রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই কোন কথা না বলেই জট করে নীলা আমায় জড়িয়ে ধরলো। বারান্দার এক কোণে তখন আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন। যেকোনো সময় তিনি এসে দেখে ফেলতে পারেন আমাদের এভাবে। আমি সাবধানে বললাম,’নীলা, আম্মা দেখে ফেলবে তো!’ নীলা ফিক করে হেসে উঠে বললো,’দেখে ফেলুক। আমি তবুও এভাবেই থাকবো। সারাদিন- রাত,সারা জনম এমনকি মৃত্যুর পরেও।’ আমি নীলার দিকে তাকিয়ে আছি।ওর ফর্সা দু ‘গালের উপর দু ‘ফোটা চোখের জল। আমি আস্হির হয়ে তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললাম,’কী হয়েছে নীলা? কাঁদছো তুমি?’ নীলা তখন লজ্জায় লাল হয়ে উঠে বললো,’এটা কষ্টের কান্না নয়। আনন্দের কান্না।’
তারপর নীলা আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে সে তার নরম পেটের উপর রেখে বললো,’এইখানে আমাদের নতুন মেহমান আসছেন। এই আনন্দে আমি কাঁদছি।’ ইশ্!শুনে আমার কী যে আনন্দ হলো! আমার মনে হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার আমি পেয়ে গেছি। পৃথিবীতে মনে হয় বাবা হতে যাবো এমন সংবাদের চেয়ে ভালো কোন সংবাদ আর নেই। আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে নীলার কপালে চুমু খেয়ে বললাম,’নীলা, তুমি কী চাইবে আমার কাছে আজ চাও।যা চাও ঠিক তাই দিবো।’ নীলা বললো,’দু রাখাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করুন। এরচেয়ে বেশি কিছু আমার চাওয়ার নাই।’
নীলার কথায় আমি দু ‘রাকাত নফল নামাজ পড়লাম ঠিকই কিন্তু উপহার তার জন্য আমি আনলামই।একটা সোনার চেইন গড়িয়ে এনেছি।এতে অবশ্য আম্মা আমার প্রতি রুষ্ট। আম্মা আমায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন,’ক’টাকার চাকরি করিস শুনি?বউয়ের বাচ্চা হবে এর জন্য ছত্রিশ হাজার টাকায় সোনার চেইন গড়িয়ে তার গলায় পড়িয়ে দিতে হবে একেবারে! দুনিয়ায় কী আর কোন মেয়ের বাল-বাচ্চা হয় নাই।হলেই কী তাদের গলায় সবাই সোনার চেইন পড়ায়?’ আমি বললাম,’আম্মা একটু আস্তে বলুন। নীলা শুনলে মন খারাপ করবে খুব!’ আম্মার গলা তখন আরো বাড়লো। তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন,’আমি কী তোর বউকে ভয় পায় নাকি? শুনুক।শুনিয়েই তো বলছি। শোন গর্দভ ছেলে।তোর বিয়েতে তোর শশুর কী দিছে? কয় টাকার জিনিস দিছে?আন্ডাটাও দেয়নাই।আর তুই তোর বউয়ের বাচ্চা হবে এই সংবাদ পেয়েই আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছত্রিশ হাজার টাকার চেইন গড়িয়ে ফেলছিস। আহাম্মক কোথাকার!’
আমি বললাম,’আম্মা থামুন আপনি। শশুর বাড়ি থেকে কী কিছু চেয়ে নিতে আছে? যৌতুক নেয়া কী ভালো?’
আম্মা কী আর তখন আমার নীতি নৈতিকতার কথা শুনেন। তিনি তার মতো গলা ছেড়ে যতটুকু পেরেছেন ততটুকু গালাগাল করেছেন।রাতে যখন নীলার পাশে শুয়ে আছি আমি তখন লক্ষ্য করলাম বালিশে মুখ চেপে নীলা কাঁদছে। আমি তাড়াহুড়ো করে নীলার পিঠে স্পর্শ করে বললাম,’এই নীলা,আজকেও কী কাঁদতে আছে?’ নীলা তখন আমায় টেনে তার বুকের সাথে মিশিয়ে বললো,’কেন আপনি আমার জন্য অত টাকা নষ্ট করলেন? আমি কী বলেছিলাম আমার অত দামী উপহার লাগবে? আপনি এক্ষুনি এটা আম্মার কাছে দিয়ে আসেন। আমি অত দামী চেইন গলায় পড়তে পারবো না!’
কথাগুলো বলে নীলা আমার বুকে মুখ চেপে অজড় ধারায় কাঁদতে লাগলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। নীলার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমি বললাম,’শোন নীলা,আম্মা তো বুড়ো মানুষ।বুড়ো মানুষেরা তো একটু এমনই হয়!তার কথা ছেড়ে দাও। আমি নিজে আম্মার হয়ে তোমার কাছে মাফ চাইছি!’ নীলা বললো,’ছিঃ ছিঃ! কোন স্বামীর কী তার স্ত্রীর কাছে এভাবে মাফ চাইতে আছে! তাছাড়া আমি আম্মার কথায়ও রাগ করিনি। এখন হয়েছে?’ আমি মৃদু হেসে নীলাকে কাছে টেনে ওর নাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললাম,’হয়েছে।’ নীলার শরীর ভারী হচ্ছে আস্তে আস্তে।পেট হচ্ছে স্ফীত। এখন তার রান্নাবান্না আর গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ করতে কষ্ট হয়। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠে। নামাজের রুকু আর সেজদায় যেতে কত যে মেহেনত করতে হয় তাকে!
আজকাল আমিও মাঝেমধ্যে অফিস কামাই করি।আম্মা তো বুড়ো মানুষ। তিনি তো আর সাহায্য করতে পারবেন না নীলার কাজে।তাই আমি সাহায্য করি।ওর জন্য জায়নামাজ টা পেতে দেয়া, তরকারি কুটা, চুলোয় নিয়ে বসিয়ে দেয়া এইগুলো। মাঝেমধ্যে নীলার কাপড় চোপড়ও ধুয়ে দেই। সেই কাপড় আবার ছাদে নিয়ে শুকোতে দেই। এইসব কিছু আবার আমাদের প্রতিবেশীদের চোখেও পরেছে।তারা এসে নাকি আম্মার কাছে অভিযোগ করেছে। আম্মা একদিন রাতে আমায় ডেকে বললেন,’ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোর জন্য আর মানুষকে মুখও দেখাতে পারবো না নাকি?পাড়া পড়শিরা কানাঘুষা করছে তোর এইসব মেয়েলি পনা কাজ দেখে।ওরা বলছে তুই বিয়ে করিসনি তোকেই নাকি বিয়ে করেছে তোর বউ।’ আম্মার কথাগুলো শুনে আমি খানিক সময় চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম ,’আম্মা, স্ত্রীর কাজে সাহায্য করা সুন্নত। আমি নবীর সুন্নত পালন করছি।’
আম্মা চুপ করে আছেন। কোন কথা বলতে পারছেন না। আমি আবার বললাম,’শুনুন আম্মা, মানুষের কথায় কিছু যায় আসে না। মানুষের কথা শোনার আগে আপনি শুনবেন আপনার বিবেকের কথা। আচ্ছা আপনার বিবেক কী বলে না একজনের স্ত্রী অসুস্থ,কাজ করতে পারছে না।অতএব তার স্বামীর তাকে সাহায্য করা উচিৎ?’ আম্মা উপর থেকে নিচে মাথা নামিয়ে হ্যা বোধক সম্মতি দিলেন। নীলার পেটের বাচ্চার বয়স যখন ছয় মাস তখন হঠাৎ একদিন বাথরুমে গিয়ে পা পিছলে সে পড়ে গেল।পড়ার পর সে এতোটাই আঘাত পেল যে তার গর্ভের বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসার আগেই মৃত্যু বরণ করলো। নীলাকে হাসপাতালে নেয়া হলো।সে একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলে সে শুধু বলছে,’আমার বাবুকে আমি নিজের হাতে খুন করে ফেলছি।ও আল্লাহ আমি খুনি। তুমি আমারেও দুনিয়া থেকে উঠাইয়া নেও।’
আম্মা তখন ধীর পায়ে নীলার কাছে গেলেন। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছি।ভাবছি, নীলাকে মনে হয় তিনি বকবেন। তাকে দায়ী করবেন সন্তান নষ্ট হওয়ার জন্য। কিন্তু না আম্মা এসব কিছু করলেন না। তিনি গিয়ে শান্ত শিষ্ট ভাবে নীলার পাশে বসে নীলার মাথাটা তার কোলে টেনে নিয়ে তার দুটো চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,’মারে, সন্তান হলো মাওলা পাকের দান। তিনি ইচ্ছা করলেই সন্তান দেন আর ইচ্ছা করলেই কেড়ে নেন।এর জন্য তো মন খারাপ করা যাবে না।সবর করতে হবে।সবর করলে আল্লাহ খুশি হন। খুশি হয়ে এর প্রতিদান দেন।ওমা,মাগো,আমি যে আগে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছি, নানান কথা শুনাইছি এইসব কিসের জন্য করছি জানো?নিজে যে শাশুড়ির হাতে জুলুমের শিকার হয়ে এসেছি এই জন্য। তাছাড়া তোমার শশুর তোমার স্বামীর মতো ছিল না গো মা।
সে তার মার কথায় উঠতে বসতে আমারে মারতো। দুইদিন পর পর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে যৌতুকের টাকা আনতে বলতো। ওদের অত্যাচারের শিকার হয়ে আমি ভাবছিলাম নিজে যখন সারা জীবন অত ঘানি টাইনা আসছি তাইলে আমার ঘরে কেডা শান্তি কইরা খায়বো? কিন্তু আমার ছেলের কথা শুনে বুঝতে পারছি মা,আমি যা করছি তা পাপ। স্ত্রীর উপর স্বামীর যেমন হক আছে স্বামীর উপরেও স্ত্রীর তেমন হক আছে। আমার ভাগ্যে স্বামী- শাশুড়ির সোহাগ জুটে নাই তাই বলে আমি কেন অন্য একটি মেয়ের সুখ নষ্ট করবো।ও মা,আমি বিরাট অপরাধী গো মা। এই মারে তুমি মাফ দেও।’ আম্মার কথাগুলো শুনে নীলা অজড় ধারায় কাঁদছে। আমি দূর থেকে এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখছি।দেখছি, আম্মার ঠোঁট কীভাবে স্পর্শ করছে তার পুত্র বধূর কপাল।
গল্পের বিষয়:
গল্প