আমি এই বিবাহিতা স্বামী মারা যাওয়া মেয়েকে তার সন্তান সহ গ্রহন করব। বলে দিলাম মাকে। অনেক অনেক আগে,, তখন একদিন বাজারে গিয়ে সবজি দোকানে সবজি দাম করছি। এই ৮০ টাকার মধ্যে তিন রকমের সবজি কিনতে হবে আমাকে। ঘরে মেহমান আসবে আজ। মা আমাকে এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে মাংশ সহ অল্প অল্প সব রকম দরকারি জিনিষগুলো কেনার জন্য বলেছে। যাতে এই এক হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যায় সব। এর বাড়তি হবে না। মাস শেষের দিকে, আর মধ্যবিত্ত পরিবারে মাস শেষ মানে কোনো রকম মেনেজ করা। তার উপর যদি আসে মেহমান তাহলে তো আর হয়ে ই গেল। সবকিছু মোটামুটি কিনে এই টাকা টা সবজির জন্য অবশিষ্ট রইল। আমার কাছেও তেমন টাকা নেই। টিউশনের টাকাটা অনেক আগে ই ভিবিন্ন কাজে শেষ হয়ে গেছে।
শীত চলে যাওয়ার পথে তবে এখনো যায় নি। তারপরও প্রচন্ড গরমে একদম ঘেমে গেছি। সারা বাজার ঘুরে টাকা মোতাবেক কিনা কম কথা নয়। আর সেটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। সবসময় দেখতাম বাবার সেই পিছনে ঘামে ভেজা শার্ট সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘরের জন্য বাজার করে বাড়ি ফিরতেন কিন্তু মুখে একটা হাসি থাকত। সেই হাসির শুভ্রতা আমি আর কোথাও খুঁজে পাই না। হঠাৎ একটা দেকানের পাশে দাড়িয়ে ছিলাম কি কারণে জানিনা। হয়ত একটু হাপিয়ে গেছি। একটু পরে ই কেউ একজন পেছনে থেকে এসে একটা আইসক্রিম এগিয়ে দিল। আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই। এমন করে আইসক্রিম এগিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে জানলাম। মেয়েটার রেজাল্ট বের হয়েছে আর সে যশোর বোর্ডে ফাস্ট হয়েছে তাই বাড়ি ফেরার পথে সে যাকে সামনে পেয়েছে তাকে ই আইসক্রিম বা মিষ্টি দিচ্ছে। আমি নিতে না চাইলেও জোর করে দিয়ে গেল।
আমি শেষে আর কিছু না বলে নিয়ে নিলাম। বেশ ভালো ই লাগছিল। মনে হয় এটার প্রয়োজন ছিল। তবে কেন জানি মেয়েটার মুখ বার বার মনে পড়ছিল। কোনো এক অজানা কারণে ভালো লাগছিল। বাসায় এসে বাজার রেখে মেয়েটার খুঁজ নিলাম। আমাদের অপর এলাকার থাকে মেয়েটি। পড়াশোনা, পরিবার খুব ভালো। এরপর থেকে কেমন একটা পরির্তন আসল যেন। সবকিছু রেখে কেমন একটা আনমনে থাকতাম। কি যেন ভাবতাম। নিজের পোশাকের প্রতি আরে যত্নশীল হলাম চেহারা দিকেও নজর দিলাম। যদিও অতটা খারাপ নই দেখতে। কিন্তু বাবার অকাল গমনে যেন হঠাৎ করে আমাদের স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত জীবন টা থমকে গেল। কোথায় যেন সুরের ছন্দ পতন হল। আচ্ছা কেন জীবন টা এমন হয় ! কত স্বপ্ন দেখতাম বাবার সেই ঘামে ভেঁজা শার্ট আর পড়তে দিব না। বাবার এই মুখের হাসিটা থেকে মনের লুকানো কষ্ট গুলো সরিয়ে নেব। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মধ্যবিত্ত বাবা দের কপাল টা এত মন্দ করে কেন পাঠান জানি না আমি। শুধু বাবার শেষ চেহারাটা মনে করে করে যেন আমার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল।
তবে ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ছেলেদের। তাদের সব কষ্ট লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে বাস্তবতা মেনে নিয়ে চলতে হয়। হাজার না পাওয়ার আর্তনাদ সকালের সূর্যের আলো তে বিলিয়ে দিতে হয়। পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ল আমার উপর। বড় বোনটার বিয়ে, সংসার খরচ, ছোট ভাইটার পড়াশোনা সহ নিজের পড়াশোনা। সব কিছু বহন করতে যেন হিমশিম খাচ্ছিলাম। আপু সেলাই করে সংসারে কিছু সাহায্য করত কিন্তু আপুর বিয়ে এখন কি ভাবে কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। বাবা মারা যাওয়ার আগে ব্যাংকে যা টাকা রেখেছিলেন তাতে আরো কিছু যোগ করে বিয়ের খরচ টা তুললাম অনেক কষ্টে। পার্ট টাইম একটা চাকরি করি স্যালসম্যানের। যত ই বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছিল ভয় পাচ্ছিলাম আপু বিয়েতে যদি কিছু কমতি পরে।
বিয়ের আগের দিন রাতে আপু কে ডেকে মুখ নিচু করে পকেট থেকে একজোড়া কানের দুল দিলাম। আর বললাম, আপু আমার পক্ষ থেকে এর থেকে বেশি কিছু দিতে পারলাম না। জানিস তো সবকিছু একটু দেখতে হচ্ছে আর আমি তেমন ভালো কিছু করি না। এই কয়দিনে একটু একটু করে জমানো টাকা থেকে এটা কিনে এনেছি তোর জন্য। আপু তুই না মার্কেটে গিয়ে পছন্দ করেছিলি টাকা না থাকায় কিনতে পারিস নি। আমি কিন্তু দেখেছি খারাপ লাগছিল ভীষণ বোনকে ভাই হয়েও কিনে দিতে পারছি না বলে। আজ একটা টিউশনির টাকাটা পেয়ে কোনো কিছু না ভেবে কিনে আনলাম। বোনের এই ছোট ইচ্ছা টা না হয় পূরণ করি।
আপু আমার হাত ধরে অঝরে কাঁদতে লাগল। না এ কান্না দুঃখের নয়। এক ভাইয়ের কাছে থেকে পাওয়া ভালোবাসার কান্না। আপু কেঁদে কেঁদে বলছিল আমি এত বড় হলাম কবে..! আপু হয়ত জানে না, মধ্যবিত্ত ছেলেদের খুব তাড়াতারি বড় হয়ে যেতে হয়। কারণ পরিস্থিতি তাদের বড় বানিয়ে দেয় বয়সে না অভিজ্ঞতায়। সে দিন ভাইবোনের কান্না দেখে মাও কেঁদেছিল অনেকক্ষণ। আপুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আরো কঠিন হয়ে গেল সবকিছু আমার জন্য। নিজের পড়ালেখা মাঝপথে বন্ধ করে দিলাম। পরিবারের ভরণপোষণ ছোট ভাই বোনের পড়াশোনা। গ্রামে বাড়ি বন্ধক রেখে পাড়ি জমালাম প্রবাসে। মাঝখানে যে মেয়েটির ছবি আমার মনে একেঁছিলাম বাস্তবতা তাকে আমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেল। অনেক ভাবনার মাঝে যেন এই ভাবনা টা চাপা পরে গেল। তবুও যখন মনে হত, তখন ভাবতাম সৃষ্টিকর্তা তো একজনকে রেখেছেন আমার জন্য আমার সকল চাওয়া না হয় তাতে ই পূর্ণ হবে।
সব অদূর ভাবনাকে দূরে সরিয়ে আমার প্রবাস জীবন কাটতে লাগল। মাঝে মাঝে অনেক একা লাগত ভাবতাম একটা কথা বলার মানুষ যদি পেতাম। তখন ই মেয়েটার মুখ ভেসে উঠত আর তখনি আমি নিজেকে সামলে নিতাম। সে হয়ত এখন অন্যকারো। আর অন্যকারো মানুষকে নিয়ে আমার চিন্তা খেলা করতে পারে না একদম পারে না।
প্রবাসে দিন শেষে যখন জায়নামাজে বসতাম তখন পরিবারের কথা মনে করে খুব কাঁদতাম। মায়ের হাতে রান্নার স্বাদ যেন আমাকে তৃষ্ণার মত টানত। বাবার কথা মনে পড়লে তখন চোখ আর বাঁধা মানত না..! প্রায় ১০ বছর পর সবকিছু অনেকটা সামলে নিয়ে দেশের জন্য পা বাড়ালাম। মায়ের শরীর টাও নাকি খারাপ। সবকিছু একটু গুছিয়ে আসছি। অনেক ভালো লাগা কাজ করল মনে। অনেক দিন পর পরিবারের সবাইকে দেখে মনটা ভরে উঠল। মোবাইলের দেখায় কি সেই স্বাদ মিটে। বাড়িতে আরো কিছু কাজ শেষে জমিজমা সব নিজের কাছে এনে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তখন ই মা বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়া শুরু করল..! কি বলব না বলব ভেবে শেষমেষ হ্যা বলে দিলাম। মা মেয়ে দেখা শুরু করল। এক জায়গায় মেয়ে দেখতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে যাই। আমি আমার সেই পরনো চিত্রাকে খুঁজে পাই সেখানে…!
অথচ সেখানে আমি তার ছোট বোনকে দেখতে গিয়েছি । আমার বুকটা যেন মনের অজান্তে কেঁদে উঠল। আমি সামলাতে পারছি না কোনো রকম ই। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল সে অন্যকারো এখন। তারপর আমি বার বার তার দিকে তাকাচ্ছি। আসার সময় জানতে পারলাম চিত্রার স্বামী ১ বছর আগে মারা গেছে। তার ২ বছরের একটা সন্তানও আছে। আমার মন টা তখন কোনো এক অজানা কারণে নেচে উঠল। হয়ত আমি আমার মানুষটা পেতে পারি। হয়ত এই মানুষটা আমার হবে। এরকম অসংখ্যা প্রশ্নের ভীরে আমি চিত্রাকে খুজলাম। কিন্তু সে কি রাজি হবে…! অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে মাকে আমার কথাটা বললাম। যদিও মা আপত্তি করছিল তারপরেও রাজি হয়ে গেল কারন চিত্রা পছন্দ হওয়ার মত মেয়ে। আর যেখানে আমি রাজি চিত্রাকে সন্তান সহ গ্রহন করে তখন ঐ পরিবার অমত করবে না।
অনেক কিছুর পর পরিবার সম্মত হল..! কিন্তু চিত্রার একটা ই কথা বিয়ের আগে সে আমার সাথে কোনো কথা বলবে না। সবার কাছে কিরকম লাগলেও আমি মেনে নিলাম। নিজের পছন্দের মানুষকে যখন একেবারে পেতে চলেছি তখন এইটুকু সময় তো অপেক্ষা করতে ই পারি..! কোনো এক অজানা কারণে ভাঁসছিলাম। আমার সব অপূর্ণতা আজ পূর্ণতার পথে। এজন্য ই হয়ত বিধাতা আমার মনে ওকে ই রেখে দিয়ে ছিলেন যখন আমি কাউকে চাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম তখন ই চিত্রা ভেসে উঠত। সত্য ঐ বিধির বিধান বুঝা দায়। বিয়ের আগের দিন। সবাই খুশি সব থেকে খুশি আমি নিজে। কজনের এমন ভাগ্য থাকে ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পাওয়ার আমি অপেক্ষা করছিলাম চিত্রাকে দেখার হঠাৎ দু বছরের মেয়েটি আমার কোলে এসে বলল, আচ্ছা আমি তোমাকে কি ডাকব..?
— এক কথায় উত্তর দিলাম বাবা। বাবা বলে ডাকবে আমায়। কথাটা বলতে ই মেয়েটা গলা জড়িয়ে ধরল আমার। আর আমি যেন সত্যিকার কোনো এক নতুন মায়ার সন্ধান পেলাম। হাসিতে চোখে জল আসল। আমি লুকিয়ে নিলাম সেটা হঠাৎ হইচই পরে গেল। সব এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। কেউ পানি হাতে কেউ ফোন হাতে। জানতে পারলাম। চিত্রা অসুস্থ হয়ে পরেছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। বুজলাম হয়ত পুরনো কিছু মনে করে এমন হয়েছে। অনেক কথা ই মনে পড়তে পারে। কিন্তু ডাক্তার যখন এসে বলল, ‘ সি ইজ নো মোর ‘ — তখন কোথায় প্রচন্ড রকম ধাক্কা খেলাম। সমস্থ পৃথিবীটা যেন অন্ধকার লাগছিল। আমার সব সাজানো স্বপ্ন…!!! চিত্রা স্টোক করেছে। এই বয়সে স্টোক করার কথা না। তারপরও কোনো অজানা কারণে হয়েছে সেটা।
আরো জানলাম সে তার স্বামীকেও নাকি খুব ভালোবাসত। হয়ত সবার কথায় সব মেনে নিয়েছিল। কিন্তু মন কি সবার কথা শুনে! মন তো মনের মত চলে! কি অদ্ভুত না আমাদের জীবন পাওয়া না পাওয়ার লীলাখেলা তে আমরা হারিয়ে যাই। আমি কি করব ..! আমি সমলাবো কিভাবে নিজেকে। নিজের দেখা এত স্বপ্ন কেন বিধাতা কাছে এনেও ছিনিয়ে নিলেন। এই অভিযোগ আমি কাকে দিব? অনেকটা বুক ভাঙা আর্তনাদ চাপা দিতে কষ্ট যে আমার। খুব কষ্ট হচ্ছে! আমিও যে মানুষ হঠাৎ, পিছনে কারো ‘ বাবা ‘ ডাকে ফিরলাম। হ্যা, আমার মেয়ে ই তো……
গল্পের বিষয়:
গল্প