বরের সাথে আজ তুমুল বেগে ঝগড়া হয়েছে।ঝগড়া লাগার কারন হচ্ছে সে আমার জন্য একটা কম দামি সস্তার শাড়ি নিয়ে এসেছে।এরকম টাইপের শাড়ি আমি কখনও পড়িনি।আমার আলমারিতে সব এক্সপেন্সিভ শাড়ি,গয়নার কালেকশন রয়েছে। বরের মুখের উপরে শাড়ি ছুড়ে ফেলে বললাম,এমন সস্তার শাড়ি আমি কখনই পড়বো না।ম্যারেজ এনিভার্সেরিতে এমন গিফট কি করে দিলা তুমি আমাকে!!
সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,শাড়ি তো আমি কিনি নি।আফতাবকে দিয়ে কিনালাম।অফিসে এতো কাজ ছিলো যে শপিংমলে যাওয়ার সময়ই পাই নি।আফতাবকে আমি গুনে গুনে দশ হাজার টাকা দিয়েছি।ব্যাটা নিশ্চয়ই টাকা মেরেছে। সেদিন রাতে রাগ করে কেক ও কাটি নি।খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছি।সেও আমাকে খাওয়ার জন্য জোর না করে ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি সব কাজ পরে আছে। ফুলির এখনও আসার নাম নেই।ফুলি হলো আমার বাসার বুয়া।ফুলিকে ছাড়া আমি পুরো অচল।সারাদিন কেটে গেলো ফুলির খবর নেই।রান্না বান্নার এতো কাজ আমি কিভাবে করবো! আগুনের তাপে আমার ভীষন অসস্তি লাগে।ফুলিই প্রতিদিন সব রান্না করে।আজকে কোনো রকম নিজেই রান্নাটা সেরে নিলাম একা হাতে।
সন্ধ্যে বেলা বসে টিভি দেখছি আর বর ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে এমন সময় হঠাৎ ফুলি এলো।ফুলিকে জিজ্ঞেস করলাম,কিরে আজকে যে আসবি না সেটা তো আগে থেকে বলবি আমাকে নাকি! কই ছিলি সারাদিন?
ফুলি মুচকি মুচকি হাসছে।ওর পরনে একটা ছাপা শাড়ি দেখতে পাচ্ছি।একদম নতুন।ওকে জিজ্ঞেস করলাম,কিরে বেড়াতে গেছিলি কোথাও? ফুলি একটা হাসি দিয়ে বলল,আপামনি আইজকা আমার আর হের ম্যারিজ ডে।সকাল থেইকা মেলা রান্নাবান্না করছি ওনার লেইগা।প্রত্যেক বছরই আমি এই দিনে ওনার লেইগা রান্না করি ভালো মন্দ।আর এই যে শাড়ি দেখতাছেন এইডা হেয় কিন্না দিছে।আমারে কইছে ম্যারিজ ডে তে এই শাড়িডা পরতে। আমি খুব অবাক হয়ে ফুলির দিকে তাকিয়ে রইলাম।একটা সস্তার ছাপা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে কতটা খুশি মেয়েটা! ফুলি লাজুক স্বরে বলল,আপামনি একটা কথা কইতাম যদি কিছু মনে না করেন। আমি মৃদু হেসে বললাম,কি কথা বল।
ফুলি মাথা নিচু করে বলল,কয়দিন পরেই তো মাস শেষ হইবো।আমারে যদি এহন কিছু টাকা দিতেন।বেতন দেয়ার সময় এই টাকা কাইটা রাইখেন আপা।এহন দিলে খুব উপকার হইতো আর কি। খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কি করবি টাকা দিয়ে? ফুলি একটা হাসি দিয়ে বলল,ওনার লেইগা গোলাপ ফুল কিনুম।উনি আমারে এতো সুন্দর একটা শাড়ি কিইনা দিলো আর আমি কিছুই দিম না কন? যাওয়ার সময় ফুলের দোকান থেইকা গোলাপ ফুল কিইনা নিমু আপা।যদি কিছু টাকা এহন দিতেন! আমি কেমন যেনো চুপ হয়ে গেলাম ওদের দুজনের প্রতি দুজনের ভালোবাসা দেখে।এদিকে ও ল্যাপটপের কাজ রেখে অবাক হয়ে ফুলির কথা গুলো শুনছে।
এতো অল্প কিছুতে কত খুশি এরা! আর আমরা! এতো বছরেও ভালোবাসার আসল মানেটাই বুঝতে পারলাম না।
আমি দৌড়ে গিয়ে আলমারি থেকে তিন হাজার টাকা বের করে নিয়ে এসে ফুলিকে দিতেই ফুলি বলল,পুরা বেতন দিয়া দিলেন এহনই? কিন্তু এক হাজার টাকা বেশি ক্যান আপা? আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম,ওটা আমি তোকে এমনি দিয়েছি খুশি হয়ে।যা বাসায় গিয়ে বরকে নিয়ে দিনটা সেলিব্রেট কর। ফুলি হাসি হাসি মুখ করে চলে গেলো। রাতে খাবার খাওয়ার সময় ও আমাকে ডেকে বলল,আজকে খাবারের স্বাদ অন্য রকম লাগছে যে! কে রান্না করেছে? আমি ওর দেয়া সেই শাড়িটা পরে সামনে এসে বললাম,আমি রান্না করেছি।
ও অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,এই শাড়িটা পরেছো যে! এটা রেখে দাও আমি কাল তোমাকে আরো দামি শাড়ি কিনে এনে দেবো। আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম,আমার কাছে তোমার চেয়ে দামি আর কিছুই নেই পৃথিবীতে।অল্পতেও যে সুখ খুঁজে নেয়া যায় সেটা এতোদিন আমি বুঝতে পারিনি।ভাগ্যিস আজ ফুলি কাজে আসেনি।নয়তো আমার চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে থেকে যেতাম সারাজীবন।ভালোবাসার আসল অর্থই আমি বুঝতে পারতাম না।একজন স্ত্রীর কাছে দামি শাড়ি,গয়নার আর টাকা-পয়সার থেকেও বেশি দামি তার স্বামীর ভালোবাসা।
ও একটু গম্ভীর স্বরে বলল,আমারও ভুল হয়ে গেছে।আফতাবকে দিয়ে তোমার জন্য শাড়িটা কেনা ঠিক হয় নি।নিজের হাতে পছন্দ করে তোমার জন্য গিফট কেনা উচিত ছিলো।আমি খাবার বারতে বারতে বললাম,অনেক হয়েছে এবার পায়েসটা খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে।নিজের হাতো তোমার জন্য বানিয়েছি। ও পায়েসটা মুখে দিয়েই একটা হাসি দিয়ে বলল,ভাগ্যিস আজ ফুলি কাজে আসেনি নয়তো বউয়ের হাতের এতো সুন্দর রান্না করা খাবারটা মিস হয়ে যেতো।
গল্পের বিষয়:
গল্প