দিনটা যদি শুরু হয় ঝগড়া দিয়ে, তবে তা শেষ হতে হবে সেক্স দিয়ে – দাম্পত্যের এটাই নিয়ম। রুমানার সঙ্গে সংসার শুরুর কদিনের মধ্যেই আমি তা বুঝে গেছি। আর আমার মনে হয় ঠিক এ-কারণেই ভাঙবো-ভাঙবো করেও আমাদের সংসারটা আজ বারো বছর হয়ে গেল, টিকে গেছে।
আসলে সংসারে এত ছোট কিছু থেকে বড় বড় পাহাড় ভেঙে পড়ে যে, কেউ এর কারণ জিজ্ঞেস করলে আমি মনে হয় হেসেই ফেলবো। যেমন কদিন আগে। পানি খেয়ে গস্নাসের ঢাকনাটা দিইনি। ও এসে ঢাকনাটা এমনভাবে দিতে গেল যে, গস্নাসটা উলটে বাকি পানিটুকু টেবিলে পড়ে আমার কাগজপত্র সব ভিজিয়ে দিলো। আমি বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকালাম।
গস্নাসের ওপর ঝনাৎ করে ঢাকনা ফেলার শব্দ আর আমার বিরক্তিভরে তাকানো – মুহূর্তের এ-ফলাফল নির্মাণের সাফল্য কে নেবে? প্রায় বরাবরের মতো রুমানাই নিয়ে ফেললো। ‘বাসাটাকে অফিস বানিয়ে ফেলো! আর গস্নাসের ঢাকনাটা কী জন্যে হয়েছে?’ – বলে কাজের বুয়াকে ডাকলো। বুয়া পানিটা মুছে দিলো বটে কিন্তু সারাদিন ধরে এটা আমাদের আলো-বাতাস-আঘ্রাণের ওপর স্যাঁতসেঁত করেই গেল। যেন দুজনই সারাদিন ধরে একটা তিলেপড়া জামা পরে ঘুরছি-ফিরছি-খাচ্ছি!
আর আজ? আগামীকাল আমাদের যুগপূর্তি। সকালটা চমৎকারভাবে শুরু করেছিলাম। ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই বিপত্তি ঘটলো। সিঁড়ি দিয়ে একেবারে নিচে নেমে গিয়ে মনে পড়লো অফিসের চাবিটা নিইনি। হুড়পাড় করে আবার যখন উঠছি, তখন রুমানা বাথরুমে। আমি হাঁপাচ্ছি আর ধপধপ করে দরজা পেটাচ্ছি। অফিসের গাড়ি চলে যাবে, লেট সাইন হয়ে যাবে, তিন লেটে একদিনের বেতন কাটা যাবে, বাচ্চাটা স্কুলে, কাজের বুয়া আসেনি! রুমানা দুম করে দরজা খুলে ‘এত ভুলো মন নিয়ে সংসার করতে কে বলছিলো’ বলেই ধাম করে সেটা বন্ধ করে দিতে যায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজার চৌকাঠে ঢুকে থাকা আমার হাতের একটা আঙুল একেবারে থেঁতলে গেলো।
টিকটিকি দেখে রুমানা একসময় খুব ভয় পেতো। ঘরে টিকটিকি থাকলে সে টিকটিকি না-মারা পর্যন্ত ঘুমাতো না। আমি তখন দুটো কাঠি দুপাশ থেকে সপাৎ-সপাৎ করে ধরে টিকটিকি মারতাম। আমার মনে হলো, আমার হাতে এখন সেই একটা মৃত টিকিটিকি ঝুলছে। আমি আঙুলের দিকে তাকালাম। ভেতরটা ফুঁসে উঠতে চাইলো। একবার রুমানার দিকে তাকালাম। দরজার আড়াল নিয়ে ঘাড়টা বাঁকানো। চুলগুলো হিজলঝুরির মতো ঝুলছে, পানি পড়ছে টপটপ। ভেজা শাড়িটাকে আরো লেপটে ধরে ও আমার আঙুলের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলো। রুমানা জানে আমার দুর্বলতা। মুখটা কি খুব ফ্যাকাসে লাগছিলো? মনে হচ্ছিল উইন্ডস্ক্রিনে প্রথম বৃষ্টির ছাঁট? ধুলোর ওপর পড়ে জমে জমে আছে? কিন্তু তাকে খুব একটা গড়াবার সুযোগ না দিয়ে ধুপধাপ করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলাম। এসব আবেগ এখন দেখানোর সময় নয়!
আঙুলে বেশ ব্যথা করছিলো। তবু স্বস্তি পাচ্ছিলাম, একটু সুবিধাজনক অবস্থায় বাসা ত্যাগ করতে পেরেছি। রুমানার বাথরুমে বিঘ্ন ঘটাটা নিশ্চয় আমার হাত ফেটে যাওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেও তা বুঝেছিলো। তাই অফিসে ফোনটা আজ সে-ই করলো। মোবাইলে করলে নিশ্চয় প্রথমে কেটে দিতাম। করেছে টিঅ্যান্ডটিতে। অপারেটর মেয়েটা আমার এক্সটেনশনে দিয়ে একগাল হেসে বললো, ‘ভাবিসাহেবা!’
জানো, আজ না মারিয়াকে স্কুল থেকে অনেক বকা দিয়েছে!
বুঝতে পারলাম, ঠিক জায়গা ধরেছে। এখন নামতে হবে। না নামলে নিশ্চিত জয়টা হাতছাড়া হয়ে যাবে, আর নামলেও কোনো নিশ্চয়তা নেই যে অবস্থানটা ধরে রাখতে পারবো। আসলে সুবিধাজনক অবস্থা আমি খুব একটা পাই না। আর পেলেও অধিকাংশ সময় তা হাতছাড়া করে ফেলি। কতবার ভাবি, এইবার দানটা আসুক, আর ছাড়বো না। কিন্তু যে সে-ই! বুঝতে পারি না, সব ছেলেই এমন কিনা! আর রুমানা খুব বুদ্ধিমতী। সে যদি বোঝে যে দান আমার, তো যেভাবেই হোক যুদ্ধটা চালিয়ে যাবে। এবং আমাকে উস্কে ঠিক এমন জায়গায় এসে থামবে, যখন দানটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। আজ অবশ্য সুযোগটা পায়নি।
ভাবছিলাম, মারিয়ার বকাটা ঠিক আজকেই দিতে হলো কেন? কিন্তু রুমানার উদ্বেগের উত্তর তো আর ‘আমার হাত ফেটে গেছে’ হতে পারে না! ‘এখন ব্যস্ত আছি, অফিসে অনেক কাজ’ – এটা বলাও ঝুঁকিপূর্ণ। ‘মেয়ে আগে, না অফিস?’ – এমন ঝাপটা আসতে পারে। আবার অপারেটর পাজি মেয়েটার কথাও ভাবছিলাম। বাসা থেকে ফোন এলে লাইন দিয়েও অনেক সময় কানে ধরে রাখে। পরে মুচকি মুচকি হাসে! তাকেও তো ঘরে চাল দিতে হয়!
সবদিক সামাল দিয়ে বললাম, ‘কেন, মারিয়া কী করেছে স্কুলে?’
ওর শার্টের টাই-বাটনটা খুলে গিয়েছিলো।
তো ম্যাম লাগিয়ে দিলেই পারতো!
লাগিয়ে দিলেই কি থাকে নাকি? আমি লাগিয়ে দিইনি? ওটা বারবার খুলে যায়! আর তোমার মেয়ে শার্ট ধরে টেনে টেনে টাইটাকে গলায় উঠিয়ে ফাঁস লাগিয়ে রাখে!
অন্যসময় হলে দৃশ্যটা কল্পনা করে আমি হেসে ফেলতাম। কিন্তু আজ হাসি চাপতে গিয়ে হাতটা নিশপিশ করছিলো। হিজিবিজি কিছু আঁকার জন্য একটা কাগজে টান দিতেই ভারী পেপারওয়েটটা পড়লো পায়ের ওপর।
শুনছো? তোমাকে কতবার বললাম যে ওর স্কুলড্রেসটা আবার বানাতে হবে, আবার বানাতে হবে! তুমি কি শুনেছো আমার কথা? তোমার তো টাকাই থাকে না!
পরিষ্কার! বহু পুরনো অস্ত্র! কিন্তু অব্যর্থ। আমার মনে হয় বউ রোজগেরে হোক আর বেরোজগেরে হোক – দুটোরই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। আমার কলিগ কবির সাহেব বলেন, ‘আরিফ সাহেব, আপনি ভালো আছেন। আমরা খোঁটা শুনতে শুনতে মরি। সংসারের সব খরচ আমি করি। আর বউয়ের চাকরির টাকায় তার নামে জমিজমা-ফ্ল্যাট কেনা হবে। সবার কাছে বলবে, কবির কি আমাকে কিছু করে দিয়েছে নাকি? সংসারই চালাতে পারে না!’ আর আমার বন্ধু বাদল বলে, ‘বেরোজগেরে বউয়েরা চায় তাদের স্বামীরা বিজনেসম্যানের মতো টাকা ইনকাম করে সার্ভিসম্যানের মতো ঘরে ফিরে আসুক!’ কিন্তু আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারি না, কোনটা হলে ভালো হতো। তবে আমার মনে হয় বেরোজগেরে বউয়েরা স্বামীর পকেট টানাটানির এই পুরনো অস্ত্রটা একটু বেশি ব্যবহার করে। এর কারণ আমার মনে হয়, তার পরনির্ভর আলো-বাতাস প্রাপ্তির সার্বক্ষণিক নিশ্চয়তার অধিকার সারাক্ষণ তাকে অস্থির করে রাখে। এখন তার সেই অধিকারে আঘাত লাগে এমন উক্তি এসে গেলেও থামিয়ে দিলাম। আসলে মানুষ যদি কারো ওপর নির্ভরশীল হয় তার মনস্তত্ত্ব খুব সহজ নয়! ভালো বললেই ভালো বুঝবে – এর কোনো নিশ্চয়তা নেই; কিন্তু জবাব তো দিতে হবে?
জানি এবার অনুকূলে থাকা দানটা একেবারে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। বললাম, ‘টাকা থাকবে কেমন করে? তুমি যদি একটা টাকার জোগাড় হওয়ার আগেই আরেকটার আয়োজন করে বসো!’ এবং বলেই বুঝলাম, এর উত্তরটা জানা এবং সটাং সেটা পেয়ে গেলাম।
আমি কি আর সাধে আয়োজন করি? আমি আয়োজন না করলে হতো তোমার একটা ফ্ল্যাট? চাকরি যখন থাকবে না, তখন কি রাস্তায় গিয়ে থাকবে? তুমি না হয় থাকলে, মারিয়ার কথা ভেবেছো কখনো?
ভুল হয়ে গেলো। আসলে আমার ভাবনায় এতসব আসেও না! সংসারে যা-কিছু অর্জন, বলতে গেলে সব রুমানার এই ঝগড়ার অবদান। নিজের সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন – বিষয়ভাবনাও নেই, আবার বিষয়বৈরাগ্যও নেই। নটা-পাঁচটা অফিস করি, পারলে একটু এদিক-ওদিক করি। বেশি সাহস নেই! রুমানার কাছে এভাবে সমর্পণ করেও দেখেছি, কাজ হয় না। জবাব আসে ‘বৈরাগী হয়ে থাকবা তো একটা বৈরাগিণী ধরলেই পারতে!’ তার যুক্তিটা যে খাপে-খাপ মেলেনি এটা বোঝাতে গেলে পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না। চুপ করে থাকি।
কথা বলছো না কেন? তোমার সঙ্গে চাকরি করেই দ্যাখো হারুনভাই দুইটা ফ্ল্যাট করেছে, তিন-তিনটে পস্নট কিনেছে!
আমার গা-টা জ্বলে ওঠে। এই একটা লোক! সারাক্ষণ পান খায় আর পিক ফেলে! মুখে ধর্মকর্মের কথা লেগেই আছে, কিন্তু টাকা ছাড়া কিছুই চেনে না! লজ্জা-পর্দা-ব্যক্তিত্ব কিচ্ছু নেই! তার সঙ্গে আমার তুলনা! এই কি সেই রুমানা, যাকে নিয়ে পাঁচ-পাঁচটি বছর স্বপ্ন আঁকতাম! যে ছিলো আমার কবিতার একমাত্র পাঠক! কখনো প্রশংসা করেনি। কিন্তু ক্যাম্পাসে একা হতেই প্রশ্ন করতো, ‘আজ কবির মনে কি কিছু নতুন ভাবের উদয় হইল?’ এখন ওসবের ধারেকাছেই নেই। আমারও কবিত্ব গেছে। মেজাজ একেবারে খিঁচড়ে গেলো! কিছু না বলে বললাম, ‘লাইন কেটে যাবে, তিন মিনিটের বেশি হয়ে যাচ্ছে। রেখে দিলাম।’
এবং রেখে দিয়েই বুঝতে পারলাম, দানটা অনেকখানি রুমানার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আমি জানি, এতক্ষণে মারিয়ার বকুনির জন্য একে-ওকে ফোন করা হচ্ছে এবং বাসায় ফিরলে এই ফোনের কথা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমার অবস্থানকে একেবারে ছাদের কিনারে নিয়ে ফেলা হবে। একটুখানি কার্নিশ। চাইলেই উলটে একেবারে নিচে পড়া যায়। কিন্তু সেখান থেকে টার্ন করা ছাড়া কী করা? আমার আঙুলের ব্যথা হয়তো তখনো থামবে না; কিন্তু এখান থেকে বেরোনোর জন্য সম্পূর্ণ সারেন্ডার করা ছাড়া আমার আর কী করার থাকবে? কারণ রাত্রি এসে যাবে। এবং আমি জানি, দিনটা যদি শুরু হয় ঝগড়া দিয়ে তবে তা শেষ হতে হবে সেক্স দিয়ে – দাম্পত্যের এটাই নিয়ম!
বাসায় ফেরার পথে মনে হলো, না, একটু সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে হবে। উলটোপথ হলেও তাই নিউমার্কেটে ছুটলাম। দীর্ঘ জ্যামে আটকে নিজেকে মনে হতে লাগলো সিগন্যালের ওই বাতিগুলোর মতো! লাল-হলুদ-সবুজ – জ্বলছি জ্বলছি! কিন্তু এর কোনো মানে নেই। কাউন্টডাউন করে জিরোতে আসা, আর না-আসার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। রুমানা তার মতোই ঘোড়া ছোটাবে! তবু একটা রেডিমেড স্কুলড্রেস আর রুমানার সবচেয়ে প্রিয় খাবার শুকনো সন্দেশ নিয়ে বাসায় ঢুকেই ড্রেসটা বিছানার দিকে ছুড়ে দিয়ে এমন সশব্দে চেয়ারটা টেনে বসলাম, যেন রাস্তার সমস্ত জ্যাম ওর মাঝে মিশিয়ে দিতে চাইলাম! সন্দেশের প্যাকেটটা ব্যাগের ভেতর পড়ে থাকলো। থাক, প্রতিক্রিয়াটা বুঝে নিতে তো হবে!
ইলেকট্রিসিটি ছিলো না। রুমানার এই সেন্সটা খুব ভালো। সঙ্গে সঙ্গে সে একটা পাখা এনে বাতাস করতে লাগলো। মারিয়া চুপচাপ আমার মুখের সঙ্গে মুখ ঘষছিলো। সেও আবহাওয়া বোঝে। তারও অর্ধযুগ পার হচ্ছে। অন্যদিন হলে ‘বাবা কী আনছো, কী আনছো’ করে অস্থির করতো। কিন্তু আজ সে জামার বোতাম খুলছে, ঘেমে আছি।
হঠাৎ বিদ্যুৎ আসতেই মারিয়ার চোখ পড়লো বিছানার দিকে। সে দৌড়ে গিয়ে জামাটা নিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘মা, বাবা জামা এনেছে, জামা এনেছে!’
তা তো আনবেই! এতদিন বলে বলে হয়রান হয়ে গেলাম! টিচারের কাছে ছোট হলাম, এখন এনেছে! রাখো বলছি! না ধুয়ে পরতে হবে না! কোথাকার ফুটপাতে কতদিন ধরে পড়ে ছিলো তার ঠিক নেই!
বলে জামাটা বাথরুমে ছুড়ে দিয়ে ‘তোমার গোসলের সময় ধুয়ে দিও, রাতে শুকিয়ে যাবে’ বলে সে রান্নাঘরে ঢুকলো। আমি চেয়ারে হেলান দিয়া চক্ষু মুদিয়া মারিয়ার স্পর্শ নিতে নিতে বুঝিতে পারিলাম আমার সকল রণনীতি বুমেরাং হইয়া আমাকেই ধূলিসাৎ করিয়া দিয়াছে!
চোখ মেলে ওপরের দিকে তাকালাম। বারো বছর আগে কেনা বারো বছরের গ্যারান্টিওয়ালা ফ্যানটা তখনো ঘুরছে। ওর গায়ের রংচটা জায়গাটা এখন বোঝার উপায় নেই। থামলে বোঝা যেতো ওখান থেকে এক খাবলা রং উঠে গেছে, কিন্তু এখন শুধুই বৃত্ত। আমি যেন হঠাৎ ওর পরিধিতে বন্দি হয়ে গেলাম। বন্দি ‘কবি’ ঘুরতে ঘুরতে একেবারে কিনারে চলে যায়। কিন্তু পরিধি থেকে খাদে পড়ার ঠিক আগেই আবার কেন্দ্রমুখী গতি ফিরে পায়। কেন্দ্রমুখী আর কেন্দ্রবিমুখী গতিতে আমি ঘুরতে থাকি, ঘুরতেই থাকি …
যখন ঘুম ভাঙলো, দেখি মশা কামড়ে সারাশরীর ফুলিয়ে দিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম, প্রায় ১২টা বাজে। তার মানে এতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম! পাশের রুমে গিয়ে দেখলাম আলো জ্বলছে, মশারি খাটানো, যেটা আমারই প্রতিদিনের কাজ। মারিয়া অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু রুমানা ঘুম, না না-ঘুম তা নিশ্চিত হতে পারলাম না। রান্নাঘরে গেলাম, মনে হলো না সে কিছু খেয়েছে। এমনটা হলে যে ওর খাওয়া বাদ যাবে তা নিশ্চিত ছিলাম। বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হলাম। বেরোনোর সময় যতটা শব্দ হলে রাগ প্রকাশ হয় ততটা নয়, যতটা হলে অপরের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয় ততটা কমও নয়, ঠিক ততটুকু শব্দ করে দরজাটা লাগালাম যেন বলতে চাইলাম, আমি বের হয়েছি।
এবং শব্দটা ঠিক ছিলো। রুমানা পাশ ফিরে শুলো। শোয়ার সময় সে একেবারে অগোছালো। অগোছালো প্রকৃতির সৌন্দর্যের চেয়ে সৌন্দর্যময় জগতে আর কী আছে! আমি অনেকক্ষণ ধরে সে-সৌন্দর্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এরপর সন্দেশের প্যাকেটটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে ওর পছন্দের স্প্রেটা নিয়ে পাশে গেলাম।
নিশ্বাসের শব্দ নেই; কিন্তু বুঝতে পারলাম, জেগে আছে। গায়ে হাত দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। এই তো সেই রুমানা! কতভাবেই না ওকে ভাবতাম! কতভাবেই না না-পাওয়ার হাহাকার হয়ে ওকে আমি পেতাম! জগতের এতো কাব্য-চিত্র-গীতি, কিছুতেই যেন ওকে ধরা যেতো না। সে ছিলো ভালোবাসার কাল। আর এখন, একটু পর যেটা ঘটবে? এই সেক্সের প্রক্রিয়াটা? মানুষের না-ভালোবাসা পাওয়ার সৃষ্টি কত মহৎ! জগতের সুন্দরতম গান, কবিতা, আর্ট – কত কিছু! আর সেক্স না পাওয়ার উৎপাদন? স্রেফ ভায়োলেন্স – মাস্টারবেশন, ধর্ষণ! ভাবলে খুব বিকৃত লাগে। এর মধ্যে মনন কোথায়? এক আদিম কায়কারবার এখানে! আর এর থেকে যে-সৃষ্টি, তার প্রক্রিয়াটা কী জান্তব! নাড়ি ছেঁড়ার কি জীবন-যাওয়া যন্ত্রণা! সেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ফসল, মারিয়া – পাশে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। হঠাৎই মনে হলো, সেক্স আর সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণে থাকলে মানুষ তাকে ভালোবাসার মতোই স্বর্গীয় করে তুলতো। হঠাৎই আজ সেই ভালোবাসায় ফিরে যেতে চাইলাম। এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে মারিয়ার মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে রুমানার মাথায় রাখতেই সে ঝটকায় উঠে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ বারো বছর হয়ে গেলো!’
মুহূর্তে যেন আমি স্বর্গচ্যুত হলাম। হাতের মুঠোয় মাটির শরীর। আর আমি আদিম সত্তার নিয়ন্ত্রণে। পার্থিব-অপার্থিব আনন্দের ভেদ-বিভেদ ভুলে নিমজ্জিত হলাম। রুমানাকেও চাইলাম ভাসিয়ে নিতে। কিন্তু কোনো অতলে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ডুবতে ডুবতেও অবচেতনমনে আমি যেন ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। ও খুব বুদ্ধিমতী! ভাসতে ভাসতেই হঠাৎ আমার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বললো, ‘পূর্বাচল পস্নটের টাকাটা তুমি একটু ম্যানেজ করো না! লক্ষ্মীটি!’
কিন্তু আমি তখন কর্তৃত্বের আসনে। চেতন-অবচেতনের ভেদ ভুলিয়ে তাকে একেবারে তলিয়ে দিলাম। শুনিইনি, ও কী বললো!