শশুর বাড়ি যাচ্ছি। মিতু রেগে গিয়ে বলল, খালি হাতে কেউ শশুর বাড়ি যায়? আমার জীবনে দেখিনাই। আমারও তাই মনে হলো, খালি হাতে শশুর বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না। কিছু তো নেওয়া দরকার। কিন্তু কি নেওয়া যায়! ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল, রাস্তার পাশে এক ব্যাক্তি, বিক্রি কারার জন্য বড় সাইজের দুইটা কাঁঠাল নিয়ে বসে আছে। আমি দামাদামি করে, খুব সস্তায় কাঁঠাল দুইটা কিনলাম।
মাথায় কাঁঠাল নিয়ে, মিতুর কাছে আসতেই মিতু রেগে বলল, তোমার মত মানুষ জীবনে দেখিনাই। তুমি মাথায় কইরা কাঁঠালের বোঝা নিয়ে শশুর বাড়ি যাইবা! একটু লজ্জা নাই। মিতুকে থামিয়ে বললাম, দেখো, কাঁঠাল নিয়ে একদম বাজে কথা বলবা না, এটা জাতীয় ফল। আর এত বড় কাঁঠাল তোমার বাবা জীবনে দেখেনাই। কাঁঠাল দুইটা বেশ নরম ছিল। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম, কাঁঠালের রস মাথা বেয়ে পড়ছে। আমি জিভ দিয়ে হালকা টেস্ট করলাম মিষ্টি কেমন। ভালই মিষ্টি। শশুর বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। উঠানে শাশুড়ি দাড়িয়ে ছিল, আমার মাথায় কাঁঠাল দেখে তব্দা খেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। হয়তো এত বড় কাঁঠাল আগে দেখেনি। আমি ঘরে কাঁঠাল রেখে বাইরে আসতেই দেখি, দুই শালী ও তাদের জামাই আসছে। তারাও দুইটা করে কাঁঠাল নিয়ে আসছে।
ফ্রেশ হয়ে, সবাই মিলে গল্প করছিলাম। কার কাঁঠালের কত দাম। এরই মধ্যে রাতে খাবারের জন্য শাশুড়ি ডাক দিল।
তিন ভায়রা ভাই খেতে বসতেই শাশুড়ি, নিজ মায়ের মতো মমতা ভরা কন্ঠে বলল, “এত কষ্ট করে কাঁঠাল আনছ, নাও খাও। বলেই এক বাটি করে কাঁঠাল আমাদের সামনে দিল।” আমরা কাঁঠাল খেতে শুরু করলাম। খাওয়া শেষ হতে না হতেই, আরেক বাটি করে কাঁঠাল দিয়ে শাশুড়ি বলল, অন্য আরেকটা কাঁঠালের আরেকে বাটি। আলাদা করে দিলাম, যাতে স্বাদটা বুঝতে পারো” দুইটা কাঁঠাল নিছি, তাই সকলকে নিজ নিজ কাঁঠালের দুই বাটি করে কাঁঠাল দিছে। আমি দ্বিতীয় বাটি থেকে কাঁঠাল খেতে লাগলাম। দ্বিতীয় বাটি কাঁঠাল শেষ হতে না হতেই, শাশুড়ি আরেক বাটি কাঁঠাল দিয়ে বলল, “এই নাও, এটা আমাদের বাড়ির গাছের কাঁঠাল।” লজ্জায় কেউ না করতে পারছিনা, আবার খেতেও পারছিনা। কোন রকমের তৃতীয় বাটি থেকে কাঁঠাল খেতে লাগলাম।
আমার পেটে আর একদম জায়গা নেই। তৃতীয় বাটি কাঁঠাল শেষ হতে না হতেই, শাশুড়ি আরেক বাটি কাঁঠাল দিয়ে বলল, “এই নাও, এটা আমাদের পশ্চিম পাশের গাছের কাঁঠাল। খুব মিষ্টি।” আমরা তিন ভায়রা ভাই, একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতাকি করলাম। ইচ্ছে করছে কাঁঠালের ভেতর ঢুকে যাই। এদিকে আমার পেটের অবস্থাও কাঁঠালের মতো গোল হয়ে গেছে। কত ইচ্ছে ছিল, শশুর বাড়ি এসে পোলাও কুরমা খাবো, তা আর হলো না। হঠাৎ করে আমার পেট মোচড় দিয়ে উঠল। আমি কোন রকমে উঠে টয়লেটের দিকে দৌর দিলাম। টয়লেটে বসে কাজ সারছিলাম। এরই মধ্যে ছোট ভায়রার গলা শুনতে পেলাম। বাইরে থেকে পাদছে, গাচ্ছে গান, ওগো ভাইজান, আমারও পরাণ যাহা চায়, হাগু তাই, হাগু তাই। একটু পরই মেঝ ভায়রার গলা শুনতে পেলাম, খোলেন খোলেন দ্বার বন্ধ করে রাইখেননা আর, বাহিরে আমরা দাঁড়িয়ে। আপনি কী বুঝেন না এ জ্বালা, কেমনে আছি খাড়ায়ে! রাতটা কিভাবে কেটেছে, তা বলে বুঝানো যাবে না।
পরদিন সকালে তিন ভায়রা মিলে গল্প করছি। পেটের অবস্থা সবারই খারাপ, থম থম হয়ে আছে। শাশুড়ি সকলের জন্য চা নিয়ে এসেছে। প্লেটে করে নিয়ে এসেছে, কাঁঠালের বিচি ভাজা। আমাদের সামনে প্লেট রেখে বলল,
“খালি পেটে চা খাওয়া ঠিক না। কাঁঠালের বিচি ভাজা খেয়ে, তারপর সবাই চা খাও।” রাগে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে। দাঁত কিটমিট করে বসে রইলাম। কেউ কিছু খেলাম না। শুধু ছোট ভায়রা চা দিয়ে দুইটা কাঁঠালের বিচি খেল। একটু পর সাকালের নাস্তার জন্য তিন ভায়রা বসে আছি। সবাই ভয়ে আছি, আবার না কাঁঠাল নিয়ে আসে। কাঁঠাল দেয়নি ঠিক, তবে যা দিছে কি আর বলব। ভুনা খিচুড়ি রান্না করছে কাঁঠালের বিচি দিয়ে, সাথে কাঁঠালের বিচি দিয়ে ভর্তা করা হয়েছে। আমরা একজন আরেক জনের মুখের দিকে চেয়ে আছি। কি আর করব। উপায় না পেয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য কোন রকমে একটু খেলাম।
নাস্তা করার পর তিন জনেই মন খারাপ করে বসে আছি। শশুর বাড়ি এসে এসব খাবার খেতে হচ্ছে। দুই ভায়রা আমার প্রতি বেশ রেগে আছে। আমি হলাম সবার সিনিয়র। আমি সবার বড় হয়েও মুখবুজে কেন চুপ করে আছি। তাদেরকে সান্তনা দিয়ে বললাম, দুপুরের খাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিব। দুপুরে, প্লেটে ভাত নিয়ে বসে আছি। এমন সময় শাশুড়ি গোমরা মুখ করে বলল, “মোরগ কাটতে গিয়ে হাত ফসকে ছুটে গেছে। কাঁঠালের বিচি দিয়ে ডাল রান্না করছি। কষ্টকরে খেয়ে নাও।” শাশুড়ি মায়ের মতো, তাই কিছু বললাম না। কোন রকমে খেয়ে উঠলাম। দুই ভায়রা আমার উপর বেশ রেগে আছে। বিকালে কাঁঠাল বাগান দিয়ে তিনজনে হাটতেছিলাম, আর কি করা যায় তাই নিয়ে ভাবতে ছিলাম। সন্ধ্যার একটু আগে। শশুর, শাশুড়ি, শালী, তিন ভায়রা সবাই মিলে গল্প করছি। হঠাৎ করে শশুর বলল, “তোমাদের তিন জামাইয়ের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হোক। এই প্রতিযোগিতা একটু ভিন্ন নিয়মে হবে। এখান থেকে তিনজনে দৌড় দিবে। যে পেছনে পড়বে, তাকে একলা একটি কাঁঠাল খেতে হবে।”
এমন প্রতিযোগিতার কথা শুনে, আমার চোখ দিয়ে জল বের হবার উপক্রম। দুই ভায়রার মুখের দিকে চেয়ে দেখি, তাদেরও একই অবস্থা। পাশ থেকে মিতু ও দুই শালী বলল, দারুন মজার প্রতিযোগিতা। মনে মনে বললাম, হায় রে হারামজাদীর দল। সবাই মিলা এইভাবে কাঁঠাল খাওয়ানোর প্লান করছ। কি আর করব। কোন উপায় না পেয়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। তিন জনে লাইনে দাড়ালাম। পেছন থেকে শশুর হাতে তালি দেওয়ার সাথে সাথে, দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাড়ি চলে আসছি। এরপর বহু বছর কেটে গেছে, কাঁঠালের সিজনে আর কোনদিন শশুর বাড়ি যাইনি।
গল্পের বিষয়:
গল্প