পুরো বাইলেনটা গরুর জিম্মায়। তারাই এই রাস্তার মালিক এই কয়দিন, আজ শেষদিন। কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তায় অনেকটা দূরেই রিকশা ছেড়ে দিতে হলো তাকে। গরুকে সমীহ দেখিয়ে দেখিয়ে বড় রাস্তার মুখে এসে রাস্তা জুড়ে দাঁড়ায় সে। অন্যদিন হলে এতক্ষণে তিনটে রিকশা চাপা দিত, মানে ধাক্কা দিত। এখন ফাঁকা রাস্তা, রাস্তা জুড়েই তাই গোধনের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। আজ অন্য অনুভূতি, অন্য ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ যাপনের হলেও খুব টকোটকো। চনার! ঝাঁঝ! সঙ্গে ভেজা খড়বিচুলির গুমোটি। মন ভালো থাকলে এগুলো তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখত, ইন্দ্রিয়কে নতুন কিছুর আস্বাদ দিত। এখনো দেখছে, এমনি, হৃদয়ে ছন্দ না থাকলে যেমন!
দুপাশের ফার্নিচারের দোকানগুলো বেশিরভাগ বন্ধ। দুপুর হতে বেশ দেরি, খুলবে হয়তো হাট থেকে গরু কি ছাগল কি উট বগলে নিয়ে!
কয়দিন ধরে ব্যাগের চেইনটা কাটা, ভয়ে থাকে কখন কী পড়ে যায়! চোখের সামনে চর্মকার পেলে আগে চেইনটা সারাবে। আশ্চর্য, দারুণ ভাগ্য তার, বয়স্ক-জটাধারী লালবসন যেন তারই অপেক্ষায় বসে আছেন। একমাত্র খদ্দের সে আপাতত। খাপ্পা মেজাজ তার মুহূর্তে অনেকটাই নিচে নেমে এলো মানে ঠান্ডা হয়ে এলো। ঠিক ছন্দে না এলেও এক ধরনের ইতিবাচক প্ররোচনা দিলো।
চেইনটা লাগাতে পারবেন?
পাত্তা না দিয়ে ব্যাগটা হাতে নিলেন লালবসন তুমুল জটাধারী। তার আগে সে মোবাইল দুখানা, মানিব্যাগ আর চার্জরত মোবাইলের পাওয়ার ব্যাংক হাতে নিল। ভেতরে একটা পত্রিকা আর কলম ছাড়া কিছু নেই।
অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর তিনি ব্যাগ হাতে রওনা হলেন উলটোদিকে অপ্রশস্ত রাস্তার ওপারে হাত-দশেক দূরে। সেখানে বাক্স হাতড়ে কৌটা খুলে একটা সস্নাইডার নিয়ে এলেন; কিন্তু লাগানোর কোনো চেষ্টা না করে নিজের হাতের আঠা পরিষ্কারে মন দিলেন। ব্যাগটা ব্যথিতমনে হা করে চেয়ে রইল।
ঠিক তখনই এসে হাজির হলো একজন, সেও এই পেশারই লোক, তার হাতে সঁপে দিলেন বস্ত্তখানা জটাধারী। তার আগে ঝটপট দু-লাইন কথা হয়ে গেল তাদের। নাম সদানন্দ মুনিদাস।
মুনিদাস কেন?
আমরা মুনি।
মানে?
মুনিঋষি, নাম শোনেননি!
এক অশিক্ষিত মানুষ সে! তাড়াতাড়ি ঘাড় নেড়ে বিশাল সবজান্তা হয়ে যায়।
ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি মুনিদাস। কার শিষ্য আপনি?
বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী, বারদী।
কতদিন ধরে এখানে বসেন?
তখন বসুন্ধরা হয় নাই, পেছনে জঙ্গল, কত লোকরে জমি কিন্না দিলাম!
জটাধারী ব্যাগ হ্যান্ডওভার করে দিলে তার ছেলের পিছু নেয় সে কথোপকথনে ক্ষান্ত দিয়ে।
ছেলে মন দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সে জটাধারীর ছেলে হলেও জট নেই, ক্লিন সেভড। সেও বহু বছর এখানে বসে জুতো সারে, জানা হয়ে গেল। বেশ, একই জায়গায় বাপবেটা, এপারে-ওপারে!
হাতে যাবতীয় জিনিস তার, কী কী আগেই বলেছি। পেছনে, নিরাপদ দূরত্বে গরুর পাল সকলেই প্রায় একা একা, কেউ কেউ হাম্বারত, কেউ জাবররত। আর সে বিক্ষিপ্তহৃদয় এক পথিক যে কিনা একটু আগে থেকে ইতিবাচক চিন্তা করতে শুরু করেছে!
ছেলের নাম জানতে চায় না, কাজ শেষ করছে দ্রম্নত হাতে। মাথায় কেন যেন লোকনাথ আর জটাজুটা খেল দিচ্ছে এখন!
নেন!
কত দেবো?
ঈদ বোনাসসহ দেন, কাল ঈদ না!
ছোট্ট পার্স খুলে পঞ্চাশ টাকা দিলে সে খুশিই হয়।
যাবতীয় জিনিস ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটা দিলে বেশ একটু নির্ভার লাগে। সত্যি বলতে, বাসা থেকে খুব খিঁচড়ে বের হয়েছে সে, যাচ্ছেতাই বলা চলে।
এখন দোকানে ঢুকবে, মেয়ের জন্য একটা জামা কিনবে তারপর দশতলায় উঠে একটা দই-ফুচকা নিয়ে বসে নিজের ভূতভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করবে!
সন্ধ্যার আগে ফিরবে না, না ফিরবে না! জীবনসংসার নিয়ে বিরক্ত, মহাবিরক্ত; একা থাকতে চায় কিছুটা সময়!
জিপারে সস্নাইডার লাগিয়ে সে যেন উড়ছে, সত্যি উড়ছে! মুক্তি! বহুদিন পর আমি! হ্যাঁ, আমি, আমিই তো! একা উড়ছি।
কয়েক কদম এগিয়েছিল, হাসিমুখ আমড়াওয়ালার। একটা আমড়ায় ইচ্ছামতো নুন-মরিচ লাগিয়ে খেতে খেতে হাঁটা দেওয়া যায়, দাম জিজ্ঞাসা করে – দশ টাকা। নাহ্, এই মধ্যাহ্নে দই-ফুচকা জমবে। আমড়া বাতিল। সামনে আবার কয়েক কদম, বালক একটা খালি গায়ে পোড়া শরীর দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে। উৎসবে পয়সা কয়টা বেশিই দেয় লোকে তো এই সুযোগ কেন ছাড়বে! সেও দিতে পারে। না, সে ব্যাগ খোলেনি। এখন এসব ভালো লাগছে না, ভাংতি থাকা সত্ত্বেও।
রাস্তা পেরোনোর জন্য বীরবাঙালি কাঠের ব্যারিকেড ভেঙে নিয়েছে, কয়দিন আগেও পান্থপথ ঘুরে বসুন্ধরায় গেছে। নিয়মের পরাকাষ্টা। এখন সময় বাঁচল, ধন্যবাদ বীরবাঙালি কবি নজরুল! রাস্তা পেরিয়ে বসুন্ধরা চত্বরে ঢোকার পথে ফের ফকির, মনে মনে বলে, মাফ করেন।
সোজা তিনতলা, টু পিস নাকি থ্রিপিস, পাক্কা এক ঘণ্টা খরচ করে একটা থ্রিপিসই পছন্দ করে। কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ায়, ভ্যাটসহ দাম শুনে টাকা বের করতে সস্নাইডারে হাত রাখে, সস্নাইডার আসেত্ম আসেত্ম টেনে একপাশে নেয়। পার্স খোঁজে, দুটো মোবাইল আর পাওয়ার ব্যাংকের আড়ালে শালা লুকিয়ে ভয় দেখাচ্ছে!
না, পার্সটা নেই! থ্রিপিস, দই-ফুচকায় জল ঢেলে দিলো একটা সামান্য নাকি অসামান্য পার্স!
কর্তৃপক্ষকে বলে, একটু ক্যামেরাটা দেখবেন! একটা ধাক্কা তো খেয়েছিলাম! ওরা তো খুব স্কিলড। হালকা টাচেই কাজ শেষ করে ফেলে। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর আবার বলল, একটু ক্যামেরাটা চেক করবেন!।
কথা রাখলেন তারা। অফিসরুমে বসালেন। ক্যামেরা ব্যাকে নিয়ে দেখাতে লাগলেন। ওহ্, মহিলাটা আমি, বেশ। কিন্তু এত সময় ধরে সে কী খোঁজে! প্রার্থিত জিনিস রেখে ইতিউতি! লোকজন দেখে, বাতি দেখে, রং দেখে, বেরং দেখে – ওই দিকটা সাদায় ঠাসা না! ওসবও দেখে!
দায়িত্বশীল দোকানের ম্যানেজার ছেলেটা। অমায়িক ভঙ্গিতে ধৈর্য ধরে দেখে চলেছে। অনেকক্ষণ পর দেখায়, এই যে দেখেন ম্যাম, নির্দোষ ধাক্কা!
তাই তো, তাহলে!
অন্য কোথাও ম্যাম!
নেমে আসে দ্রম্নত, টাকার অংকটা তত বেশি নয়, ছত্রিশশো; কিন্তু অপমান লাগছে। একই রুটে ফিরছে বাসার দিকে, রাস্তা পার হয়ে মহানন্দ মুনিদাস বসে আছেন তখনো। ছেলেও অন্য পাশে। বলে, পার্সটা দেখেছেন? মনে হয় এখানেই হাত থেকে পড়ে গেছে ব্যাগে ঢোকানোর সময়!
আসলে পড়ে গেলে কি অভিযোগ আনা যায়! যায় না। বাসায় ফিরে আবার টাকা নেয়, মাস্টারির টাকা! পার্সের জন্যও মন কেমন করে।
মুক্তির আনন্দ সইল না! না ফুচকা! না ফুচকা হলো নিজের জন্য শাস্তি!
একই পথ আবার দেখা, এবার আমড়াওয়ালাও যোগ দিয়েছে, না, না এহানে পড়ে নাই, দেখতাম না!
থ্রিপিস নিয়ে ফিরছে, দই-ফুচকার গুষ্টি নিপাত, জীবন নিয়ে ভাবনা যে-তিমিরে, সে-তিমিরে! দশতলা হাত ইশারায় দূরে যায়, আহা রে ভাগ্য!
ফাইনাল ফেরার সময় আবার সদানন্দ মুনিঋষি! বসে আছে চুপচাপ। সে বলে, পার্সটা হাত থেকে এখানে পড়ে গেছে! সত্যি তো, পড়লে কি আর দেখতেন না! কিন্তু দোকানে যায়নি।
ছেলেটা নরম গলায় বলে, বাবা কত লাখ ফিরায় দিছে, লোভ নাই এসবে। এহানে পড়ে নাই। আইসেন আবার!
আসব, বলে। কিন্তু মনে মনে বলে, কোনো দিন আর আসব না। জীবনের জন্য তোদের সঙ্গে শেষ!
দশদিন পর ম্যাসেঞ্জারে টেক্সট, আন্টি, একজন খুঁজতে আসছিল, আপনি কী হারায় ছিলেন?
অবাক হয়নি একটুও, যেন আশা ছিল। কয়েকদিন শেষ বিচারের দিনের ভিডিওটা দেখছিল। আমড়াওয়ালা হা-হা করে ছুটে আসে। মুনিঋষি ঝাঁপ দিয়ে পড়ে! ছেলে বলে, সরেন দেখি … আমার কাস্টমার!
আগের বাসার ঠিকানা। ভোটার আইডি কার্ড দেখে সে বিসি দাস স্ট্রিটে পৌঁছে গেছে!
কিছু দিয়ে গেছে কি?
হ্যাঁ, একটা পার্স। ভেতরে আপনার ছবি আর জাতীয় পরিচয়পত্র আর …
আর ছত্রিশশো টাকা!
না তো, টাকা তো নাই, দেখলাম না তো আন্টি!
তবে আর কী, রেখে দাও, ওদিকে গেলে নিয়ে আসব।
আদনিন চিৎকার করে ওঠে, আন্টি ইন্টারেস্টিং একটা চিঠি আছে।
না, আর তো কিছু থাকার কথা নয়।
না, আপনার কাছে লেখা লোকটার চিঠি। পিস্নজ আন্টি, বিকেলে আসেন, চা খাব আর একটু আড্ডাও হবে! আর চিঠি!
ধুর কী চিঠি!
খুব রহস্যময় চিঠি আন্টি!
আচ্ছা আসবোনে বিকেলে।
এই শতকে চিঠি!
সন্ধ্যার আগেই বিসি দাস স্ট্রিটে। আদনিন চিঠিটাই আগে এগিয়ে দেয়।
খুব খারাপ হাতের লেখা কিন্তু পড়া যায়।
সালাম,
সেদিন আরো একটু জোর দিয়ে কেন চাইলেন না ব্যাগটা! আমার কালির বাক্সেই ছিল। ছেলেও চাইছিল দিয়ে দিই। আমড়াওয়ালা ভাগ নেওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। বাবা লোকনাথ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি জাগ্রত ছিলাম লোভে। এক জায়গায় পাঁচ হাজার টাকা ধার শোধ করতে পারছিলাম না। সেই এলাকায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আপনার ব্যাগ পেয়ে দিয়ে এলাম তিন হাজার। খুব আরাম লাগছিল দিয়ে এসে। ছেলে রেগে ছিল। সে খুব বিরক্ত এ-ব্যাপারে। মেয়ের শ্বশুরের টাকা শোধ করলাম। কত খারাপ কথা বলেন, টাকার জন্য মেয়েকে দু-বেলা কথা শোনায়।
পরশু আমার ছেলেটা চলে গেল। দু-দিনের জ্বরে, হাসপাতালে নিলাম, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ছিল আর কিছু না। আজকে আপনার ব্যাগটা কালির বাক্সের ভেতর পেলাম। পাশের রনি ফার্নিচারের দোকানের একটা ভাই চিঠিটা লিখে দিলো।
আরেকটা কথা, আপনাকে না বললেও হয়। তবু বলি, এত কথাই যখন বললাম। আমি কিন্তু এই স্বপ্নটা দেখছিলাম কদিন আগে, বউকে বলেও ছিলাম। বউকে বলছিলাম একটা ব্যাগ কুড়ায় পাব, মালিক নাই। অনেকগুলা টাকা পাব গোবিন্দের টাকাটা শোধ দেবো। বউ তো তখন বলে নাই – না, অন্যের টাকা নিয়েন না! এখন কেন সে আমাকে দোষ দেয়! আমি নাকি একটা ভ-, প্রতারক। ছেলেটা চলে না গেলে কি এসব সে বলত! বাবা লোকনাথে গিয়ে কী বলব জানি না!
আপনি আমারে মাফ করেন, আপনি তো মেয়ের জামা কিনতে পারছেন, কিনে নিয়া আসছেন দেখলাম। অভিশাপ দিয়েন না মা।
ইতি
সদানন্দ
পার্সটা হাতে নিয়ে সে হাসল। ভেতরে জাতীয় পরিচয়পত্র আর দশ টাকার একটা রেভিনিউ স্ট্যাম্প ঠিকঠাক আছে।
আদনিন চা বানাল, এলাচ দিয়ে ঘন দুধচা আর বাখরখানি। এখানে থাকতে আদনিনের হাতে খুব খেত। দুজনে খুব হাসল, গল্প করল। কিন্তু সদানন্দ মুনিদাসের ছেলেকে নিয়ে কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করল না।
নিচে পৌর লোকেরা মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে সন্ধ্যাবেলা, বিকট শব্দ। গা ম্যাজম্যাজ করছে কাঁচাঘুমটা ভেঙে। কপালে মশার কামড়ের চুলকানি, কামড় সত্যি হতেও পারে নাও পারে।