আঁতুড়ঘরে ঠাঁই হওয়ার পর থেকেই স্বপ্নটি বন্যার ওপর জেঁকে বসেছে। কেবল রাতের ঘুমের মধ্যেই যে স্বপ্নটি সে দেখে তা নয়, দিনের বেলায়ও, একটু তন্দ্রার মতো এলেও, একই স্বপ্ন দেখে বন্যা দাই। চোখে ঘুম কি তন্দ্রা ভর করলেই মানুষ স্বপ্ন দেখে কিনা, তাও আবার প্রতিদিনই একই স্বপ্ন; বন্যার তা জানা নেই। দিন সাতেক হলো বন্যা দাই আঁতুড়ঘরে উঠেছে; এর মধ্যে রাতে কি দিনে কতবার যে সে স্বপ্নটি দেখেছে, দড়িতে গেরো দিয়ে হিসাব রাখলে তা হয়তো একশ ছাড়িয়ে যেত। বন্যা দাই সে-হিসাব রাখেনি। তবে চোখ বুজলেই একই স্বপ্ন ভর করে চোখে, আর একই স্বপ্ন দেখতে দেখতে বন্যা ভয়ে এবং দুশ্চিন্তায় ফাঁদে আটকা-পড়া ইঁদুরের মতো মুষড়ে পড়েছে …।
প্রথম দুদিন, রাতে কি দিনে একই স্বপ্ন দেখার পরও বন্যা দাই স্বপ্নের এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। স্বপ্নের আয়ুষ্কালও ছিল খুব কম। জন্ম নিতে নিতেই মৃত্যু! ঘুম বা তন্দ্রা কেটে যাওয়ার পর বুঝতে পারত তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে; কিন্তু স্বপ্নে সে কী দেখল তা আর ঠিকঠাক মনে করতে পারত না। আবছা আবছা মনে পড়ত – তাদের বাড়ির মাদি বিড়ালটা বাচ্চা দিয়েছে, বাচ্চাটাও মাদি, দেখতে খুব সুন্দর, শরীরে হলুদ-সাদা ডোরাকাটা সাজ; কিন্তু বিড়ালছানাটির কপালের মাঝ-বরাবর একটা বড়োসড়ো গর্তের মতো, যেন গুলির চিহ্ন …।
তৃতীয় দিন থেকেই স্বপ্নের আয়ুষ্কাল অল্প অল্প করে বাড়ছে। জন্ম নিতে-নিতেই সে আর মারা যায় না। বন্যা যেন সারারাত একই স্বপ্ন দেখে। ঘুম ভাঙার পর স্বপ্নটিকে আবছা আবছাও মনে হয় না। মনে হয় ঘুমের মধ্যে যা সে দেখেছে তা স্বপ্ন নয়, জীবন্ত ঘটনা; তার চোখের সামনে, টলটলে জলভরা পুকুরের মাঝখানে একগুচ্ছ কচুরিপানা যেভাবে ভাসে, স্বপ্নটি সেভাবেই যেন ভাসে …।
সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পর বন্যা টের পেল – ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। শীতের রাত, তারপরও ঘামজলে চপচপ করছে শরীরের কাপড়। তাদের বাড়িতে কোনো মাদি-বিড়াল নেই, তবু কেন সে এরকম স্বপ্ন দেখছে! সে নিজে পোয়াতি। সন্তান প্রসবের সময় হয়ে এসেছে। ব্যথা উঠতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। এই সময়ে এ-ধরনের স্বপ্ন দেখা কোনো বিপদ সংকেত কিনা, কে জানে! বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকে বন্যা দাই। মাকে স্বপ্নবৃত্তান্ত জানানো দরকার। স্বামীকেও ফোন করে জানাতে হবে …।
বাড়ির দক্ষিণ-দুয়ারি দোচালা ঘরটি বন্যার মা-বাবার। ঝুপড়ির মতো রান্নাঘরটি ছাড়া বাড়তি ঘর নেই বাড়িতে। এই ঘর ঘেঁষেই কামরাঙাগাছের নিচে মেয়ের জন্য ছনে-ছাওয়া আঁতুড়ঘর তুলেছে বন্যার মা ঝর্ণা দাই। বন্যার বাবা পঙ্গু। শয্যাশায়ী। তার কোনো ভাই নেই। বড় দুই বোন স্বামীর বাড়ি। বন্যার মাকেই সবকিছু সামাল দিতে হয়। এতদিন বন্যা মা-বাবার ঘরেই থেকেছে। বন্যার মা খেজুরপাতার পাটি বানিয়ে দিয়েছিল। বন্যারা খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হলেও কিছু কিছু হিন্দুরীতি এখনো মেনে চলে। তাতেই আঁতুড়ঘরের ব্যবস্থা …।
বন্যা প্রথমবার পোয়াতি হয়েছে। প্রথম সন্তান প্রসবের সময়, পোয়াতি হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান – যা-ই হোক না কেন, তারা মায়ের কাছে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সন্তানের জন্ম দেওয়া – এ তো এক নতুন অভিজ্ঞতা। নিদারুণ যন্ত্রণাও ভোগ করতে হয়। প্রসবব্যথা যে কতটা ভয়াবহ, তা তো শুধু ওই নারীই জানে, যে কিনা সন্তান জন্ম দিয়েছে। প্রসবের সময় হয়ে এলে, গর্ভস্থ সন্তান যখন পৃথিবী দেখার জন্য পোয়াতির গর্ভের ভেতর গুঁতোগুঁতি শুরু করে, তখনই পোয়াতির মনে মৃত্যুভয় জেঁকে বসে। ভীতবিহবল পোয়াতি তখন মায়ের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চায়। বন্যাও তিনমাস আগে থেকেই পীড়াপীড়ি শুরু করেছিল – মায়ের কাছে যাবে। বন্যার স্বামী বকুল দাই, তার শ্বশুর-শাশুড়ি শুরুতে রাজি ছিল না, এত আগেই বউ কেন বাবার বাড়ি যাবে? তারা নিজেরা গরিব, পোয়াতি বউয়ের তেমন যত্নআত্তি করতে পারে না, কিন্তু বন্যার মা-বাবা যে আরো গরিব। কোনো বিপদ-আপদ হলে, আর পোয়াতি বউদের তো বিপদ লেগেই থাকে; তখন কি দিয়ে কি করবে তারা! বন্যার বাবা পঙ্গু মানুষ, বিপদ হলে ছোটাছুটিই বা করবে কে? কিন্তু বন্যার চোখের জলের কাছে বাড়ির সবাইকে হার মানতে হয়। মায়ের কাছে যাওয়ার অনুমতি মেলে বন্যার। ধীরগঞ্জ থেকে সে ধনুচেংঠি চলে আসে …।
পৌষের রাত। বৃষ্টির মতো শিশির পড়ে আঁতুড়ঘরের চালে। কিন্তু ছনে-ছাওয়া চাল তো, নিঃশব্দ পতন। ঘরের চালে কিংবা বাইরে কোনো শব্দ নেই। বন্যা অনুমান করতে পারে না, রাত কত? তার স্বপ্নের ঘোর তখনো কাটেনি। চোখের সামনে ভাসছে সদ্য ভূমিষ্ঠ মাদি-বিড়ালের ছানা। ছানার কপালে জ্বলজ্বল করছে একটা গর্ত, যেন কপালে গুলি লেগেছিল; পেছনে গর্ত রেখে বুলেট বেরিয়ে গেছে …!
আঁতুড়ঘরের দরজা খোলে বন্যা। মাকে ডাক দেবে। স্বপ্নবৃত্তান্ত তাকে না-জানানো পর্যন্ত স্বস্তি নেই। স্বপ্নটা ক্রমশ তার গলা টিপে ধরছে। এই আপদ ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে না-পারলে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। সন্তানের মুখ আর দেখা হবে না …।
কিন্তু মাকে ডাকতে হয় না বন্যার। উঠোনে পা রাখতেই বন্যা দেখে কুপি-হাতে ঘর থেকে বেরোচ্ছে মা …।
কী রে মা, ঘুমাসনি! বাইরে যাবি …?
না, মা …।
তবে এই শীতের মধ্যে ঘরের বাইরে কেন মা …?
ঘরে চলো, বলি …।
মা-মেয়ে আঁতুড়ঘরের বিছানায় বসল। বন্যা বলল – ‘মা, আমি না ঘুম বা তন্দ্রার মতো এলেই একটা স্বপ্ন দেখি। সবসময়ই একই স্বপ্ন …।’
বলিস কী …!
হ্যাঁ মা। একটা মাদি-বিড়াল ছানা দিয়েছে। ছানার কপালে গর্ত। দেখতে যেন ঠিক গুলির চিহ্ন …।
ঝর্ণা দাই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের কপোলে-কপালে চুমু খেল। তারপর বলল, ‘ভয় পাসনে মা। বাচ্চা পেটে এলে সবারই এরকম হয়। পোয়াতিরা নানা ধরনের স্বপ্ন দেখে। যিশুর নাম করে ঘুমিয়ে পড়। আমি যাই …।’
ঘরের দরজা টেনে দিয়ে ঝর্ণা দাই বেরিয়ে গেল। সে মেয়েকে বলল না, ঘুম বা তন্দ্রা এলেই সেও এ-স্বপ্নটাই দেখে …।
দুই
বকুল দাইরা ধীরগঞ্জ ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু সে চামড়ার কাজ করে না। চামড়ার গন্ধ বকুলের নাকে এলেই বমি আসে। এ নিয়ে বাবা রতন দাইয়ের কম বকাঝকা তাকে খেতে হয়নি। চামড়া ছেনেঘেঁটেই ঋষি পরিবারের ছেলেরা বড় হয়, আর দেখো, নবাবপুত্তুর বকুল, সে কিনা চামড়ার গন্ধই সহ্য করতে পারে না। কী করে খাবে নবাবের ব্যাটা …?
চামড়ার কাজ শেখেনি বকুল, শিখেছে ক্ষৌরকর্ম। কাজটা সে ভালোই পারে। ধীরগঞ্জ বাজারে শ্রীদাম শীলের সেলুনে বছর-পাঁচেক নবিশি করেছে সে। শ্রীদাম যত্ন নিয়েই তাকে কাজ শিখিয়েছে। বাজারের বটতলায় বকুলের দোকান। তার খুব ইচ্ছা ছিল, বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে বাজারের কারো ঘর ভাড়া করে শ্রীদাম শীলের সেলুনের মতো কাচঘেরা সেলুন দেবে। সেলুনে গদিওয়ালা চেয়ার থাকবে। দেয়ালে ঝোলাবে দামি কাচের বড়োসড়ো আয়না। তাতে খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকবে সেলুনে। কিন্তু সেসব স্বপ্ন বকুলের অধরাই থেকে গেছে। অনেকদিন ধরে রতনের চামড়ার ব্যবসায় খুব মন্দা যাচ্ছে। সে ছেলেকে টাকার জোগান দিতে পারেনি, বকুলও সেলুন দিতে পারেনি বাজারে। অগত্যা নিজের কাছে কিছু টাকা ছিল তা দিয়েই দু-ফালি টিন কিনে বটতলায় ছাপরার মতো তুলেছে বকুল। কাজ সে ভালো জানে। চুল কাটুক কি দাড়িমোচ, কাটে খুব যত্নসহকারে। বকুলের সেভও খুব আরামদায়ক; কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। সেলুনের আরাম রেখে কে তার ছাপরায় আসে? ছাপরাঘরে যা গরম …!
বকুলের খদ্দের কম, ফলে আয়রোজগারও কম। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। কিন্তু এখন যে তার বেশকিছু টাকার প্রয়োজন। বউয়ের বাচ্চা হবে। প্রথম বাচ্চা। হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিতে হলে টাকা লাগবে অনেক। পাঁচ হাজারও লাগতে পারে। এত টাকা পাবে কোথায় …?
দুপুর সেই কখন গড়িয়ে গেছে। শীতের দিনের দুপুর গড়িয়ে নামলে দিন ফুরাতে আর খুব একটা সময় লাগে না। ধীরগঞ্জের দিনও সেদিন আর কিছুক্ষণ পরই অস্তাচলমুখী হবে, সব আয়োজন প্রায় সমাপ্ত। সীমান্তের ওপারে গেছিল যেসব পাখি। ওপারে পাখিদের খাবারের প্রচুর সমারোহ। প্রতিদিনই সকালে ঘুম থেকে উঠে হরিপুর, ধীরগঞ্জ, বুজরগঞ্জ, নদীগাঁও, ঠাকুরগাঁও, মানপাড়ার অনেক পাখি ওপারে খাবার খেতে চলে যায়। ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরতে শুরু করেছে। বকুল দাই তখন দোকানের বেঞ্চে বসে ঝিমুচ্ছিল। সেদিন খদ্দের পেয়েছে কম। এমনিতেই তার দোকানে খদ্দের খুব একটা আসে না। বাজারে নতুন নতুন সেলুন খুলছে অনেকে। শ্রীদাম শীলের সেলুনের চেয়েও আরামদায়ক সেলুন। ওসব সেলুনে চেয়ারে বসামাত্র ঘুমঘুম ভাব আসে শরীর-মনে। শ্রীদাম শীলই যেখানে খাবিখাচ্ছে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, তো তার ছাপরায় আসবে কে? বকুল দাই সেদিন দুপুরের খাবারও খায়নি। তখন পর্যন্ত কামাই হয়েছে মাত্র ৩৫ টাকা, এর থেকে গোপালের দোকানে সবজি-রুটি খেয়ে ১০ টাকা খরচ করা। যখন তার যে-কোনো সময় পাঁচ হাজার টাকার দরকার; কিন্তু হাতপাত একদম খালি, তখন সবজি-রুটি খেয়ে ১০ টাকা খরচ করবে, সাহসে কুলায়নি বকুলের। ক্ষুধা-পেটে বিড়ি টানছিল বকুল। বিড়ি টানতে টানতেই ঝিমুনি এসে গেছে তার …।
বকুলের খদ্দের যৎসামান্য, তা ঠিক, তবে তার বাঁধা কিছু খদ্দের আছে। এই বাঁধা খদ্দেরদের অধিকাংশই বুড়ো শ্রেণির। আবার কেউ কেউ আছে, যারা ধীরগঞ্জ কি বুজরগঞ্জের প্রভাবশালী মানুষ। এসব খদ্দের কেন শ্রীদাম শীলের কি বাজারের অন্য কারো শীতল সেলুনে না-ঢুকে বকুলের ছাপরাঘরে আসে, একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ তা জানে না …।
আজিমুল্লাহ তাদের একজন …।
ধীরগঞ্জ কি বুজরগঞ্জ, নদীগাঁও কি ঠাকুরগাঁও – সীমান্তবর্তী প্রায় সব এলাকায়ই আজিমুল্লাহ সুপরিচিত। তিন মেয়াদে ১৬ বছর ইউপি সদস্য ছিল। এই কারণে সে সুপরিচিত, এটা একটা দিক; তার চেয়ে বড়, ঘরে তার তিনটি বউ, এটাই তার পরিচিতি বাড়িয়েছে। ঘটনা আরো আছে। যখন ইউপি সদস্য ছিল তখনো যেমন, এখনো সে রাতে গরুর কারবার করে। বিজিবি কি বিএসএফ, দুই দেশের দুই বাহিনীর কমান্ডারদের সঙ্গেই দহরম-মহরম ভাব তার। লোকে তাকে চিনবে না কেন? চেনে তো বটেই, সীমান্তের লোকজন সবাই তাকে সমীহও করে …।
বকুল ঘুমাইছিস নাকি …?
ও কাকা! না, ঘুমাই নাই …।
মনটা যে খুব ভারভার লাগছে। বউয়ের খবর কী …?
আজিমুল্লাহ রাতে গরুর কারবার করে, তা ঠিক;
ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়ের বহু মানুষ এই কারবারের সঙ্গে জড়িত; তবে আজিমুল্লাহ সজ্জন মানুষ। এলাকার মানুষের খোঁজখবর রাখে। বকুলের বউ পোয়াতি, মায়ের কাছে গেছে, আজিমুল্লাহ তা জানে …।
বউ ক্লিনিকে, কাকা …।
ক্লিনিকে কেন …?
বাড়িতে হবে না। কী যেন সমস্যা। দুপুরে বউ ফোন করেছিল। ব্যথার চোটে ভালো করে কথাই বলতে পারল না …।
তুই যাবি না …?
বলেছি, যাব কাল সকালে। কিন্তু কাকা, মেলা টাকার দরকার। পাঁচ হাজারও লাগতে পারে। হাত একদম খালি। কী নিয়া যাব, কাকা …?
বকুল …?
জি, কাকা …।
তোকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম – তোরা সবাই ধর্মত্যাগ করলি কেন – মনে আছে …?
জি, কাকা। মনে আছে …।
তুই কী উত্তর দিয়েছিলি, তাও মনে আছে …?
মনে আছে, কাকা। বলেছিলাম – আগে পেটরক্ষা, তারপর ধর্মরক্ষা …।
পেট কি রক্ষা করতে পারছিস …?
বকুলের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সে বিড়ি ধরিয়ে টানতে শুরু করল …।
আজিমুল্লাহ বলল, ‘তোকে কত করে বললাম – নূরু যায়, আজাদ যায়, সামাদ যায়; কিন্তু তুই কোনোদিন গরু আনতে গেলি না। তোর ধর্ম যাবে। যিশু তোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এখন দ্যাখ, বউ-বাচ্চা বাঁচাতে টাকার দরকার পড়ে …!’
তিন
পথে নামল আজিমুল্লাহ। ‘যাই রে বকুল …।’
সেভ …?
আজ থাক, তোর মন খারাপ। ক্ষুর গলায় চালিয়ে দিতে পারিস …।
এপারে আজিমুল্লাহ, বরকতুল্লাহ, বাহার, কাদের; ওপারে শ্যামল, কমল, নিখিল – কারবারির অভাব নাই। প্রতি রাতেই গরু আসে। হাতির মতো বিশালাকৃতির ষাঁড়, বলদ। আসে লাল গরু। কালো গরু। ডোরাকাটা গরু। শিংচোখা গরু। শিংবোচা গরু। হরিয়ানা থেকেই বেশি আসে। মূলত মাংসের জোগানদার এসব গরু। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া আছে। বিজিবি-বিএসএফ সদস্যদের টহল আছে। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া কিংবা সীমান্তরক্ষীদের টহল কখনো গরু-পারাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারবারিরা বাধা ডিঙানোর পথ জানে। সব পথই তাদের মুখস্থ …!
গরু আসে। শ্যামল-কমল কিংবা নিখিলের গরু আসে। ওরা নিজেরা কিংবা ওদের লোকজন কিন্তু গরুর সঙ্গে সীমান্ত পর্যন্ত আসে না। ওদের লোক গরু নিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত এলে যে-টাকা তাদের দিতে হয়, তার সিকি টাকায় ধীরগঞ্জ-বুজরগঞ্জ-নদীগাঁওয়ের লোক মেলে। ফলে হয় কী, শ্যামল-কমলরা শর্ত জুড়ে দেয় – গরু নিতে চাইলে লোক পাঠাতে হবে। আমাদের লোক সীমান্ত পর্যন্ত যাবে না। তখন শর্তানুযায়ী আজিমুল্লাহ-বরকতুল্লাহর লোকজন সীমান্তের ভেতরে একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত ঢোকে। শ্যামল-কমলরা আগে থেকেই সেখানে গরুর চালান নিয়ে অপেক্ষা করে। রাত থাকতে থাকতেই ধীরগঞ্জ কি বুজরগঞ্জ থেকে যারা যায়, তারা গরু নিয়ে চলে আসে। তারা যখন সীমান্ত অতিক্রম করে, তখন কোথাও কাঁটাতারের বেড়া কিংবা সীমান্তরক্ষীদের টহল তাদের চোখে পড়ে না। অবাক কা- …!
তবে গোলমাল কিন্তু মাঝেমধ্যেই ঘটে। যারা গরু আনতে যায় তারাও জানে, গোলমাল ঘটতে পারে। গোলমালের মধ্যে তারাও পড়তে পারে। তারপরও তারা যায়। না গিয়ে তো উপায় নেই। নূরু-আজাদ-সামাদ দিনমজুরি করে, দিনে খুব জোর ১৩০ টাকা রোজগার; এ দিয়ে সংসার চলে না। ধীরগঞ্জ, বুজরগঞ্জ, নদীগাঁও – সীমান্তবর্তী সব গ্রামেই এরকম দিনমজুর আছে, গোলমালের মধ্যে পড়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও তারা কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে গরু আনতে ভেতরে ঢোকে। তবে ভাগ্যের ফেরে এই গোলমালের মধ্যে যারা পড়ে, তারা কিন্তু আর ফিরে আসতে পারে না। বিএসএফের গুলি খেয়ে বেঘোরে মরে। কারো কারো লাশটাও তো মেলে না। কেউ কেউ হয়তো জান নিয়ে কোনোমতে ফিরে আসে; কিন্তু হাতে কি পায়ে কিংবা শরীরের অন্য কোথাও, যতদিন তারা বেঁচে থাকে, গুলির ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় …।
এই যে গরুর চালান নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমকালে কাঁটাতারের বেড়া কিংবা সীমান্তরক্ষীদের টহল কিছুই কারো চোখে পড়ে না, ভোঁজবাজির মতো একটা ব্যাপার তখন ঘটে; তাহলে হঠাৎ হঠাৎ এই গোলমাল বাধে কেন? এই গোলমাল বাধার পেছনেও আখ্যান আছে। যদি শুনতে চান কেউ, বলি, শুনুন …।
শ্যামল-কমল বা নিখিলরা বিএসএফ ক্যাম্পে যোগাযোগ রাখে, ক্যাম্পে বসে কমান্ডারের সঙ্গে খানাপিনা করে, জওয়ানদের সঙ্গে খুনসুটি করে। তাতেই তো পরিষ্কার থাকে পথঘাট, কাঁটাতারের বেড়া অদৃশ্য হয়। জওয়ানরা টহলে বেরিয়ে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম পাড়ে; আজিমুল্লাহ-বরকতুল্লাহর লোকেরা গরু নিয়ে নিরাপদে চলে আসে। তারা জানে, বিজিবি তাদের কিছু বলবে না। কারণ তারা মনে করে – দেশে গরু আসছে, এটা দেশের জন্য ভালো। সস্তায় মাংস পাওয়া যাবে, গরু আসুক। তাহলে, প্রশ্ন কিন্তু ওঠে, গোলমাল কেন? বিএসএফ জওয়ানরা গুলি ছোড়ে কেন? গুলি ছোড়ে রাগে, ক্রোধে। রাগে-ক্রোধে উন্মত্ত হওয়ারও কারণ আছে। ওপারের কারবারিরা মাঝেমধ্যে তাদের ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। ক্যাম্পে হয়তো কথা হয়েছে, মাসে চার চালান গরু যাবে, কথাবার্তা সেইমতোই পাকা। কিন্তু কোনো মাসে হয়তো কারবারিরা ক্যাম্পে যোগাযোগ না-করেই পঞ্চম চালান পাঠানোর চেষ্টা করে। এই খবর ক্যাম্প কমান্ডারের কানে এলেই তিনি নির্দেশ দেন – একটা গরুও যাবে না। গুলি কোথায় লাগল দেখার দরকার নেই …।
বকুল এটা জানে – গুলির ঘটনা যেদিন ঘটে। ওরা ফাঁকা গুলি ছোড়ে না, গুলি যে-কারো হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে, পেটে-কপালে লাগতেই পারে। এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে ওরা। কপালের জোর না থাকলে জীবিত ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। তাই তো বকুল কোনোদিন গরু আনতে যায় না। পাপ ও যিশুর দোহাই দেয় বটে, আসলে ভয়েই সে এ-পথে পা বাড়ায় না। না হলে টাকা তো কম না! একরাতেই পাঁচশো …।
সেদিন বকুল মনে মনে তৈরি হয়েছিল, আজিমুল্লাহ যদি বলে, বকুল, গরুর চালান আসবে আজ, তোর তো টাকার খুব দরকার, নূরুদের সঙ্গে যা; তবে সে যিশুর নাম করে রাজি হয়ে যাবে। আগে পেটরক্ষা, পরে ধর্মরক্ষা …।
কিন্তু আজিমুল্লাহ সেদিন এসবের কিছুই না বলে পথে নামে, বকুলকে ভৎর্সনা করে; ক্ষুর গলায় লাগিয়ে দিতে পারিস …।
সীমান্তে তখন সন্ধ্যা নামছে, লালচে সন্ধ্যা। তখন নূরু এলো বকুলের দোকানে। বকুল আজিমুল্লাহর সেভ করছিল। লোকটা কোথায় কোথায় যেন ঘুরে আবার বকুলের দোকানে এসেছে। সেভ হচ্ছে। নূরু বেঞ্চে বসল। সেভ হতে-হতেই আজিমুল্লাহ বলল – নূরু যে …।
চুল কাটাব চাচা, তাই এলাম …।
ভালো। বোস …।
সেভ হয়ে গেলে আজিমুল্লাহ পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে বকুলের দিকে বাড়িয়ে দিলো – নে …।
পাঁচশো টাকার নোট! ভাংতি নাই কাকা …।
ফেরত দিতে হবে না। পুরাটাই রাখ। তোর বউ না ক্লিনিকে …।
কাকা …!
রেখে দে। আমি যাই। যাই রে নূরু …।
টাকা হাতে গণেশের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল বকুল। নূরু বলল – তোকে একটা কথা বলি বকুল। এর আগেও বলেছি, কান দিসনি …।
বকুলের মুখে কোনো রা নেই। নূরু বলল – তোর বউ ক্লিনিকে। কত টাকা লাগে, কে জানে! আজিমুল্লাহ কাকার গরুর চালান আসবে আজ রাতে। যাবি …?
চোখে জল এসে গেছে বকুলের। হয়তো এখনই ওর কপোল বেয়ে গড়িয়ে নামবে। বকুল বলল – যাব নূরুভাই, যাব …।
যাবি? সত্যিই যাবি …?
যাব। আগে বউ-বাচ্চা রক্ষা …।
চার
নূরুরা রাত দুটোর দিকে ৩৬৫/১ এস পিলারের কাছে জড়ো হয়। নূরু ও বকুল ধীরগঞ্জের বাসিন্দা। এ দুজন ছাড়াও বুজরগঞ্জের আজাদ, সামাদ, রাজু; নদীগাঁওয়ের পিন্টু ও কালাম দলে আছে। নূরুই দলনেতা। পৌষের শীত। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে, নো ম্যান্স ল্যান্ডে শীত যেন আরো বেশি। ওপার থেকে কনকনে হাওয়া এসে নূরুদের জাপটে ধরছে। ওদের কারো গায়েই তেমন গরম কাপড় নেই। শীতে দাঁতকপাটি লাগার মতো পরিস্থিতি। কিন্তু পথে যখন বেরিয়েছে, কিছুই আর করার নাই। এখান থেকে সীমান্তের ভেতরে, বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটা পথ, ওই পথেই ঢুকতে হবে। সবাই বিড়ি ধরিয়ে গা গরম রাখার চেষ্টা করছে। জোনাকির আলোর মতো টিপটিপ করে বিড়ির আগুন জ্বলছে সবার মুখে। ৩৬৫/১ এস পিলার ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার মুখেই বিড়ির আগুন, কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। কথা বলা নিষেধ, নূরুই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বিড়ির আগুন যে জোনাকির
আলোর মতো জ্বলছে-নিভছে। যদি বিএসএফ বা বিজিবি জওয়ানরা দেখে, এটাকে জোনাকির আলোই ভাববে; কিন্তু কথার আওয়াজ কানে গেলেই তারা সন্দেহ করবে, এই শব্দ নিশ্চয়ই গরু পাচারকারীদের। এই রীতিনীতি নূরুর ভালো করেই জানা, তাই সে তার সঙ্গীদের কথাবার্তা বলা নিষিদ্ধ করেছে। সে একটা সংকেতের অপেক্ষা করছে। শ্যামল বণিকের লোকজন ওপার থেকে সংকেত পাঠাবে, পথ শত্রম্নমুক্ত, কোথাও কোনো সমস্যা নেই, ভেতরে ঢুকে পড়ো। সংকেতটি রাজঘুঘুর ডাকের মতো, বহুদূর থেকে এই ডাক ভেসে আসে। রাতের বেলা তো, ডাকটি স্পষ্ট শোনা যায়; ঘঘুর ঘুঘ, ঘু … ঘ। ডাকটি আসলে রাজঘুঘুর নাকি শ্যামল বণিকের নিজের, নাকি তার বাঁধা কোনো লোকের, নূরুর তা জানা নেই। কিন্তু সে জানে, ঘুঘুর এই ডাক শুরু হলেই ভেতরে ঢুকতে হবে …।
নূরু বকুলের নিজের গাঁয়ের লোক, আজাদ-সামাদ-রাজু প্রতিবেশী গাঁ বুজরগঞ্জের; নূরু তো বড়ভাইয়ের মতো, বুজরগঞ্জের ওরাও পরিচিত; নদীগাঁওয়ের লোকদুটোই বকুলের অপরিচিত। ওরাও যে আজিমুল্লাহ-বরকতুল্লাহ – কারো না কারো গরু আনতে ওপারে যায়, ওদের বিড়িটানা দেখেই বুঝে ফেলেছে বকুল। কী রকম গলগল করে ওরা বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে! অথচ দেখো, বেজায় জোরেশোরে বিড়ি টানছে বকুল, কিন্তু বিড়ির ধোঁয়াই বেরোচ্ছে না; নাকেমুখে বিড়ির ধোঁয়া ঢুকলে শীতের ত্যাঁদড়ামি কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যেত। নূরু নদীগাঁওয়ের লোকদুটিকে বকুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, বলে – বকুল, তুই তো আজ প্রথম এসেছিস, সবাইকে চিনবি না, দু-চারবার এলেই সবাই পরিচিত হয়ে যাবে …।
নূরুভাই …।
কী রে বকুল, তুই কাঁপছিস কেন? শীতে, না ভয়ে …?
ভয় করছে নূরুভাই …।
কী যে বলিস না তুই, বকুল! ভয়ের কী আছে? তুই আজই প্রথম এসেছিস, ঠিক আছে; আমি তো আছি। আমি সব চিনি। এই যে, এখন যে-পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছি, শ্যামলদার সংকেত আসবে। সংকেত এলেই যে-পথে ভেতরে যাব, সে-পথ দিয়ে গরুর চালান নিয়ে ফিরে আসব। দেশের ভেতরে ঢুকব, আজিমুল্লাহ চাচাকে চালান বুঝিয়ে দেবো, সব আমার মুখস্থ …!
কিন্তু …।
কিন্তু আবার কী …?
সব ঠিকঠাক আছে তো …?
কী রকম …?
আমি গরু আনতে যাই না, কোনোদিন যাইনি, সব ঠিক আছে। কিন্তু তোমরা যে গরু আনো, কীভাবে আনো, কিছু কিছু তো আমাদের কানেও আসে …।
কী জানিস তুই, বকুল …?
না, তেমন কিছু না। শুধু জানতে চাইছিলাম, গরু আনতে হলে তো পথ ঠিকঠাক থাকতে হয়, বিএসএফ ক্যাম্পের জানা থাকতে হয় যে গরু ওপার যাবে, এজন্য ওপারের কারবারিরাই ক্যাম্পে যা যা করার দরকার সব করে। আজ করেছে তো? ওরা যদি সব মিটমাট না করেই গরুর চালান পাঠাতে চায়, শুনে আসছি তো এতদিন ধরে, তখনই গোলমাল ঘটে, বিএসএফ জওয়ানরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে …।
শ্যামলদা বলেছে, আজিমুল্লাহ কাকাও বলেছে, কোনো চিন্তা নেই, সব ঠিকঠাক আছে …।
এটা কয় নম্বর চালান, নূরুভাই …?
পাঁচ নম্বর …।
পাঁচ নম্বর! বলো কী? চারের ওপরে কি অনুমতি মেলে …?
মাঝেমধ্যে মেলে …।
তারপরও আমার ভয় করছে, নূরুভাই। মাঝেমধ্যেই তো বিএসএফের গুলিতে লোকজন মরছে। এই তো সেদিনও …।
সব আমাদের আল্লাহ আর তোর যিশু জানে, বকুল। এসেই যখন পড়েছিস, কথা আর বাড়াসনে। তুই তো জানিস, আমরা কীভাবে চলি, কীভাবে বেঁচে আছি; বাড়িতে কারো পেটে ভাত নাই, আমি কোনোভাবেই ভাতের জোগাড় করতে পারছি না। তোর বউ ক্লিনিকে, বাচ্চা হবে। অনেক টাকার দরকার, তোর কাছে টাকা নেই। আমার বউ আবার পোয়াতি, ঠিকমতো খাবার দিতে পারি না। তুই এবারই প্রথম বাচ্চার বাবা হবি, আমার আরো দুটো বাচ্চা আছে। ওদের কী কষ্টে যে বড় করছি বকুল, তোকে বলে বোঝাতে পারব না। তাহলে, তুই-ই বল, গরু আনতে ওপার গেলে আমাদের কেন পাপ হবে? যিশু কি আল্লাহ, কারো কি কোনো বিচার নেই? ওরা তো জানে, কেন আমাদের গরু আনতে যেতে হয়? কেন আমার বাবা বিএসএফের গুলি খেয়ে মরে …?
নূরু হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে-কাঁদতেই জড়িয়ে ধরল বকুলকে …।
দলনেতা এভাবে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করবে, তাও আবার নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ৩৬৫/১ এস পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে। ওপার থেকে গরুর চালান আনতে যাওয়ার সময় দলের কেউ কিছুই বুঝে উঠতে না-পেরে, কুয়াশাভেজা ঝাপসা চাঁদের আলোর নিচে, বকুল ছাড়া অন্য আর সবাই একজন আরেকজনের চোখ-মুখ খুঁজতে লাগল। তারা দেখতে চাইল নূরু সর্দার একাই কাঁদছে, নাকি তারা সবাই কাঁদছে …।
নূরু দেখল, সবাই কাঁদছে …।
বকুল দেখল, সবাই কাঁদছে …।
বুজরগঞ্জের আজাদ-সামাদ-রাজুর চোখে জল …।
নদীগাঁওয়ের পিন্টু-কালামের চোখেও জল …।
তখনই ওপার থেকে রাজঘুঘুর ডাক ভেসে আসে; ঘুঘুর ঘুঘ, ঘুঘুর ঘুঘ, ঘু … ঘ …।
পাঁচ
নূরুরা যে-পথে ওপার গেছিল, শ্যামল বণিকের কথামতো গরুর চালান নিয়ে ওই পথেই ফিরে আসছিল। শ্যামল কারবারি বলেছে পথ একদম পরিষ্কার। একেবারে কোজাগরীর আলো পড়লে পথ যেরকম ঝকমক করে, পথটি সেরকমই ঝকমক করছে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বিএসএফ ক্যাম্পেও যথাযথভাবেই যোগাযোগ করা হয়েছে। কোথাও কোনো খুঁত নেই। পদ্মার ইলিশ, রামের বোতল, সঙ্গে আর যা যা লাগে, ক্যাম্পে সবই দেওয়া হয়েছে। তোমরা নিশ্চিন্তে যাও …।
তখনো ভোরের আজান হয়নি। একটু পরেই হয়তো হবে। ওরা কেবলই ৩৬৫/১ এস পিলারের কাছাকাছি এসেছে, নূরু গরুর পালের সামনে, বকুলও সঙ্গে রয়েছে। বাকিরা পালের পেছনে; তখনই বিএসএফ জওয়ানরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। শ্যামল বণিক বলেছিল – পথঘাট কোজাগরী পূর্ণিমার আলোর মতো ঝকঝকে, আসলে পথে কোনো আলো ছিল না। পথ ডুবে ছিল আলকাতরার মতো কালো অন্ধকারে। গুলির শব্দ শুনেই নূরু বসে পড়ে। বকুলকেও বসিয়ে দেয়। বাকিরাও বসে পড়েছে। তারা সবাই জানে, গুলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। দাঁড়িয়ে থাকলে গুলি লাগবে। নূরু মনে মনে বলে – শ্যামল শালা মিথ্যা কথা বলেছে। প্রতারণা করেছে। আসলে সে পঞ্চম চালান পাঠানোর ব্যাপারে ক্যাম্পে যোগাযোগ করেনি। বিএসএফকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল …।
অন্ধকার ছিঁড়েখোঁড়ে গুলি আসছে। কখনো একটা-দুটো। কখনো কইমাছের ঝাঁকের মতো। কতক্ষণ গুলি চলবে, আল্লাহই মালুম! নূরু বলল, তোরা কেউ দাঁড়াবি না। গরুর দড়ি ছেড়ে দে …।
গুলির শব্দ শুনেই গরুগুলো ভয়ে দাপাদাপি শুরু করেছিল। প্রাণের মায়া কার না আছে। একটা গুলি লাগলেই তো ভবলীলা সাঙ্গ! দড়ি ছাড়া পেয়ে গরুগুলো দৌড়ে পালাতে শুরু করে। যত তাড়াতাড়ি পারো গুলির আওতার বাইরে যেতে হবে। কিন্তু দুটো ষাঁড় বিকট স্বরে হাম্বা রব তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। গায়ে গুলি লেগেছে …।
এরপর অনেকক্ষণ গুলি আসছিল না। নূরু ভাবল – বিএসএফ জওয়ানরা আর গুলি করবে না। এখন যতটা সম্ভব দ্রম্নত নো ম্যান্স ল্যান্ড ত্যাগ করা উচিত। গরু গেছে, যাক। লোকসান হলে আজিমুল্লাহর হবে, আর প্রাণ গেলে যাবে তাদের নিজের। নূরু বলল – শালারা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আর গুলি করবে না। চল, আমরা দৌড়াই …।
নূরুরা যেই না দৌড় শুরু করেছে, আবার গুলি! মুহুর্মুহু …।
তারপর সম্মিলিত চিৎকার। ও মাগো, ও বাবাগো …।
তারপর দিগ্বিদিক ছোটাছুটি …।
তারপর একক কাতরানি, গোঙানি …।
তারপর চরাচর নিস্তব্ধ …।
ছয়
সীমান্ত এলাকায় সকাল আসে একটু দেরিতে। জনবসতি নাই তো, তাই! কিন্তু সেদিন ধীরগঞ্জ সীমান্তে দ্রম্নত জেগে ওঠে সকাল। আর সকাল হতে না-হতেই চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে যায় ৩৬৫/১ এস পিলারের কাছে চারটি লাশ পড়ে আছে। দুটো লাশ মানুষের, দুটো গরুর …।
হালিমা জানে – তার স্বামী নূরু রাতে গরু আনতে গিয়েছিল, বাড়ি ফেরেনি …।
রতন জানে তার ছেলে বকুল রাতে গরু আনতে গিয়েছিল, বাড়ি ফেরেনি …।
৩৬৫/১ এস পিলারের কাছে লাশ পড়ে আছে, খবর শুনে অকুস্থলে বহু মানুষ এসেছে। গিজগিজ করছে। হালিমা এবং রতনও এসেছে খবর শুনে …।
হালিমার আত্মা ঢিপঢিপ করছিল – দুটো লাশের একটা তার স্বামীর নয় তো …?
রতনের আত্মা ঢিপঢিপ করছিল – দুটো লাশের একটা তার ছেলের নয় তো …?
নূরুর লাশ শনাক্ত করল হালিমা – ডান বুকে গুলি লেগেছে …।
বকুলের লাশ শনাক্ত করে রতন – কপালের মাঝ বরাবর, মেয়েরা যেখানে টিপ পরে, ঠিক সেখানেই গুলি লেগেছে …।
হালিমা বুক চাপড়ে কাঁদছিল – এখন আমার কী হবে গো? এ তুমি কী করলা গো আল্লাহ? আমার কোলে দুই বাচ্চা, পেটে এক বাচ্চা …!
রতন ছেলের লাশ সামনে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিল। জলটল কিছু নেই তার চোখে। এখন পুলিশ আসবে।
বিজিবি-বিএসএফ ক্যাম্পের লোকজন আসবে। পতাকা বৈঠক হবে। তারপর যদি লাশ হাতে পাওয়া যায়…!
হঠাৎ রতনের ফোন বেজে উঠল। বন্যা ফোন করেছে …।
বাবা …।
হ্যাঁ মা, বলো …।
তোমার নাতনি এসেছে …।
খুব ভালো খবর …।
জানো বাবা, তোমার নাতনি কপালে টিপ নিয়ে এসেছে। লাল টিপ। টিপটা দেখতে যা সুন্দর না …!
তাই নাকি …!
হ্যাঁ বাবা। তা, তোমার ছেলের ফোন বন্ধ কেন? ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়েছে নাকি! ওকে ডেকে দাও …।
পাদটীকা
হাজার ডাকাডাকি করলেও বকুলের ঘুম যে আর ভাঙবে না রতন তা তার বউমাকে বলতে পারল না। তার চোখ পড়ল ছেলের কপালে, যেখানে গুলির চিহ্ন। এ কী! গুলি লেগে যে-গর্ত হয়েছে, রক্তমাখা গর্ত; দেখতে যেন ঠিক টিপের মতোই। বকুলের কপালে জ্বলজ্বল করছে লাল টিপ। নাতনিও টিপ নিয়েই এসেছে। বাহ্ …!