস্ত, স্ত্রী মারা গিয়েছেন আরো বছর পনেরো আগেই। মোতালেব সাহেবের সাথে আমার পরিচয় বিসমিল্লাহ বিরিয়ানি হাউজে। আমি প্রায়ই যাই বিরিয়ানি খেতে, আর প্রতিটা দিনই দেখতাম এই ভদ্রলোক একা একা খুব ধীরে, তৃপ্তি নিয়ে বিরিয়ানি খাচ্ছেন, কখনো কাঁচামরিচ কামড়াচ্ছেন আদুরে ঢঙে আবার কখনোবা বোরহানির গ্লাসে চুমুক দিয়েক চোখ বুজে আছেন। কৌতূহল থেকে তার সাথে আলাপ জমালাম, তারপর তার সাথে বন্ধুত্ব, আর আমার মারফত শামীমা জামানের সাথে তার বন্ধুত্ব। মোতালেব সাহেব সাত কেজি ওজনের কাতলা মাছ এনেছেন, সঙ্গে দেশি টমেটো, বিলাতি ধনেপাতা। আমাকে দেখেই গদগদ হয়ে বললেন, শোনো শিহাব, আমি আজকে মাছের কোনো দামাদামি করি নাই৷ মাছওয়ালা বলল, একদাম পনেরোশো, আমি ব্যাটারে ঐ দামই দিলাম৷ সে কী করছে জানো? মাছ ব্যাগে দিয়ে আমারে তিনশো টাকা ফেরত দিয়ে বলল, স্যারের কাছ থেইকা বেশি দাম নিমু না।
-ওহ, চেনা মাছওয়ালা! এজন্যই ফেরত দিল। তা এতবড় মাছ কাটবে কে এখন? শামীমা তো কাজের লোককে বিদায় দিয়েছে৷ সে কি! কেন? আচ্ছা মুশকিল হলো তো। আমি ভেবেছিলাম কাতলার তেলতেলে ভুনা আর টমেটো, ধনেপাতা দিয়ে ঝোলঝোল খাব। খেয়ে তারপরে…
– থামলেন কেন? তারপর কী? হা হা। খাওয়ার ভেতর তো ঐ জিনিসটাই খাই ভক্তি নিয়ে, খোটা দিচ্ছো শিহাব?
– আ্য! কেবল ওটাই খান? শামীমা বলল কাল নাকি সিগারেট খেতে যেয়ে কেশে সারা শহর কাঁপিয়েছেন?
কে বলল এই কথা! শামীমাকে বারবার না করেছিলাম বলতে।
-আহ! কী হয়েছে তা? ওমন আমিও কেশেছি, এই বয়সে সিগারেট ধরেছেন, ভেতরের যন্ত্রপাতিও তো যায় যায়, একটু কাশবেন স্বাভাবিক । এসব ছাড়ুন, এখন মাছ কাটতে হবে চলুন। তুমি পারবে! আমি তো পারি না।
-আহ, পারব না কেন? আপনি মাছের টুকরো করেবন, আমি আঁশ ফেলে কেটে দেব। পারবেন না? হ্যাঁ, তা পারব, অবশ্য।
শামীমা বহুদিন পর নিজের হাতে আমাদের জন্য রেঁধেছিল। মাছ ভুনাটা লা জবাব ছিল। মোতালেব সাহেব পাকা দুই বাসন ভাত খেলেন মাছ ভুনা দিয়ে৷ এখন আমরা চাঁদের আলোয় ছাদে পাটি বিছিয়ে পাশাপাশি বসে আছি। সামনেই রাশিয়ান হুইস্কি, কাজু, আর ঠান্ডা স্প্রাইটের বোতল রাখা। মোতালেব সাহেব আর আমার এই মদের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে শামীমা জামান। মোতালেব সাহেবের বাসায় ফেরার বাধ্যবাধকতা নেই বলেই প্রতিদিন খান, আর আমি বিশেষ দিন ছাড়া খাই না।
মোতালেব সাহেবের গ্লাসে মদ ঢেলে দিয়ে শামীমা জামান শাসনের সুরেই বলল, আপনি একটু রয়েসয়ে খাবেন তো, হুশ থাকে না আপনার। মোতালেব সাহেব বাচ্চাদের মতো আদুরে ঢঙে মাথা দুলিয়ে শামীমা জামানের কথাকে কায়মনোবাক্যে মেনে নিয়ে হুশ করেই মদ গিলতে গিলতে কিছুক্ষণ বাদেই বেহুশ হয়ে গেলেন, চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে আমাদের জ্যামিতির ক্লাস নিতে লাগলেন, একটু থেমে বীজগণিতের সূত্র আওড়াতে শুরু করলেন। তার ক্লাস আমাদের বেশিক্ষণ করতে হলো না, অল্পতেই ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। শামীমা জামান ঈষৎ হেসে বলল, দেখলে মোতালেব সাহেবের কান্ডটা! হা হা। তবে কি জানো তো বেচারা সারাটা জীবন বাচ্চাদের পড়িয়ে দুটো মেয়েকে মানুষ করলো, বিয়ে দিলো, লোকে কী বলবে এই ভেবে বিয়েটাও করলেন না। আর এখন? মহাবিশ্বের ধূলিকণার মতো সে বড্ড একা, জ্বর হলে, গুটিবসন্ত হলে কেউ থাকবে না পাশে, এটাই কি জীবন শিহাব?
– জীবন হওয়া উচিত পাসপোর্ট সাইজের
রঙিন ছবির মতো। নানা রঙে জীবন ভরে থাকবে। মোতালেব সাহেব কিংবা তুমি জীবনটাকে সাদা কালো স্ট্যাম্প সাইজ ছবির মতো করে রেখেছিলে। বউয়ের জন্য, সংসারের জন্য, ছেলেমেয়ের জন্য দিনকে রাত করে টাকার পিছনে ছুটে চলাটাকে কর্তব্য মনে করো না? মোতালেব সাহবে তো তাই করলেন। আর কর্তব্য যখন নেশা হয়ে যায় তখন ব্যক্তি জীবনকে তুচ্ছ লাগে, ক্ষয়ে যাওয়াতেই সুখ মনে হয়। তাইতো মোতালেব সাহেবরা ক্ষয়ে যান অন্যের সুখের জন্য, কর্তব্যের নেশায় ডুবে থেকে।
-জীবন নিয়ে আমার দর্শন দশে দুই পাবার মতো যোগ্যতা রাখে। তবুও আমার কাছে মনে হয় ক্ষয়ে যাওয়া মানে নিজেকে ঠকানো। সাতটা দিন থেকে একটা দিন যে মানুষ নিজেকে দিতে পারে না সে একটা না একটা সময় পর নিজেকেই প্রশ্ন করবে, আমার কী আছে? কেউ যদি বলে সুখ আপেক্ষিক, তাতে আমার দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। কারো কাছে সুখ মানে অন্যর ভালোর জন্য নিজেকে বিসর্জন দেয়া। তবে কি জানো তো এই মানুষগুলোই শেষ জীবনে এসে একবার না একবার হলেও সুখের ভিন্ন সঙ্গা দাঁড় করায়, আর এই ভিন্ন সঙ্গাটাই কিন্তু খুব ভোগায় মানুষটাকে। আচ্ছা এসব কথা বাদ। বড্ড ভারী কথা এসব। ড্রাইভ করতে পারো না রাতে? হ্যাঁ, পারি তো। কেন?
-গাড়ি বের করো। কক্সবাজার যাব। এক্ষুনি? সিরিয়াসলি!
-হ্যাঁ, এক্ষুনি মোতালেব সাহেব ঘুম ভেঙে যখন দেখবেন তিনি কক্সবাজার তখন বেশ পুলকিত হবেন। যাবে কি না বলো? ওকে, তোমাকে না করবার শক্তি এই ঢিলে চামড়ার মহিলার নেই, চামড়া পুরোট থাকলে হয়তো উত্তরটা অন্য কিছুও হতে পারতো , হা হা। আচ্ছা, তুমি উনাকে গাড়িতে তোলো, আমি আসছি।
দুদিন হলো আমরা কক্সবাজার এসেছি। কাল ভোরে চিটাগং চলে যাব। আজ পূর্ণিমা। ঘড়ির কাঁটায় এখন এগারোটা একুশ। সমুদ্রের পাড়ে কেউ নেই কেবল আমরা তিনজন বাদে। মোতালেব সাহেব পোড়ানো গরম ভুট্টা কামড়ে খাচ্ছেন, আর একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন মুগ্ধ চোখ নিয়ে। শামীমা জামান আমার হাত চেপে ধরে চাপা গলায় বলল, রাতের সমুদ্র এতটা মায়া জানে! ষোলোই পা দেয়া যুবতীর চেয়েও যে আবেদনময়ী এই সময়ের সমুদ্র! কেউ সুইসাইড করতে চাইলে তাকে বলবো ভরা পূর্ণিমার রাতের সমুদ্রে যেন সে ডুবে মরে, বিশ্বাস করো এমন মরণে কারো বুক কাঁপবে না। মোতালেব সাহেব শামীমা জামানের কথা শেষ হতেই লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, সমুদ্র কেমন হয় সেটা দূর থেকে জেনেছি, গাল গল্প শুনেছি। কোনোদিন বিন্দুমাত্র ফুসরত পাইনি সমুদ্রের ধারে এসে একটু বসে গা জুড়াবার। এখানে না আসলে আফসোস নিয়ে মরে যেত হতো।
-আহ! কী শুরু করলেন আপনারা! মৃত্যু সুন্দর, সত্য, আমি মানি তা। তাই বলে এমন মুহুর্তটা উপভোগ না করে বয়সের দোহাই দিয়ে মৃত্যু নিয়ে কেন ভাবছেন কেবল? মোতালেব সাহেব আধখাওয়া ভুট্টাটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, দোষটা আসলে আমাদের অতীতের, তাই না শিহাব? অতীতে নিজের একান্ত কোনো সুখ স্মৃতি নেই, যা জাবর কেটে মৃত্যু ছুঁইছুঁই এই বয়সটা পার করা যাবে। স্মৃতিহীন বার্ধক্য বড়ো তেতো হয় শিহাব। আপনার বলতে কিছুই থাকে না। আমি যদি এই সমুদ্র সফর আরো কুড়ি বছর আগে আমার স্ত্রীর সাথে কাটাতাম তবে আমার দামী কিছু স্মৃতি থাকত, বুকের ভেতর থাকা কোনো এক কৌটোর মাঝে তা খুব যত্নে থাকত। পেইন কিলার হয়ে বার্ধক্যের অবসরকে, একলা থাকার পেইনকে কিছুটা হলেও কমাতো, তাই না?
শামীমা জামান নীরবে কেঁদে চলেছে, চোখ মুছে, নাক টেনে বলল, ইলিয়াসকে কতবার বলেছিলাম চলো আমরা প্যারিস যাই, আমার বড্ড শখ ফরাসি কালচার খুব কাছ থেকে দেখা, ওদের মিউজিয়ামে সারাদিন পড়ে থাকার। তার সময় হলো না কোনোদিনও। জানেন মোতালেব সাহেব, আমারও মনে রাখার মতো, স্মৃতিকাতর হবার মতো যথেষ্ট কোনো স্মৃতি নেই। কেবল নিরামিষের মতো ছুটে চলেছি স্টেশনে পর স্টেশন। এই বার্ধক্য সত্যিই তীব্র এক ব্যথার নাম। যে ব্যথার উপশম হয় স্মৃতির রোমন্থনে, প্রিয় মানুষগুলোকে কাছে রেখে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় চুপিসারে দিন গোনায়। প্রিয় মানুষগুলো কাছে থেকেও থাকে না, বুড়োদের দুটো কথা শোনার সময় থাকে না কারো,কোনো বন্ধু থাকে না, একটু সঙ্গ দেবার ধৈর্য হয় না কারো। বুড়ো নড়বড়ে হাড়, পূর্ণিমায় ওঠা বুকে ব্যথায় কেউ হাত বোলায় না। মরণের আগে জীবন্ত মরণ যাকে বলে আরকি। লাশ হয়ে বাঁচতে হয়।
-আহ! হচ্ছেটা কি! এসব ভারী কথা কেন বলো তোমরা? চলো তো ওঠা যাক, এখন পথ দিলে ভোর হবার আগেই চন্দ্রনাথের পাহাড়ে পৌঁছে যেতে পারব৷ মোতালেব সাহেব শঙ্কিত গলায় বললেন, এই শিহাব! এই বুড়ো শরীরে উঠতে পারবো তো?
-আমি কেন আছি? শামীমা আমার কোলে আর আপনি পিঠে উঠবেন। সুযোগ নিচ্ছো না? শামীমাকে এই সুযোগে কোলে উঠিয়ে নিচ্ছো, হা হা হা। মোতালেব সাহেবের সাথে শামীমাও সাগর কাঁপিয়ে, দাপিয়ে খিলিখিলিয়ে হেসে উঠল। ওদের হাসিতে সমুদ্রের ওপার বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে ওপারের বসে থাকা বিষণ্ণ জ্যোৎস্নাটারও মন ভালো হয়ে যাবে। ভোরের আলো ফুটবার আগেই শিশির মাড়িয়ে, বুনোপাখির অজানা ডাকে কান ডুবিয়ে চন্দ্রনাথে পাহাড়ে উঠেছি আমরা। মেঘগুলো হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে যেন! মোতালেব সাহেব ধরা গলায় বললেন, কোথায় নিয়ে আসলে শিহাব? মেঘ এই জীবনে এত কাছে দেখিনি যে! একটা বুনো উন্মাদনা আছে এই পাহাড়ের ভাঁজে। শামীম মিনারেল ওয়াটারের বোতলে মুখ লাগিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমার কয়েক হাজার দিনের বয়সে এত সুন্দর সকাল দেখিনি জানো। ঐটা কী পাখি শিহাব?
– এটাকে বলে সোনা কপালি হরবোলা। খুব আদুরে স্বভাবের এরা, এদের ডাকট বাঁশির চিকন সুরের মতো হয়।
শতাব্দীর মতো চিকন সুরের গলা?
– সে কি! তুমি শতাব্দীর গলা কোথা থেকে শুনলে?
ফোন দিয়েছিলাম গতকাল রাতেই। তুমি আমাদের দুই বুড়ো-বুড়ির নিয়ে পড়ে থাকার দায়ে মেয়েটা থেকে কেমন দূরে সরে যাচ্ছো, এটা কি হতে দেয়া যায়?
– হা হা, আরে তা নয়। ও এমনই, খামখেয়ালি স্বভাবের, হুটহাট চটে যায়। রাগ কমে গেলে পানির মতো হয়ে যায়। আচ্ছা চলো খানিকটা নিচে নামা যাক, পাহাড়িদের খাবার হোটেল আছে এই পাহাড়ের উপরেই৷
মোতালেব সাহেব, শামীমা দুজনেই আলু ভর্তা আর পোড়ানো শুকনো মরিচ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে চলেছে দুরন্ত কিশোর-কিশোরীর মতো। কে বলবে এদের বয়স পাঁচ যুগ পেরিয়ে এসেছে? আলু ভর্তা, শুটকি ভর্তা আর ডিম ঝোলে পেট ঠেসে ভাত খেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দিরের সামনের দিকের সিঁড়িতে এসে বসেছি আমরা তিনজন। উপর থেকে দেখা যাচ্ছে আস্তে-ধীরে মানুষের সমাগম হতে শুরু করেছে। মোতালেব সাহেব, আমি আর শামীমা মিলে একটা সিগারেটের পাছা পালাক্রমে টেনে চলেছি, এর মাঝেই শামীমা জামানের ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করে খানিকক্ষণ কথা বলতেই শামীমা জামানের মুখখানি কালো হয়ে এলো। মোতালেব সাহেব শঙ্কিত হয়ে বলল, কী হয়েছে শামীমা? কোনো সমস্যা?
– হ্যাঁ, মেয়েরা দেশে আসছে আগামীকাল। আমাকে নিয়ে যাবে নাকি। ঝলমল আকাশটা যেন মুহূর্তে মেঘে ছেয়ে গেলো। শামীমার চোখের সামনে যেন মুহূর্তে ভেসে উঠলো, মেয়েরা তাকে বিদেশ-বিভুঁইয়ের কোনো এক ঘরে একলা ফেলে যার যার কাজে ব্যস্ত, তারা পার্টি করছে, কেউ তার পুরো কথা শোনার আগেই মাঝপথে থামিয়ে দিচ্ছে বিরক্তি নিয়ে, তার কোনো বন্ধু নেই এই ঢাকার মতো । মোতালেব সাহেব প্রথমবারের মতো শামীমার হাতখানির উপর হাত রেখে ধরা গলায় বললেন, যতটুকু স্মৃতি কুড়ালে এ কদিন তা জাবর কেটে না হয় ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটাবেন। মন খারাপ করবেন না।
শামীমা মাথা নিচু করে নরম গলায় বলল, আপনি প্রেশারের ওষুধ খাননি এখনো। ওষুধটা বের করো তো শিহাব, আমার ব্যাগেই আছে। মোতালেব সাহেব শামীমার হাতটা ছেড়ে দিলেন, তার হয়তো সাহসে কুলাচ্ছে না এমন নিরব অধিকারের মানুষটাকে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাঠিয়ে দিতে কিংবা তার প্রতি থাকা শামীমার প্রচ্ছন্ন মায়ার খোঁজ পেয়েই ভয়ে হাতটা ছেড়ে দিলেন পাছে শামীমার অনুপস্থিতি তার মন খারাপের দাগকে যাতে মোটা না করে, চিকন দাগের মন খারাপ সয়ে নিলেও মোটা দাগের মন খারাপ সইবার বয়স, শক্তি কোনটাই যে তার নেই।
আমাদের শামীমা জামানের ফ্ল্যাটে রাতকে ভোর করার সময় নিখোঁজ হয়েছে মাস দুয়েক হলো, মোতালেব সাহেব এখন নিঃসঙ্গ হয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ান। আমি ফোন করলে আসেন, আবার উধাও হয়ে যান৷ যাবার আগে তৃপ্তির হাসি হেসে বলেন, শামীমা সেদিন ফোন করে ওর রিপোর্টের কথা জানালো, মোটামুটি সব ঠিকঠাক। ও সারাটাদিন একলা হয়ে থাকে, ও সমুদ্রের সেই রাত কিংবা ভোরের পাহাড় আর ফ্ল্যাটের কতশত গল্প যে তোলে! একটা মানুষ যখন জীবনের শেষ ক্ষণে এসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, গল্প বলার ছলে যখন কেবল বুড়ো বয়সের মধুর গল্প করে তখন বুঝে নিতে হবে তার স্মৃতির খাতা বড্ড ছোটো, ফ্যাকাশে আর যন্ত্রের মতো কর্তব্যর পেছনে ছোটার অতীত ছিল কেবল। যে অতীত ছিল কোনো এক যন্ত্রের, দু পায়ের স্বাধীন কোনো মনুষ্যের না। তুমি এমন অতীত নিয়ে বার্ধক্য ছুঁতে যেয়ো না শিহাব, তুমি আমার খুব প্রিয়।
আমি মোতালেব সাহেবের উত্তর দেই না।বিয়ের পরও শতাব্দীকে নিয়ে সপ্তাহে একদিন সিনেমাতে যাই এখন। মা, বউকে নিয়ে কখনো সিকিম যাই, কখনো জাফলং আবার কখনোবা সমুদ্র বিলাসে। ছদিন অফিস করার পর সাতদিনের মাথায় নিজের মতো বাঁচি, নিজেকে ভালোবাসি, নিজের বার্ধক্যর জন্য স্মৃতি কুড়াই । যে স্মৃতির জাবর কেটে ঢিলে চামড়া নিয়ে মৃত্যু ছোঁব । সঙ্গ দেবার জন্য বন্ধু খুঁজে নেব যখন ছেলেমেয়ে আমার কথা শোনার আগ্রহ হারাবে। জীবন্ত লাশ হয়ে মরবার অপেক্ষায় বাঁঁচলে জীবনের সবটা শুষে না নিয়ে মরে যাবার মতো উদার আমি হবো না। মরার আগে সবটা শুষে নিয়ে মরব। যাতে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে মনে হবে, “লাইফ ইজ বিউটিফুল “।
গল্পের বিষয়:
গল্প