‘খামটা বুঝে নিন ভাইজান। পিস্নজ এখনই দেখবেন না। শুধু নিয়ে আমাকে কাইন্ডলি মাফ করে দেবেন।’
‘কীসের খাম স্যার? কিছু তো বুঝছি না!’
‘বুঝলেন না? ওই যে সেই বড় ব্রিজের ব্যাপারটা …’
‘ও … সেই কালিদহের ব্রিজটা? কিন্তু স্যার, ওটা তো আপনাকে খুশি হয়েই দিয়েছিলাম। আপনি তো আর চেয়ে নেননি।’
‘না মিলন সাহেব। না চাইলেও আমার রিজেক্ট করা উচিত ছিল। পারিনি। সবটা ফেরতও দিতে পারিনি।’ – রিটায়ার্ড অফিসার আবুল হাসান কন্ট্রাক্টর মিলন শেখের হাতদুটো চেপে ধরেন।
‘আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে স্যার। নিচ্ছি। বাট অনেকেই তো নেয়। আমরাও বেনিফিটেড হই। এখানে ফেরত দেওয়া-নেওয়ার কী আছে বলুন তো স্যার।’
‘অনেক কারণ আছে রে ভাই। সেসব কথা থাক। আপনি মন থেকে মাফ করে দিয়েছেন তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দিয়েছি। বাট ব্যাপারটা ঠিক ক্লিয়ার হলো না স্যার, খচখচানিটা থেকেই গেল।’
‘ওটা না হয় থেকেই যাক। আসি তাহলে মিলন ভাই। আলস্নাহ হাফেজ।’
মেইন রোডে এসে পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করেন আবুল হাসান। তাতে এখনো পর্যন্ত তেইশজনের নাম উঠেছে। স্মৃতি হাতড়ে যখনই যার নাম মনে পড়ছে টুকে নিচ্ছেন চিরকুটে। এ-সংখ্যা কততে গিয়ে ঠেকবে কে জানে। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। হাতে যা আছে তার থেকে কিছু কিছু করে দিয়ে মাফ চেয়ে নিলেই হবে। মালেক হজুর তো সে-রকমই বললেন। এছাড়া আর উপায়ই-বা কী? সারাজীবন কার কাছে কত খাম নিয়েছেন সেসব তো আর লিখে রাখেননি। হাতেও তেমন থাকেনি। এখন পেনশনসহ সম্পদ যা আছে, তাতে বড় কোনো বিপদ না হলে বাকি দিনগুলো মোটামুটি হেসেখেলেই পার করে দেওয়া যাবে। দিনগুলো যাচ্ছিলও সেভাবেই। কিন্তু পড়শি মালেক হুজুর দিলেন সব উলটোপালটা করে।
হুজুর খুব পরহেজগার মানুষ। মসজিদে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পড়তে তার নেক নজরে পড়ে গেলেন আবুল হাসান। একদিন তাবলিগের দাওয়াতে পনেরো দিনের জন্য তাকে বাইরে নিয়ে গেলেন হুজুর। ব্যস। পালটে গেল আবুল হাসানের চেহারা-সুরত। ফিরলেন তিনি একমুখ সাদা-কালো দাড়ি, গোল টুপি আর লম্বা জোববা গায়ে নিয়ে। মেরিনা বেগম তো রেগেমেগে কেঁদে জারেজার। তার স্মার্ট স্বামীর এ কী হাল! সে যেন এখনই সত্তর বছরের থুরথুরে বুড়ো। বললেন, ‘ছাড়ো তো এখন এসব মুনার বাপ। তোমাকে চিনতেই পারছি না আমি। আরো পরে না হয় করো এসব। দিন তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না।’
আবুল হাসান মুচকি হাসেন। মনে মনে বলেন, দিন কি আর আছে মেরিনা বেগম। মরণ তো ঘণ্টা বাজিয়ে আসবে না। সুন্নত-তরিকার চেহারা-সুরত ছাড়া কবরে গেলে মুগুরের ঘায়ে দফারফা করে দেবে। দুনিয়াপাগল মেরিনা বেগমের এখন এসব বুঝে আসবে না। এর ওপর কদিন আগে এক মাহফিলে হুজুরদের বয়ান শুনে তো তার দিশেহারা অবস্থা। হুজুররা বলেছেন, খাম-টামের রক্ত-মাংস নিয়ে ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। হায়! হায়! ইবাদত কবুল না হলে তো পরকাল ঝরঝরে! মাথার ভেতরে তুফান ওঠে আবুল হাসানের। তবে নাজাতের পথ দেখিয়ে ঠান্ডা করেন মালেক হুজুরই। তারপর থেকে স্মৃতি হাতড়ে লিস্ট তৈরি করে মাঠে নেমে পড়েছেন আবুল হাসান। তালিকার দু-নম্বরে এখন আবদুল হামিদ মিয়া। ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু তার সেই ইলেকট্রনিকসের ব্যবসার রমরমা অবস্থাটা এখন আর নেই। হামিদ মিয়া বয়সের ভারে চেয়ারে ঝিমুচ্ছিলেন। মুখে লাল মেহেদির ছোট সাইজের দাড়ি। আবুল হাসান সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তড়াক করে দাঁড়িয়ে যান হামিদ মিয়া। ‘আরে, স্যার আপনি! চেনাই যায় না! এ্যাত্তো চেঞ্জ স্যার! আসেন আসেন। বসেন।’
‘বহুত শুকরিয়া হামিদ মিয়া। বসার দরকার হবে না। আপনার সঙ্গে যে দেখা হয়েছে সেটাই পরম সৌভাগ্য। একটা জরুরি কাজ সেরেই চলে যাব।’
‘তা কী করে হয় স্যার। কতদিন পর দেখা হলো। কিছু না খাইয়ে তো ছাড়তে পারব না। গরিব হয়ে গেছি বলে ইজ্জত করতে তো আর ভুলিনি স্যার।’
‘না হামিদ মিয়া সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে ভাই। আপনার এ-অবস্থা দেখে আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু কী করবেন বলুন। ধন-দৌলতের সবকিছু তো ওই আলস্নাহপাকের হাতে। তিনিই আবার দেবেন ইনশালস্নাহ।’ – এই বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সাদা খাম বের করে হামিদ মিয়ার সামনে ধরে বললেন, ‘এতে সামান্য কিছু আছে। নিয়ে আমাকে কাইন্ডলি মাফ করে দিন ভাই।’
‘এ-আপনি কী করছেন স্যার! কিসের খাম? মেয়ের বিয়ের দাওয়াত-টাওয়াত নাকি?’
‘আরে না হামিদ মিয়া। দাওয়াতের কিছু না। ওই যে একটা প্রজেক্টের জন্যে …’মুহূর্তেই সব মনে পড়ে যায় ঝানু ব্যবসায়ী হামিদ মিয়ার। খাম ফেরত! তা-ও একেবারে নিজে হেঁটে এসে! এ-সুযোগ তো হাতছাড়া করা যাবে না। আসলটা ফেরত পেলেও ব্যবসাটা আবার দাঁড় করানো যাবে। আহা! আনন্দে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে হামিদ মিয়ার।
‘বুঝেছি স্যার। আপনি খুব ভালো মানুষ। না হলে কেউ কি এভাবে পায়ে হেঁটে দিতে আসে? কিন্তু স্যার, মনে কিছু নেবেন না। আমি তো আপনাকে তিনটে মোটা খাম দিয়েছিলাম। অনেক আগের কথা। মনে না-ও থাকতে পারে। তো আপনার দয়ায় কাজটা পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু ধরে আর রাখতে পারলাম না। জমি গেল। জমানো টাকা গেল। বউয়ের গয়না গেল। এখন তো দেখতেই পাচ্ছেন কী করুণ অবস্থা!’
‘বুঝতে পারছি হামিদ মিয়া। খামের কথাও জানি। কিন্তু কী করব বলুন। অবসরে গেছি। আমার যে এর বেশি সাধ্য নেই রে ভাই। দয়া করে মাফ করে দেন। আলস্নাহ আপনার অনেক ভালো করবেন।’
হামিদ মিয়ার মুখ থেকে এবার বিনয়ের পর্দাটা সরে যায়। শক্ত চোয়াল দুটো উঁচু হয়ে ওঠে। একেবারে ভিন্ন মানুষ সে এখন। দৃষ্টিটা অন্যদিকে রেখে বলে –
‘রাখেন মিয়া ওসব আলতু-ফালতু কথা। সারাজীবন দু-হাতে কামাইছেন। এখন হুজুর হইয়া ফাজলামো করতে আইছেন, না? আমি ছেলেপুলে নিয়া না খাইয়া মরতেছি আর আপনি আইছেন ভিক্ষা দিতে! শোনেন সাহেব, দিলে পুরোটাই দিবেন, না দিলে সব ফাঁস কইরা দিমু। কেয়ামতেও বুঝবেন ঠেলাটা। আপনি মানি মানুষ। এর বেশি আর কিছু বললাম না। বাসায় গিয়ে ভাবেন। যান।’
দুই
খুব মুষড়ে পড়েছেন আবুল হাসান। হামিদ মিয়ার কথা মানতে গেলে পেনশনের প্রায় অর্ধেকটাই নেই হয়ে যাবে। এরপর বাকিদের কাছে যাওয়ার কোনো উপায় থাকবে না। তখন শহরের বাড়িটা বিক্রির কথা ভাবতে হতে পারে। শেষজীবনের সব সম্পদই যদি এভাবে তলানিতে এসে ঠেকে তাহলে বাকি নিশ্বাসটুকু চলবে কী করে? সারাটা রাত নির্ঘুমই কেটে গেল আবুল হাসানের। বিষয়টা যে এতটা জটিল হয়ে পড়বে তা বিন্দুমাত্র ভাবতে পারেননি তিনি। এরপর ভয়ে আর কারো কাছে যাওয়ার ভাবনাও উবে গেছে তার। কারণ মোবাইলের যুগে ব্যাপারটা আর গোপন থাকবে না। সবাই তখন হামিদ মিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু এখন করবেনটা কী তিনি। বাড়ি বিক্রির কথা বললে মেরিনা বেগম কী করবে কে জানে। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে হাসানের। বাইরে কোথাও একটু গেলে মন্দ হয় না। প্রিয় এক ভাগনি বুলি। কাছেই মোহাম্মদপুরে থাকে। ওর বিয়ের পর সাতটি বছর পার হয়ে গেছে, একটিবারও যাওয়া হয়ে ওঠেনি কাজের চাপে। একটা ছেলে কোলে এলেও ওকে নিয়ে কষ্টের শেষ নেই বুলির। অটিজমের এই বাচ্চা নিয়ে ও কী করবে তা নিয়েই ওর যত ভাবনা। মামা আবুল হাসান সান্তবনা দিয়ে ওকে থামিয়ে রাখলেও সামনাসামনি আজো দেখা হয়ে ওঠেনি। সেখানেই যাবেন তিনি। কিন্তু সেখানেও যে আরেক কিসিমের টেনশন অপেক্ষা করছিল – কল্পনাও করেননি আবুল হাসান।
এতদিন পর মামাকে কাছে পেয়ে আনন্দে কান্না থামতে চায় না বুলির। একমাত্র ছেলে মৃদুল সামনে আসে। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় আবুল হাসানের দিকে। একসময় চোখদুটো নিচে নামিয়ে বলে,
‘কে এটা?’
‘তোমার নানু বাবা সোনা।’ – বুলি পরিচয় করিয়ে দেয়।
‘নানু মানে কী? আমি চিনি না, চিনি না। ওকে যেতে বলো, যেতে বলো’ – চিৎকার করে বলতে বলতে পাশের ঘরে চলে যায় মৃদুল।
হতবাক আবুল হাসান কী বলবেন ভেবে পান না। বুলি বুঝিয়ে বলেও ওর চিৎকার থামাতে পারে না। মামার কাছে বসে বলে,
‘এরকমই করে মামা। নতুন কাউকে সহ্যই করতে পারে না।’ – চোখে পানি আসে বুলির। আবুল হাসান সান্তবনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন –
‘কাঁদিস না। শুনেছি ওর নাকি অনেক মেধা। ভালো গান করতে পারে, পড়াশোনাতেও ভালো। অতীত-ভবিষ্যতের কথাও নাকি নির্ভুল বলতে পারে। এমন ট্যালেন্টেড ছেলে কজনের হয় বল?’
‘হ্যাঁ মামা। এই মেধাটুকু আলস্নাহ দিয়েছেন বলেই একটু সান্তবনা পাই।’ – ওড়নায় চোখ মোছে বুলি। পেছনে তাকিয়ে দেখে আধখোলা দরজার ফাঁকে চোখ রেখে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে মৃদুল। ইশারায় কাছে ডাকে বুলি। আপত্তি করে না সে। সোজা এসে নানুর পাশে বসে দাড়ি নিয়ে খেলা করতে থাকে। তবে মুখটা তখনো গম্ভীর। আবুল হাসান ওকে খুশি করার জন্য বলেন –
‘ভাইয়া, তুমি নাকি সুন্দর গান করতে পারো। শোনাবে একটা?’
‘না, এখন গান করা যাবে না। মুড নাই।’
‘ঠিক আছে। তাহলে কী করবে? তুমি নাকি কোন মাসের কোন তারিখ কী বার হয় – ঠিক ঠিক বলে দিতে পারো?’
‘হ্যাঁ, পারিই তো।’
‘তাহলে বলো তো, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কী বার ছিল?’
‘শুক্রবার। মোবাইলে সার্চ করে দ্যাখো।’ – বুলি মোবাইল সার্চ করে দেখাল মৃদুলের কথাই ঠিক। বিস্ময়ে থ মেরে যান আবুল হাসান। কৌতূহলও বেড়ে যায়। বলেন,
‘বাহ্ ঠিক বলেছ তো। এবার বলত ভাইয়া, ২০২৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর কী বার হবে?’ হঠাৎ মৃদুল উঠে পড়ে মুখ গম্ভীর করে যেতে যেতে বলে –
‘বুধবার।’ – বুলি মোবাইলে মিলিয়ে দেখল – ঠিক তাই। আবুল হাসান খুশিতে ওকে কাছে ডেকে আদর করতে চাইলেন। কিন্তু পেছন ফিরে তাকিয়েই দিলো সে এক পিলে চমকানো ঘোষণা।
‘এই যে মিস্টার নানু। বুড়ো হয়েছ। তুমি আর বেশিদিন বাঁচবে না, বুঝেছ? ২০১৬ সালের ১৬ জুন তুমি মারা যাবে। পেপারে বড় বড় করে তোমার মৃত্যুর খবর ছাপা হবে। হা-হা-হা।’
বুলি দৌড়ে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে বলে –
‘ছিঃ ছিঃ মৃদুল, এভাবে বলতে হয় না বাবা সোনা। নানু কষ্ট পাবে।’
আবুল হাসান কথাটা গায়ে মাখেননি – এমন ভাব করে বলেন,
‘থাক থাক বুলি, ওকে কিছু বলিস না। বাচ্চা ছেলে। এমনিই হয়তো বলেছে।’
‘হ্যাঁ মামা। হঠাৎ হঠাৎ কখন যে কী বলে ফেলে … কিছু মনে করবেন না মামা।’
‘না না কিছু মনে করিনি। স্বাভাবিক বাচ্চা হলে নিশ্চয়ই এরকম বলত না।’
কিন্তু মন কি আর তা মানে? বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে আবুল হাসানের। মৃত্যু! তাও একেবারে দিন-তারিখের ঘোষণা! এখন মার্চ চলছে। তার মানে ওর কথা সত্যি হলে তিন মাস সময়ও হাতে নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ভাবেন – অটিজমের বাচ্চা হলে কী হবে, দু-দুটো বছরের বার ঠিক ঠিক বলে দিলো! মৃত্যুর তারিখটাই-বা তাহলে ঠিক হবে না কেন? ভেতরে কালবোশেখির ঝড় চলছে তখন তার। ভাবেন – মৃত্যু তো হবেই একদিন। কারো রেহাই নেই। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে তার বেলায় এত চটজলদি? দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ, মৃত্যু-যন্ত্রণা, কবরের আজাব, আখেরাত-পুলসিরাত – এসব থেকে বাঁচার তো কোনো উপায়ই করা গেল না। খাম ফেরত দেওয়ার কাজটা মাত্র শুরু করেছিলেন। সেটাও গেল গ্যাঁড়াকলে আটকে। এত কম সময়ের মধ্যে গুনাহর হিসাব-নিকাশই মেটাবেন, না আখেরাতের পুঁজি জোগাড় করবেন?
তিন
‘রুনার বিয়ের তারিখটা কি একটু এগিয়ে আনা যায় না, মেরিনা বেগম?’
‘বলো কী গো! ঊনত্রিশ জুনে ওর প্র্যাকটিক্যাল শেষ হবে। তারপর সাত-আটদিনের ঈদের ছুটি। কেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে দিতে চাও নাকি?’
‘আরে না। সম্ভব কিনা সেটা জানতে চাইছিলাম। জুনের পাঁচ তারিখেই তো থিওরিটিক্যাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা তেমন আর কি। অ্যাটেন্ড করলেই হলো। ওই গ্যাপটাতেই …’
‘না, না। পরীক্ষা পরীক্ষাই। তাছাড়া তখন রোজা চলবে। এর মধ্যে বিয়ের কথা ভাবো কী করে? আসল কথাটা কী বলো তো, বড় কোনো সমস্যা?’
‘সমস্যা-টমস্যা কিছু না মেরিনা। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তো। নিশ্বাসেরও ভরসা নেই। তাই ভাবছিলাম দায়টা যত তাড়াতাড়ি সারা যায়। এই আর কী।’
‘কী যে বলো না তুমি মুনার বাপ। বয়স বুঝি আর কারো হয় না। ওসব ঝেড়ে ফেলো তো মাথা থেকে। বরং দোয়া করতে থাকো মেয়েটা যেন রেজাল্টটা ভালো করে।’ – চুপসে যান আবুল হাসান। আসল কারণটা আর বলতে পারলেন না। প্রসঙ্গ পালটে বলেন,
‘ঠিক আছে, থাক। অন্য কথা বলি। মাথা গোঁজার জন্য একটা বাড়ির দরকার ছিল আমাদের, সেটা তো হয়েছে। কি বলো?’
‘হ্যাঁ হয়েছেই তো। তাতে কী?’
‘কিন্তু পরে যেটা করেছি সেটার কি কোনো দরকার আছে?’
‘দরকার নেই মানে? কী বলছ তুমি? দুই মেয়ের জন্য দুই বাড়ি। বেশি হলো কোথায়?’
‘বেশিই তো হয়েছে। মেয়েরা জন্মেছে ঢাকায়। বড় হয়েছে ঢাকায়, থাকবেও ঢাকাতেই। মফস্বল শহরে শুধু থাকার জন্য নিশ্চয়ই ওরা যাবে না। আমরা পটল তোলার সঙ্গে সঙ্গে জামাইরা বউদের রাজি করিয়ে বাড়ি দুটো বেচে খাবে। বোঝো এটা?’
‘খেলে খাক না। মেয়ে-জামাইরাই তো খাবে। সমস্যা কী?’
‘সমস্যা আছে মেরিনা। দুটো বাড়ি করতে গিয়ে যে-ঋণ হয়েছে সেটা তো শোধ করা ফরজ। ওটা তো আর জামাইবাবাজিরা করবে না। পেনশনের টাকায় হাত দিলে তো জানই শেষ। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? ঋণ নিয়ে কবরে গিয়ে মুগুরের ঘাই খাব আমি একা, আর ওদিকে জামাইবাবাজিরা শ্বশুরের বাড়ি বেচার টাকা নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াবে। এটা আমাকে মানতে হবে?’
‘ভারি মুশকিলের কথা। আমরা মরলে মেয়েরা কী করবে, না করবে সেটা নিয়ে ভাবার দরকার কী? আমাদের জীবনটা কেটে গেলেই তো হলো। আসলে তোমার হয়েছে কী, সত্যি করে বলো তো?’
‘হবে আবার কী? প্রশ্নটা হলো ঋণ শোধের। সেই টাকা তো হাতে নাই। তাই এক্সেস বাড়িটা বিক্রি করে ঋণ শোধ করে কবরে যেতে চাই। ক্লিয়ার?’ – না ক্লিয়ার হলো না। পেট্রল-আগুনে জ্বলে ওঠেন মেরিনা বেগম।
‘ও … এই তাহলে আসল কথা? কিসের ঋণ শোধ? সারাজীবন তো ঋণের কোনো কথা শুনলাম না। উলটো ঋণ তুমিই মানুষকে দিয়ে বেড়িয়েছ। এখন আবার ঋণ এলো কোত্থেকে? ভেলকিবাজি, তাই না? ওসব আমি বুঝতে চাই না। খবরদার বাড়ি বিক্রির কথা আর মুখে আনবে না। এই আমার শেষ কথা।’ – এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে যান মেরিনা বেগম।
নাহ্! দুটো ইস্যু তুলে কোনোটারই সুবিধে করা গেল না। আর ইস্যু দুটোও এমন ডেলিকেটেড যে, কাউকে বুঝিয়ে বলার মতোও নয়। মেয়ের বিয়েটাকে না হয় ইগনোর করা গেল। কিন্তু খামের ইস্যু? এর আর তো কোনো সোর্স নেই। পার্কের ফুরফুরে বাতাসেও ঘামতে থাকেন আবুল হাসান। বিষণ্ণ মন নিয়ে দুপুরে নামাজ পড়ে সোজা চলে এসেছেন পার্কে। এখন বেলা তিনটে। ক্ষক্ষধেয় নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে। তিন-চারবার কল এসেছে এর মধ্যে বাসা থেকে। বোঝাই যাচ্ছিল – খেতে ডাকা হচ্ছে। কিন্তু খাবেন কেন তিনি? জাহান্নামের পোড়াপুড়িটা এখানেই হয়ে যাক। খাবেন না তাই কলও ধরছেন না। পার্কে তিনি একা। এ-সময়টা একা থাকারই কথা। কিন্তু দূরে ওটা কী দেখা যায়? একটা গাছের ঝোপের তলে ওরা কারা? হ্যাঁ, কমবয়সী ছোকরা-ছুকরিই তো। কে যে কার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জঘন্য ল্যাপ্টালেপ্টি অবস্থা। ছিঃ ছিঃ। এরকমভাবে প্রকাশ্যে! ছেলেমেয়েরা আজকাল এতটাই বেহায়া-বেশরম! নাউজুবিলস্নাহ! অনিচ্ছুক চোখদুটোকে জোর করে ফেরাতে চাচ্ছিলেন আবুল হাসান; কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। ততোক্ষণে বুড়ো রক্ত-মাংসের ভেতরে টগবগে তরুণ আবুল হাসান জেগে উঠতে শুরু করেছে। একসময় পাজামায় এক ঊর্ধ্বমুখী চাপও অনুভব করেন আবুল হাসান। রোমাঞ্চিত হয়ে ভাবেন – বাহ্, এখনো আছে দেখছি! ফুরোয়নি। কিন্তু তাতে কী। মেরিনা বেগম তো অলরেডি ফিউজড। শিরিনটা থাকলে অবশ্য জমতো দারুণ। ও ছিল আগুনের টুকরো। কয়লার আগুন। ও নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি নিভে যেত না। ঠিক এ-সময় বেরসিক মোবাইলটা বেজে ওঠে আবারো। উফ্! এত জ্বালায় ক্যান ফোনটা? প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেটটা বের করেন আবুল হাসান। দেখেন – জামাই মারুফ! ইস্রে, জামাই আর সময় পেল না! গেল সব মজার তড়বড়ানি। কী আর করা। ধরতেই হলো।
‘আববা, আপনি নাকি মসজিদ থেকে বাসায় ফেরেননি। কারো কলও ধরছেন না। কেইসটা কী বলুন তো? এই ভরদুপুরে কোথায় আপনি? কী করছেন? খেয়েছেন কী?’
‘কোনটা আগে বলব বাবা।’
‘ও-কে, এখন কিছুই বলতে হবে না। আপনি এক্ষুনি বাসায় চলে যান। আম্মা, রুনা, মুনা সবাই খুব টেনশনে। আর আপনার যা প্রবলেম একটু শুনলাম, সেগুলো কিছুই নয়। রাতে বাসায় ফিরে সব ক্লিয়ার করে দেবো। কিচ্ছু ভাববেন না। ও-কে আববা?’
‘ও-কে বাবা।’ – সুবোধ ছেলের মতো উঠে পড়েন আবুল হাসান। রক্তের ক্ষুধাটা তখন আবারো নাড়িভুঁড়িতে। এবার আরো জোরেশোরে।
চার
‘না আববা, আপনি যা বলছেন তা ঠিক ক্লিয়ার হলো না। আমার মনে হয়, কেউ আপনার কাছে মোটা অংকের চাঁদা চেয়েছে, না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। জঙ্গি-টঙ্গি নয় তো আববা?’ – জামাই মারুফ উত্তরের জন্য শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘না রে বাবা, জঙ্গি-টঙ্গি কিছু না। বিষয়টা আসলে তোমাদের বোঝানোর মতো না। একটু কমপিস্নকেটেড। তোমার আম্মাকে যেটা বলেছি সে ব্যাপারে যদি কিছু করতে পারো তো করো, না পারলে আমাকে আর বিরক্ত করো না বাবা। আমার ভালো লাগছে না।’
কারো কাছে কোনো হেলপ পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিলেন আবুল হাসান। অনেক ভেবেচিন্তে যে-পথ ধরলেন তা অনেকটা আত্মঘাতী। খাওয়া কমিয়ে দিলেন। সকালে শুধু এক কাপ চা, দুপুরে হাফ পেস্নট ভাত আর রাতে এক গস্নাস গরম দুধ। এর বেশি কেউই তাকে জোর করে খাওয়াতে পারে না। কথাও বলেন খুব কম। এভাবে মাসদেড়েক কেটে গেছে। শরীর ভেঙে পড়েছে। দুর্বলতায় মসজিদেও ঠিকমতো যেতে পারেন না। সারা দিন-রাত একা ঘরেই পড়ে থাকেন। মোবাইলে ঘনিষ্ঠ কারো সঙ্গে যে টুকটাক কথা বলতেন, সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। তার খাম দেওয়া-দেওয়ির বিষয়টা সম্ভবত হামিদ মিয়ার মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় ফোনের পর ফোন আসতে শুরু করল। কিন্তু কী উত্তর দেবেন আবুল হাসান? সমস্যাটার সুরাহা তো করা গেল না। রাগে-দুঃখে মোবাইলটা ছুড়ে ফেলে দিলেন ঘরের বাইরে। এখন একেবারে বিচ্ছিনণ। দুনিয়া আর আখেরাতের আজাবের কথা ভেবে ভেবে মাঝেমধ্যে হাউমাউ করে কাঁদেন, পাগলের মতো চিৎকার করেন। এরপরও মেরিনা বেগমের অনড় অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না।
মে মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। সাত জুন থেকে রোজা শুরুর সম্ভাবনা। আবুল হাসানের বেড থেকে ওঠানামা করতেও এখন কষ্ট হয়। বেডের পাশে ক্যালেন্ডারের দিকে অসহায়ের মতো তাকান তিনি। ১৬ তারিখটাকে কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন সেদিকে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল অনুভূতি নেমে যায় কোমরে। তিনি কি সত্যিই বিশ্বাস করছেন তারিখটাকে? হয়তো, হয়তো-বা নয়। হতে পারে – একটা নিষ্পাপ শিশুর মুখ দিয়ে তারিখটা আলস্নাহই বলিয়েছেন, আবার এ-ও হতে পারে – এ এক অস্বাভাবিক শিশুর অর্থহীন প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়। তবু মালাকুল মউত যদি ওইদিন তশরিফ এনেই ফেলেন, তাহলে? সময়ই তো নেই হাতে। রাত-দিন আলস্নাহর কাছে ক্ষমার জন্য কান্নাকাটি করছেন বটে; কিন্তু সম্পদ থাকতে তো এর দায় থেকে মুক্তি মিলবে না। অর্ধ অনশনও কাজে আসছে না। স্ত্রী-সন্তান সবাই হঠাৎ করে পর হয়ে গেল। কেউ আর কাছেও আসে না। সম্পদের মায়া সব বন্ধনকে এভাবেই মিথ্যে করে দেয়? কাদের জন্য তাহলে জীবনটাকে শেষ করলেন তিনি! চোখের কোণটা ভিজে ওঠে আবুল হাসানের। হঠাৎ কিসের একটা হইচইয়ের শব্দ কানে আসে পাশের ঘর থেকে। বিছানা থেকে উঠে বসেন আবুল হাসান। হ্যাঁ, মারুফের গলাই তো।
‘আমি আর কোনো কথাই শুনতে চাই না আম্মা। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে আববাকে পেয়েছি। সেই আববাকে আপনারা সবাই প্রায় না খাইয়ে মেরে ফেলছেন। এ আমি হতে দেবো না আম্মা। হয় আপনি রাজি হবেন বাড়ি বেচতে, না হলে এক্ষুনি আমি সবকিছু ছেড়ে চলে যাব। গো আই মাস্ট। কোনোদিন ফিরব না। নেভার।’
‘শোনো মারুফ। একটু বোঝার চেষ্টা করো। তোমার আববাকে তো আমি চিনি। সরল-সোজা মানুষ। কেউ হয়তো কুবুদ্ধি দিয়ে বলেছে – তোমার তো ছেলে নেই, দু-দুটো বাড়ি রেখে কী করবে? একটা বেচে দাও। ঋণ-টিন আসলে কিছু না। তোমার আববা ঋণ করার মানুষ না। ওটা একটা অজুহাত। কয়েকদিন পর রোজা। দেখবে তখন আর উনি না খেয়ে পারবেন না। আরেকটু ধৈর্য ধরো বাবা।’
‘বেয়াদবি নেবেন না আম্মা। ধৈর্য অনেক ধরেছি। আর না। আপনারা কেমন মানুষ বলুন তো? চোখের সামনে নিজের স্বামী বাবা না খেয়ে খেয়ে বিছানায় লেগে যাচ্ছে, প্রেসার লো হয়ে যাচ্ছে। সেটাকে কিছুই মনে করছেন না? তুচ্ছ বাড়িটাকেই বড় করে দেখছেন? আফটার অল, এটা আববার নিজের সম্পদ। তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন। এখানে আমরা বলার কে?’
‘তোমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তো বলেছিলাম বাবা। আমার আর কী প্রয়োজন।’ – অস্ফুট কান্নায় গলাটা কেঁপে ওঠে মেরিনা বেগমের। আর কথা বাড়ান না। ধীরপায়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন –
‘ঠিক আছে। দক্ষিণ পাশের বাড়িটা রেখে বাকিটা যা ইচ্ছে হয় করো। আমার আর কিছু বলার নেই।’
পূর্ণ অনশনে আর যেতে হলো না আবুল হাসানের। অর্ধ অনশনেই কাজ হয়ে যাওয়ায় শরীর-মন দুটোই এখন বেশ চাঙ্গা। মনে মনে খুশি হন তিনি মারুফের ওপর। পরের ছেলে হয়েও যে এতটা করবে – ভাবতেও পারেননি তিনি। মেইন রোডে বাড়ি বলে বিক্রি হতে সময়ও লাগল না। টাকা হাতে পেয়েই আবুল হাসান হামিদ মিয়ার সঙ্গে ঝামেলা মেটালেন আগে। তালিকার অন্য সবার সঙ্গেও যোগাযোগ করে খাম বিতরণের কাজ শেষ করে এনেছেন প্রায়। রোজা শুরুর আগেই তালিকার সর্বশেষ মানুষটির কাছে খাম পৌঁছে দিয়ে মনে খুব প্রশামিত্ম অনুভব করেন আবুল হাসান। কিন্তু চট করে মনে পড়ে যায় সেই তারিখটার কথা। আর মাত্র আটদিন বাকি। ধক্ করে ওঠে বুকটা। শেষ হয়ে যাচ্ছে কি সময়?
পাঁচ
সকালে হুট করে পরিবারের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার ব্যাপারটায় হকচকিয়ে যায় সবাই। হলো কি আবুল হাসানের? কিন্তু তা আর জানা সম্ভব হলো না। বিস্ময়, প্রশ্ন, উদ্বেগ, কান্না সবকিছু মনেই থেকে গেল সবার। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না আবুল হাসান। সবাইকে চলে যেতে বলে শুধু মারুফকে কাছে টেনে নেন। ফিসফিস করে বললেন –
‘শোনো মারুফ। কেন যেন মনে হচ্ছে – আজ এই ১৬ জুন আমার জন্য একটা বস্ন্যাক ডেট। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। যখন-তখন যে-কারো জীবনে এমন একটি দিন আসতে পারে। হয়তো আমারও সে-দিনটি এসে গেছে। ওরা শুনে খামোকা হাউমাউ করবে। তাই ওদের সরিয়ে দিয়েছি। তুমি আমার ছেলের মতো। অস্থির হবে না। শোনো, আজ যদি আমি বেঁচে যাই তো গেলাম। আর যদি চলে যেতেই হয়, তাহলে মকবুল হুজুরকে খবর দেবে। ওনাকে সব বলা আছে। যা করার উনিই করবেন। তুমি আজ ছুটি নাও। আজ আমি কারো সঙ্গে কোনো কথা বলব না। কেউ যেন আমার ঘরে না আসে, ডিস্টার্ব না করে – সেটা তুমি দেখবে। আমি না থাকলে রুনার বিয়ের ব্যবস্থা সব তুমিই করবে। টাকা-পয়সা ক্যাশ করে আমার লকারে রেখেছি। আম্মাকে বললেই পেয়ে যাবে। যা বললাম সব গোপন রাখবে। ওকে?’
‘কিন্তু আববা। আমার মনে হচ্ছে আপনি মিছেমিছি এসব ভাবছেন। থানায় জিডি করেছি। আমার র্যাব-পুলিশের বন্ধুরা ওদের রেগুলার ডিউটিতে অলরেডি ব্যাপারটাকে ইনক্লুড করেছে। একটা টিকটিকিও ঢুকতে পারবে না বাসায়।’
আবুল হাসান মনে মনে একটু বিরক্ত হলেন। কিন্তু মারুফ মন খারাপ করবে ভেবে শুধু বললেন –
‘এসবের কোনো দরকার ছিল না বাবা। আলস্নাহর ফয়সালার ওপরে কারো কোনো হাত নেই। যাও, যা বললাম করো।’
সকালেই গোসল সেরে নিলেন আবুল হাসান। ধোপদুরস্ত সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা আর সাদা গোল টুপি পরে জায়নামাজে বসে পড়লেন। সারাদিন মসজিদেও গেলেন না। ঘরেই নামাজ আদায় করলেন। নামাজের ফাঁকে ফাঁকে সিজদায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন আর জীবনের সমস্ত গুনাহর কথা মনে করে আলস্নাহর দরবারে মাফ চাইতে থাকেন। সময় গড়াতে থাকে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। দুটো খেজুর মুখে দিয়ে ইফতারি সারেন। রাত আসে। আবুল হাসান বুঝতে পারেন – দরজার ওপাশে মেরিনা, মেয়ে, কাছের কিছু মানুষ উদ্বিগণ হয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেউ কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। মারুফের কড়া নিষেধ। রাত এখন সাড়ে এগারোটা। এর মধ্যে মারুফ এসে শ্বশুরের কানে কানে বলে গেছে –
‘কোনো চিন্তা নাই আববা। র্যাব-পুলিশের বন্ধুরা টেকনিক্যালি পুরো বাড়িটা ওয়াচে রেখেছে। বাড়ির গার্ডকে ম্যানেজ করে সিসিটিভিতে সারাক্ষণ নজর রাখতে বলেছি। এমনকি বাড়ির ছাদেও আমার নিজস্ব লোকজন চারপাশে লক্ষ রাখছে। কারো বাবার ক্ষমতা নেই যে কিছু করবে।’
আবুল হাসানের তাতে কোনো ভাবান্তর হলো না। রাত বারোটার দিকে সেই যে তিনি সিজদায় মাথা রেখেছেন আর তুলছেনই না। ঘণ্টাখানেক ধরে একেবারেই চুপচাপ। কারো ডাকেই সাড়া দিচ্ছেন না। রাত তখন দুটোর কাছাকাছি। মারুফ এবার আর অপেক্ষা করে না। অনেকটা আনন্দধ্বনি দিয়েই বলতে থাকে –
‘হুর রে আববা! মাথা তুলুন। বারোটা পার হয়ে গেছে। দ্যাট হরিব্ল সিক্সটিন ইজ ওভার! নাউ নো প্রবলেম আববা!’
আবুল হাসানের নিথর শরীরটা এবার একটু নড়ে ওঠে। মাথাটা জায়নামাজ থেকে একটু উঠিয়ে কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকেন মারুফের দিকে। তারপর খুব ধীরে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন,
‘আজ কয় তারিখ বাবা?’
‘সেভেনটিন আববা! লাকি সেভেনটিন! য়ু আর নাউ ফ্রি ফ্রম ডেঞ্জার! আমি ফেসবুকে অলরেডি পোস্ট দিয়ে বন্ধুদের বলে দিয়েছি – আমাদের প্রিয় আববাজান ভয়াবহ এক বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তোমরা যে-যেখানে আছো চলে এসো আমাদের বাসায়। একসঙ্গে সেহরি খেয়ে আনন্দটাকে সেলিব্রেট করব। সবাই আসতেও শুরু করেছে।’
‘আলহামদুলিলস্নাহ। আমি আরো কিছুক্ষণ সিজদায় থাকতে চাই। সেহরি শেষ হওয়ার মিনিট পনেরো আগে ডেকো।’
‘কিন্তু আববা, একটা জরুরি কথা। চৌদ্দ-পনেরোজন ভদ্রলোক সেই রাত দশটা থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি বলেছি – আববা বারোটার আগে কারো সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। সমস্যা আছে। এখন তো তারা …’
তড়াক করে জায়নামাজ থেকে লাফিয়ে ওঠেন আবুল হাসান। যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন।
‘কী বলো, প-নে-রো জন! চলো চলো, দেখি কারা।’ – দ্রম্নত এগোতে থাকেন আবুল হাসান। তাকে অনুসরণ করে শুধু মারুফ।
ড্রইংরুমে ঢুকতেই অপেক্ষমাণ লোকজন আবুল হাসানের সম্মানে দাঁড়িয়ে যান। সালাম দেন। তাদের মধ্যে শুধু একজনকে চিনতে পারেন আবুল হাসান। নোমানুর রহমান।
‘কী ব্যাপার নোমান সাহেব, এত রাতে?’
‘কী আর বলব স্যার, অনেকদিন দেখা নেই। তাছাড়া হামিদ মিয়ার মুখে শুনলাম আপনি নাকি সবার কাছে গিয়ে গিয়ে খামগুলো ফেরত দিচ্ছেন। আমরা কী অপরাধ করলাম স্যার। একটু মনেও করলেন না। তাই …’
‘কিন্তু আমি তো ওসব শেষ করেছি নোমান সাহেব। আপনারটাই শুধু বাকি থাকতে পারে। কিন্তু ওরা …’
‘ওরাও দিয়েছিল স্যার। আপনার হয়তো মনে নেই। সেজন্য ওরা কোন খাতে কয়টা খাম সব লিখে এনেছে। দেখলেই আপনার মনে পড়ে যাবে।’
ভড়কে যান আবুল হাসান। হতেও পারে ব্যাপারটা সত্যি। সব কি আর মনে থাকে? কিন্তু হাতে তো তেমনটা আর নেইও। কী করা যায়। একটা উপায় মাথায় নিয়ে মারুফের দিকে তাকান আবুল হাসান। কিছু বলতে চাইছিল মারুফ; কিন্তু শ্বশুরের ইশারায় বেরিয়ে যেতে হলো। আবুল হাসান সবাইকে কাছে ডেকে বললেন –
‘দেখুন, ভীষণ এক ঝামেলায় ছিলাম, আসতে পারিনি। স্যরি। সেহরির সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। জামাইয়ের র্যাব-পুলিশের বন্ধুরা সেহরির দাওয়াতে আসছে। ওদেরকে সময় দিতে হবে। তাই বলে আপনাদের খালি হাতে ফেরাব না। সবাইকে দিয়ে-থুয়ে হাতে সামান্য যা আছে তা নিয়েই যদি সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে মাফ করে দেন, তাহলে চেষ্টা করতে পারি।’
সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। ফিসফাস করেন। যে কারণেই হোক দ্রম্নতই রাজি হন তারা। আবুল হাসান চটজলদি ঘরে গিয়ে পনেরোটি খাম নিয়ে ফিরে আসেন। খামগুলো নিয়েই সালাম দিতে দিতে বেরিয়ে যান তারা। আবুল হাসান ভেবেছিলেন – যাক খামের ইস্যুটা থেকে অন্তত বাঁচা গেল। কিন্তু তা আর হলো কই? ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লেন অনেক পুরনো এক আদরের অতিথি। শিক্ষিকা শিরিন বেগম।
‘আরে শিরিন! তুমি এত রাতে! কী ব্যাপার?’ – বিস্ময়ে হতবাক আবুল হাসান। অতিথির চোখে চোখ রেখে ভাবেন – আহা, এই শিরিন তার কীই-না ছিল। শুধু স্ট্যাটাস মিলল না বলে বিয়েটা হলো না। কপাল পুড়ল শিরিনেরও। বছরদেড়েকের একটা ছেলেকে নিয়ে সেই যে বিধবা হলো – আর বিয়েই করল না। তারপর এখনো কি টানটান শরীর ওর! পঁয়তাল্লিশ পার হয়েও যেন বত্রিশের গনগনে আগুন! অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই পরিস্থিতিতেও চোখ সরাতে পারেন না আবুল হাসান।
‘হ্যাঁ এলাম। আমার জন্য রাতই কী, আর দিনই কী? কারো সাহস আছে নাকি আমার সামনে আসার? শুনলাম – তুমি চুপে চুপে খাম ফেরত দিয়ে বেড়াচ্ছ সবাইকে। খুব ভালো কথা। তো আমি আর বাদ যাই ক্যানো। আমার খামটা কই?’
‘তোমার আবার খাম কিসের? ওইরকম কিছু তো নিইনি তোমার কাছ থেকে।’
‘নাওনি মানে? সবচেয়ে দামিটাই তো নিয়েছ।’
‘সেটা আবার কী?’
‘কেন, আমার এই শরীরের টসটসে খামটা? ওটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছে কে? এখন ভুলে থাকার ভান করছ, তাই না? ছিলে-ছিবড়ে খেয়ে ফেলে দিতেও তো দ্বিধা করোনি। কাওয়ার্ড কোথাকার!’
আবুল হাসান এবার মাথা নিচু করেন। শিরিন বেগম আবারো ঝলসে ওঠেন –
‘শোনো আবুল হাসান, তবু তোমার মতো এক অথর্বের কাছে এসব বলতে আমি আসতাম না। বাট যখন শুনলাম তুমি জান্নাতের পথ ক্লিয়ার করতে দু-হাতে খাম ফেরত দিতে শুরু করেছ তখন আর থাকতে পারলাম না। আমাকে জাহান্নামের আগুনে রেখে তুমি যাবে জান্নাতি বালাখানায়? এত্ত সোজা? নো, সবাইকে যখন ফেরত দিচ্ছ আমারগুলোও দিতে হবে। যা যা নিয়েছ সবটা চাই। সব। আমার খামটাই হবে সবার চেয়ে ভারী আর হেলদি। বুঝেছ সোনার চান?’ – আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে যেন শিরিনের মুখ থেকে। রাগে কাঁপতে থাকে সে।
‘ওগুলো তো যা হওয়ার হয়ে গেছে শিরিন। ফেরত দেবো কীভাবে। পিস্নজ শিরিন, ওসব নিয়ে সিনক্রিয়েট করো না। ঘরভর্তি মেহমান। আমাকে মাফ করে দাও পিস্নজ। পিস্নজ শিরিন।’ জোড়া হাত সামনে বাড়ান আবুল হাসান।
‘কিসের মাফ? কোনো মাফ নেই। আমাকে শেষ করে দিয়েছ তুমি। এখন কড়ায়-গ-ায় ফেরত চাই। কীভাবে দেবে আমি জানি না। বাট না নিয়ে আমি যাচ্ছিও না। এই আমি বসলাম।’ – ধপ করে সামনের সোফায় বসে পড়েন শিরিন।
‘তা-ই!!’
হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাতেই স্ট্যাচু হয়ে যান আবুল হাসান। মেরিনা বেগমের হিংস্র চোখ একবার আবুল হাসানের দিকে, আরেকবার শিরিনের দিকে ছোটাছুটি করছে। ঘাড়টা আর ঘোরাতে পারেন না আবুল হাসান। শক্ত হয়ে যাচ্ছে ঘাড়ের রগগুলো। কে যেন হাঁ করে গিলে খাচ্ছে সমস্ত আলো। মুঠোটাও আলগা হয়ে যাচ্ছে। হাতের সাদা তসবিহটা হঠাৎ পড়ে যায় মেঝেতে। পাড়ভাঙা নদীর এক চাপ মাটির মতো। ঝুপ করে।