— ও আল্লাগো! এইডা তুমি কী করলা ভাবী? হায় আল্লাহ! ও আল্লাগো! এইডা তুমি কেমনে করলা ভাবী?
রাবেয়ার চিৎকারের শব্দ শুনে তার মা রোকেয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। ঘরের আসবাবপত্র চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিছু জিনিস ভেঙে মেঝেতে পড়ে আছে। ঘরের কারুকার্য খচিত বড় যে আয়নাটি তাও মাঝ বরাবর ভেঙে গিয়ে সামান্য কাঁচের টুকরো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আয়নাটি আফরীনের বড় শখের ছিল। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে আফরীন। সামান্য দূরেই লম্বা মসৃণ চুলগুলো মেঝেতে গাড়াগড়ি খাচ্ছে, কিছু চুল বাতাসে উড়ে এদিক সেদিক গিয়ে পড়েছে। আফরীন স্থির হয়ে বসে আছে, পাশেই পড়ে আছে কেঁচি। এত যত্ম করে বড় করা চুলগুলো অবহেলে পড়ে আছে মেঝেতে। আফরীনের মুখে,হাতে, বাহুতে, ঘাড়ে, পিঠে ছোপ ছোপ কালচে দাগ পড়ে গেছে। আফরীনের পাঁচ বছরের ছেলে আয়ান জানালার কপাট ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সচরাচর তাকে এমন শান্ত থাকতে দেখা যায় না কিন্তু আজ সে ভীত, তার মায়ের এমন রূপ সে আগে কখনো দেখেনি।
— মা ,দেখ ভাবী কী করছে? এত্তো সুন্দর চুলগুলারে এমনে কাটল কেমনে? দয়া- মায়া কিছু নাই নাকি? রোকেয়া বেগম বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে আফরীনের দিকে। মেয়ের কথা শুনে যেন ঘোর ভাঙল তার। সত্যিই তো এত লম্বা চুলগুলো কেটে ফেলার সাহস কী করে হল আফরীনের?
— ওই মাইয়া এইডা কী করলা? কেন করলা? চুল হইল আল্লাহর দান… ও দিয়া দিছে তো এই জন্য মর্ম বুঝো না। আইজ শরীফ আইয়া লউক বাড়িতে। এত্তো সাহস পাইলা কই তুমি? পোলাডারে আগেই কইছিলাম এত শিক্ষিত্ বউ আনোনের দরকার নাই। ডুবাইল তো মান-সম্মান! মাইনষে কী কইব এহন? ছি ছি ছি! অলক্ষ্মী একটা মাইয়া! একটা অলক্ষ্মীরে বাড়ির বউ কইরা আনল? আমিও পোলাডার মুখের দিকে চাইয়া সব মাইন্যা লইলাম। এহন বুজতাছি কত্তো বড় ভুলই না করছি! ছি ছি ছি! আমার উচিত আছিল বাড়ির চৌকাঠ মাড়ানোর আগেই এই মাইয়ারে চুলের মুডি দইরা এলাকা ছাড়া করোন। আর না। আইজ শরীফ আইয়া লউক খালি বাড়িতে। এই বাড়ির বাত তোর আর খাওন লাগত না। একটা অলক্ষ্মী , সর্বনাশী, রাক্ষসী!
রোকেয়া বেগম বকাবকির এক পর্যায়ে তুই তোকারিতে নেমে পড়লেন। তার একমাত্র ছেলে শরীফ আহমেদের স্ত্রী আফরীন। যদিও পারিবারিকভাবে দুজনের বিয়েটা হয়েছে তবুও রোকেয়া বেগম কখনোই আফরীনের উপর সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একেতো আফরীনের গায়ের রং দুধে আলতা নয়, তার উপর শরীফের চেয়ে বেশি পড়ালেখা করেছে আফরীন। বিয়ের পর যখন বাড়ি মেরামত করে দুটি ঘর তোলার জন্য আফরীনকে বলল তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে তখন শরীফকে কীসব নয়-ছয় বুঝিয়ে বশ করে নিল আফরীন। এরপর থেকে তো আফরীন রোকেয়া বেগমের চক্ষুশূল। বিয়ের পর দেড়-দুই বছর বেশ সুখেই কেটেছে আফরীনের। তখন সে ও শরীফ দুজনেই কাজ করত। আয়ান জন্মানোর সময় আফরীন চাকরিটা ছেড়ে দেয়। পরে আর আফরীনকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। অবশ্য আফরীনও খুব বেশি জোর করেনি। ধীরে ধীরে সব বদলে গেছে। বদলে গেছে শরীফ, বদলে গেছে সম্পর্ক, বদলে গেছে ভালোবাসা। বিয়ের চার বছর পর তাদের মাঝে অল্প-স্বল্প ঝগড়া শুরু হল, তারপর ধীরে ধীরে তা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠল। কিছুদিন যাবৎ শরীফ আফরীনের গায়েও হাত তুলতে শুরু করেছে।
গত রাতে এক দফা গৃহযুদ্ধ হয়ে গেছে দুজনের মাঝে। তারই প্রমাণ স্বরূপ ঘরের আসবাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে। কাল শরীফের হাতে প্রচুর মার খেয়েছে আফরীন। ঝগড়ার এক পর্যায়ে আফরীনের চুলে ধরে আছড়ে ফেলেছিল আয়নার উপর।তারই ফলস্বরূপ আয়না সামান্য ভেঙেছে আর আফরীনের কপাল যথেষ্টই ফুলেছে।
রোকেয়া বেগমের চেঁচামেচিতে আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। রাস্তা থেকেও কেউ কেউ উঁকিঝুঁকি মারছে। কেউ কেউ রোকেয়া বেগমের কথায় সায় দিচ্ছে আবার কেউ কেউ উল্টোটিও করছে। আফরীন এতক্ষণ চুপ করে শুধু শুনছিল। এখন উঠে খাটের নিচ থেকে ব্যাগ বের করে হাতে নিল, আয়ানের দিকে তাকাতেই আয়ান দৌড়ে এসে আফরীনের বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল মুঠোয় গুঁজে নিল। আফরীন এই বাড়িতে আর থাকতে চায় না।
ভোর বেলা উঠেই নিজের আর আয়ানের জামা কাপড় গুছিয়ে রেখেছে আফরীন। ভাঙা আয়নাটির একটি টুকরা সযত্মে ব্যাগের ভেতর রেখেছে আর অন্য আরেকটি টুকরা নিয়ে কাটা চুলগুলো চাপা দিয়ে রাখল। আয়নার ভাঙা টুকরাটির উপরে আটটি কালো টিপ রাখল সে। প্রতিবার বিবাহ বার্ষিকীতে পরা টিপগুলো সে খুব যত্ন করে রেখেছিল। শরীফ বলত টিপ পরলে তাকে বড্ড মায়াবতী লাগে।আট বছরের সংসার আফরীনের, অবশ্য পাঁচ বছরের পর আর শরীফের সময় কিংবা ইচ্ছা হয়ে উঠেনি তার কপালের টিপ দেখে বিবাহ বার্ষিকীর তারিখ মনে করার। পাশেই একটি ছোট্ট চিঠি, হাতে প্রচন্ড ব্যথা থাকায়ও আফরীন যথাসম্ভব ভালো করে লেখার চেষ্টা করেছে।
চিঠিতে লেখা — আট বছরের সংসারে তিন বছর সুখে কাটিয়েছি, দুই বছর অপেক্ষা করেছি, দুই বছর মানিয়ে চলেছি আর বাকি এক বছর শুধুই ভেবেছি আর কেঁদেছি। আজ ভাবনার অন্ত হল। ভাঙা আয়নার টুকরায় আমার জীবনের আটটি বছর রেখে যাচ্ছি, তুমি চাইলে এই আটটি বছর রেখে দিতে পার আর চাইলে ফেলে দিতে পার। আয়নাটির মতো আমার আটটি বছরের সংসারও ভেঙে গেছে, আয়নাটির মতো আমার আটটি বছরও ফিরে পাওয়া যাবে না। ভালো থেকো জেনে রাখো আমি ভালোই থাকব। আফরীন এক হাতে কাপড়ের ব্যাগ আর অন্য হাতে আয়ানের হাত ধরে হাঁটার জন্য উদ্যত হল। তার পূর্বে রোকেয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল
— মেয়েরা চুল লম্বা করে সৌন্দর্যের জন্য, যে কেউ যেন তার চুল ধরে টানা হেঁচরা করতে পারে এজন্য না। দেখুন এখন আর কেউ আমার চুল ধরতে পারবে না। আমার চুলের মুঠি ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়ার আপনার ইচ্ছেটা আর পূর্ণ হল না। তাই আপনার ইচ্ছে রাখতেই আমি নিজেই বেরিয়ে যাচ্ছি। কথাগুলো বলে হাঁটতে লাগল আফরীন।
–মাইয়া মাইনষের আবার এত্তো জেদ কীসের? সংসার করতে গেলে এইগুলা হয়ই। আমরা কি সংসার করি নাই নাকি? ছি ছি ছি! অলক্ষ্মী মাইয়া বাড়ির মান সম্মান ডুবাইল।- মনে রাখিস, একবার বাড়ির চৌকাঠ পার হইলে এই বাড়ির ভিতরে আর ঢুকতে পারবি না।
পেছন থেকে রাবেয়া, রোকেয়া বেগম এবং অন্যান্য মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। আফরীন হেঁটেই চলেছে,আজ সে থামবে না। এতদিন সে একজন আদর্শ স্ত্রীর মতো আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে খুব। কিন্তু আজ সে বুঝতে পেরেছে শেষটা সবসময় মিলনের হয় না মাঝে মাঝে বিচ্ছেদেই সমাপ্তি ঘটে। সবসময় ভাঙা সংসার জোড়া লাগানোতে সুখ পাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে সংসার ভেঙে দিলেই শান্তি পাওয়া যায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প