বৃষ্টি এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।রিফাত এবার ক্লাস এইটে উঠেছে। তাদের মা আঞ্জুমান বেগমের মৃত্যুর পাঁচ বছর হয়ে গেছে। আর তাদের বাবা নাসিরুদ্দিন সাহেবের অসুস্থতাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।তাই তিনি বৃষ্টির বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন।দুনিয়া ত্যাগ করার আগে তিনি তার মেয়ের বিয়ের কাজটা দেখে যেতে চান।অবশ্য ছেলে আগে থেকেই ঠিক করা।নাম জাহিদ। এদিকে বৃষ্টি রানু খালার সাথে রান্না-বান্নার কাজ,বাবার খেয়াল রাখা,রিফাতের দিকে নজর রাখা সহ পরিবারের সকল দায়িত্বই কাঁধে তুলে নিয়েছে। আজকে রিফাতের জন্মদিন। রাত থেকে বন্ধু-বান্ধব সহ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। কিন্তু বাসার অবস্থা একদম সাদামাটা।এখন পর্যন্ত কেউ তাকে শুভেচ্ছা জানায়নি। বৃষ্টি আর রানু খালা এখন রান্না করছে।রিফাত কাছে এসে বলল,
-আপু,আজকে কত তারিখ তোমার মনে আছে? বৃষ্টি একটু ভেবে বলল,
-জুলাই মাসের চৌদ্দ তারিখ।
-এইটুকুই, আর কিছু মনে পড়ছে না?
-না। হতাশ হয়ে রিফাত তার ঘরে ফিরে গেল। ঘরে গিয়ে দেখল তার বন্ধু সাজ্জাদ ফোন দিয়েছে।
-শুভ জন্মদিন,দোস্ত।
-ধন্যবাদ,বন্ধু।
-আজকে খাওয়াবি কখন?
-হাতে টাকা-পয়সা নাই বন্ধু।বাসায় তো আমার জন্মদিনের কথা সবাই ভুলেই গেছে।এই অবস্থায় টাকা চাই কি করে।
-এসব কথা বললে চলবে না।আমি সবাইকে বলে দিচ্ছি তুই বিকালে খাওয়াচ্ছিস।
রিফাত ফোন কেটে দিয়ে ভাবতে লাগল, যেভাবেই হোক ইশারা ইঙ্গিতে তাকে বোঝাতেই হবে যে আজ তার জন্মদিন। মাথায় একটা সুন্দর প্ল্যান আসল রিফাতের।কলম কেনার কথা বলে সে বাইরে গেল। পাঁচ মিনিট পর কলিং বেলের শব্দ শুনে রানু খালা দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে রানু খালা চিৎকার করে বলল,
-বৃষ্টি, কই গেলা? দেহো আইয়া তোমার ভাই কি সাইজ্জা আইছে বাইরে থাইকা। চেঁচামেচি শুনে বৃষ্টি কাছে এসে বলল,
-কি হয়েছে খালা? রানু খালা জবাব দেওয়ার আগেই রিফাত বলল,
-আর বলোনা আপু।বাইরে গিয়েছিলাম কলম কিনতে।দোকানে যাওয়ার পথে হঠাৎ তিন-চারজন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল।এরপর জোর করে মাথায় ডিম ভেঙে দিয়েছে।আজকে জুলাই মাসের চৌদ্দ চারিখ তো তাই। বৃষ্টি রাগী মেজাজে রিফাতকে বলল,
-তো মাথায় ডিম নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? তোর মাথা থেকে কি এখন ডিম নিয়ে তরকারি রান্না করব?
যা, তাড়াতাড়ি গোসলে ঢুক। রিফাতের হতাশার মাত্রা আরও বেড়ে গেল।কোন কাজ তো হলো ই না।বরং এক হালি ডিম ও কিছু আটা বাবদ পঞ্চাশ টাকা খরচ হলো। রিফাতকে গোসলে পাঠিয়ে বৃষ্টি তার বাবার রুমে ঢুকলো। বৃষ্টিকে দেখে তার বাবা বলল,
-রিফাত কি করেছে রে?
-তোমার ছেলে সকাল থেকে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে আজকে ওর জন্মদিন। তার বাবা হেসে বলল,
-ছোট সময় তুইও তো তোর মায়ের সাথে এমন করতি।তোরই তো ভাই,এমন তো করবেই।
-একটু আগে কি করেছো জানো বাবা,বাইরে থেকে নিজের মাথায় ডিম ভেঙে ঘরে ঢুকেছে।
-এই কাজ কীসের জন্য?
-মনে হয় কিছু টাকার জন্যে। বন্ধুদের খাওয়াতে হবে তো।
-টাকা তো তোর কাছেই থাকে।ওখান থেকে কিছু দিয়ে দে। বৃষ্টি তার বাবার হাতে দুইহাজার টাকা দিয়ে বলল,
-চার তলার ভাড়াটিয়া আজকে ভাড়া দিয়ে গেছে।ওখান থেকে দুইহাজার টাকা সরিয়ে রেখেছি।এক হাজার টাকা রিফাত কে দিও আর এক হাজার নিজের কাছে রেখে দিও।টাকা দেওয়ার সময় তোমার ছেলেকে বলবে যাতে বাজে খরচ না করে।
-ঠিক আছে বলব।আর জাহিদের কি কোনো চাকরি-বাকরির খবর হলো?
-না,বাবা।
-কবে যে চাকরি হবে! তোকে ওর হাতে তুলে দিতে পারলেই বড় একটা কাজ থেকে রক্ষা পেতাম।
-এসব নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।মেধা থাকলে চাকরি এমনিতেই হবে।আমারও তো পড়াশোনা এখন শেষ হয়নি। গোসল শেষ করে রিফাত তার বাবার রুমে গিয়ে বলল,
-বৃষ্টি আপু বলল,তুমি নাকি আমায় ডেকে ছিলে?
-হুম।আমার পাশে বস।আজকে তোর জন্মদিন আর সকাল থেকে আমার কাছে একবারও আসলি না?
-তাহলে তোমার মনে আছে।বাড়ির আর সবাই তো ভুলেই গেছে।আমার এখনও মনে আছে আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মা এই দিনটাতে অনেক কিছু রান্না করত।বাসায় কেক বানাতো।
-আজকেও সব হবে।আমি তোর আপুকে বলে দিব সব কিছু করতে।
-তোমাকে কিছু বলতে হবে না।নিজে থেকে মন চাইলে এমনিতেই করতো। এরপর নাসিরুদ্দিন সাহেব রিফাতের হাতে দুইহাজার টাকা দিয়ে বললেন,
-এই টাকা গুলো রেখে দে।দরকারের সময় খরচ করিস। রিফাত টাকা গুলো হাতে নিয়ে বলল,
-আজকেই টাকাগুলোর দরকার ছিল বাবা।তুমি ছাড়া আর কেউ আমার মন বোঝে না। মূহুর্তের মধ্যেই রিফাত তার বন্ধুদের ফোন করে বের হওয়ার জন্য বলল।সে এখন বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।
তার আপু রুমে ঢুকে বলল,
-কোথাও যাচ্ছিস নাকি?
-হুম।যেকোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকে পরব।
-হঠাৎ রেস্টুরেন্টে কেন?
-তুমি তো ভুলেই গেছ আজকে আমার জন্মদিন।তাই বন্ধুদের ট্রিট দেওয়ার জন্য যাচ্ছি রেস্টুরেন্টে।
-তো টাকা কোথায় পেলি?
-বাবা দিয়েছে।
-কত দিল?
-দুই হাজার।
-আমাকে একহাজার দিয়ে দে।এত টাকা দিয়ে কি করবি?
-কেন! তোমার হিংসা হচ্ছে?
-হিংসা তো কিছু হচ্ছেই।
-এক টাকাও দিব না।তুমি তো ছোট সময় মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাইরে থেকে খেয়ে আসতে।আর আমার জন্য চকলেট,চিপস নিয়ে আসতে।আমিও তোমার জন্য তাই নিয়ে আসব।
-আমার জন্য এগুলো কিনতে হবে না।তোর জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনেছিলাম আগে এইটা পড়ে দেখ ঠিক হয় নাকি। বৃষ্টি রিফাতের হাতে নতুন পাঞ্জাবী দিয়ে বলল,
-এই পাঞ্জাবী পড়ে বাইরে যা।নায়কের মতো লাগবে।আবার বেশি খাবার খেয়ে ফেলিস না।বাড়িতে খাওয়ার জন্যও পেটে কিছু জায়গা রাখিস।এখানেও ভালো-মন্দ কিছু রান্না হচ্ছে। রিফাত বাইরে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর রানু খালা দৌড়ে এসে বৃষ্টিকে বলল,
-খালুজান তোমারে ডাকতাছে।মনে হয় কোনো সুসংবাদ। বৃষ্টি তার বাবার কাছে গিয়ে বলল,
-কি হয়েছে বাবা?
-জাহিদের মা ফোন করেছিল।তুই কিছু জানিস না?
-কেনো কি হয়েছে?
-আরে জাহিদের চাকরি হয়ে গেছে।খুব ভালো চাকরি।
-আমাকে তো কিছু বলল না।
-জানাবে পরে বোধহয়। আমাকে তো ফোন দিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করার কথা বলল। বৃষ্টি তার রুমে গিয়ে জাহিদকে ফোন দিল।
-কি খবর তোমার?
-তোমার বাবার কাছ থেকে কি কোনো খবর শোনোনি?
-শুনেই ফোন দিলাম।শুনলাম বিয়ের প্রস্তাব নাকি পাঠিয়েছ?
-হুম।আগামী শুক্রবার দিন ধার্য করার চিন্তাভাবনা চলছে।তুমি কি বলো?
-শুক্রবার হোক আর যেই দিনই হোক।আমার শর্ত একটা-ই।
-কি শর্ত?
-বিয়ের দিন বৃষ্টি হতে হবে।
-এটা আবার কেমন শর্ত।বৃষ্টি তো আর আমরা ইচ্ছা করে আকাশ থেকে ফেলতে পারব না।
-আমার এই একটাই শর্ত।বৃষ্টি হলে বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই।তবে বৃষ্টি না হলে আমি কবুল বলছি না।
-তোমার কি মাথা কি ঠিক আছে।এমন শর্ত তো আগে কোনো বিয়েতে শুনিনি। আর কিছু বলার আগেই বৃষ্টি ফোন রেখে দিল। পরের দিন সকালে রিফাত বৃষ্টির কাছে কতগুলো চিঠি নিয়ে এসে কানে কানে বলল,
-আপু,বাবার রুমে পেয়েছি।মনে হয় বাবা-মার বিয়ের আগের চিঠি। বৃষ্টি ধমকাধমকি করে চিঠি গুলো নিজের হাতে নিয়ে রিফাতকে বলল,
-বাবা-মার চিঠি তুই হাতে নিলি কোন সাহসে।এসব চিঠি পড়ার তোর বয়স হয়নি।তুই তোর রুমে যা। রিফাত কে রুম থেকে বিদায় করে বৃষ্টি চিঠি গুলো পড়তে শুরু করলো। চিঠি পড়ে সে বুঝতে পারল,তার মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের রাতে বৃষ্টি হলে দুজন একসাথে ভিজবে।তার বাবাও সম্মতি দিয়েছিল। এখন বৃষ্টির খুব জানতে ইচ্ছে করছে যে বিয়ের রাতে কি বৃষ্টি হয়েছিল নাকি। সে চিঠিগুলো তার রুমে রেখে বাবার কাছে গিয়ে বসলো।
-বাবা আমার একটা বিষয় খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
-কি কথা বল।
-মায়ের তো খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ের রাতে বৃষ্টিতে ভেজার।বৃষ্টি কি ঐ রাতে হয়েছিল?
-হুম।
-ভিজেছিলে বৃষ্টিতে?
-না।
-কেন?
-ছাদে যাওয়ার অনেকে চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু বাড়ি ভরতি মানুষ ছিল।তোর মাকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার পরিস্থিতি ছিল না।
-একটা বিষয় খেয়াল করেছো বাবা।আমরা সবাই মাকে কষ্ট দিয়েই গেলাম।মা তার জীবনের অনেকে ইচ্ছা থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর জাহিদ ফোন দিয়ে বলল,
– মোটামুটি বৃষ্টির একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
– কীভাবে?
-আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে খবর নিয়েছি আগামী ২০,২১,২২ তারিখে আমাদের এলাকায় বৃষ্টি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
-ঠিক আছে।বৃষ্টির জন্য আবহাওয়া অধিদপ্তর পর্যন্ত খবর নিয়েছ শুনে ভালো লাগল।
-তাহলে তো আর কোনো আপত্তি রইলো না।আগামী একুশ তারিখ তাহলে বিয়ের দিন ধার্য করছি।
আজকে জুলাই মাসের একুশ তারিখ। সারাদিন বৃষ্টি না হলেও বিয়ের কাজ ঠিক ভাবেই সম্পন্ন হলো। জাহিদ বাসর ঘরে ঢুকতেই বৃষ্টি চাপা গলায় বলল,
-মিথ্যুক তুমি।বৃষ্টি নিয়ে মিথ্যা কেন বলেছিলে?
-আমি কোথায় মিথ্যা বললাম।আমাকে তো আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলেছে।তবে এখন কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে।
-সত্যি?
-হুম।প্রচুর বৃষ্টি। বৃষ্টি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা খুলে দেখলো সত্যিই প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। সে জাহিদ কে বলল,
-বৃষ্টিতে ভিজব।
-কখন?
-এখন।
-এখন কীভাবে সম্ভব।মাথা ঠিক আছে তোমার?
-মাথা ঠিকই আছে।ব্যবস্থা করো তুমি।
-আরে বাসা ভরতি মেহমান।এর মধ্যে তুমি বাড়ির নতুন বউ।এই অবস্থায় তোমাকে নিয়ে ছাদে যাবো কি করে?
-আমি জানি না।কিন্তু যেতে হবেই।তুমি না গেলে আমি একলা চলে যাবো।
-আরে দাঁড়াও দেখছি কি করা যায়।এই শর্তের কথা আগে বললে না কেন?
-সবকিছু আগে থেকে জানা থাকলে এখন যে থ্রিলটা তোমার মধ্যে কাজ করছে তা কি করতো?
-চুপ করে বসো তো। দেখছি কি করা যায়।
অবশেষে জাহিদ তার ছোট বোনের সহায়তায় অনেক কষ্টে বৃষ্টিকে নিয়ে ছাদে গেল ভিজতে। এদিকে রিফাত বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছে অনেক আগেই তার জন্মদাত্রী নিষ্ঠুর মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।আজ বিদায় নিল তার মায়েরই এক প্রতিচ্ছবি তার দায়িত্ব থেকে। এখন কি সে পারবে পরিবারের দায়িত্ব গুলো নিজের কাঁধে তুলে নিতে?
গল্পের বিষয়:
গল্প