বিয়ের তিন বছর পর আমার যে কন্যা সন্তান জন্ম নিলো সে অন্ধ। চোখে দেখতে পায় না।অথচ কী মিষ্টি তার মুখ,গাঢ় সুন্দর হাসি। যখন ছোট বাচ্চাদের ফুল কিংবা রঙিন কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে উল্লাস করার বয়স হয় সেই বয়সে আমার মেয়েটা চোখ পিটপিট করে হাত পা নাচিয়ে উল্লাস করলো না।তার তাকানো দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে তার চোখে আলো নেই।সে অন্ধ। এটা শুধু আমি একাই আবিষ্কার করিনি কন্যার বাপ আর তার দাদিও আবিষ্কার করেছিলেন।কন্যার দাদি অর্থাৎ আমার শাশুড়ি তখন থেকে আমায় রাত দিন বকতে শুরু করলেন।
অলক্ষ্মী,অপয়া ঘরে এনেছি। এই অলক্ষ্মী আরেকটা অলক্ষীকে পয়দা করেছে। এখন এটাকে পাড় করবি কী করে রে!ঘরে কী সিন্দুক ভর্তি টাকা আছে রে যে তা জামাইকে দিয়ে ঘর খালি করবি?’ আরো কত অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন তিনি। একদিন তো ত্যাড়ে মারতেই এলেন।মারতে এলেন এই জন্য যে আমি বলেছিলাম,’মেয়েকে কী আমি অন্ধ বানিয়েছি। যে অন্ধ করে পাঠিয়েছে তাকে বকুন।তার সাথে তর্ক করুন, আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছেন কেন? আমার কী দোষ?’
শাশুড়িমার মাথা তখন আউলে গেল। নিজের পুত্রবধূ তার মুখের উপর কথা বলে দিয়েছে।একে কী আর আস্ত রাখা যায়!পর মানুষে শুনে থাকলে তার মান সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে আল্লাহ জানেন! আমার শাশুড়ি সঙ্গে সঙ্গে দপদপ করে পা ফেলে আমার কাছে এসে আমার ঘাড়ে ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন না তার ছেলে অর্থাৎ আমার স্বামীর জন্য। তিনি আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরেছেন মাত্র। ঠিক তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এমন এক বর্বর দৃশ্য। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন,’ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আম্মা, আপনি অত নীচ হয়েছেন কী করে!’
আমার শাশুড়ি সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলেন। থেমে গিয়ে তার ছেলেকে বললেন,’তোর অপয়া বউটার জন্য আমায় নীচ বলেছিস!ওই অপয়া টা সব ধ্বংস করবে।সবে তো শুরু।ও শুধু অন্ধ সন্তান নয় পুরো সংসারটা অন্ধ করে ছাড়বে!’
বলে আমার শাশুড়ি রাগে কেঁদেই ফেললেন। আমার স্বামী তখন তার টুপিটা মাথা থেকে খুলে ভাজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বললেন,’আম্মা, আপনার আর সংসার ভাঙা নিয়ে ভাবতে হবে না। এই অপয়া স্ত্রী আর অপয়া কন্যা নিয়ে আমি আপনার বাড়িতে থাকবো না।আজ এক্ষুনি চলে যাবো।’
বলে তিনি আমাদের অন্ধ কন্যাকে তার কোলে টেনে নিয়ে চুমু খেতে খেতে আমায় বললেন,’ইলমা, বোরখা পড়ে নাও এক্ষুনি।আর ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও।আমরা মাগরিব পড়েই বের হবো।’ স্বামীর কথার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঘরে গিয়ে কাপড়ের ব্যগটা গুছিয়ে বোরখা পড়ে নিলাম। আমার শাশুড়ি মা তখন রাগে ফুসফুস করে বলতে লাগলেন,’দেখা যাবে বাইরে কতদিন টেকো। এইসব চল চাতুরি।ভেবেছো পা ধরে তোমাদের ফিরাবো?এটা ভুল।অলক্ষ্মী অপয়ার পা আমি ধরবো না কোনদিন। দুদিন পর তোমরাই ফিরে এসে পা ছুঁবে আমার।’
মাগরিব পড়ে আমরা বাড়ি থেকে বের হলাম।বাড়ির গেট থেকে রিক্সা করে স্টেশন পর্যন্ত এলাম।আসার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেন চলে এলো।আমরা একটা কামড়ায় উঠে গিয়ে বসলাম।আমরা যে সিটে বসেছি তার সামনে অর্ধ বয়স্ক এক দম্পতি বসেছেন।আধ পাকা চুল তাদের। মেয়ে লোকটির মাথা থেকে কপাল পর্যন্ত লাল টকটকে সিদূর মাখা।হাতে শাখা।দেখেই বুঝা যায় সনাতন ধর্মের।মহিলাটির হাসি কী মিষ্টি! তিনি সংকোচ ঠেলে ফেলে আমায় বললেন ,’বাবুটার নাম কী?’ আমি মৃদু হেসে বললাম,’জান্নাত। জান্নাতুল ফেরদৌস।’ মহিলাটি গাঢ় হেসে বললেন,’কী ভালো নাম! আসলেই আপনার বাবুটা স্বর্গের মতো সুন্দর। যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনার বাবুটাকে আমার কোলে যদি দিতেন!’ আমি বললাম,’না কোন সমস্যা নাই।নিন,কোলে নিন।’ বলে জান্নাতকে মেয়ে লোকটির কোলে তুলে দিলাম। তিনি জান্নাতকে কোলে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন।গালে কপালে চুমু খেতে খেতে কত কত মিষ্টি কথা যে বললেন। তারপর জড়জড় করে হঠাৎ করে কেঁদে উঠলেন। আমি বড় অবাক হয়ে বললাম,’কী হয়েছে দিদি,কী হয়েছে?’
তিনি দীর্ঘ এক দীর্ঘশ্বাস টেনে ভেজা গলায় বললেন,’আজ তিরিশ বছর হয়ে এলো আমরা ঘর সংসার করছি। এখন অবধি একটা সন্তানের মুখ দেখতে পেলাম না। ভগবানের কাছে কত চেয়েছি।কত মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছি। কিন্তু ভগবান আমায় মা হতে দেননি। শুধু মেয়ে করেই বৃদ্ধা বানিয়ে দিলেন!’ কথাগুলো বলে আবার কেঁদে উঠলেন তিনি।মেয়ে লোকটির পাশে বসা তার স্বামীর চোখ থেকেও টপটপ করে রংহীন জল গড়িয়ে পড়ছে তার গালের উপর। আমার স্বামীকে দেখছি কেমন হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এই এক জোড়া সন্তানহীন দম্পতির দিকে।কী বলে যে তাদের সান্ত্বনা দিবো বুঝতে পারছিলাম না আমরা।
আমাদের গন্তব্যে যেতে আরো দু স্টেশন বাকী। তখন হিন্দু মেয়েলোকটি বললেন,’এই স্টেশনেই আমরা নেমে যাবো বোন। আপনার রাজকন্যা ঘুমিয়ে গেছে।ওর জন্য একটা সামান্য উপহার দিতে চাইছিলাম যদি আপনি কিছু মনে না করেন তবে ‘আমি হেসে বললাম ,’আপনি তো ওর আন্টিদের মতই। আন্টি যদি তার ভাগ্নীকে কিছু দিতে চায় তবে তাতে মনে করার কী আছে!’ হিন্দু মেয়ে লোকটি তখন তার কাঁধের ঝুলি থেকে একটা ছোট্ট সোনার আংটি বের করে জান্নাতের হাতের আঙুলে পরিয়ে দিয়ে ওর আঙুলটা কাছে টেনে চুমু খেয়ে বললেন,’যাই।’ স্টেশনে ট্রেন থেমে গেলে তারা নেমে গেলেন। আমি আর জান্নাতের বাবা ওদের চলে যাওয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
ট্রেন আবার ছুটছে।জানলা দিয়ে মৃদু বাতাস এসে লাগছে আমাদের গায়ে। জান্নাতের ঠান্ডা লাগতে পারে এই ভয়ে তার বাবা নিজের গায়ের শার্ট খুলে মেয়ের উপর জড়িয়ে দিলেন। তারপর আমার হাতটা স্পর্শ করে বললেন,’জান্নাতের আম্মু?’ আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন,’সন্তান মহান আল্লাহর দান। এই সন্তান যার নাই সে বুঝে এর কত মূল্য। মায়ের কাছে কি’বা বাবার কাছে ছেলে/মেয়ে/অন্ধ/হাত-পা ভাঙা নামের কোন সন্তান নেই।মা-বাবার কাছে সন্তান মানে শুধুই তার রাজ পুত্র কিংবা রাজকন্যা।’ জান্নাতের আব্বুর দিকে আমি তাকিয়ে রইলাম।ওর চোখে মুখে যে আনন্দের দ্যুতি আমি দেখছি তার মূল্য আমার কাছে শাহজাহানের তাজমহলের চেয়েও বেশি।
গল্পের বিষয়:
গল্প