ও তমিরের বাপ, শুনিজেন, কী সব্বনাশে কদাগো। তুমি না হয় যাইও না।
ছাতার মাথায় বাঁধা বোচকাটা রমজান ফকির কাঁধে তুলেছে মাত্র। এমন সময় পেছন থেকে বাধা পড়ল। তাকে আর থামায় কে। মুখ তো মুখ নয়, দুধারী করাত। রাগলে তার মুখে ভালো কথা কেউ শোনেনি কোনোদিন। নাম রমজান হলে কী হবে, তাকে রোজা করতে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। রমজান ছাতার মেকার। ছাতা মেরামত করে গ্রাম বেড়িয়ে। তিনদিন টানা বর্ষার পর আকাশ ফর্সা হতেই ছাতা মেরামতের বোঁচকা সাজিয়ে কাঁধে তুলে প্রথম ধাপ দিয়েছে। আর সেই শুভক্ষণেই পেছন-ডাক পড়ল। কড়মড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে পেছন ফিরে বউয়ের দিকে তাকাল একবার। বউ বোধহয় খেয়াল করেনি। করেনি বলেই পুনরায় কী একটা বলার জন্য হাত উঁচিয়েছে মাত্র। অমনি রমজানের স্বরূপ প্রকাশ পেল মাগি জুয়ায়াই থাকে। বেত্তমিজ মাগি চিল্লাস ক্যান। দ্যাগোজু কিবল পা বাড়ায়জি। অমনি মাগির হামলানি উডলো।
আরে বারোজাইত্যা তুর ভালোর ক্যানেই বুলোজি। না শুনলে যা; তুর নাঙ্গেরা ঠাপাবেনি।
এবার একটু চুপসে গেল রমজান। কাঁধ থেকে বোঁচকাটা নামিয়ে রাখল। বিড়িতে আগুন দিয়ে বসল নিমগাছের শিকড়ে। বউ কাছে এলো। রমজান বউয়ের দিকে তাকাতেই বউ বলল Ñ শুনিজেন, গিয়াসোক মানষে তাড়ায়া ধরিজলো। কুনো রুকুমে জান লিয়া পালাইয়া আসিজে।
ক্যা, গিয়াস আবার কুন মাগির ঘরোত ঢুকিজোলো?
মরদটার খালি ব্যাতাল্যা কদা। ভালো কইরা শুনেক আগে, না শুনতেই মরিশ ন্যা। ওইদ্যা চারদিক ছাওয়াল ধরার হপ উডেনি? গিয়াসক মানুষ ছাওয়াল ধরা মুনে করিজোলো। শ্যাটা ফাটাইয়া দিজে মুনে হয়।
এবার কিছুটা থমকালো রমজান। সহসা মুখে কিছু বলতে না পারলেও হাজারো প্রশ্নরেখা ফুটে উঠল মুখাবয়বে।
গিয়াস শীল-পাটাতে ধার কাটে। তার ওপর এখন ধার কাটার মৌসুম। পনেরো দিন বাদে কোরবানি ঈদ। বউ-বেটিরা বলতে গেলে মুখ চেয়ে আছে তার। কেউ চাল দিয়ে কেউ টাকা দিয়ে। পাঁচ বাড়ি ঘুরতেই ব্যাগটা ফুলে উঠেছিল। ছয় নম্বর বাড়িতে ঘটনাটা ঘটল। তিন বছরের এক শিশু পাটাতে ধার কাটা দেখছিল। একেবারে যে কাছে ছিল, তাও নয়। খানিক দূরেই ছিল। তবু একটা ঝাল-মেশানো কুচি গিয়ে পড়ল শিশুটির চোখে। অমনি শিশুটি চিল্লিয়ে উঠল বাবারো-মারো বলে। দ্রুত বেরিয়ে এলো তার মা; আরো পাঁচ মা। শিশুটির বাপ বাড়িতে না থাকলেও দৌড়ে আসাতে বাপের অভাব পড়েনি। সবাই এসে শিশুকে চেপে ধরল। চোখের জ্বালার সঙ্গে হাজারো প্রশ্নের জ্বালা মিশলে শিশুটি হিমশিম খেয়ে দম আটকার উপায়। কিছু বলতে পারল না। শুধু হাত-ইশারায় দেখিয়ে দিলো পাটাতে ধারকাটার দিকে। শিশুটি পাটা দেখাল না ধারকাটা লোকটাকে দেখাল তা বোঝা গেল না। তবে সবাই বুঝল লোকটাকেই দেখাল। অমনি এক প-িত মুখ ফসকে বলে ফেলল Ñ ও শালা ছেলেধরা। একে ঝুলাতে ভরতে চাইজোলো। মার সমুন্দিক।
বুদ্ধিমান গিয়াস। দৌড়ে পালায়নি। সে দাঁড়িয়ে থেকেই দু-চারটে কিল-ঘুসি হজম করল। আর বারবার চিল্লিয়ে গেল হামি ছেলেধরা লয়, হামি ছেলেধরা লয়। অবশেষে এক বৃদ্ধ এসে সবাইকে থামাল। একচোট নিল সবাইকে। তবে এর আগেই গিয়াসের যা হয়েছে, তা খুব একটা মন্দ নয়।
গিয়াস ফিরে এসেছে বাড়িতে। এই কথাগুলোই গড়গড় করে বলে ফেলল তমিরের মা। রমজান কোনো রা-শব্দ না করেই হা করে শুনল কথাগুলো। বেশ কয়েকটা অশ্লীল গাল পাড়ল আকাশের দিকে তাকিয়ে। গালির ওজন এতটাই বেশি যে, বাতাসও বোধহয় বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে না। এমন সময় একটা কোকিল ডেকে উঠল। কোকিলেরও সময়জ্ঞান লোপ পেয়েছে। বর্ষাতেও কোকিল ডাকে বেশুমার। এটা আগাম না নামলা, তা হিসাবে মেলে না। তবে ডাকটাতে অতটা রস নেই। কিছুটা খসখসে। রমজানের কাছে সেই ডাক অবশ্য কাকের মতোই শোনাল। ওপরদিকে তাকাতেই ঠিক দেখতে পেল কোকিলটাকে। একটা ঢিল তুলে সোজা কোকিলকে মারল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও পালাল কোকিল। ‘সমুন্দি তুমার সুময় লাগে না। রং লাইগাই থাকে তুমার। ভরা বর্ষাতেও তুমার ডাকাডাকি।’ আরো হাজারও গালি দিলো তমিরের বাপ। শেষ গালিটা দিলো কিস্তির মাস্টারকে। ‘ওই শালা তো ঠিক সুময়মুতো আসবেনি। সে তো আর শুনবে না, হামি কামোত যাইতে পারিনি।’ তার বোঁচকাটা তমিরের মাকে দিয়ে সে বসে থাকল আরো কিছুক্ষণ।
এ এক আজব পাড়া। মূল গ্রাম থেকে দলছোটা পাড়া। গ্রামের শেষে গিয়ে কয়েকটা ধানের ভুঁই পার হলেই সেই পাড়া। লোকে নাম দিয়েছে হঠাৎপাড়া। একটা ছোট পুকুরের চারধার দিয়ে কয়েকটি বাড়ি। ছোট ছোট বাড়ি। আছে মুসলমান, আছে হিন্দু, আর আছে দুই ঘর পাহাড়িয়া। পুকুরটা ব্যক্তিমালিকানায় হলেও এর চারধার হলো খাস। এটাও এক আজব ঘটনা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই বসতিরা তিন শতাংশ করে জমি পত্তন নিয়েছে। তারা ভূমিহীন ছিল; এখন ভূমির মালিক হয়েছে। হঠাৎপাড়াকে কেউ কেউ আজব পাড়াও বলে। কী করে যে মানিকজোড়গুলো এক জায়গায় জুটেছে, সেটা ভেবে কূল পায় না ভিনপাড়ার মানুষ। গিয়াস পাটায় ধার কাটে, রমজান ছাতা মেরামত করে, তারাপদ ঈদ সামনে রেখে একটা প্যাডেল মেশিন কিনেছে। অস্ত্রে ধার দেবার প্যাডেল মেশিন। এনজিও থেকে লোন নিয়ে কিনেছে। কষ্ট সিং দুই বছর নিখোঁজ থাকার পর গত মাসে ফিরেছে। তবে খালি হাতে ফেরেনি। মুনিয়াকে নিয়ে ফিরেছে। মুনিয়া বানরের নাম। সে এখন দিব্যি বানরনাচ দেখিয়ে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে। আয়-রোজগার মন্দ নয়। বউভাগ্য, সিং এতে মহাখুশি। দুবছর ধরে খেয়ে না খেয়ে কঙ্কাল হওয়ার দশা ভুলতে বসেছে এখন। ভুটি বাবুল বরফ বেচে সংসার চালায়। আজ এই স্কুল তো কাল ভিন্ন স্কুল। পাড়ার মধ্যেও বউ-বেটি খায়। চাল দিয়ে, গম দিয়ে, আলু দিয়ে কিংবা টাকা দিয়ে। নিখিল আর অখিল, এই দুই খিল মিলে তো বলতে গেলে আচারের ফ্যাক্টরি দিয়েছে। এই দুই ভাই আর তাদের বউ-বাচ্চা মিলে চালায় ফ্যাক্টরি। এক সপ্তাহে চালতা তো আর সপ্তাহে আম। আবার অন্য সপ্তাহে বরই। নিখিল যদি যায় পুবে, তবে অখিল যায় পশ্চিমে। শুক্রবার তাদের ছুটির দিন। স্কুল বন্ধ। ওইদিন বাড়ির কাজ সারে। বলতে গেলে আগামী ছয়দিনের কাজ এই একদিনে সারে।
দেশজুড়ে এখন একটাই গুজব। গুজবও যে এত জীবন্ত হয়ে ছড়াতে পারে তা এর আগে দ্যাখেনি কেউ। খবরের কাগজ, এফএম রেডিও, টিভির পর্দায়, খবর এখন একটাই। গুজবের খবর। গুজবকে সামনে রেখেই ঘটে যাচ্ছে একের পর এক ঘটনা। আতঙ্ক ছড়িয়েছে রাজধানী থেকে অজগ্রাম পর্যন্ত। আতঙ্ক স্কুলপড়–য়া শিশুর মায়ের মনে, শিক্ষকের মনে, পিয়নের মনে, দারোয়ানের মনে। আচার, বরফ, ফুচকা বা বারোভাজা বেচা মামার মনেও। তাদের বসতে দেওয়া হচ্ছে না স্কুলের গেটে। তারা এখন বাড়িতে ঝিমুচ্ছে। ভাবছে বিকল্প কাজের কথা। আতঙ্ক সবখানে। আতঙ্ক প্রধানের মনে, আতঙ্ক সহকারীর মনে। আতঙ্ক আবার ভাগ্য সিংয়ের মনে। আতঙ্ক একটাই, ছেলেধরা। পদ্মা সেতু তৈরিতে মাথা লাগবে। অনেক মাথা। এই গুজবই এখন দেশজুড়ে। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। প্রাণও গেছে অনেকের। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমেছে যথেষ্ট।
প্রথমে গুজবটা কীভাবে শুরু হলো, কে বা কারা শুরু করল, কোন উদ্দেশ্যে করল তার তলানি এখনো পাওয়া যায়নি। এখন আর খোঁজেও না কেউ। তবে গুজবটা সত্য হয়ে জেঁকে বসেছে সবার মনে। স্কুলে বা কোচিংয়ে নিজ সন্তানকে আনতে গিয়েও ভয় নিয়ে থাকতে হয় অভিভাবককে। না জানি তাকে ছেলেধরা বলে তেড়ে আসে কেউ। রাজধানীর বাড্ডায় রেনুকে মেরে ফেলার পর ভয়টা আরো শক্ত আসন গেড়েছে।
এই গুজব আরো বেশি কালো ছায়া হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছে এ-পাড়াকে। হঠাৎপাড়াকে। একটা ঝিমুনি সবার মনে। শোকাচ্ছন্ন সবাই। এই শোকটা আরো বড় হওয়ার কারণ, এই পাড়ার প্রতিটি পরিবারেই ঢুকে আছে এনজিওর ঋণ। কারো দুটি, কারো তিনটি। সাপ্তাহিক কিস্তির হিসাব বাচ্চা হারানো ফিঙের মতো মাথার ওপর বনবন করে ঘোরে। এনজিওগুলোও তাদের লোন দেয় কোনো আপত্তি ছাড়াই। এই পাড়ার সুনাম আছে, এরা কিস্তি মিস করে না। সবাই ক্ষুদে ব্যবসায়ী। কাঁচা টাকা। বড় কথা, এক খৈলানে বসলে সবার টাকা পাওয়া যায়। এখন সব উলটো। ছেলেধরা গুজবের জুজু গ্রাস করেছে সব। সাপ্তাহিক কিস্তি কেউ দিতে পারছে, কেউ পারছে না।
চাঁদনি রাত। পূর্ণিমা গেছে গতকাল। হঠাৎপাড়ার সবাই আজ এক জায়গায় বসেছে; পুরনো তেঁতুলগাছের নিচে। এই পাড়ায় সবচেয়ে প্রাচীন বলতে ওই তেঁতুলগাছটাই। চলমান সমস্যা নিয়েই বসেছে সবাই। রমজান, গিয়াস, নিখিল, অখিল, কষ্ট সিং, তারাপদ, ভুটি বাবুল। সবাই। দু-একজনের বউও আছে। জোছনায় ভাসছে তামাম দুনিয়া। খলবলিয়ে হাসছে সারাগ্রাম। তেঁতুলগাছে বসা সাদা বক, ঝুলন্ত বাদুড়, ইঁদুর ধরতে ঘাপটি মেরে থাকা পেঁচা, লাঙল দেওয়া শ্রাবণের ভুঁই; দুধ-জোছনায় ভাসছে সব। অন্ধকার শুধু তেঁতুলগাছের গোড়ায়। অন্ধকার বসে থাকা মানুষগুলোর সামনে, পিছে, ডানে, বাঁয়ে। চারদিকে। তাদের মাথার ওপর যম হয়ে বসেছে কিস্তির শামিয়ানা। না খেয়ে দিন পার করা যায়, কিস্তি না দিয়ে নয়।
কথা ওঠাল তারাপদ। তার তাড়াটা বেশি। তারাপদর কিস্তি সপ্তাহে দুটো। ভেবেছিল এই মৌসুমের রোজগারে একটা লোন শোধ করবে। এই ভেবেই ধার দেওয়ার মেশিনটা করেছিল। কোরবানির আগে বড় ব্যবসা হবে। গ্রাম ঘুরলেই টাকা। প্রতিটি প্যাডেলে প্যাডেলে টাকা। লোহা আর পাথরের ঘর্ষণে যেভাবে ফুলকি ছুটে পালায়, ঠিক সেভাবেই টাকা তার কোঁচায় আসে। কিন্তু দুদিন যেতেই আর যাওয়া হলো না। হাল জুড়তেই ফালে বাড়ি।
এই মিটিংয়ে সবচেয়ে বড় রমজান। তাকে লক্ষ্য করেই তারাপদ বলল ‘দাদা তুমি সবার বড়, তুমিই একটা কিজু করো।’
তা হামি কী করমু, ঘটনা জি বেগতিক।
তুমার দশ জাগাত উডা-বসা, তুমাক সবাই চিনে, একটা কিজু রাস্তা বাইর কর। হামরা জি মরতে বসনু।
চলেক, হামরা মিম্বারের বাড়িত যাই। এক কোনা থেকে সড়াৎ করে কথাটা বলল কষ্ট সিং।
দ্যাখ শালার বুদ্ধি। এই শালা, মেম্বার কী করবে। উই মানুষের লাডি ছানবে মুনে হয়। কয়জুনার হাত ধরবে। শুনো ভাই, হামার এক কদা। জান হারাতে পারমু না। জান থাকলে কিজু না কিজু কইরা খামু। না খাইয়া মানুষ মরে না। গিয়াস কিছুটা রাগ মিশিয়ে বলল কথাগুলো।
না খাইয়া মরবু না ভালো কদা; কিন্তুক কিস্তির মাস্টারের ঠাপ সামলাবু ক্যামন কইরা? তুমার তো একটা কিস্তি, তাই চেলকি কাটোজেন। হামার দুইড্যা, বড়জুনার তিনড্যা। অখিল লুঙ্গির এক কোনা ঝাড়তে ঝাড়তে রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়াল।
এই সমুন্দি, হামি চেলকি কাটোজি? কিল তো খাওনি শালা; একবার ঘুসি খাও তগন বুঝবেন নি।
দাদা তুমি থামো তো, ও চ্যাংড়ার অ্যাকনাতেই মাথা গরম হয়। কী করা হোবে তাই বুলো। নিখিল পরিবেশ শান্ত করতে চাইল।
তাদের আলোচনা প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলল। রাত পোহালেই কিস্তিবার। শেষে এই সিদ্ধান্তে তারা পৌঁছাল যে, কিস্তির মাস্টার এলে তাকে নিয়ে সবাই ওই এনজিওর অফিসে যাবে। ম্যানেজারের হাতে-পায়ে ধরে বলবে, একটা মাস কিস্তির হাত থেকে তারা রেহাই পেতে চায়। আরো অনেক কথাই হলো। সাত-পাঁচ কথা। তবু কথা চলে। সবশেষে সবচেয়ে বড় অর্থহীন ঘটনাটা ঘটাল অখিল। অখিল এতক্ষণ আলোচনা সভা থেকে সরে কিছুটা দূরে ছিল। বড়ভাই তাকে মাথা গরম বলেছে। এই অভিমানেই সরে থাকা। তবে কিছু একটা ভাবছিল নিশ্চয়। আর ভাবনা থেকেই এমন একটা ঘটনা ঘটাল। একটা মাঝারি ঢিল তুলে সর্বশক্তি দিয়ে তেঁতুলগাছের ডগায় মারল। আর মুখে বলল Ñ ‘ওই তো শালা ছেলেধরা।’ কঁক কঁক শব্দ তুলে কয়েকটা সাদা বক উড়ে গেল। হুতুমপেঁচা ঘাপটি মারল। উড়ল না বাদুড়ও। উঠে দাঁড়াল সবাই। অখিল আর সেখানে দাঁড়ায়নি। সোজা বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। রমজান খেঁকিয়ে বলল Ñ ‘এসবের মানে হয়? শালার চ্যাড়ামু আর গ্যাল না।’
না দাদা, কদিন থাইকা হামি দ্যাগোজি, অখিল বাড়িত খুব অশান্তি করোজে। অ্যাকনাতেই রাইগা যাওজে। বউকে একদিন মারল সুদ্দা। নিখিল পরিস্থিতি সামলে নিতে চাইল।
ওগল্যা কিজু লয়, নাঙ কুয়্যারা। হাতোত ট্যাকা নাই তো, তাই অ্যামন হওজে। কথা আর সামনে এগুলো না। যে যার বাড়িতে ঢুকল।
অখিল বাড়িতে ঢুকেই সোজা ঘরে গেল। বউ অনিতা বারান্দায়। খুঁটিতে হেলান দিয়ে সুজনী সেলাই করছে। অনিতার হাতের কাজের সুনাম আছে। অনেকেই অনেক কিছু সেলাই করতে দেয়। শাড়ি কাপড়ে ফুল তোলা, কামিজে ফুল তোলা কিংবা পাঞ্জাবিতে। খাটুনি-তুল্য মজুরি না পেলেও অনিতা যত নিয়ে করে কাজগুলো। সংসারে ঠেকা দিতে কাজে লাগে। অনিতাও ঘরে গেল। স্বামীর কাছে গিয়ে বলল ‘ভাত বাড়বো?’
না, তুই খা।
ক্যান তুমি খাবেন না?
হামি খাইজি, তুই খা। পুন্নি খাইজে? মেয়ে পূর্ণিমার কাছে এগিয়ে গেল অখিল।
পুন্নি খাইজে, কিন্তু তুমাক আবার কুন ঢেমনি খাইতে দিলো?
ক্যা হামার খাইতে দিবার মানুষ নাই?
থাকপে না ক্যান, তুমার আবার অভাব হোবে?
বেতাল্যা কদা বুলিস ন্যা।
কদিন থাইক্যা হামার পিত্তি জ্বলাওজেন, সেদিকে লয়, হামি বুললেই দুষ।
ভালো কদা, কাল তো কিস্তিবার; কালক্যাও কি তুর মাস্টার দিবে?
শুনো পুন্নির বাপ, তুমি আবোক্তা শুইঙ্গা শুইঙ্গা লুচ্চা ধইর না। মাস্টার হামার কিস্তি দিবে ক্যান, তুমি কি দশের কান্দোত উডিজেন?
কী বুললু মাগি, হামার মরণ দ্যাগোজু, হামি মরলে তুর রাস্তা ফাঁকা হোবে? এতদূর গড়াইজু মাগি।
খবরদার, বাজে কদা বুইল না। একটা কিস্তি না হয় গেল সপ্তাহে ধার হিসেবে দিজেই, তাই বুইল্যা প্রতিদিন দিবে? তুমার অত ক্ষমতা তে ট্যাকাডা মাস্টারের মুগোত ফুঁইক্যা মারতে পারলেন না। সাতদিন তো হইয়াই গ্যালো। সেদিক মরদানি নাই, যত গরম মাইগের কাজে আইস্যা।
কী মাগি, হামি মরদ লই? দ্যাগাওজি, থাম। অখিল অনিতার হাত ধরে ঝটকা টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। মেয়ে পূর্ণিমার ঘুম ভেঙে গেল। সেও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের ঝগড়া কিংবা মারামারি সামনে আর এগোলো না। তবে অখিল যে অস্বাভাবিক কা-টা করল, তা হলো; দরজার কোনার লাঠিটা নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরের মধ্যে দাঁড়াল। তার ফোঁপানির ধরন বলে দেয়, বউয়ের কোমর নির্ঘাত ভাঙবে। অনিতা ভয়ে মেঝের সঙ্গে যেন মিলিয়ে যায়। পূর্ণিমাও আঁতকে উঠল। এদিকে অখিল যা করল, তা আগে কিংবা পরের কোনো কিছুর সঙ্গেই মিলল না। সে সোজা বাহিরে এসে হাতের লাঠি দিয়ে বারান্দার এক খুঁটিতে বাড়ি মারল। গায়ের শক্তি এতটুকুও বাদ রাখেনি। মুখে উচ্চারণ করল ‘শালা ছেলেধরার কী বুলিজি।’ মড়াৎ করে ভেঙে গেলে খুঁটি। অনিতা দৌড়ে বাইরে এলো। লোকটা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? নিজেকে অপরাধী ভাবছে অনিতা। বারবার ধিক্কার দিলো নিজেকে। কেন যে মাস্টারের কাছ থেকে টাকাটা ধার নিলো! আরো তো কয়েকজন কিস্তি দিতে পারেনি সেদিন। তাদের তো তেমন কিছুই হয়নি। আর কিছু হলেই বা ক্ষতি কী। স্বামী তো আর পাগলের মতো আচরণ করত না। অনিতার কষ্টগুলো বুকের মধ্যেই কু-লী পাকিয়ে মরে। স্বামীর কাছে আসতে পারে না সে। অখিল যেন আরো উলটাপালটা কী কী বকে যায়। ‘শালা ছেলেধরা। তুর পুকাই মারমু শালা।’ আরো বলে চলে অখিল। খানিকের অর্থ হয়, খানিকের হয় না। তবে রাতে ঘুম হলো না কারো।
আজ কিস্তিবার। বড় সুনসান হঠাৎপাড়া। আজ কেউ কিস্তি দেবে না। দিতে পারবে না। দু-একজন যে পারবে না, তা নয়। তবে আজ কেউ দেবে না। কিস্তির মাস্টারকে সবাই মিলে অনুরোধ করবে; এক মাস ছুটি চাইবে। প্রয়োজনে সবাই মিলে ওই মাস্টারের সঙ্গে অফিস যাবে। সঙ্গে ওই ওয়ার্ডের মেম্বারকেও নেবে।
তারাপদর বাড়িতে ছোরা-চাপাতি রেখে গেছে ধারেকাছের দু-একজন। সেটা নিয়েই বসেছে সকালে। তার মেশিনের বল বিয়ারিংয়ে পোড়া মবিল লাগিয়ে প্যাডেলে চাপ দিলো। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তার মাথার মধ্যে রয়েছে কিস্তি। কষ্ট সিং বসে আছে মুনিয়ার কাছে। যেভাবে প্রতিদিন সকালে বসে, সেভাবে। তবে প্রতিদিনের মতো নতুন খেলার কৌশল নিয়ে নয়। আজ বসে মুনিয়ার শরীরের দুর্দশা দেখছে। এই কদিনেই বুকের কাঠিগুলো গোনা যায়। মুনিয়াও জেনে গেছে তার মনিবের মনের কথা। সেও এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মনিবের দিকে। মনিবের চোখটা ভেজা। ভেজা চোখ মুনিয়ারও। কষ্ট সিং একবার ভাবে, মুনিয়াকে ছেড়ে দেবে; বেঁধে রেখে কষ্ট দেওয়ার মানে হয় না। আবার ভাবে, ছেড়ে দিলে বান্দর ছেলেরা মুনিয়াকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নির্ঘাত মেরে ফেলবে। মুনিয়াকে ইদানীং ভাতের মাড় দিলেও আপত্তি তোলে না। ক্ষুধা এক আজব জিনিস। নিখিল, গিয়াস, রমজান, পাড়ার সবাই যে যার মতো ঝিমুচ্ছে। আলসেমির নয়; অস্থিরতার ঝিমুনি। সবার চোখ রাস্তার দিকে, যে-রাস্তা বেয়ে কিস্তির মাস্টার আসবে। বর্ষার দিনে মাস্টারের সাইকেলটা পাড়া অবধি পৌঁছায় না। বড় রাস্তার মুখে তা রেখে আল বেয়ে হেঁটে ঢুকতে হয় পাড়ায়। পাড়ায় ঢোকার আগে আরো দুই কেন্দ্রে টাকা ওঠায় মাস্টার। তারপরে হঠাৎপাড়া। সবাই কথা গোছায় যে যার মতো। কেউ আবার বউকে শেখায় বলতে যাওয়া কথাগুলো। সবকিছু টপকে পাড়ার মধ্যে এখন একটাই শব্দ Ñ তারাপদর ধার দেওয়ার শব্দ।
একসময় মাস্টার এলো। খানিকটা দেরি করেই এলো। সাইকেল পায়ে হাঁটা রাস্তার মুখে অর্থাৎ বড় রাস্তায় রেখে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আলে পা ফেলল মাস্টার। এমন সময় কথাটা এলো। কথা নয়, শব্দটা এলো। গগনবিদারী শব্দ। হঠাৎপাড়া এতক্ষণ জাঁকিয়ে ছিল তারাপদর ধার দেওয়ার মেশিনটা। সেই মেশিনের শব্দকে, স্ফুলিঙ্গকে হার মানাল সে-শব্দ। ভিমরুলের বাসা লাঠির আঘাতে ভাঙল কে যেন। সবাই একসঙ্গে বের হলো। হঠাৎপাড়ার সবাই। পাশের পাড়ারও কমবেশি সবাই। আর গ্রামের যারা শুনতে পেল, তারাও। যেন দীর্ঘক্ষণ স্টেশনে বসে থাকার পর হঠাৎ ট্রেনের বাঁশি। শব্দটা সবার কানেই পৌঁছাল। চেনা কণ্ঠ। অনুমানে আসে; মনে আসে না নামটা। ভালো করে মনে আনার সময়-ই বা কোথায়? ছেলেধরা গো ছেলেধরা। তোমরা দৌড়াও গো, ছুইটা আইসো গো, ছেলেধরা পালাওজে গো।
সবাই যখন ছুটে আসছে বাইরে, কিস্তির মাস্টার তখন আলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সেও চারদিকে খুঁজে মরে ছেলেধরাকে। মনে মনে ফন্দি আঁটে, ছেলেধরাকে সে-ই প্রথম চেপে ধরবে। বাহাদুরি নেবে। কিন্তু ছেলেধরা তার চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে গ্রাম থেকে বের হয়ে আসা মানুষ আর মানুষ। তবে কি সবার মধ্যে হারিয়ে গেল ছেলেধরা। অথচ মানুষগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে তার দিকেই।
প্রথম কিলটা যখন পড়ল, তখনো মাস্টার বুঝতে পারেনি, কী ঘটল। ভাবল ছেলেধরাকে মারতে গিয়ে ফসকে তার গায়ে লেগেছে। কিন্তু পরের কিল, তার পরের কিল এবং তার পরের ঘুসিটা যখন মাথার নিচের অংশে পড়ল, তখন মাস্টার ঠিক চিনে ফেলেছে ছেলেধরাকে। অসংখ্য তারকা ছুটে গেল চোখ দিয়ে। ছোট তারা, বড় তারা, সাতভাই তারা। অন্ধকার হলো চারদিক।
সামনে ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগল মাস্টার। ফসলহীন ফাঁকা মাঠ। জমির আলসমেত পানি। থকথকে কাদা। শ্রাবণের ভুঁই। নামলা বর্ষণে হুমড়ি খেয়েছে ক্ষেতাল। দুই বা তিন চাষ দিয়ে প্রতিটা ভুঁইয়ে এখন জাবাড়। মাটিতে কালচে ভাব এখনো আসেনি। তা আসার অপেক্ষায় আছে কৃষক। আসামাত্র বাকি চাষ দিয়ে কুহুক ধরা বিছনে ঢেকে দেবে মাঠ। এখন মাঠ ফাঁকা। ফাঁকা মাঠে দৌড় দেওয়াই যায়। তবে টপকাতে হবে মানুষের বেড়া। মাড়াতে হবে কাদাপানির বেড়া। থাক বেড়া; টপকাতে হবে সব। মাস্টার দৌড়া। জীবনটা টপকাবার আগে, টপকা সকল বেড়া। নইলে পাঁচ বাই তিন হাত চেগার আটকে দেবে তোকে। ‘মিনহা খালাক না কুম।’ পিঠের ওপর তখনো কিলের শব্দ। মাস্টারের হাজারও চিল্লানি শুনতে পায় না কেউ। এবার দৌড়া মাস্টার, জীবনের শেষ দৌড়। কাদা মাড়ানো গেলেও পথ আগায় না। এ যেন স্বপনে সাপের তাড়া-খাওয়া দৌড়। তবু দৌড়া। জীবন একটাই। কাঁধের ব্যাগটা এখন নেই। বাজারে হাজারও ব্যাগ আছে। ব্যাগের টাকার জন্য বাপের ভিটা আছে। কিন্তু জীবনের জন্য কিচ্ছু নেই। জীবন জীবনই। দৌড় দৌড়। পড়ে গেল কিছুদূর আগাতেই। এবার নির্ঘাত খোঁচন হবে। ‘ওয়া ফিহা নই দুকুম।’ সিংহের শক্তি আজ মাস্টারের মনে, বুকে, শরীরে। আবার উঠে দৌড় দিলো। বদলির দরখাস্ত পর্যন্ত তাকে টিকতেই হবে। পেছন থেকে কয়েকজন চিল্লায় ‘এই তুরা থামেক, এডা ছেলেধরা লয়, কিস্তির মাস্টার। এই তুরা থামেক …।’ তবে মাস্টারের কান শুধু একটাই শব্দ শুনতে পায় ‘মার শালাকে মার।’ পেছনের জনতার দৌড় একসময় থেমে গেলেও মাস্টারের দৌড় থামেনি।
সমস্ত দিন চলল নানা গুঞ্জন। মোড়ে, চায়ের দোকানে, পুকুরঘাটে, জমির আলে, সবখানে শুধু একই কথা। চলবেও কিছুদিন। কেউ দুঃখ করে কিস্তির মাস্টারের জন্য। কেউ বামারতে চায় গুজব রটনাকারীকে।
সবচেয়ে বেশি হইচই হলো হঠাৎপাড়ায়। সবাই গালি পাড়ে বা অভিশাপ দেয় একজনকে; যে ছেলেধরা বলে লোক জোটাল, তাকে। কিন্তু কে সে? মনে মনে খোঁজে আর গালি দেয় পাড়ার বউ-বেটি। ভাগ্যিস মরেনি মাস্টার। হাতকড়া পরত সবার হাতে। আরো কত কথা বা কত ভাবনা ভাবল মানুষ। তবে একজন চুপ ছিল সারাদিন। অনিতা।