আমি তখন তিন মাসের গর্ভবতী। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরা স্বামীর সাথে যখন বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে যাবে, ঠিক এমন সময়েই শাশুড়ি আমাকে কাঁদো কাঁদো গলায় হাতে ধরে বলেছিলেন,
-মারে আমার ছেলেটাকে ঠিক করার দায়িত্ব এখন তোর। তোর ছেলে যখন দুনিয়ায় আসবে তখন বুঝবি মা হওয়ার কী জ্বালা।
শ্বশুর পত্রিকার আড়ালে মুখ রেখে শক্ত সুরে বলেছিলেন, বিয়ে করা যতোটা সহজ ভাঙ্গা ততোটাই কঠিন।
প্রথম যখন বিয়ে করে এ বাড়িতে আসি তখন সবকিছু ভালোই চলছিলো। আলিফ স্বামী হিসেবে ছিলো যথেষ্ট কেয়ারিং। আমাদের বিয়েটা ছিলো এরেঞ্জ ম্যারেজ। আমার বাবা একজন সরকারি চাকুরে। ডাক অফিসের সহকারী ইনচার্জ হিসেবে আছেন। বেতন যৎসামান্য। বয়স হয়েছে বাবার। আমার কোন ভাই বোন নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। মা গৃহিনী। তখন সবেমাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি। স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবো। পড়াশোনায় ও মোটামুটি ভালো ছিলাম। খুব স্বপ্ন দেখতাম, আমার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা আমি নিজেই করবো। আমার বাবার হার্টের সমস্যার জন্য আমি নিজে রোজগার করে বাবাকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাবো। একটা ঘর হবে।আমাদের সুন্দর একটা সংসার হবে। যেই সংসারে শুধু আমি আমার বাবা আর আমার মা।
হয়তোবা বিধাতা এর কোন কিছুই চাননি। ইন্টার শেষেই আমার জন্য আলিফের বিয়ের প্রস্তাব এলো। যেদিন আলিফের মা তাদের প্রাইভেট কার নিয়ে আমাদের টিনশেডের ভাড়া বাসায় এলেন সেদিন বিকেলে পাশের বাসার রহিমা খালা মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে শুনেছি, উনিতো অনেক বড়লোক। আমাদের বাসায় এলেন কেনো?
মা তখন সহাস্যে বলেছিলেন, আমার রিমাকে উনার ছেলের জন্য পছন্দ হয়েছে। তাই সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলেন।
আমি বসার ঘরে ছিলাম। জানালা দিয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলাম রহিমা খালা বলছেন, এই সম্বন্ধ হাতছাড়া যেনো না হয়। তাদের বাড়ি-গাড়ি সব আছে। সেই ঘরে যদি আমার বিয়ে হয়, তাহলে আমার ভাগ্যই খুলে যাবে। সন্ধ্যার পর বাবা বাসায় আসলেন। মা সবকিছু খুলে বললেন বাবাকে। বাবা প্রথমেই আমাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি বিয়ে করতে রাজি কী না? আমার এক কথার উত্তর। আমি বলেছিলাম আমি বিয়ে করবো না।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। পরেরদিনই বাবা আলিফদের বাসা গেলেন। মত দিলেন। এখানে মত না দেওয়ার ও কিছু ছিলো না। আমাদের মধ্যবিত্ত বাবারা তাদের মেয়েকে একটু সুখে শান্তিতে দেখতে পেলেই শান্তি। আলিফদের দুইটা গার্মেন্টস আছে। ধানমন্ডিতে পাঁচতলা বিল্ডিং আছে। গাড়ি আছে। আমার মধ্যবিত্ত বাবার স্বপ্নের কল্পনাতেও এসব ছিলো না। মা আমার আমাকে কাছে নিয়ে বলতেন, আমার মেয়েটার এরকম রাজ কপাল হবে সেটা আন্দাজ করতে পারিনাই। সবাই বাড়ি দেখলো, গাড়ি দেখলো, গার্মেন্টস দেখলো। বিয়েতে আমাকে স্বর্ণ দেওয়া হয়েছিলো বিশ ভরি। আমার চাচি-খালারা এসব দেখে মাকে বলেছিলো, মেয়ে আমাদের ভাগ্যবতী। নাহলে এরকম ঘরের মেয়ের কপালেও যে এরকম রাজ ভাগ্য অপেক্ষা করছিলো, সেটা কজনই বা জানতো বলো? মায়ের মুখে তখন একটা হাসি দেখলাম। হাসি দিয়েই মা বললো, মেয়ে আমার কম রূপবতী না কী? এমনি এমনিই তাদের পছন্দ হয়েগেলো?
মায়ের কথাটায় সেদিন আমি স্পষ্টতই একটা দাম্ভিকতার ছাপ দেখেছি। আমার রূপের গরিমা দেখেছি। আমার বাবার টিন শেডের ভাড়া বাসায় সানাই বাজলো না। হলো না কোন লাইটিং। বিয়ের দিন সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগেই আমার শাশুড়ি একটা কার পাঠিয়ে দেন আমাদের বাসায়। আমাকে নিয়ে পার্লারে যাবে। সেখান থেকে সাজগোছ করে সোজা কনভেনশন সেন্টারে! মা আমার এগিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসলেন কারে। চাচি-খালারা পেছন থেকে সহাস্যমুখ নিয়ে আমাকে বিদায় জানালেন। আমিও হাসিমুখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। এই আমার কন্যাবিদায়। অভিনব এক বিদায়। আমার জন্য আমার মায়ের চোখে জল নেই। মা-বাবা ছেড়ে চলে যাবো বলে আমার মনেও কোন উৎকণ্ঠা নেই। নেই কোন দুশ্চিন্তা। আমার যে বড় ঘরে বিয়ে হতে চলেছে। আমায় যে বিশ ভরি স্বর্ণ দেওয়া হয়েছে, আমার বরের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, গার্মেন্টস আছে। কিন্তু কেউ একটাবার খোঁজ করলো না আমার বর কে? সে কেমন?
বিয়ের পর ভালোই চলছিলো সব। প্রথম প্রথম আলিফকে চিনতে আমার ভুল হয়েছিলো। এখন ঠিকই চিনতে পেরেছি। সারারাত বাইরে কাটিয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরা যেনো তার আরেকটা নেশা। তারপর আমি কিছু বললেই আমার মা বাবা তুলে আমাকে গালাগালি। বন্দি রুমের ভেতরের চাপা কান্না রুম পেরিয়ে পাশের রুমেও যে যায় সেটা বুঝতাম না। সকালে যখন শাশুড়ি বলতেন, মারে মেয়েদের বিয়ের পর স্বামীই সব। এসব ঠিক হয়ে যাবে, তখন বুঝতাম রাতের চাপা কান্না আর আলিফের গালাগালি কোন কিছুই তাদের অগোচরে নয়।
মারামারি, গালাগালি আর মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে ফেরা অতিমাত্রায় বেড়ে চললো। আমি দিনকেদিন অসহ্য হয়ে পরেছিলাম। মাকে কল করে বলতাম সব। মা বলতো, সহ্য কর। বাবাকে কল দিলে বাবা কোন জবাব দিতো না। তবে এটুকু বুঝতাম বাবা আমার চাপা কান্না করছে। গত সপ্তাহে বাসায় গিয়েছিলাম। আমাদের সেই টিনশেডের ভাড়া বাসাটায়। আমার চাচিও এসেছিলো। আমার চোখের নীচে কালি পরা দেখে মাকে বলেছিলো, আমাদের রীমার চোখের নীচে কালি কেনো? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? শুনেছি মা বললো, ঠিক আছে মানে কী? অনেক ঠিক আছে । আমার জামাই অনেক ভালো মানুষ। তারা আমার মেয়ের খাতির যত্নে কোন কমতি রাখেন না।
বুঝে নিয়েছিলাম আমার ভালো থাকাটা এখন কর্তব্য। সমাজের সামনে আমি ভালো আছি এইটা দেখানো এখন আমার ব্রত। আমার মধ্যবিত্ত বাবা মায়ের অহংকার। সেদিন প্রেগনেন্সি ট্যাস্ট করালাম। জানলাম আমি মা হবো। জীবনের বেড়াজালে আরেকটা সম্পর্কে আমি আবদ্ধ হলাম। আলিফকে কোন মতেই ভালো করা যাচ্ছিলো না। একবার চিন্তা করেছি এখান থেকে চলে যাবো। বাবা মায়ের কাছেও যাবো না। সেখানে গেলেও আমার ঠাই হবে না। পরে চিন্তা করলাম গিয়ে কী করবো? আমার পড়াশোনাই বা কতটুক? আমি করবোটা কী? অবশ্য একা হলে চলে যেতাম যেদিকে চোখ যায়। এখন আমার ভেতরে বেড়ে উঠা আরেকটা বাচ্চার জন্য আমাকে থেকে যেতে হবে। শাশুড়িকে রোজ বলি,
– এভাবে আমাকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিলেন কেনো? শাশুড়ির একই উত্তর।
-আমিতো মা। ভেবেছিলাম বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
-তাহলে আমাকেই পেলেন? বড়লোকের কোন মেয়ে আনতেন ছেলের জন্য।
-মারে। তুমিযে এখনও আছো বড়লোকের মেয়ে হলে দুইদিনও থাকতো না। এখন তুমি মা হতে চলেছো। এখন তোমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি শুধু আলিফের স্ত্রী না। তুমি এখন থেকে তোমার ভেতর বেড়ে উঠা বাচ্চার মা। মা হবা যখন তখন এই মায়ের কষ্ট বুঝবা। শাশুড়ির কথায় চাপা কষ্টটাকে আরও চাপা দিয়ে রাখি। মা’কে কল দেই। কান্না করি বেশ কিছুক্ষণ। শেষমেশ মা আমার বলে উঠলেন, মানুষ বড়লোক জামাই পায় না। তুই তোর ভাগ্যগুণে পেয়েছিস। কোথায় জামাই নিয়ে অহংকার করবি তা না হুদা হুদাই তার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছিস। আর বড়লোকের ছেলেরা এসব একটু আধটু করেই।
-তাই বলে গায়ে হাত দেওয়া? বাবা তোমার কোনদিন হায়ে হাত দিয়েছিলো? মা আমার কোন জবাব দেয় না। শেষে এটুকুই বলে, বড়লোক জামাই নিয়ে অহংকার করতে হয়। দোষারোপ না।
গল্পের বিষয়:
গল্প