কড়কড়ে নোটগুলো আরেকবার গুনে মারিয়াম ইতসত্মত করল খানিকক্ষণ, শেষমেশ বলেই ফেলল, ‘একটা নোট বেশি দিছেন!’
শরীরে লোলুপ চোখ বুলিয়ে হাসল লোকটি, ‘ভুল হয় নাই! সন্তুষ্ট হয়েই দিছি, শামিত্ম দিছো মেলা! শরীরডা বড় সরস, বয়স কত তোমার?’
দ্রম্নত উঠে দাঁড়াল সে, এলোমেলো কাপড় ঠিক করে, আয়নায় দেখে নিল একবার নিজেকে, ‘আবার দরকার হলে ডাকবেন! মতিনরে বললেই হবে, ও জানাবে আমারে।’
‘অবশ্যই ডাকব! খুব পছন্দ হইছে তোমারে, নাম কী তোমার?’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মারিয়াম, ‘নাম বইলা কিছু নাই এই লাইনে, নম্বর আছে আমাগো, আমার নম্বর ৭।’
পেছনের সিঁড়ি বেয়ে দ্রম্নত নেমে এলো, এখনো জেগে ওঠেনি ব্যসত্মতা আর কোলাহলের এই নগরী, মেতে ওঠেনি প্রতিদিনের যান্ত্রিকতায়। দ্রম্নত পা চালাল সে, বাড়ির গলিটার মুখে যখন পৌঁছল, তখন কেবল রিকশার গ্যারেজের বশার চাচা ঘুমচোখে গ্যারেজের ঝাঁপ খুলছে, খেয়াল করেনি তাকে। একরকম দৌড়ে ঘরে ঢুকল মারিয়াম, হাঁপাচ্ছে সে। আরো আগে বের হওয়া উচিত ছিল, যতটা সম্ভব লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে রাখতে চায় সে। তবু মাঝে মাঝে এমন করে দেখা হয়ে যায় দু-একজনের সঙ্গে! ক্লিনিকের স্টাফ হিসেবে নাইট ডিউটি থাকে প্রায়ই, থাকাটা খুব স্বাভাবিক। তার গুছিয়ে বলা এমন মিথ্যে গল্পটা সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে সবাই। আজকাল মিথ্যে বলাটা ভালোই রপ্ত করেছে সে! রপ্ত করতে হয়েছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে ঢুকল, মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে, একটু চা খেতে পারলে ভালো লাগত। চায়ের কথা এলেই বাবার কথা মনে হয়, বাবা খুব ভালো চা বানাতেন। মাঝে মাঝে কাজ থেকে ফিরে যত্ন করে চা বানিয়ে ডাকতেন, ‘কই রে মারিয়াম, আয়!’ মাঝে মাঝে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন বাবলুকে। ঘুমচোখে বাবার কোলে বসে চা দিয়ে টোস্ট ভিজিয়ে খেত বাবলুটা। কী যে ভালো লাগত সেই সময়টুকু!
বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো, কাজ থেকে ফিরে কত যে গল্প করতেন শুয়ে শুয়ে! ছেলেবেলার গল্প, বড় বড় মানুষের জীবনের গল্প, নিজের পূরণ না হওয়া স্বপ্নের গল্প! মুগ্ধ হয়ে শুনত সে। মাঝে মাঝে মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতেন, কপালে চুমু দিয়ে বলতেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা তুই অনেকদূর লেখাপড়া করবি, নিজের পায়ে দাঁড়াবি। বুড়া বাপ তখন তোরে নিয়া গর্ব করব, বলব আমার যোগ্য মাইয়া! বড় গাড়িতে কইরা যখন বড় বড় অফিসার যায়, তখন আমার মনে হয় চাইলে তুইও তো এমন হইতে পারিস একসময়, কী পারিস না!’ সে হাসত। বাবার সেই ছেলেমানুষী ভরা আবদার, স্বপ্নভরা সেই চোখ এখনো কত স্পষ্ট, জীবন্ত তার কাছে!
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে! চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে নিঃশব্দে মায়ের ঘরে ঢুকল, হাত-পা ছড়িয়ে কেমন আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে বাবলু, কপালে হাত রাখতেই কেঁপে উঠল। ঘুরে দাঁড়াতেই পেছন থেকে ফিসফিস আওয়াজ কানে এলো, ‘গোসল ছাড়া ছেলেটার গায়ে হাত দিস না, কতবার কইছি! শুনিস না ক্যান!’
ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে সে জানালার কাছে বসল, মূল রাস্তার অনেকটা দেখা যায় এখান থেকে। দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে সবে। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মারিয়াম, মায়ের কথাগুলো অনবরত বাজছে কানে! অস্পৃশ্য সে! মায়ের আচরণটা সবসময় এমন। সবকিছু জেনেবুঝেও কেমন নির্লিপ্ত একটা ভাব করেন, সবকিছুতে মিশে থাকে প্রচ্ছন্ন অবহেলা, অনাদর। কিন্তু কেন? কেন, কী জন্য, কীভাবে আজ পরিস্থিতি এখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা তো অজানা নয় তার! মায়ের এমন আচরণ সহ্য করতে পারে না সে, খুব কষ্ট হয়; খুব। মোড়ের চায়ের দোকানটায় ভিড় জমতে শুরু করেছে, জববার চাচাকে দেখতে পেল। মানুষটাকে দেখলে এখনো শিউরে ওঠে সে, বাবার দুর্ঘটনার খবরটা সে-ই দিয়েছিল ছুটতে ছুটতে এসে। মনে আছে তার, সেদিন ছিল তার প্রথম কলেজের দিন, বাড়ি ফিরে ব্যাগ রেখে কেবল হাতমুখ ধুতে গিয়েছে কলতলায়, বাবলু বল নিয়ে খেলছিল সামনের উঠোনে, জববার চাচা এসেই বাবলুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন, কান্নায় জড়িয়ে যাওয়া কথার কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। খানিক বাদে বুঝতে পেরেছিল সে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সময়টা সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের! আহ্! কী যে দুর্বিষহ ছিল সেই সময়টা! চাটাইয়ে পেঁচিয়ে বাবার থেঁতলে যাওয়া শরীরটা যখন সবাই ধরাধরি করে উঠোনে রেখেছিল, পা-দুটো বেরিয়ে ছিল চাটাইয়ের ভেতর থেকে। জববার চাচা চিৎকার দিয়ে বিলাপ করছিলেন, ‘বিল্ডিংটা আচমকা চোখের সামনে ধইসা পড়ল! তাজ্জব হইয়া সব মানুষ চাইয়া রইল, কারো কিচ্ছু করার ছিল না! মেসমার হইয়া গেল সব চোখের পলকে। ফায়ার ব্রিগেডের লোকগুলান টাইনা তর বাপেরে যখন বাইর করল, আমি চিনতে পারি নাই প্রথম! সিমেন্ট-বালুতে মুখটা লেপ্টাইয়া ছিল রে মা!’ উঠোনে বসে পড়েছিল মারিয়াম, মনে হচ্ছিল পা-দুটোতে এক ফোঁটাও জোর নেই! মা সত্মব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ, তারপর টলতে টলতে অসাড় পায়ে এগিয়ে বাবার পা-দুটো বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমারে কাজ থেইকা ফিরা আর কেউ কোনোদিন কইব না, জোহরা! পায়ে বড় ব্যাদনা! একটু ত্যাল মালিশ করে দিবা!’ মায়ের আর্তনাদে সেদিন ভারী হয়ে উঠেছিল বাতাস, সেই ভার বয়ে বেড়াচ্ছে সে আজো, এমনকি বাবলুও।
বাবার চলে যাওয়ার শোক কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল খুব শিগগিরই, কারণটা প্রয়োজন। কোনোরকম দিন চলা সংসারটায় অভাব-অনটন জেঁকে বসেছিল সপ্তাহ পার না হতেই। প্রিয়জনের প্রস্থান কেবল মনকেই বিধ্বসত্ম করে না, বিবশ করে শরীরও।
মায়ের চেহারায় এ-কথার প্রমাণ স্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল, যা উপেক্ষা করে জীবনের তাগিদে মা ঝিয়ের কাজ নিলেন কয়েক বাসায়,
সকাল ছটায় বের হয়ে রাত প্রায় নটায় ফিরতেন প্রতিদিন। সে আর বাবলু জানালার ধারে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত মায়ের। কিছুক্ষণ পরপর বাবলুটা শুধু বলত, ‘বুবু! কয়টা বাজে? মা ক্যান আসে না! আচ্ছা! এমন যদি হয়, আজ মা ফিরল না, তখন কী করবি বুবু?’ সে জবাব দিত না, খুব ভালো করেই জানত এসব বাবলুর ছেলেমানুষী, তারপরও অজানা আতঙ্কে তার হাত-পা ঠান্ডা হতো ক্রমশ, চোখ ভিজে যেত, বারবার মনে হতো, যদি সত্যি হয়ে যায় এ-কথা!
মেনে নেওয়ার মতো না হলেও এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির পক্ষে হাজার যুক্তি দাঁড় করিয়ে মনকে শান্ত করতে চেষ্টা করত সে প্রতিটি মুহূর্ত, প্রায় অভ্যসত্মও হয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে, ঠিক এরকম এক সন্ধ্যায় মা কাজ থেকে ফিরলেন প্রচ- শরীর খারাপ নিয়ে। রাতে আকাশ-পাতাল জ্বর; মোড়ের ডাক্তার চাচা দেখে বললেন, হাসপাতালে নিতে হবে, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ল নিউমোনিয়া, তারপর টাইফয়েড। মাত্র সাতদিনে হাসপাতালের বেডে শোয়া মানুষটার শরীরে হাড্ডি আর চামড়া ছাড়া অবশিষ্ট কিছু রইল না, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখগুলোতে কী যে হতাশা আর কষ্ট!
হাসপাতাল থেকে ফিরতে পাশের গলির মমতাজ খালার সঙ্গে দেখা হতো প্রায় দিন, খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না, তবু আন্তরিকভাবে মায়ের খোঁজখবর নিতেন, আফসোস করতেন বাবার জন্য, মায়া নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। এত যে শামিত্ম লাগত! মুখ গুঁজে রাখত সেও, শাড়িতে ধোঁয়া আর মশলা মেশানো কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ থাকত সবসময়, সেই গন্ধটুকু বড় আপন মনে হতো! এক সন্ধ্যায় বাটিতে করে ভাত-তরকারি নিয়ে এলেন, না করতে পারল না একবারও, কারণ ওটাই ছিল তিনদিন পরে প্রথম পেট ভরে খাওয়া, বাবলু কেমন হাপুস-হুপুস করে খাচ্ছিল! বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তার! মমতাজ খালা পর্যন্ত চোখ মুছছিলেন দেখে। কী যে ভয়ানক টাকার কষ্ট শুরু হলো! বাবার কারখানা থেকে প্রথম প্রথম ক্ষতিপূরণ দেবে বলেছিল, মায়ের নাম-ঠিকানাও নিয়ে গিয়েছিল বেশ তোড়জোড় করে, তারপর শুধু অপেক্ষা! একসময় বুঝতে পেরেছিল, সবই লোক-দেখানো। কোনো সাহায্য-সহযোগিতার আশা করা এখানে বোকামি, কাউকে এ-কথা বুঝিয়ে বলতে হয়নি, বুঝতে পেরেছিল সে নিজে থেকেই। ১৭ দিন পার হয়ে গেলে মা ছাড়া পেল হাসপাতাল থেকে। আশপাশের মানুষের সাহায্য নিয়ে কোনো রকমে ছাড়িয়ে এনেছিল মাকে। কিন্তু তারপর! সংসার নামক জায়গাটায় পুঁজির পরিমাণ একেবারেই শূন্য, একটা সময় আসল খাবার বলতে সামান্যতম কিচ্ছু নেই! বেচারা বাবলু সারাদিন ঘুরেফিরে আর সহ্য করতে না পেরে কাছে এসে ফিসফিস করে বলেছিল – ‘পাঁচটা টাকা আছে বুবু! একটা বনরুটি কিনে খেতাম! অনেক ক্ষিদা পাইছে।’ কী অসহ্য কষ্ট নিয়ে তাকিয়ে ছিল সে! ছেলেটা আর কিচ্ছু বলেনি, চলে গিয়েছিল নিঃশব্দে। রাত জেগে শুধু দিশেহারা হয়ে ভাবত, কী করবে সে! ঘর ভাড়া, খাওয়া, মায়ের ওষুধ – কেমন করে চলবে এসব! ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় ঘুম আসত না, অভুক্ত বাবলুর শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকত সে, আর মনে মনে ভাবত, দুবেলা ভাইটার মুখে দুটো ভাত দেওয়ার জন্য পৃথিবীর সব কাজ করা যায়, সব কাজ!
দুদিন পরে কাজের খোঁজ মিলল, মমতাজ খালা নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে। বেশ ভরসা নিয়ে, নিশ্চিন্ত মনেই গিয়েছিল তার সঙ্গে। আপনমনেই হাসল সে, ভরসা! বিশ্বাস! এই জীবনে এই শব্দগুলো বড়ই অর্থহীন এখন! প্রথম দিন মাংসলোভী কুকুরের থাবায় যেমন রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল শরীরটা, মনটাও! তার দাম পেয়েছিল যা, নেহায়েত কম নয় সেটা। বাবলুর জন্য বিরিয়ানি কিনেছিল, কী যে তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিল ভাইটা তার!
কেন যেন আক্ষেপ হয় না কারো প্রতি, রাগও হয় না আজকাল। শুধু মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে না, তাকালেই বুকটা মুচড়ে ওঠে! অগাধ বিশ্বাস রাখা এই মানুষটার প্রতি সৃষ্টিকর্তা কি একটু সদয় হতে পারতেন না! দুর্বল মানুষটার বুকের ভেতর যত্নে লালন করা সব বিশ্বাসকে একে একে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে কেন এত আত্মতৃপ্তি তার! নিজের জন্য তার কোনো অনুতাপ হয় না, অপরাধবোধও নয়! অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে; শুধু প্রতিরাতে নগ্ন অপবিত্র, এঁটো শরীরটায় লেগে থাকা পাপ ধুতে গিয়ে মনে হয় ‘… বাবা তুমি দেখছ না তো! দেখো না বাবা! আমি মারিয়াম নই!’