গরুগাড়ির কাফেলা। সাত-সাতখানা গরুর গাড়ি। পরপর এগিয়ে চলেছে শালবনের ভেতর দিয়ে। আসছে রাঢ় থেকে। যাবে বাগড়ি। নদী পেরোবে। ভাগীরথী নদী। লোকে বলে ‘মা-গঙ্গা’! যার অনেক গল্প শুনেছে লিটন। কখনো চোখে দেখেনি। আজ দেখবে। এতদিন পুকুর দেখেছে – রখিদ, টুটিকাটা, আকারপুকুর। দিঘি দেখেছে – পোঁপাড়ার সাগরদিঘি। খরার সময় জল কমলে সেই দিঘির মধ্যেকার মন্দিরের চূড়া জেগে ওঠে। লোকে বলে ‘মঠ’। কত লোক দেখতে যায়। নমঃ করে। পয়সা ছোড়ে। সেই দিঘি নিয়েও অনেক গল্প আছে। লিটন তা জানে। একটা গল্প তো তার মুখস্থ! ছোটবেলায় নানির মুখে কতবার যে শুনেছে!
… সাগরা নামে এক কুমোর ছিল। সে-ই নাকি খুঁড়েছিল ওই দিঘি। কোনো এক রাজরানিমার আদেশে। রাজ্যে প্রচণ্ড জলের কষ্ট। মা-মাটি ফেটে চৌচির। রাজরানিমার সহ্য হয় না। তিনি ডেকে পাঠান তার রাজ্যের শ্রেষ্ঠ কুমোর সাগরাকে। দিঘি খুঁড়তে হুকুম দেন। সাগরা কুমোর দিঘি খোঁড়ে; কিন্তু জল কই? দিঘিতে জল ওঠে না! মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে যায় সাগরা। কী করবে ভেবে পায় না। রাজরানিমা কী ভাবেন কে জানে! তবে সাগরা কুমোরের চোখে ঘুম নেই। এই বুঝি রাজরানিমা তার গর্দান নেয়! কিন্তু রাজরানিমা গর্দান নেয় না, তার আগেই সাগরা স্বপ্ন দেখে। আশ্চর্য সেই স্বপ্ন! আর তার ভয় কেটে যায়। সে নির্ভয়ে রাজরানিমার দরবারে গিয়ে হাজির হয়। রাজরানিমা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে সে নিজেই বলে তার দেখা স্বপ্নের কথা। জলের দেবতাঠাকুর তার স্বপ্নে এসেছিল। তার কাছে বলি চেয়েছে। বলি না দিলে দিঘিতে জল উঠবে না।
কার বলি? রাজরানিমা জিজ্ঞেস করেন।
আত্মবলি মা-ঠাকরান। আমার বলি চাইছে দেবতাঠাকুর।
তোমার ইচ্ছা কী?
আপনি যা বলবেন মা-ঠাকরান।
তাহলে তুমি তোমার স্বপ্নাদেশ পালন করো।
তাই হবে মা-ঠাকরান।
এরপর সাগরা কুমোর তার খোঁড়া দিঘির ঠিক মাঝখানে একটা বিগ্রহহীন মন্দির নির্মাণ করে। সাতশো ব্রাহ্মণে মিলে সাতদিন ধরে যজ্ঞ করে সেই মন্দিরে। যজ্ঞ শেষ হলে প্রধান ব্রাহ্মণের নির্দেশমতো সাগরা নেচে নেচে সেই মন্দির সাতবার পরিক্রমা করে। মুখে নিজের উদ্দেশে নিজেই সুর করে গান গায় :
নাচ-রে সাগরা কুমার।
পোঁপাড়ার দিঘি রাজরানিমার।
তারপর সাত পরিক্রমা শেষ হলে বিগ্রহ সেজে সাগরা নিজেই মন্দিরে প্রবেশ করে দরজায় খিল দেয়। আর বের হয় না। অবাক কা-! চোখের পলকে জলে সয়লাব হয়ে যায় দিঘি। রাজরানিমার নামে জয়ধ্বনি ওঠে।
তারপর আজ পর্যন্ত যতই খরা হোক, সেই জল একটু-আধটু কমলেও ওই দিঘি কখনোই পুরোপুরি শুকোয় না।
গল্পটা মনে পড়তেই মনটা কেমন হয়ে যায় লিটনের।
‘মা-গঙ্গা’র জন্যে আর মন আকুলি-বিকুলি করে না। সাগরা কুমোরের জন্যে তার মন আনচান করে ওঠে। সেই কত যুগ আগে দেশ থেকে জলের কষ্ট দূর করতে একটা লোক আত্মবলি দিয়েছিল।
সবার আগে বাবুলালের টাপরবাঁধা গাড়িটা। পেছনে আসবাববোঝাই বাকি ছখানা গাড়ি। বাবুলালের গাড়িতে আববা-মায়ের সঙ্গে লিটন নিজেও আছে। বাবুলাল তার মামাবাড়ির মাহিন্দার। তার পরানবন্ধু। বাবুলালের বাড়ি এই শালবনের ভেতরে কোনো একটা মু–তে। মু– মানে পাড়া। পাড়াটার নাম শুকনাডাঙা। নাম শুকনাডাঙা হলেও চারপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল। তার মধ্যে একটা ছোট পাড়া। কী সুন্দর! এই শালবনে পাতা কুড়োতে এসে একবার সে বাবুলালদের শুকনাডাঙায় গিয়েছিল। বাবুলালদের বাড়িতে কাঠবিড়ালির গোস্ত দিয়ে ভাত খেয়েছিল। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। ভুল করে সে নিজেই তার মামাতো ভাইবোনদের বলে দিয়েছিল সে-কথা। আর তার মামাতো ভাইবোনেরা গিয়ে লাগিয়েছিল তাদের আববাকে। তারা তাদের আববার কান ভাঙিয়েছিল।
তাদের আববা মানে তার মামা সাংঘাতিক একরোখা মানুষ। ব্যাপারটা বরদাস্ত করেনি। শাসিত্ম দিয়েছিল। বাবুলালের মতো তারও ভাতের থালা আলাদা করার হুকুম দিয়েছিল বাড়িতে। তিন মাস চলেছিল সেই শাসিত্ম। আরো চলত হয়তো! ওই সময় হঠাৎ ন-পাড়ার মাহামুদা নানি, তার মায়ের ছোট খালা, এসে মামাকে ধমক-ধামক দিয়ে উঠিয়েছিল তার সেই শাসিত্ম।
মাহামুদা নানি বেঁচে নেই। তার নিজের নানিও বেঁচে নেই। তবে মামা আছে; কিন্তু মামার সেই সাংঘাতিক ব্যাপারটা আর নেই। মামা কেমন চুপসে থাকে আজকাল। মামি অসুস্থ বলেই কিনা কে জানে! মামা স্কুলমাস্টার, স্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময় মামির সেবায় কাটে তার।
অদ্ভুত একটা মানুষ তার ওই মামা। সে যখন চলে আসছিল, মামা তাকে শুধু বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। মুখে একটিও কথা বলেনি। নিজের দুচোখ থেকে শুধু ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরিয়েছিল। সেই ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়েছিল তার মাথায়, শরীরে।
দাদোবাড়ি, দাদোর কথা না ভেবে মামাবাড়ি, মামার কথা ভাবছে লিটন। যদিও শুনেছে তার দাদো খুব বড়লোক! প্রচুর জোতসম্পত্তির মালিক! মজ্জাতপুরে নাকি বিশাল দালানবাড়ি আছে! যদিও আজ পর্যন্ত কোনোকিছুই চোখে দেখেনি। খালি গল্প শুনেছে। পরানবন্ধু বাবুলাল শুনিয়েছে সব। বাবুলাল কী কাজে তার দাদোর বাড়ি গিয়েছিল একবার! ফিরে এসে গল্প করেছিল, ‘জানিস লিটন – তোর দাদোর একটো বিশাল বড় আমের বাগান আছে! ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া সব আমের গাছ! খালি আমের বাগান লয় খো? আরো কত কিছুর বাগান আছে! লিচুর বাগান। বাঁশের বাগান। কাঁঠালের বাগান। একটো বাগানে তো আবার হরেকরকমের ফলের গাছ! জাম, বড়হর, আমলকী, একটো বিলাতি আমড়ার গাছ আছে পর্যন্ত!’ বাবুলাল শুধু তাকে গল্প শোনায়নি, তার জন্যে বেশকিছু বিলাতি আমড়া এনেছিল। কী সুন্দর দেখতে! খেতেও মিষ্টি। সেই আমড়া সে তার ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিল। গর্ব করে বলেছিল, ‘জানিস – এই আমড়া আমার দাদোর বাগানের!’
কুতু বলেছিল, ‘তোর দাদোর বাগান! কতিকার বাগান বে? তোর আববাটো কে, তাই তো কুনুদিন ভালো করি চোখে দেখলাম না! আবার দাদো, দাদোর বাগান!’
তার ইয়ারদোস্তদের মধ্যে ওই কুতু শালা খুব হারামি। ওর জন্যই সে যাচ্ছে তার দাদোর সাম্রাজ্য দেখতে। বাবুলালের কথা যদি সত্যি হয়, একদিন কুতুকেও নিয়ে গিয়ে দেখাবে। কুতু যে কথায় কথায় তাকে অপমান করে, সেটার আসল বদলা হবে কুতুকে সবকিছু দেখানো।
কিন্তু মা-গঙ্গা আর কতদূর? শালবনটাই যে এখনো শেষ হচ্ছে না। পরানবন্ধুকে জিজ্ঞেস করবে নাকি?
না জিজ্ঞেস করতে পারে না লিটন। তার আগেই তার মা তার আববাকে বলছে, ‘ওই জি সাইকেল চড়হি রহমতভাই আসিছে। অর সুথে কথা বলতে যেয়েন না খো আবার!’
আববা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন – কী হয়েছে আবার তোমাদের? ঝগড়াঝাঁটি!’
মা বলে, ‘না – না। তা লয় খো। রহমতভাই কাদিয়ান হুন গেলছে। গাঁ-তে উ আখুন একাঘোর্যা।’
লিটন মায়ের কথা শুনতে শুনতে দেখছে তার রহমতমামা সাইকেল চড়ে তাদের গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তাদের দিকে তাকিয়েও দেখল না। আবার আববা-মা কেউই রহমতমামার সঙ্গে কথা বলল না। এমনকি সালাম আদান-প্রদান করল না পর্যন্ত।
রহমতমামা হলো গিয়ে মায়ের চাচাতো ভাই। অথচ মা তার সেই চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলল না। আববাকেও বলতে দিলো না। এটা লিটনকে খুব অবাক করলেও সে চুপ করে থাকল।
রহমতমামার বাড়ি তার মামার গ্রাম ওই চাঁদপুরেই। তবে ভিন পাড়ায়। সে অনেকবার গেছে ওই রহমতমামার বাড়ি। দেখেছে রহমতমামার একটা ঘর আছে। কী সুন্দর! কত বইপত্তর সেই ঘরে। বাংলা, ইংরেজি, আরবি বইপত্তর সব। রহমতমামা যে খুব পড়াশোনা করে, ওইসব বইপত্তর দেখে সে বুঝেছিল। তারপর নিজের মামাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মামা – ওই পাড়ার রহমতমামা কোনো স্কুলে পড়ে?’
‘কোন স্কুলে পড়ে বলতে?’
‘তার ঘরে যে অনেক বই। অত বই কী করে রহমতমামা?’ সে আবার জিজ্ঞেস করেছিল। মামা উত্তরে বলেছিল, ‘কী করবে আবার? এমনি পড়ে।’
এত বই একজন মানুষ কী করে পড়ে? কেন পড়ে? বুঝতে পারেনি লিটন। আজো পারে না। ক্লাসের কটা বই পড়তেই তো তার মাথা ধরে যায়। সেই কারণেই রহমতমামার ওপর তার অন্যরকম শ্রদ্ধাভক্তি ছিল। কিন্তু মা যে বলছে রহমতমামা কাদিয়ান হয়েছে। ‘কাদিয়ান’ ব্যাপারটা কী তাহলে? মাকে জিজ্ঞেস করবে নাকি?
ভাবে বটে, জিজ্ঞেস করতে পারে না। ততক্ষণে তাদের গাড়িটা শালবন পেরিয়ে জোলায় নেমে পড়েছে।
এই জোলায় এমন পাইপ পোঁতা আছে যাতে বিনা দমকলে হুহু করে জল ওঠে। ফটফটে পরিষ্কার জল। সেই জল শালবনে পাতা কুড়োতে এসে সবাই খায়। পরানবন্ধুর সঙ্গে পাতা কুড়োতে এসে লিটন নিজেও খেয়েছে কতবার। খুব মিষ্টি জল। মনে পড়ে গেল তার সেই কথা। আর তার চোখ খুঁজতে শুরু করল সেই জল ওঠা পাইপটাকে। কিন্তু কোথায় সেই পাইপ? ধানচাষে সবুজে সবুজ হয়ে আছে গোটা জোলা। যেন ডানা মেলা একঝাঁক টিয়া পাখি! ডানা মেলে উড়ছে নীল আকাশের নিচে!
জোলা মানে নাবাল জমি। কোনো কালে নাকি মা-গঙ্গার স্রোত বইত এই খাতে! পরানবন্ধু বাবুলাল তাকে বলেছিল। কোনকালে তা বলেনি। সেও জিজ্ঞেস করেনি। পরানবন্ধু এখন তার সঙ্গেই।
পরানবন্ধুকে এখন জিজ্ঞেস করবে নাকি? কিন্তু এখন আববাও তার সঙ্গে। তাই জিজ্ঞেস করতে পারে না। আববা-মা নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে কথা বলছে। তাদের কথা একটু একটু তার কানে ঢুকলেও সে কিছু বুঝতে পারছে না। তবে মায়ের কণ্ঠস্বরে চাপা উত্তেজনা আছে। সেটা বুঝতে পারছে। আববা কথা বলে মায়ের উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করছে।
সত্যি সত্যি একঝাঁক টিয়া জোলার ধানক্ষেত থেকে শালবনের দিকে উড়ে যাচ্ছে। লিটন দেখছে। নাকি জোলাটাই উড়ে যাচ্ছে টিয়ার ঝাঁক হয়ে? সে ভাবছে, একঝাঁক নয় – তার নিজের যদি একটা টিয়া থাকত! কুতুর ভাই পাতুর যেমন আছে। পাতুর টিয়াটা পাতুর সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। ‘পাতু’ ‘পাতু’ করে ডাকে আবার! কী যে লোভ হয়!
সেই লোভে বাবুলালকে একবার একটা টিয়া ধরে দেওয়ার কথা বলেছিল সে। বাবুলাল টিয়া ধরে দেবে বলেছিল। কিন্তু সেই টিয়া রাখবে কোথায়? সমস্যা দেখা দিয়েছিল মামাকে নিয়ে। মামার বাড়িতে থেকে সেটা সম্ভব নয়। মামা যে মানুষের মানুষ! একবার রুহুলভাই কোথা থেকে একটা পায়রা এনেছিল পোষার জন্য! সেই কারণে মামা মেরে রুহুলভাইয়ের যা হাল করেছিল। নিজের চোখে দেখেছিল সে। নিজের ছেলে বলে রুহুলভাইকে খাতির করেনি মামা। লাঠিপেটা করেছিল। অগত্যা মামার ভয়ে তৎক্ষণাৎ টিয়া পোষার ভাবনাকে মন থেকে বিদায় করেছিল সে।
এখন আবার টিয়া পোষার ইচ্ছাটা ফিরে আসছে তার মনে। এখন থেকে সে তার দাদোবাড়িতে থাকবে। যা খুশি করবে। টিয়াও পুষবে। মনে মনে উত্তেজনা বোধ করে লিটন। এবং কত তাড়াতাড়ি দাদোবাড়িতে গিয়ে পৌঁছবে তার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। আর আববা লোকটাকে ভুলে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে, দাদোবাড়ি আর কতদূর মা?
মা কী জানে ছাই! মা কি কখনো গেছে নাকি? মা তো জীবনে কখনো মা-গঙ্গাই পেরোয়নি। তবে আববা লোকটা জানে। আববা লোকটা মা-গঙ্গা পেরিয়েছে। আববা লোকটা তার প্রশ্নের উত্তর দেয়, ‘আর খানিকটা। ওই জোলার ওপারে যে-গ্রামটা দেখছিস, ওটা বালিয়া গ্রাম। তার পরেই গঙ্গা নদী। ওই নদী পেরিয়ে কিছুটা গেলে …’
আববা লোকটার কথা শুনতে শুনতে মা-গঙ্গাকে কল্পনা করে লিটন। কিন্তু যা কখনো চোখে দেখেনি তা কল্পনায় আনবে কী করে? স্কুলে ভূতনাথ মাস্টার বলত, ‘যা কখনো চোখে দেখনি তা কল্পনায় আসবে না।’ সত্যিই মা-গঙ্গা তার কল্পনায় আসেও না। সেই কারণেই বোধহয় তার অস্থিরতা বেড়ে যায়। সঙ্গে বাড়ে পরানবন্ধুর ওপর রাগ। কিন্তু আববার কারণে পরানবন্ধুকে কিছু বলতে পারে না। আববা লোকটা কেমন তাই তো সে জানে না আজ পর্যন্ত!
বালিয়ার ভেতর দিয়ে গরুগাড়ির কাফেলা এগিয়ে চলেছে। বালিয়া ঠিক গ্রাম নয়। অনেকটা পোঁপাড়ার মতো একটা গঞ্জ। মধ্যে রাসত্মা। দুধারে সারি সারি দোকানপাট, বাড়িঘর। দোকান বলতে মিষ্টির দোকান। মাটির হাঁড়ি-কলসির দোকান। তেলেভাজার দোকান। কালো কালো বেগুনি-চপ-ফুলোরি সাজানো আছে। মিষ্টির দোকানেও হরেক রকমের রংবেরঙের মিষ্টি সাজানো। জিলাপি, কদমা, বাতাসা, ম-া, মিঠাই।
খাবার লোভ হয় লিটনের। কিন্তু খাবার কথা কাকে বলবে? কে কিনে দেবে? মা তো আববা লোকটার সঙ্গে কথা কলতেই ব্যস্ত। অন্য কিছুতে মায়ের মন নেই, খেয়ালও নেই। সারাক্ষণ খালি আববা লোকটার কানের কাছে গুজগুজ, ফিসফিস করছে। কী অত কথা বলছে, কে জানে!
মাকে একবার দেখে নিয়ে গাড়ির সামনের দিকে তাকায় লিটন। দেখতে পায় বেশ বড় বড় কয়েকটি বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে রাসত্মার দু-ধারে। আর রাসত্মাটাও বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে অদ্ভুতভাবে ঢালু হতে হতে নেমে গেছে। কোথায় নেমে গেছে?
তার নয়, কৌতূহল হয় যেন বাবুলালের গাড়ির বলদজোড়ার। বলদজোড়া ছুটতে শুরু করে। বলদজোড়াই যেন তার আগে দেখবে রাসত্মাটা কোথায় নেমে গেছে। বলদজোড়ার ভাবখানা যেন এমনই।
লিটন বেশ মজা পায়। যদিও সেই মজা পাওয়াটা সে প্রকাশ করতে পারে না। সঙ্গে আববা লোকটা আছে যে। কিন্তু সঙ্গে আববা লোকটা থাকল তো কী হলো? আববা লোকটা তো কোনোদিন তাকে বকাঝকা করেনি। মারেওনি। মামার মতো কখনো চোখও রাঙায়নি। এমনকি, জোরে কথা বলেনি পর্যন্ত। তাহলে আববা লোকটাকে তার এত ভয় লাগে কেন? লিটন ভাবে।
আচমকা গাড়িটা এসে থমকে দাঁড়ায় একটা খাদের কিনারায়। আর একটু হলে সবাইকে নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ত ওই খাদে। বাবুলাল সতর্ক ছিল। সময়মতো বলদজোড়ার লাগাম টেনে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
লিটন সাংঘাতিক ভয় পেলেও সামনের দৃশ্য দেখে অবাক না হয়ে পারে না। এত বড় খাদ? তাও আবার বালির খাদ! নাকি সামনে ওটা বালির খাদান একটা?
সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবুলাল বলে ওঠে, ‘এদ্দ্যারে লিটন, এই দ্যাখ মা-গঙ্গা।’
মা-গঙ্গা! মা-গঙ্গা তো জল কই? জলের স্রোত কই? শুধু বালি আর বালি যে! টাপরের ভেতর থেকে মুখ বের করে ভালো করে জল খোঁজে লিটন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দেখতে পায়, দূরে ধু-চিকচিক বালির মধ্যে ছিলছিলে একটা ধারা বয়ে চলেছে। সেই ধারা ঘিরে এখানে-ওখানে বহু মানুষের ভিড়! কেউ কাকের মতো স্নান করছে। কেউ কাপড় কাচছে। কেউ কলসিতে জল ভরছে। দূরে আবার ওই নদীর বুকেই লকড়ি-কাঠে আগুন জ্বলছে দাউদাউ, যার কু-লী পাকানো ধোঁয়া উড়ে গিয়ে মিশছে নীল আকাশে। তবে আগুন ঘিরে অনেক লোক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাশে ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে। কান্নার সুরও ভেসে আসছে সেখান থেকে।
ওসবে লিটনের কোনো আগ্রহ নেই যদিও। সে ভাবছে
মা-গঙ্গাকে নিয়ে। দিঘির চাইতে নদী অনেক বড়! তাহলে মা-গঙ্গায় জল নেই কেন? অথচ পোঁপাড়ার সাগরদিঘিতে কত জল। তাহলে নদীর চেয়ে দিঘি ছোট হয় কী করে?
লিটনের এমন ভাবনার মধ্যে বাবুলালের গাড়িটা নদীতে নামার লিক খুঁজে পেয়েছে। সেইমতো গাড়িটা হাওলে হাওলে এগোচ্ছে। সেটাকে অনুসরণ করছে কাফেলার অন্য গাড়িগুলি।
বালির ওপর দিয়ে রাসত্মা! কোথায় রাসত্মা? শুধুই বালি। বালিতে লিক পড়ে না। গাড়ির চাকা পড়ে না। বলদগুলির খুব কষ্ট হচ্ছে! লিটন অনুভব করছে। বালিয়া ছেড়ে তাদের গাড়িটাকে বলদজোড়া যে-গতিতে ছুটিয়ে এনেছিল ঘাট বরাবর, এখন আর গাড়িটার সেই গতি নেই। বলদজোড়ার দিকে তাকিয়েই তা বুঝতে পারছে সে। সঙ্গে এও বুঝতে পারছে, বালি কাউকে রাসত্মা দেয় না। বালির ওপর রাসত্মা করে নিতে হয়। যেমন বলদজোড়া করে নিচ্ছে!