লাশটা উলটে দিয়েই লগি হাতে বসে পড়ে জয়নাল, এহ্হে রে!
না বলতে চাইলেও মুখ দিয়ে ভেসে আসে কথাগুলো। চোখদুটো যেন পাথর হয়ে যাচ্ছে। রোমকূপগুলো ডগা ডগা হয়ে ফুলে উঠছে। ঠিক সে-সময় নদীটা ঢুকে গেল ওর মাথার ভেতর। পানির ভারে মাথা দুলছে জয়নালের। ছলছল পানির খলবল স্রোতে কলকল করে উঠছে নদী। কী যেন বলতে চায়। কিছু যেন বলছে ও। কিন্তু ও বোঝে না।
আউলা-ঝাউলা লাগছে চারপাশ। ও কি ফিট হয়ে যাবে ভয়, আতংক আর দুঃখে?
এ-সময় কাছাকাছি কেউ থাকলে ভালো হতো! কিন্তু নদীর বুকের ওপর, ধারেকাছে কোনো নৌকা নেই। নদীর এপার-ওপারে মনুষ্য বলেও কেউ নেই। কিছুক্ষণ আগেই ঢেউয়ের ফেনা উড়িয়ে মগনলাল চলে গেছে বড় নদীর মোহনায়। সেখানে নাকি চিতল মাছের খনি পাওয়া গেছে। ডাকবে নাকি মগনাকে?
ডাকা দরকার। জয়নালের গা গুলিয়ে আসছে। ফটিকজল পাখির মতো ওর হৃদয়। চেনাপরিচিত মানুষদের কষ্ট দেখলে বড় কষ্ট পায় ওর মন। কষ্ট পেলেই ওর মাথার ভেতর ছায়ারা নাচে। স্মৃতির ছায়া। সারারাত-সারাদিন নাচে। নেচেই চলে। ওই নাচমাথায় মাঝেমধ্যে ঘুমের ভেতর উঠোনে নেমে আসে জয়নাল। গলা তুলে ডাক দেয়, সাবিনা ও সাবিনা, তুই কই মা?
সাবিনার মা তখন ওর ডানা ধরে নিয়ে আসে ঘরে। সাবিনা মরে গেছে প্রায় পাঁচ বছর হলো। পিটিয়ে নাকি গলা টিপে মেরে ভাসিয়ে দিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এখন আর মনে নেই জয়নালের। তবে নদীতেই ভেসে গেছে, এটা সে জানে।
লাশ দেখেনি ওরা। কেউ কেউ বলে তারা দেখেছে। বড় নদীতে পড়েই উথালপাতাল ঢেউয়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে সাবিনার লাশ। শেষ পর্যন্ত নদীতেই সংসার পাতল সাবিনা। নদীর কি যৌতুক লাগে? ছ-আনির কানপাশা, জামাইয়ের জন্য ভালো মোবাইল ফোনসেট। কিন্তু মোটরসাইকেলের বায়না যে মেটাতে পারেনি জয়নাল!
নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে নীল পলিথিনের ব্যাগ বের করে জয়নাল। এর মধ্যে ওর মোবাইল থাকে। গভীর অনুনয়ের স্বরে ডাক দেয় জয়নাল, মগনারে একবার ফিরি আয় ভাডি। বেদম একখান ঘটনা ঘটিছে এখানে। ত্বরা দিয়ি চলি আয় তুই।
মগনলালের শ্যালো নৌকা। ভটভটিয়ে চলে-ফেরে। নদীর পানি উছলে ওঠে। হাসে। সাদা ফেনা ছিটিয়ে-ফিটিয়ে নিজেরাই খেলা করে ঢেউ। মগন কোনোদিন স্টেশন ঘাটে খেয়া দেয়। মানুষ টানে। কখনো ওদের সঙ্গে এসে মাছ ধরে। মাছ বিক্রি করে কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। বড় ইয়ারি মগনের মন।
জয়নাল মোবাইল রেখে পস্নলাস্টিকের দড়ি বের করে ফাঁস বানায়। তারপর লাশের মাথার দিকে ছুড়ে দেয়। দু-দুবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে ফাঁস; কিন্তু দড়ির টান লেগে লাশ ঘুরে যায়। চকিতে কেঁপে ওঠে জয়নাল। জেতা নাই তো মেয়েটা? এমন পা বাড়িয়ে দিলো তার নৌকার দিকে!
সুতাহীন লাশটা স্রোতের দোলায় দুলছে। ভালো করে দেখতে চেয়েও তাকায় না জয়নাল। কন্যাসন্তান বড় হয়ে গেলে তাদের শরীরের দিকে পিতার তাকানো উচিত নয়। পিতা সেও যে পুরুষ। গলার রগে টান পড়ে জয়নালের। কাঁদন আসছে বুক ভেঙে।
আ-হ-হা সোনার মেয়ে রে। কী সুন্দর গান গাইত। কতবার তার নৌকায় করে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গেছে!
ও কাকা, তোমার নাওয়ে যে-পাল নাই। এখন কেমনে গাই অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া?
তানিয়া নামে বান্ধবীটা হেসে বলত, এই রাখ তোর অমলধবল। ডুবছিস যখন, তখন ওইটা গা; ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি … হাসির হল্লা উঠত নৌকায়। ঠাকুরবাড়ির সেজো ছেলে সোমেন মুচকি হেসে তানিয়ার গায়ে পানি ছিটিয়ে বলত, তুই একটা আসত্ম শয়তান তানি। নিজে ডুবিছিস তাই এই গান শুনতি চাতিছিস তাই না?
মেয়েটা বুকের কাছে ভেজা হাত রেখে নদীর দিকে তাকিয়ে কী সুন্দর করে যে গাইত, তোমার খোলা হাওয়া …
ভটভটিয়ে মগন এসে ওর পাশে শ্যালো থামায়। মগনের নাওয়ের পেছনে উছলে ওঠা সাদা ঢেউয়ের রাস্তা ভেঙে ভেঙে মিশে যাচ্ছে নদীতে।
কী হইছে রে জাওনা? জোর তলব দিলি য্যান। শইল খারাপ? কথা কোস না ক্যান?
জয়নাল হাত তুলে লাশ দেখায়। লাশের পায়ে কমলা রং দড়ি পায়েলের মতো দেখাচ্ছে। এখনো পেট ফুলে ঢোল হয়নি। হয়তো সদ্য লাশ। চেনা যাচ্ছে। চেনা যাচ্ছে বলেই জয়নাল কাঁপছে।
চিনিছিস?
মগন বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে থাকে। জলে ভাসা মূর্তির মতো দুলছে লাশটা। হোগলা ঝোপের ছায়ায় লাশটা রেখে জয়নাল বসে ছিল মগনের অপেক্ষায়।
মাধু মা। সিন্দুর আছে কপালে। মনে কয় বিয়ে করছিল। তয় কারে কতি পারিস তুই? মগন চোখ তুলে আরো জানতে চায়, আমি যা ভাবতিছি তুই কি তাই ভাবতিছিস জাওনা?
হ ভাবতিছি। তয় আরো ভাবতিছি, এ কী করে হয়? ওরা যে ভালোবাসত দুইজন দুইজনারে।
জয়নালের গলা ভাঙা। একা বসে কতক্ষণ কেঁদেছে। কতবার যে ওর ইচ্ছে করেছে গামছাটা দিয়ে মেয়েটার শরীর ঢেকে দিতে। এমন চেহারা সে দেখতে চায় না। মেয়েটাকে যে কন্যার মতো ভালোবেসেছিল জয়নাল।
কী করবি এখন?
মগনলাল লাশের কাছে যায়। লাশ অবিকৃত। তাজা। স্ফীত বুক দেখে মগনলালের মন বলে, মেয়েটা বুঝি মা হচ্ছিল। তবে কি সিঁথির সিন্দুর কোনো ফাঁদ ছিল?
মগনলালের মন গলতে থাকে কাদামাটি পানির মতো। মেয়েটা গান গাইত। ছেলেটা তবলা বাজাত। ভালোবাসায় খাদ ছিল না কোনো। খাদ ছিল জন্মকোষ্ঠী বংশলতায়। জাতপাতের এই ধাঁধা জয়নাল বুঝবে না। ওরা এক জাত। ধনী-গরিবের পার্থক্য ছাড়া ওদের ধর্মে কোনো অচল নেই। সবাই সমান।
হোগলা গাছের আঁকশি বলে কোনো বাঁধন নেই। তবু কয়েকটি গাছ একসঙ্গে করে লাশ বাঁধা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মেয়েটাকে ঘন ঝোপের ভেতর ঠেলে দেয় মগনলাল।
চল ভাডি সাহাবাবুর বাড়ি যাই। খবরটা তারে দিয়ে আসি গে।
জয়নাল হোগলা ঝোপ ছেড়ে নড়তে চায় না। মেয়েটা যদি ভেসে যায়! ওর চোখ লাল। বুকে ফোঁপানি। গলায় কান্না, তুই যা। যদি জোর ছোরোত আসি পড়ে নদীতে? যদি ছোরোতে ভাসি যায় আমার মাধু মা!
মগনলালের চমক লাগে। বোঝে সাবিনা ভেসে গেছিল নদীতে। জয়নালের কাছে মাধুরীলতা সাহা এখন সাবিনা শেখ হয়ে গেছে। সাবিনার মৃত্যুর পর বিভ্রম রোগ হয়েছে জয়নালের। মাঝে মাঝে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করে। সারাদিন-সারারাত হেঁটে যায়। কখনো কখনো হাত দিয়ে চোঙা বানিয়ে ডাক ছাড়ে, সাবিনা রে এ এ – এ সাবিনা আ আ।
জয়নালের কাঁধে ভেজা হাত রাখে মগন, ভাসি যাবিনানে। শক্ত করি বান্ধে রাখছি। আয় ভাডি, তাড়াতাড়ি যাই। রোদ্দুর উঠলি পর পচি যাবিনি লাশডা। কেউ দেখি ফেলালি কলঙ্ক রটি যাবেনে! চল জাওনা, চল। জেবনে একবার পুন্নির কাজ করি আমরা।
সাহাবাবুর গেট খোলা। শক্তপোক্ত বাড়ি। বাড়িঘেরা উঁচু দেয়ালে তারকাঁটার মালা। কুকুর আছে চারটে। বছরে কয়েকবার ইন্ডিয়া যায় বেড়াতে। বাজারে কানাঘুষা আছে, কলকাতার কোথাও বড় বাড়ি করেছে নৃপেন সাহা। কেবল পিতৃপুরুষের চালু ব্যবসাটা ছাড়তে পারছে না বলে পড়ে আছে এদেশে। ছেলে নেই। দুটো মেয়ে। তার একটা তো ভেসে গেল আজ ভোরে।
দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে জয়নাল বলে, সাপ যে অনেক রকমের হয় তা কি জানত না সাহাবাবু?
জানবে না ক্যান! খুব জানে। জাত সাপরা মারিছে মেয়েডারে। আমি দেখিছি রে জাওনা। সেদিন দুফুরে দুজনে আগেপিছে আসি বাসে উঠি ভাগি গেল। মনে কয় দুডেই খুলনার বাস ছেলো।
পরিপাটি সেজে বুকের কাছে কালো ব্যাগটা চেপে বেরিয়ে আসে সাহাবাবু। কী রে, তোরা? মাছ আনিছিস নাকি? কী মাছ? দেখা তো …
জয়নাল অবাক হয়। মেয়ে পালিয়েছে সাতদিন হয়। তার কোনো চিহ্ন নেই মুখে, চলায়, বলায়, কথায়। মেয়েটা কি এতই ফ্যালনা ছিল! নাকি সাহাবাবু জানত মেয়েটা কোথায় গেছে?
বাবু এট্টা কথা ছেলো যে! মেলা গুপ্ত কথা …
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ওদের নিয়ে বাগানের খুপরিঘরে চলে আসে নৃপেন সাহা। দুটো কুকুর শুয়ে আছে আলস্যে। অন্য দুজন বাগানে খেলছে। জয়নাল দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। এই বুঝি বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়বে বাবু। আহা বাপের মন।
কিন্তু সাহাবাবুর মুখ-চোখ-ঠোঁট কষ্টে ভেঙেচুরে যেতে যেতে সামলে যায়। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে। যেন সজল ঘুমে নিসত্মব্ধ হয়ে যায় খুপরিঘর।
আলস্য ভেঙে কুকুরদুটো শোয়া থেকে উঠে আসে। কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে দেখে জয়নাল আর মগনকে। কী শোঁকে কে জানে। হয়তো মৃত্যুগন্ধ পায়। মুখ তুলে সাহাবাবুর হাঁটু ছুঁয়ে দুটো কুকুরই মৃদুস্বরে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। সাহাবাবু জেগে ওঠে সজল মুখে।
মগনা রে আমার মানসম্মান বাঁচা ভাই। সবাই যেমন জানে তাই জানুক। তুই লাশ ভাসায়ে দে। ভাসি যাক যেখেনে খুশি।
কিন্তু মারল কিডা বাবু? সেজো ঠাকুর যে বড় ভালোবাসত মেয়েডারে। বিয়েও করিছিল। তো মারল কিডা?
জয়নালের প্রশ্নে চোখ মোছে বাবু, তুই বুঝবি না রে জয়নাল। তারপর মগনের দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা ভাবিছিলাম ওরা কলকাতা পলায়ে গেছে। সোমেনরে নাকি দেখা গেছে শ্যামবাজারে। শুয়োরের বাচ্চাডা নিজে পলায়ে আমার মেয়েডারে ফেলি গেল মরার মুখে। আহা রে আমার মা, আমার মাধুমা।
এবার সত্যিই কেঁদে ফেলে সাহাবাবু। কাঁদতে কাঁদতেই গোঙানি গলায় বলে, আমার মেয়ের কী দোষ ছেলো! জম্মের মতো মারি ফেলাল আর নিজের ছেলেডারে সরায়ে দেলো ওরা। মাধু রে মা আমার। কেন আগে তোরে নিয়ি চলে গিলাম না রে মাধু!
মগন আর জয়নালের মনে হয়, সেই তো ভালো ছিল। মেয়েরে নিয়ে কেন যে চলে গেল না! কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে ব্যাগ থেকে মোটা গোছের টাকা বের করে মগনের হাতে দেয় সাহাবাবু। মগন অবাক হয়, একবার মুখখান দেখফেন না বাবু।
রুমালে মুখ-চোখ মুছে বাবু বলে, ভাসায়ে দে। বড় গাঙে ভাসায়ে দে মগনা। হারানোর জিনিস একিবারে হারায়ে যাক।
থানায় জানাবেন না বাবু? ধক্ধক্ করে ওঠে জয়নালের চোখ।
নৃপেন সাহা জয়নালের কাছে এসে দাঁড়ায়, কী হবে জানায়ে? তুই কি ফেরত পাইছিস তোর মেয়েরে? শোন ভাই, আমার মান রাখ। দয়া কর। ভাসায়ে দে। ভাসি যাক মা দুগ্গার মতন। আমার যে আরেকটা মেয়ে আছে রে জাওনা।
জয়নালের কোমরের লুঙ্গি টাইট হয়ে আসে। রাগ ভর করছে ওর শরীরে। ওর টাকা নেই তাই থানায় যায়নি। সাহাবাবু তো টাকার কুমির। তবে? রাগে মাথার ভেতর ছায়ানাচ শুরু হতেই ও দেখে, অসহায় এক বাবার মুখ। ছায়ারা তখন নাচের ছন্দে ছবি আঁকতে শুরু করেছে।
নদী ছলবল সাদা বুকে কার ছবি আঁকে ছায়ারা? হাত নেই। পা নেই। লতাপাতা, আঁকশি বাহু কিচ্ছু নেই। ওর শরীর কাঁপে। স্খলিত পায়ে ও মগনলালের সঙ্গে হেঁটে আসে নদীর ঘাট। তারপর পাড় ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতেই থাকে। মগনলাল বাধা দেয় না। হাঁটুক। এই হাঁটাই যে ওর কান্না।