কলেজ স্কয়ারকে কলকাতার করোটি বলা যায়। আজকাল আবার বিজ্ঞানী-মন্তব্য – হৃদয় নেই। মানব আচরণের সবকিছু মস্তিষ্কজাত। নিউরনের বিভিন্ন অংশের ক্রিয়াকর্ম। সুতরাং ওপেন হার্ট সার্জারি করে হৃদয় বিয়োগ করা যুক্তিযুক্ত। আসলে এই স্কয়ারে মস্তিষ্কেরই প্রাধান্য। পাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, বইয়ের আড়ত। পুবে মহাবোধি সোসাইটি, বিনোদনের ব্যবস্থাও অনেক। বাঁধানো পুষ্করিণী। সকাল-বিকেল হণ্টন-যোগ। বিদ্যমান বিদ্যাসাগরের বাস্ট মর্মর মূর্তি। সাঁতার তো আছেই। আর দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলও বসে যথাসময়ে। আছে অ্যালবার্ট হল, মানে কফি হাউস। কলকাতায় আরো কয়েকটি কফি হাউস বিদ্যমান যেমন ল্যান্সডাউনে … তবে সব সেরা কলেজ স্কয়ার। মান্না দে-র গাওয়া গানটি বাঙালি সংস্কৃতিতে স্থায়ী আসন।
বেলা প্রায় দুটো। ট্যাক্সি ডান-মোড় নিতেই কলেজ স্কয়ারের ভেতরে দুর্গাপ্রতিমার অর্ধসমাপ্ত আর্মেচারটা বিপণিসার ছাপিয়ে নজরে।
পুজো তো এসে গেল! মানিক, মূর্তি তো বেশ জাঁকালো হবে! ফজলের উক্তি।
দিন দিন বাড়ছে। আপনার মনে পড়ে – বামপন্থি এক মেয়র পুজো প্যান্ডেলের খরচ-বহর দেখে বলেছিলেন, আমাকে আপনারা দশটা পাম্প কেনার পয়সা দিন, আমি কলকাতা জলজট মুক্ত করে দেবো। কেউ সে-কথায় কর্ণপাত করেনি, বরং উৎসাহটা প্রতিমা নির্মাণে বেশি পড়েছে।
এ-যুগে ভাগের মা বেশি মুদ্রা পাচ্ছে। করপোরেট হাউস আছে। মানুষও ধর্মমুখী। মানে ফুর্তিমুখী।
ট্যাক্সি কলেজ স্কয়ারের পুব-বাহুর প্রায় মাঝামাঝি স্থির।
হোটেলের নাম ও আদল আদর্শ। রাজর্ষি। বাংলা ব্যাকরণের সমাস পড়তে গিয়ে এই শব্দটিই প্রথম পেয়েছিল, যিনি রাজা তিনি ঋষি। দ্বিগু সমাস। দু-শব্দের অর্থই প্রধান। অর্থাৎ সমান গুণসম্পন্ন।
ভেতরে প্রবেশপথে আন্ডারগ্রাউন্ড জলের ট্যাঙ্কের উপচেপড়া, সিক্ত রাস্তা। কমমূল্যের একটি বাল্ব আরো আলো-আঁধারির জন্ম। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তেতলায়। কামরা ছাড়ালে অলিন্দ। উজ্জ্বল। সামনে কলেজ স্কয়ারের ফাঁকা অম্বর। পশ্চিমটা রোদভেজা। মন উৎফুলস্ন করা। ছোট কামরা, এসি সমৃদ্ধ। ভাড়া দ্বিগুণ। হাজার ছাড়িয়ে।
শরৎকাল। দীর্ঘ বিকেল। তাপ কমার অপেক্ষা।
পশ্চিম গগনে আবির। মানিক অলিন্দে। ক্ষণিক দর্শন।
প্রবেশ-পর। দাদা, এবার কি বেরোবেন?
অবশ্যই।
কোথায় যেতে চান?
তোমার প্রোগ্রাম কী?
চলুন, আমাদের এক দাদা মানাদা-র ওখানে যাই। আপনার ভালো লাগবে। তিনি খুবই গুণী মানুষ। একটি পাবলিশিং হাউস আছে। আরো আছে রেস্টুরেন্ট। শুধু মিষ্টির দোকানও আছে।
আরে চলো চলো, আমি মাছি হয়ে প্রবেশ করব।
তা হবে না। মাছির প্রবেশে মানা।
হাতে ঝাঁটা নেই তো …
না, তা নেই।
তবে চলো।
হোটেল থেকে বেরিয়ে ডানে। মোড়ে পৌঁছে আবার ডান। খানিকটা যেতেই মানার বিপণি। মিষ্টির দোকানে স্বল্প আলো। চেয়ার-টেবিল সাজানো। মধ্যম আকারের দোকান। ঢুকতে পড়ে ম্যানেজার বা মালিকের ডেস্ক। লম্বাটে। মৌরি, খিলাল ইত্যাদি উপকরণ সাজানো।
উপবিষ্ট মানাদার সামনে মানিকের উপস্থিতি : এই যে দাদা।
নমস্কার …
নমস্কার …
মানার আসনত্যাগ। ডেস্ক ছেড়ে বেরিয়ে একটা খালি টেবিলে বসতে বলল।
বলুন, কী খাবেন! এখানে মিষ্টি আর চা ছাড়া কিছু নেই। মানিকের তথ্য।
দোকান মিষ্টির, চা সহগ। মানাদা বিশদ করে। ঠিক আছে, ভোলা …
মানার হাঁক।
গামছা ঘাড়ে এক তরুণ দৌড়ে আসে।
ফজল সাহেব, আপনার কোনো পছন্দ …
আপনার সেরাটা …
তিনটে সন্দেশ।
গুণ, স্বাদ বেশ উঁচু। ফজল মন্তব্য দেয় সন্দেশ মুখে পুরে।
এটার চাহিদা বেশি।
কথায় কথায় সন্ধ্যা।
দাদা, এখন কোথায় যেতে চান?
চলো, কফি হাউস। একাত্তরের পর ওখানে আর যাওয়া হয়নি।
ঠিক আছে।
চলুন, আমিও যাই। দোকান ফেলে সময় পাই না।
তিনজন বেরিয়ে পড়ে।
কফি হাউসের বয়স বেড়ে গেছে। যেমন নিজের বয়সের হিসাব করে ফজল। এক তরুণ যুবা প্রায় সন্ধ্যায় আসত। বিশেষ উদ্দেশ্যে। দেশের খবর নেওয়া। এখানে সব সাংবাদিক আসে। আসে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-শিল্পকর্মী। আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রছাত্রী।
সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ঢুকে ধূমপানের তীব্র গন্ধ মাথা ধরিয়ে দেয় ফজলের। কোনো টেবিল খালি নেই। অগত্যা তিনতলা। এখানে একটা খালি টেবিল মিলল। অ্যালবার্ট হলের ব্যালকনি। নিচে সবটা দেখা যাচ্ছে। এমন ধোঁয়া আগে কফি হাউসে দেখেনি ফজল। তার কাছে বদলটা বড় হয়ে দেখা দেয়।
জনামিত্মকে ফজল।
তোমরা ধূমপান নিষেধ করো না?
কে কার কথা শুনছে! মানার জবাব।
ভালো। খুব ভালো। চালিয়ে যাও। চলছে চলবে … তোমাদের গণসংগীতটা বড় উপযুক্ত।
মানা হোস্ট।
টোস্ট আর কফির অর্ডার।
ফজলের নজর শুধু দোতলায়। সে খুঁজে চলেছে যে-টেবিলটায় সে একাত্তরে প্রায়ই বসত। হলঘরে প্রবেশের পর বাঁয়ে মোড় নিয়ে সব শেষ কোনার টেবিলটা ছিল পছন্দের। শব্দদূষণ তখন তেমন ছিল না। আজ সবাই উচ্চস্বর। সঙ্গে ধূম্রজাল।
ফজলের চোখ কোনার টেবিলটা খুঁজে পায়। এক বয়স্ক লোক আর একজন তরুণী মুখোমুখি। প্রায় চমকে ওঠার মতো ফজলের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে যীশুকে। সপ্তাহ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। মেয়েটা কি রুবি? রুবি ঘোষ? কলেজপড়ুয়া। ওদের দুজনের দেখা পেলেই হৃদয় নেচে উঠত ফজলের। যাক সন্ধ্যাটা ভালো কাটবে। বর্ষায় সন্ধ্যাটা বড় মন কেমন করা। ঘরে থাকা দায়। তার ধারণা মিলে গেল।
আরে ফজলদা, আসুন আসুন … আপনার কথাই ভাবছিলাম।
আমিও তোমাদের উদ্দেশেই বেরিয়েছি। নতুন কোনো খবর আছে যীশু?
আছে। বর্ষাটা ভালো নাবায় হানাদার বাহিনী মুভমেন্টে বেশ বেকায়দায় পড়েছে। বেশকিছু আর্মিবোঝাই লঞ্চ মুক্তিবাহিনী ডুবিয়ে দিয়েছে। এদিকে কোনো ক্যাজুয়ালটি হয়নি। শুধু অসুবিধা করছে রাজাকাররা।
সব সমীকরণ তো একবারে মিলবে না।
এই সময় ফজলদের বয়সী এক যুবক ইন করে।
আরে অসিত, তোমার পত্রিকার কদ্দূর?
যীশুর জিজ্ঞাসা।
দিনদশেক আরো লাগবে। ফজল, জানো তো অসিত পরিচয় পত্রিকা দেখাশোনা করে।
বাহ্! খুশি হলাম। পরিচয় আসলেই আমাদের পরিচয় তুলে ধরে।
অবশ্য নতুন সাহিত্য পটভূমি তৈরি করে দিয়েছে। অসিত যোগ করে।
ফজলের মনে পড়ে নতুন সাহিত্য পত্রিকার কথা। তারা তখন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামবাসী গোপাল বিশ্বাস কাকার একটা ছোটগল্প বেরিয়েছিল নতুন সাহিত্যে। তাতে তাদের পরিবারের চিত্র ছিল। তার চট্টগ্রামবাসের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সদর্পে চট্টগ্রামে বাবার চলাফেরার কথা।
মনে পড়ে, তাদের চন্দনপুরার বাসায় ১৯৫৭-র কাগমারি সম্মেলনের একমাস ধরে রিহার্সাল। গোপালকাকা সদরঘাট থেকে নিয়মিত আসতেন। কখনো আসতেন রোববার সকালের দিকে। এস্রাজ বাজিয়ে গান গাইতেন এবং তাকে বেশ কয়েকটা গান তুলে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে : তোমার খোলা হাওয়া … এখনো মন গুনগুন করে। এছাড়া ছিল : বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই …, মুক্তিযুদ্ধকালে গানটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
বেকবাগান ট্রাম স্টপেজ থেকে তার যাত্রা। নামত কলেজ স্কয়ারে। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা। রাতের কলকাতার আর এক রূপ। সব শহরই রাতে মোহনীয়। আলো-আঁধারির খেলা। জীবনের অন্য এক ধারা। বিশ্রাম। আবার রাত কেন্দ্র করে নতুন কর্ম-উন্মাদনা। গভীর রাত জ্যান্ত।
কফি হাউস নটায় বন্ধ, গভীর রাতের সংস্কৃতিহীন। ওটা আছে গ্র্যান্ড হোটেলে।
নিচে টেবিলে সে রুবির উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছে। কলেজপড়ুয়া মেয়েটি ছোটখাটো। গড়বাঙালি চেহারা। শুধু যৌবনের শ্রী সবকিছু ছাপিয়ে : ছোট একটা নাকছাবি, শ্রীবর্ধনের উপচার। রোজ আসত। যুদ্ধের খবরে তার রক্ত উঠত টগবগিয়ে। একদিন তো বলেই বসে : ফজলদা, আপনি ব্যবস্থা করে দিন, আমি যুদ্ধে যাব।
ধ্যাৎ! যুদ্ধে যাবে! যুদ্ধ কাকে বলে জানিস!
যীশুর ধমক।
থাক যীশু। ওকে বকিস না। ওর তো যুদ্ধে যাবারই বয়স। ফজলের সামাল।
ফজলের মনে পড়ে এর কয়েকদিন আগে একচোখ কালো চশমায় ঢাকা এক প্রৌঢ়ের দেখা মেলে। যীশু আলাপ করিয়ে দেয়। চেনো, শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়।
ফজল ফর্সা অবয়বের লোকটির দিকে চেয়ে থাকে। তার প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বইয়ের ইলাস্ট্রেশনে যে সই করা ছবি সে দেখেছে তিনি নন তো!
সুকামেত্মর বইয়ের আলংকারিক?
ঠিক ধরেছ।
সে নমস্কার করে চেয়ে থাকে। অবাক করা ভাবটা যেতে সময় লাগে। তার বাবার চেয়ে বয়সে সামান্য বড়।
চেয়ারে বসেই মুখ খোলেন।
জানো, আমি আর্টিলারি ডিভিশনের সৈনিক ছিলাম। যুদ্ধশেষে তুলি নিয়ে লড়াই করছি।
ফজল আরো অবাক। যোদ্ধাশিল্পী। বাপরে এঁরাই সাচ্চা কমিউনিস্ট। একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য … নজরুল স্মরণে আসে তার।
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ,
চায় একমুঠো ভাত, একটু নুন …
জীবনযুদ্ধ ছেড়ে বাঙালি আজ সত্যিকার রণক্ষেত্রে। হাতে আধুনিক হাতিয়ার।
মনে পড়ে অক্টোবরের দিকে দেবুদা তাকে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, শোনো শোনো ফজল, ভালো খবর আছে। নতুন করে মুজিব বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, জোর লড়াই করছে ওরা। পাকিস্তানিরা পিছু হটছে, মনে হয় দুমাসের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে।
আপনার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক দেবুদা। একদিন আপনার বাসায় যেতে হবে।
শেয়ালদার কাছে থাকতেন। যাওয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর তিনি লোকান্তরিত হন। এখনো আফসোস রয়ে গেছে ফজলের। দেবুদাকে বাংলাদেশ দেখানো হলো না। সেই অকৃতদার দেবতুল্য মানুষটাকে স্বাধীন দেশে সঙ্গ দিতে পারল না। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্যে তাঁরা কী না করেছেন! মনে পড়ে সাহিত্যিক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। ছোটখাটো মানুষটি চরকির মতো ঘুরেছেন বাংলাদেশের সমস্ত শিল্পী ও লেখকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার জন্যে। আপন মায়ের পেটের ভাইও এমনটা করে না। এই মানুষটিও ধরাধাম ছেড়ে গেছেন। ভাবতে বসলে এখনো ফজলের চোখ ভিজে যায়।
দেবব্রত বাবুর বক্তব্য শুনে যীশুকে খুব উৎসাহিত দেখাল।
বললে, ফজল আর মন খারাপ করে থেকো না। খুব শিগগির দেশে ফিরে যেতে পারবে।
আমি ঢাকায় আপনার বাড়িতে যাব ফজলদা। উৎসাহিত গলায় বলে রুবি।
নিশ্চয়। তোমাদের সবার অবারিত দ্বার।
বেশ একটা আনন্দ-হিলেস্নাল বয়ে গেল।
দেবুদা সবার জন্যে কফি আর টোস্ট অর্ডার দিলেন। তাকে ঠিক আর্মি অফিসারের মতোই লাগছিল। অনেকটা হাবিলদার কবি নজরুলের মতো।
কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট … সংগীতটা কানে বাজছিল ফজলের।
কী খাবেন? খাবেন কী? … মানার দ্বিত্বর ধাক্কায় ফজল বাস্তবে ফিরে আসে।
কফি হাউসের খাওয়া তো বাঁধা। সেই পকৌড়া আর বাটার টোস্ট।
তা-ই, কিন্তু অনুমতি চাচ্ছি। তাহলে পকৌড়া আসুক। যদি ফুরিয়ে গিয়ে না থাকে। একটু থেমে ফজল বলে, আমার না, খুব ’৭১ সালের কথা মনে পড়ছিল।
কেন? কেন? দ্বৈত প্রশ্ন।
’৭১ সালের পর এই প্রথম প্রবেশ।
তাই! আবার দ্বৈত বিস্ময়।
কতবার কত কাজে কলকাতা এসেছি, কিন্তু কফি হাউসে প্রবেশ করা হয়নি। মনে পড়ে, আমাদের কয়েকটা টেবিল পরে সৌমিত্রবাবু বসতেন তাঁর দলবল নিয়ে। তাঁর বিদগ্ধ পত্রিকা এক্ষণ, সবার কাছে ছিল অবশ্যপাঠ্য। মাল্যদান সিনেমাটাও দেখেছি; উত্তম কুমারের পর বাংলার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে নামি ব্যক্তি। দূর থেকে দেখতাম। কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি। তখন আমি ভিনদেশি এক শিক্ষক। লেখক হিসেবে কজনই-বা চেনে।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। কলকাতাজুড়ে মিষ্টি খাওয়ানোর ধুমধাম। কোনো দোকানে মিষ্টি পড়ে থাকেনি। সব আধার শূন্য।
কফি হাউসে গিয়ে যীশুকে পেল না ফজল। এমনকি রুবিও নেই। প্রায় টেবিল খালি। সচরাচর এরকম হয় না। সন্ধ্যায় কফি হাউস গমগম করে।
তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। যীশুর প্রবেশ। পেছনে রুবি। যীশু ফজলকে জড়িয়ে ধরে।
অন্যান্য টেবিলেও এরকম দৃশ্য তাদের নজর এড়ায় না।
ফজলের মনে হলো বাংলাদেশ জয়ী হয়নি, জয়টা যেন পশ্চিমবাংলার।
তার খুব মনে পড়তে থাকে ঢাকার কথা। ঢাকার দৃশ্য সে মিস করল। রাস্তা নিশ্চয় লোকে লোকারণ্য।
আবেগ অবসান হলে তারা রোজকার মতো আসন।
যীশু খুব উৎসাহ নিয়ে বলে, ফজল তোমাদের নতুন দেশ হলো। নিশ্চয় অনেক নতুন কাগজ বেরুবে।
নিশ্চয়।
আমি তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই।
ফজলের মনে পড়ে একদিন দুপুরের দিকে সে যীশুর আস্তানায় গিয়েছিল – ডালিমতলায়। এক চলচ্চিত্র পরিচালকের সঙ্গে থাকে। ইন্দ্রনীলদা তিনতলার ছাদের কামরাটা ভাড়া নিয়েছিলেন। একটা মাত্র সিঙ্গেল তক্তপোশ। চারদিকে বই। ম্যাগাজিন। যীশু মেঝেয় একটা পাটি মেলে শোয়। তক্তপোশের নিচে কেরোসিন স্টোভ। যীশু নিজ হাতে বাজার আর রান্না করে। দুজনের খাবার। ইন্দ্রনীলদা গৃহস্থ।
এই সময় বিশ-বাইশ বছরের একটি মেয়ে আসে। শ্যামলা। মুখশ্রী ভালো। যীশু পরিচয় করিয়ে দিলো, এ হচ্ছে আমার বন্ধু, ইভা। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ায়।
নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পালা। আড্ডায় আড্ডায় ছাদ থেকে একেবারে কফি হাউসে গিয়ে আড্ডার দ্বিতীয় দফা শুরু করে।
ফজল কবে ঢাকা ফিরবে জানতে চায় যীশু।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে দিনসাতেক লেগে যাবে। এর কমে হবে না যীশু …
আমার কথাটা মনে রেখো ফজল।
ফজলের মনে হলো এতদিনের যীশুর উচ্চাসনটা যেন হ্রাস হয়ে গেল। তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। যীশুকে সে উচ্চাসনেই দেখতে চায়।
দেশে ফিরে দেশের অবস্থা দেখে ফজল বাস্তবে আসে। সব কল্পনা উবে যায়।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ভবনটি অটুট। কিন্তু শূন্য মেঝে ছাড়া আর কিছু নেই। ’৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। রংপুর, ময়মনসিংহের ভয়াবহ পরিস্থিতি।
সব বিপত্তি কাটিয়ে দেশে যখন সামান্য উজান বইছে, আসে নির্মম আঘাত। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিধন হলেন।
অনিশ্চয়তায় ডুবে গেল দেশ। এর মধ্যে দু-একটা নতুন কাগজ যে বেরোয়নি তা নয়; কিন্তু নিজেদের লোককেই জায়গা দিয়ে উঠতে পারছে না … আচ্ছা মানাবাবু, যীশু চৌধুরী নামে এক সাংবাদিককে চেনেন? আমারই বয়সী।
নামটা তো খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।
সপ্তাহ পত্রিকায় কাজ করত, শশীভূষণ মুখার্জি রোডে ছিল অফিস। তারপর এ-ও শুনেছিলাম, ও নিজেই একটা পাক্ষেক বের করেছিল। এরপর আমার কাছে ওর আর কোনো তথ্য নেই।
আচ্ছা, আমি খোঁজ করব।
নটা বাজে। কফি হাউসের পালা শেষ।
রাতে বিছানায় শুয়ে ফজলের ঘুম আসে না। তার মনে পড়ে ১৯৯২ সালে সে একটা জলরং প্রদর্শনী করে পার্ক স্ট্রিটে। সাতদিন সে প্রতিনিয়ত মনে করত, এই বুঝি যীশু আসবে। একটা ভালো কভারেজ পাওয়া যাবে; কিন্তু যীশুর দেখা পায়নি।
এরপর কলকাতায় সে আরো একটা জলরং প্রদর্শনী করে, বালিগঞ্জে, চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে। এবারো তার আশা ভঙ্গ হয়। যীশু আসেনি।
তার উসখুসানি দেখে মানিক বলে, কী হলো দাদা … ঘুম আসছে না?
না, মানিক, যীশুর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আজ খুব বেশি করে ওর কথা মনে পড়ছে।
ঠিক আছে। আমাকে কিছু সময় দিন, আমি যীশুদার হদিস এনে দেবো।
একটা স্বস্তির প্রলেপ বয়ে যায় ফজলের শরীর জুড়ে।
এখন সে ঘুমোতে পারবে।