যুদ্ধ

প্রথমে তো ভেবেছিলাম পত্রিকায় গল্প লিখেই সময় কাটিয়ে দেবো।
ঘরে ঢোকার বেশ অনেকক্ষণ পর এই কথাটা বললেন। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’ দেখছিলেন।

কত সাহস দ্যাখো মেয়েগুলোর! কতটা প্রতিকূল পরিবেশ পার হতে পেরেছে।
যতদূর জানি আপনাকেও এরকম প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হয়েছিল।
আমি মুখ খুললাম।
আমার আর এদের মধ্যে তো অনেক তফাৎ।
কেন?
আমার একটা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল। এদের সেটাও ছিল না। একেবারে শূন্য থেকে উঠে এসেছে। এখন কত সফল সবাই।
ডোরবেল বাজতে নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
বাচ্চারা এখনো বাসায় ফিরে আসেনি।
একটু থেমে বললেন, – বসো।
ঘরের চারিদিকে না চাইলেও চোখ যেতে বাধ্য। সুন্দর, পরিপাটি করে সাজানো। কোথাও বাহুল্যের অভাব মালিকের সুরুচিরই প্রমাণ বেশি করে দেয় যেন।
তুমি বসো। আমি তোমার জন্য একটু নাস্তা নিয়ে আসি।
দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। শরীরের বাঁধন পঁয়ত্রিশের মতো। অথচ বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই করছে।
বিশ মিনিট পর ফিরে এলেন ট্রে হাতে নিয়ে।
ক্যাপুচিনো পছন্দ? আমার খুব পছন্দের।
ট্রের ওপর সুন্দর প্লেটে পাটিসাপটা পিঠা। আর সুন্দর দুটো কাপে ক্যাপুচিনো।
আপনি সব কাজ একা করেন। সমস্যা হয় না?
তা হবে কেন!
বয়স তো একটা ফ্যাক্টর।
আরে পাগল বলে কী! কাজ করি বলেই আমি তো সুস্থ আছি। আমার না আছে ডায়াবেটিস, না আমার রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি। আর আমার বয়সী অন্যদের দ্যাখো তুমি।
পত্রিকায় লিখবেন মনস্থ করে আবার বই প্রকাশের দিকে ঝুঁকলেন কেন?
আমার এক বন্ধু এগিয়ে এসেছিল। ওর প্রকাশনা সংস্থা আছে। সেখান থেকেই আমার সব বই ছাপা হয়।

আপনি প্রেমের গল্প কম লেখেন কেন?
প্রেম তো আর জীবনের সবকিছু নয়। আমি মূলত লিখি মেয়েদের জন্য। ওরা আবেগে চলে। আমি চাই এই আবেগটা থেকে ওরা বেরিয়ে আসুক।
অনেকেরই অভিযোগ, আপনার গল্পে কষ্ট বেশি থাকে।
ঠিক বলেছো এটা। অভিযোগটা সত্যি। কিন্তু দ্যাখো কজন আসলে জীবনে সুখী! সবার জীবনেই কিছু না কিছু দুঃখ আছে।
হঠাৎ হাসি। বাঁধভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়লেন যেন। অনেকটা সময় নিলেন হাসি থামাতে।
বিখ্যাত লেখকদের বই পড়ো। দেখবে তাঁদের গল্প কষ্ট দিয়ে শেষ হয়। আমিও ছোটবেলায় যখন পড়তাম রেগে যেতাম। আর এখন আমার পাঠক আমার ওপর রেগে যায়।
হাসি থামলেও চোখের কোণে এবং ঠোঁটে এখনো সেটার রেশ রয়ে গেছে। আমি এ-সুযোগ হাতছাড়া করিনি। ক্যাম-কর্ডারটা বন্ধ করে দিয়ে মোবাইলে এই হাসির ছবি তুলে নিয়েছি এবং ভিডিও করে রেকর্ডও করেছি। তিনি খেয়াল করেছেন কি না জানি না। সবার অভিযোগ লেখিকা ইশরাত মেহজাবীন হাসেন না। আমি প্রমাণ করে দেবো যে, তিনিও হাসতে জানেন। ওহ্! আপনাদের তো বলিনি, আমি নিরন্তর ডটকমের হয়ে এ-সময়ের বিশিষ্ট লেখিকা ইশরাত মেহজাবীনের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি।
এখনকার সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু বলবেন?
হ্যাঁ। বলা উচিত তো।
আমি উৎসাহ নিয়ে আবার ক্যাম-কর্ডার অন করলাম।
বলুন।
এখনকার সাহিত্য হয়ে গেছে ফেসবুককেন্দ্রিক।
ঠিক বুঝলাম না।
যারা লিখছে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। আর যতক্ষণ বন্ধুবান্ধব বইটা না কিনছে তাদের জোর করছে। এতে করে আসল সাহিত্য আমরা হারিয়ে ফেলছি। – সেটা কী রকম? বুঝিয়ে বলবেন একটু!
দ্যাখো আমার লেখা যদি ভালো হয়, লোকে এমনিতেই আমার বই কিনবে। আমাকে আমার প্রকাশনা সংস্থার স্টলে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হবে কেন!
বইমেলা সম্বন্ধে কিছু বলুন। আগের এবং এখনকার পরিবেশে পার্থক্য কি কিছু আছে?
একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
আছে তো অবশ্যই। আমি একদিন মেলায় এক স্টলে গেছি। দেখি ওই স্টলের একজন লেখক দুঃখ করছেন তাঁর বইটা শেষ হয়ে গেছে তবু প্রকাশকের মাথাব্যথা নেই যে বইটা দ্রুত আনাতে হবে স্টলে।
মেলা সম্বন্ধে আর কিছু …

হুম। আরো বলার আছে। অন্য একটা স্টলে আরেকদিন বসে ছিলাম। সেই স্টলে একজন স্বনামধন্য লেখিকা তাঁর অবজারভেশন শেয়ার করলেন আমাকে। তিনটে থেকে মেলায় বসে ছিলেন ওইদিন। সবাই আসছে হাতে একটা করে লিস্ট নিয়ে। লিস্টটা কিসের? পরিচিত যারা বই বের করেছে তাদের বইয়ের। ওই বইগুলোই শুধু কিনবেন তিনি, সেগুলো ভালো হোক আর না হোক। আমি আমার বাচ্চাদের সবসময় ছেড়ে দিই মেলায়। বলি, ‘তোমাদের যে-বই পছন্দ সেগুলোই কিনবে। কারো অনুরোধে ঢেঁকি গিলবে না।’
তুমি বসো। আমি নামাজটা পড়ে আসি।
কথায়, গল্পে কখন যে এশার আজান দিয়েছে টের পাইনি। তিনি ঠিকই খেয়াল করেছেন। তিনি উঠে গেলেন। আমি ক্যাম-কর্ডার চালিয়ে পুরো ইন্টারভিউটা দেখতে থাকলাম। থেমে যেতে হলো তার হাসির জায়গায় এসে। এই জায়গাটায় আমি কর্ডারটা বন্ধ করে দিয়ে মোবাইল অন করেছিলাম। আবার একই কাজ করলাম। তার হাসির ভিডিও অন করলাম। এই গম্ভীর মানুষটা এরকম হাসতে পারেন! বারবার দেখছিলাম ভিডিওটা। কখন তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি।
অনেকদিন পর হাসলাম প্রাণ খুলে।
আমি নির্বাক। কী বলব! একাত্তরে ছোট্ট দুটো বাচ্চা নিয়ে যাকে বিধবা হতে হয়েছে তাঁর মুখে হাসি আসবে কোথা থেকে!!
তোমাকে আর কিছু দেবো? আমার কাছে ভালো গ্রিন টি আছে।
খেতে লোভ হলো; কিন্তু তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হলো না। বরং সাক্ষাৎকার শেষের দিকে মন দিলাম।
এ-সময়ের সাহিত্য নিয়ে আরো কিছু বলুন।
একটা অপ্রিয় কথা বলি তাহলে।
বলুন।

নতুন যারা লেখা বের করছে, তারা নাকি নিজেদের টাকায় বই ছাপছে। এটা দুঃখজনক। আমরা তো লিখে রয়্যালটি পাই বইয়ের। স্বত্বও থাকে আমাদের নামে। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।
ইন্টারভিউ শেষ হলে উঠলাম। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বের হলাম বাসা থেকে। এর মধ্যে তার ছেলে এবং মেয়ে ফিরে এসেছে। যাদের তিনি বারবার বাচ্চা বলছিলেন তারা মোটেও বাচ্চা নন। একজন কলেজে এবং আরেকজন ভার্সিটিতে পড়েন। ওদের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খেতে হলো।
আমার রান্না কেমন?
খেতে বসে প্রশ্ন করলেন।
বলব?
বলতেই তো বলছি।
এককথায় অসাধারণ!
তিনি থাকেন ধানমণ্ডি। আমি কলাবাগানে। বাসায় ফিরতে বেশি সময় লাগল না আমার। এসেই ইন্টারভিউটা এডিট করে অনলাইনে দিয়ে দিলাম। তারপর একটা ফোন করলাম,
ম্যাডাম দেখেন ইন্টারভিউটা খুব সুন্দর হয়েছে।
আজ পনেরোই ডিসেম্বর। ষোলোই ডিসেম্বরের ঠিক আগের মুহূর্তে একজন বীর নারীর সাক্ষাৎকার ছাপতে পেরে নিজের ভেতর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার। সেটা আনন্দের নাকি বেদনার ঠিক বলতে পারছি না, বুঝতেও পারছি না।
ইশরাত মেহজাবীন ফোনটা পাওয়ার পর অনলাইনে নিরন্তর ডটকমের ওয়েবসাইট ওপেন করলেন। সাক্ষাৎকার দেখতে এবং শুনতে শুনতে হঠাৎ সেই হাসির রেকর্ডের জায়গায় এসে থমকে গেলেন। তারপর ব্যালকনিতে গেলেন। রেকর্ড চলতেই থাকল। আকাশের দিকে তাকালেন। কোন তারাটা ইশতিয়াক! জানেন না। তবু বললেন,
দ্যাখো, তুমি আমাকে আমার হাসি দেখে পছন্দ করেছিলে। আজ আমার সেই হাসি এতদিন পর ফিরে পেয়েছি।

মায়ের ঘরে হাসির আওয়াজ পেয়ে ইফতি আর ইভা দুজনেই সে-ঘরে গেল। কিন্তু মা তো ঘরে নেই। কোথায় গেল? আর এত হাসছেই বা কে! হঠাৎ দুজনেরই ট্যাবটার দিকে দৃষ্টি গেল। ওটায় মায়ের সাক্ষাৎকার বেজে চলেছে। মা হাসছে! এত সুন্দর লাগে ওদের মাকে হাসলে! ওদিকে ব্যালকনিতে আকাশে ইশতিয়াককে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে কেবল ঘুরে ঘরে ঢুকতে যাবেন, অমনি খেয়াল করলেন তাঁর দুই কাঁধে দুটো কচি মুখ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত