শেষ হয়েও হল না শেষ

শেষ হয়েও হল না শেষ
–কেমন আছো জয়???
হঠ্যাং শপিংমলের ভেতরে অচেনা একটা ঢাকে থতমত হয়ে গেলো জয়।এ শহরে তো তার চেনা কেউ থাকার কথা না।ভাবতে,ভাবতে পিছনে তাকাতেই বিদ্যুৎ চমকানোর মত ধাক্কা খেলো জয়ের ভেতরটা। এতদিন পর হঠ্যাৎ জয়ার সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবতেই অবাক লাগছে জয়ের। এইতো ভাল আছি।তুমি কেমন আছো? আর তোমার এমন অবস্থা কেন?তোমার স্বামী কোথায়??
আছে হয়তো ভাল।পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি।আমি তোমাকে কাছে পেয়েও চিনতে পারিনি।লোভে পড়ে নিজেই নিজের জীবনটা শেষ করে দিলাম।তোমাকে ঠকানোর শাস্তি প্রতিনিয়ত পাচ্ছি আমি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া।তোমার মত মানুষের বড্ড অভাব জানো জয়।তোমাকে হারানোর পর বুঝেছি আমি। “জয় আমার শপিং করা শেষ চলো বাড়ি যাবো।আর থাকতে ভাল লাগছে না।দুজনেই পিছনে তাকালো! নিধি জয়ের কাছে আসতেই জয় জয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। নিধি জয়া নামটা শুনেই তাকে চিনতে পেরেছে।জয়ের যে বিয়ের আগে একটা সম্পর্ক ছিল।সে কথা বলেছিল জয় নিধিকে। নিধি হল জয়ের বিয়ে করা স্ত্রী। দু বছর হল তাদের বিয়ে হয়েছে। আগামীকাল তাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী।
সেই উপলক্ষ্যে আজকে শপিং করা। জয় জয়ার থেকে বিদায় নিবে ঠিক সেই মুহূর্তে নিধি জয়াকে তাদের বিবাহ বার্ষিকীর জন্য নিমন্ত্রণ করে। জয়া আসবে বলে কথা দেয় তাদের। তারপর দিন জয়া সত্যিই তাদের বিবাহ বার্ষিকীতে এসেছিল। কালো শাড়ি,লাল ব্লাউজ আর খোঁপায় বেলীফুলের মালাতে জয়াকে অপরুপ সুন্দর লাগছে আজ। তোমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে অনেক,অনেক ভালোবাসা আর দোয়া রইল অনেক সুখের হোক তোমাদের দুজনের জীবন। আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য এই সামান্য কিছু উপহার। নিধি জয়াকে বসতে দিয়ে খাবার পরিবেশনের জন্য গেলো। তাদের বিবাহ বার্ষিকীটা অনেকটা ঘরোয়া ভাবেই উৎযাপন করছে তারা।অতিথি হিসেবে জয়ের কিছু সহকর্মী আর নিধির ভার্সিটির কিছু বান্ধবী এতটুকুই।
নিধি একা কাজ করছে দেখে জয় তার কাজে সাহায্য করতে গেল।নিধি পারবে বলে সবাই কে সময় দিতে বলল।
ঐ দিকে জয়া কথা বলার মত কাউকে না পেয়ে একাই বসে আছে। তাই জয় দেখতে পেয়ে তার কাছে গেলো। তারপর জয়া সেদিন তো ভাল করে কিছু জানা হলো না। আর তোমার স্বামীর কথা বললাম কিছু তো বললে না। কি বলবো! তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দেওয়ার পর বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করি আমি। শুরুর দিকে সব ভাল ভাবে কাটলেও কিছুদিন পর থেকে বুঝতে পারি।তার মধ্যে অনেক খারাপ দিক আছে! নেশা করা,মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করা। প্রতিদিন আমার গায়ে হাত তোলা সব করতো। এক সময় পেরে না উঠে তাকে ডির্ভোস দেই।আর আমি একটা এনজিওতে চাকরি করার সুবাদে এই শহরে থাকি। তোমার বাবা কেমন আছেন জয়া?
বাবা গত বছর মারা গেছেন।তিনি মারা যাওয়ার আগে তোমার কথা অনেক বার বলেছেন।সে মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলেছেন আমি জেনো তার হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাই। কি সব বলছো জয়া আমি কিছু মনে করিনি।আর উনাকে আমি কোন দোষ দেই না।সব বাবারাই চায় তাদের মেয়েকে একটা নিশ্চিন্ত জায়গায় তুলে দিতে।তার কাছে হয়তো সেদিনের সিদ্ধান্ত ঠিক মনে হয়েছিল বিধায় উনি সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন। আমি তার উপরে কোন ক্ষোভ রাখিনি জয়া। আচ্ছা সব বাদ দাও।তোমার কি অবস্থা তাই বল?? আমার অবস্থা আর কি হবে।যেমন দেখছো তেমনই।সেদিন তোমাদের বাসা থেকে আমি আর আমার বাড়িতে ফিরে যাইনি।মনের মধ্য একটা ক্ষোভ নিয়েই এই শহরে আশা।এখানেই নিধির সাথে পরিচয়।আর এখন তো সব বুঝতেই পারছো। তোমার বউ টাকে দেখলাম অনেক সুন্দর। আর অনেক ভাল একটা মানুষ পেয়েছো স্ত্রী হিসেবে। তা ধরতে গেলে ঠিক বলেছো।অনেক ভালবাসে আমাকে। আর সব থেকে যেটা বেশি সেটা হল বিশ্বাস করে আমাকে।।
সবার নাস্তা তৈরি।সবায় খেতে চলে আসুন।বলে খাবার ঘর থেকে নিধির আওয়াজ ভেসে আসছে। সবাই খাওয়ার জন্য খাবার ঘরে গেলো। আজ নিধি একার হাতে করেছে সব। অনেক পদের রান্না করেছে নিধি। নিধির রান্নার হাত অনেক ভাল। এ দুবছরে যে কত রকমের রান্না জয়কে খেতে হয়েছে তার হিসেব নেই।জয় তো মাঝে মধ্যে তাকে রাঁধুনী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বলে। সে নাকি অংশ নিলেই বিজয়ী হবে। জয়ের মুখে খাবারের এরকম প্রশংসা শুনতে অনেক ভাল লাগে তার। তাইতো সে এত,এত রান্না করে।নিজের হাতে রান্না করে জয়কে খাওয়াবে দেখেই তো বাড়ির কাজের লোককে বিদায় করে দিয়েছে। সবাই খাবার খেয়ে নিধির অনেক প্রশংসা করলো। খাবার পর্ব শেষ করার পর জয় ঘোষণা দিলো তাদের মাঝে জয়া গান পরিবেশন করবে।।
জয়া প্রথমে না বললেও সবার জড়াজুড়িতে গাইতে বাধ্য হল।তার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত;- “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি বাহির পানে চোখ মেলেছি আমার হৃদয় পানে চাইনি আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায় তুমি ছিলে আমার কাছে আমি তোমার কাছে যাইনি তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায় আনন্দে তাই ভুলেছিলাম কেটেছে দিন হেলায় গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখ সুখের গানে আমি তোমার গান তো গাইনি আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে তোমায় দেখতে আমি পাইনি।” গানের মাঝখানে জয়ার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল শাড়িতে। প্রচন্ড করতালির মাধ্যমে শেষ হল জয়ার গানের পর্ব। এবার সবার বিদায়ের পালা।এক,এক করে সবাই কে বিদায় দেওয়া হল।জয়াকে গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে আসলো জয়।
জয় বাড়িতে এসে নিজের চোখ কে জেনো বিশ্বাস করতে পারছে না।নিধি ড্রয়িংরুমে সেন্সলেন্স হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। সে তারাতারি করে হসপিটালে নিয়ে গেলো। জয় এখন বসে আছে ডঃমনিরুজ্জামানের চেম্বারে। ডঃ সাহেব নিধিকে চেকআপ করে খুশির সংবাদ দিলেন। নিধি নাকি মা হতে চলেছে। আর এভাবে সেন্সলেন্স হয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো বেশি কাজ করার ফলে হয়েছে।তাকে এখন থেকে পুরোধমে বিশ্রাম নিতে হবে বলে জানিয়ে দেয় ডক্টর সাহেব। জয়ের ভেতরের কালো মেঘ সরে গিয়ে যেন সূর্যের আলো এসে ভর করেছে। তার খুশি দেখে কে।বাসায় গিয়ে গেটের সামনে থেকে নিধিকে পাঁজা কোলে করে সিঁড়ি বেড়ে উপরে উঠে গেলো জয়। এভাবেই কাঁটতে লাগলো সময়গুলো।তাদের ওখানে আপন মানুষজন না থাকায় জয়াই হয়ে উঠল তাদের আপনের মতই একজন।
পরিবারের সাথে মিশে গেছে জয়া।তার মনেই নাই জয়কে সে এক সময় ভালবেসেছিলো। দেখতে,দেখতে নিধির সন্তান প্রসবের সময় এসে যায়। নিধি প্রায়ই ঘুমের ভেতরে দুঃস্বপ্ন দেখে,তাকে তার মা ঢাকছে।তার মা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নাকি এসেছে। জয় কে বললে জয়ও এগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেয় না।এ সময় এ রকম একটু-আধটু দুঃস্বপ্ন নাকি মানুষ দেখেই। একদিন জয় অফিস শেষ করে এসে দেখে নিধি রান্না ঘরের মেঝেতে পড়ে কাঁতরাচ্ছে।সাথে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। জয় দেরি না করে তাৎক্ষণিকভাবে পাশের একটা ক্লিনিকে নিধিকে ভর্তি করালো। প্রায় তিন ঘন্টা ঝমে ডক্টরে যুদ্ধ করে অপারেশন শেষ করল। তারা অপারেশন শেষ করে জয়ের কোলে একটা কন্যা সন্তান ধরিয়ে দিয়ে খবর দিলো তারা শুধু সন্তান কে বাঁচাতে পেরেছে,নিধিকে বাঁচাতে পারেনি।নিধিকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও তারা নিধিকে বাঁচাতে পারেনি।
প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হওয়ার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ডক্টরের ধারণা। জয়ের পাশেই জয়া এসে দাঁড়িয়ে আছে।জয়া এতক্ষণ সব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। জয়া জয়কে শান্তনা দিতে গেলেই জয় একপ্রকার হাওমাউ করে কেঁদে উঠে। যে মানুষটা জয়কে এতটা বুঝতে পারে।জয়ের সব কিছুতে মিশে গেছে,সেই মানুষটা নাকি জয়ের সাথে আর থাকবে না।সে নাকি এখন ঐ আকাশের তারা হয়ে থাকবে। জয় যে নিধিকে অনেক বেশি ভালবাসে নিধি কেমন করে পারল জয়কে ছেড়ে যেতে। জয় নিধির পাশে দাঁড়িয়ে আছে।মানুষ মরে যাওয়ার পরও এতটা সুন্দর কি করে থাকে।মনে হচ্ছে তাকে যেন বেহেস্তের ফেরেস্তারা এসে সাঁঝিয়ে দিয়ে গেছে। এতক্ষণে জয়ের কোলের কন্যা সন্তানটা কেঁদে উঠল।জয় ওকে নিয়ে কেমন করে কি করবে কিচ্ছু ভাবতে পারছে না।
তবুও সবায় কে যে এই চরম সত্যটা মেনে নিতে হয়।এটাই যে জগতের নিয়ম। নিধির দাফন সম্পূর্ণ হয়েছে।বাড়িতে এসে তাদের কন্যা সন্তানকে জয়ার হাতে তুলে দিলো জয়। জয়ার সাথে একপ্রকার কথা না বলেই সে অজানায় রওনা হলো। জয়ের চলে যাওয়া দেখে জয়া তাকে প্রশ্ন করলে জয় উত্তর দেয়, সে নিধির কাছে চলে যাচ্ছে। নিধির নাকি একা,একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তারপর থেকে জয়ের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সবার ধারণা সেদিনে হয়তো জয় আত্মহত্যা করেছে। এই গল্প লেখা পর্যন্ত জয়ের ফিরে আসা বা মারা যাওয়ার কোন সঠিক প্রমান পাইনি। তাই আমরা তার হারিয়ে যাওয়াটা একটা রহস্যর মধ্যেই না হয় রেখে দিলাম। একজন কন্যা অপেক্ষা করুক না,তার পিতার ফিরে আসার জন্য। একজন প্রেমিকা অপেক্ষা করুক না,অনিশ্চিত একটা প্রেমিকের ফিরে আসার জন্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত