যুদ্ধশিশুর মুজিব-আকাশ

তিন দিন ধরে রায়ানের মন খুব খারাপ। স্কুলে গিয়েও মন খারাপ থাকে। ক্লাসে মন বসাতে পারে না। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলা হয় না। ভাবে, ওর জীবনের গল্পটা ওদেরকে শোনানো দরকার। এখন চুপচাপ থাকাই ভালো। কিন্তু বাড়িতে আসার পরে দিনের বাকি সময় মনে হয় দাউদাউ পুড়ছে। কখনো দু-হাতে চোখের পানি মোছে। চোখের পানি লুকিয়ে মোছে, যেন কেউ দেখতে না পায়।

আজ সকালে মা-মেরীকে বলেছিল, আমার একটা গল্প আছে বলেছ। গল্পটি আমাকে শোনাবে, কিন্তু শোনাচ্ছ না কেন? আমি প্রতিটি মুহূর্ত গল্প শোনার অপেক্ষায় আছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে গল্প শোনার অপেক্ষায় থাকতে। – গল্পটা বলার জন্য আমরা রেডি হচ্ছি। নিজেদের শক্ত করছি।
কেন? তোমাদের রেডি হতে হবে কেন? গল্পটা কি খুব খারাপ?
বলতে পারো খুব খারাপ। নইলে বলতে পারো গল্পটা এক নিষ্ঠুর সত্য।
নিষ্ঠুর সত্য! এমন নিষ্ঠুর সত্যগল্প আমি শুনব না।
না না, তোমাকে শুনতেই হবে। আমরা তোমাকে কোনো মিথ্যা ধারণায় বড় হতে দিতে চাই না। তোমাকে তোমার আইডেনটিটির কথা জানতে হবে।

কী বললে, আইডেনটিটি? তোমরা আমাকে শিখিয়েছ যে মা-মেরী আর বাবা-জন বলে ডাকতে। সেদিন আমার মনে হয়েছিল যে, আমার বন্ধুরা তো কেউ বাবা-মাকে নাম ধরে ডাকে না। তাহলে আমি ডাকি কেন?

আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার জন-বাবা বাড়িতে ফিরলে আজকেই তোমাকে গল্প বলব।
বাবা-মায়ের কাছ থেকে নতুন গল্পটি শোনার পরে রায়ান একছুটে বাইরে চলে আসে। ভাবে, যেটুকু শুনেছি এটুকুই যথেষ্ট। এর বেশি কিছু শোনার দরকার নেই। এই ভাবার সময় বুকের ভেতর হাঁফ ধরে। বুঝতে পারে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ও দু-হাতে বুক চেপে ধরে বাড়ির পেছনের বাগানে আসে। ছোট ফুলগাছ যেখানে আছে, সেখানে গিয়ে ঘাসের ওপরে বসে পড়ে। স্নিগ্ধ রোদ ওর গায়ে পরশ দিচ্ছে। ও দু-হাতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, আমার জন্য নতুন সূর্য উঠেছে।

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর হাঁফ-ধরা বুক স্বাভাবিক হয়ে যায়। ও ডানদিকে ঘুরে গোলাপ ফুলের ওপর নাক লাগিয়ে জোরে শ্বাস টানে। গোলাপের সৌরভে ওর বুক উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। বাগানের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে বলে, এই সূর্য আমার। আর কারো নয়। আজকে আমি এক অন্য জীবনের পায়ের আওয়াজ শুনেছি।

সে-জীবন ছিল যুদ্ধদিনের গল্প। না, না গল্প না। সত্যি ঘটনা।
পরক্ষণে হা-হা করে হাসে রায়ান। একসময় হাসি থামিয়ে বলে, সত্যি ঘটনার নতুন জীবন। এই জীবনে আমার আর কোনো সূর্য নাই। সূর্যের কাছ থেকে অদৃশ্য শব্দ ভেসে আসছে। বলছে, যোদ্ধা তুমি একটা সোনার ছেলে।

যোদ্ধা? আমার নাম তো যোদ্ধা না। বাবা-মা আমাকে রায়ান বলে ডাকে। আমার নাম রায়ান ম্যাকওয়ে।

তোমাকে জন্ম দেওয়া মা তোমার নাম যোদ্ধা রেখেছিল। বলেছিল, ও আমার যুদ্ধের সন্তান।
রায়ান হা-হা করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, আমি যুদ্ধের সন্তান, যুদ্ধের সন্তান।
হাসতে হাসতে ও বাগানের চারদিকে দৌড়ে আসে। গোলাপ ফুলের কাছে বসে পড়ে নাক রাখে ফুলের ওপর, তোমার ফুলের গন্ধ সবাই ভালোবাসে। তুমি আমার শরীরে তোমার চমৎকার গন্ধ সবসময় ছড়িয়ে রাখবে। কেউ যেন আমাকে ঘৃণা না করে গোলাপ।
এখানে সবাই তোমাকে ভালোবাসে। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার তোমার শহর।
আমার শহর কী?
নিঃশব্দ হয়ে যায় রায়ান। মনে হয় চারদিকে কেউ নেই। শুধু নতুন সূর্য ওর পাশে আছে। রায়ান দু-হাতে মাথা চেপে ধরে। বলে, নতুন সূর্য তোমার কথা শেষ হয়নি। কথা শেষ কর। বলো, ভ্যাঙ্কুভার আমার শহর কেন? আমার জন্ম তো এখানে হয়নি। মা-মেরী আমাকে বলেছেন।
জন্ম হয়নি ঠিক, কিন্তু তুমি এখন এই দেশের বাসিন্দা। কানাডার নাগরিক।
বাবাও তাই বলেছেন।
ঠিক আছে এখন আর কথা বলব না।
রায়ান বলে, টা-টা। গুডবাই।
কোনো অদৃশ্য কণ্ঠ ভেসে আসে না।
রায়ান আবার বলে, তুমি তো আমার বন্ধু নতুন সূর্য। আমার জীবন ধন্য করেছ।

অদৃশ্য কণ্ঠ আর ভেসে আসে না। রায়ান গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ টেনে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকে। রোদের তাপ বেড়েছে। ভেবেছিল চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু হলো না। চোখ বন্ধ হয়ে যায়। রোদের তাপে চোখ খোলা যায় না। ঘাসের বুকে শুয়ে মাটির গন্ধ নিশ্বাসে টেনে বলে, তুমি কি আমার বাংলাদেশ?

অদৃশ্য কণ্ঠ বলে, কেমন করে বাংলাদেশ হব। এটা তোমার স্বপ্নের ভূমি। তুমি ঘাসের ওপর চোখ লাগিয়ে দেখো, কি শব্দ পাও?
রায়ান জোরে জোরে বলে, তুমি কি আমার বাংলাদেশ?
না, না, আমি তোমার বাংলাদেশ না। আমি কানাডা। আমি তোমার প্রতিপালক। বিশ্বের আরেক প্রান্তে বেঁচে থাকার জন্য এই দেশে নিয়ে এসেছেন তোমার এখনকার বাবা-মা।
কেন নিয়ে এসেছেন?

তাদের নিজের সন্তান নেই তো সেজন্য তোমাকে মানবসন্তান হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছেন।
রায়ান দাঁত খিঁচিয়ে বলে, কিসের অধিকার? আমাকে বেঁচে থাকার ভালোবাসা দিয়েছেন।
তুমি যাতে ঠিকমতো বেঁচে থেকে বড় হতে পারো – এটাই তোমার জন্য করা হয়েছে। বড় হয়ে সুন্দর মানব-জীবন পাওয়া তো তোমার অধিকার। নইলে মানুষেরা তোমার গায়ে থুতু ছিটাত।
তুমি খুব বাজে কথা বলছ কানাডা। তোমার মাটির ওপর শুয়ে আমি এমন কথা শুনতে চাই না। তুমি চুপ করে থাকো কানাডা।

রায়ানের মনে হয় চারদিক নিশ্চুপ হয়ে গেছে। বাতাস বইছে না। ঘাসের ভেতরের পোকাগুলো শব্দ করছে না। পাখি ডাকছে না। গাছের শুকনো পাতা ঝরছে না। এই মুহূর্তে ওর চারপাশে মায়াবী অন্ধকার নেমে এসেছে। ও ভালোলাগার আবেশে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। তখন নতুন সূর্যের কণ্ঠ ভেসে আসে, তুমি তো একা সোনার ছেলে নও বন্ধু। আমার আরো বন্ধু আছে। তাদের আমি দিনের আলো দেখাই। দিনের তাপ দিই।

থেমে যায় রায়ানের নতুন সূর্যের কণ্ঠ। একটুক্ষণ চুপ থেকে বলে, হ্যাঁ, তাই তো যে-ঘটনায় আমার জন্ম, এমন জন্ম তো অনেকেরই হবে। হবে না কেন? শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য এটা একটা অস্ত্র। শত্রুর এই অস্ত্রে আমাদের জন্ম।

রায়ান স্তব্ধ হয়ে যায়। নিশ^াস ফেলাও কঠিন কাজ হয়ে যায় ওর কাছে। বাবা ওকে এমন কথাই বলেছে। বলেছে, পৃথিবীর সব দেশে এমন ঘটনা ঘটে। তুই দুঃখ পাবি না সোনার ছেলে। তোকে পেয়ে আমাদের জীবনে শান্তি এসেছে। তোকে আমরা ইচ্ছা করে এই কথা বলেছি। না বললে, তোর কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থাকতাম।
তাহলে আমার দেশ কোথায়?
তুই তো কানাডার নাগরিক।
কিন্তু আমি তো তোমাদের মতো নই।
আমাদের মতো তো হবি না। তোর মায়ের মতো তুই হয়েছিস।
তাহলে আমি মাকে খুঁজতে বাংলাদেশে যাব।
হ্যাঁ। যাবি। এজন্য তোকে তোর জন্মের কথা বলেছি। তোর সামনে শুধু মা আছে। বাবা নেই।
চাই না এমন বাবা। শয়তান একটা। আমি তোমাদের মতো বাবা-মা পেয়েছি। আমি জীবনে দাঁড়াতে পারব। আমি কবে যাব জন্মদাত্রী মাকে দেখতে?
তোর স্কুল ছুটি হলে। আমরাও যাব তোর সঙ্গে। আমরা তোকে একা ছাড়ব না।
তোমরা গেলে আমি খুব খুশি হব।
বাহ্ সুন্দর করে বললি। তুই আমাদের খুব ভালোলাগার ছেলে।
দুজনে হো-হো করে হাসে বেশ কিছুক্ষণ। হেসে দুজনে থেমে যায় একসঙ্গে। রায়ান দুচোখ ভরে জন আর মেরীর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসির শব্দ নিজের বাজানো গিটারের শব্দ হয়ে ওর চারদিকে ঘুরপাক খায়। ওর দৃষ্টি তাদের চেহারায় আকাশ নেমে আসতে দেখে। তাদের হাসিতে মনে হয় কোথায় যেন ঢোলের মতো বাজছে। মানুষ জড়ো হয়ে নাচছে।

অদ্ভুত তো! হঠাৎ করে ওর চারদিকে শব্দের জলপ্রপাত মনে হয়। ওর বাবা-মা তিন বছর আগে ওকে নায়েগ্রা জলপ্রপাত দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকা নয়, কানাডার দিকে যেটা আছে সেটা। জলপ্রপাতের শব্দে ও অভিভূত হয়েছিল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমাকে এখানে থাকার সুযোগ করে দাও। আমি রাত-দিন জলপ্রপাত দেখব। এক মিনিটও মিস করব না। তাহলে আমার এখানে আসার সময় পূর্ণ হবে। আমি সবটুকু দেখেছি মনে হবে।

মেরী ওর কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, আমার ছেলেটা কবি হবে। ওর বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা কবিতার শব্দ পেয়েছি আমি।
মা আমি শুধু কবিতা লিখব না। গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ সব লিখব।
আবার হা-হা করে হেসেছিল জন আর মেরী। হাসি থামলে বলেছিল, আমাদের ছেলেটার স্বপ্ন অনেক বড়। ও বড় কিছু হবে।
হতে পারব বাবা? আমি যে যুদ্ধশিশু।
খবরদার এমন কথা বলবি না।
বলবই তো। না হলে আমি এখানে বাস করছি কেন বাবা? তোমরা আমার বাবা-মা কেন? আমি ইংরেজিতে কথা বলি কেন?
সব ঠিক আছে। এসব কথা বলবি না।
মেরী ধমকের স্বরে কথা বলে। রায়ান নিজেও বুঝতে পারে যে মা-মেরী ভীষণ রেগে গেছে। মুহূর্ত সময় মাত্র। রায়ান দু-হাতে মেরীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মায়ের জামায় দ্রুত মুখ মুছে বলে, তোমরা আমার বেঁচে থাকা –
চুপ কর বলছি।
মা ওকে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিল।
সেবার ছোট একটি হোটেলে রেখেছিল ওকে সাতদিনের জন্য। ও একা একা মনের আনন্দে জলপ্রপাত দেখেছিল। এখনো সেই স্মৃতি ওর কাছে আনন্দের জলপ্রপাত হয়ে আছে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে জলপ্রপাতের শব্দ শুনতে পায় ও। মনে হয় বেঁচে থাকা এমনই সত্য। সেই সত্য ওর মনে দু-পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে যায়। ও শুনতে পায় জন আর মেরীর কণ্ঠস্বর, আজ তোমাকে একটি নতুন কথা বলব। এটা তোমার জানা দরকার। নইলে তোমার সঙ্গে আমাদের অন্যায় আচরণ করা হবে।
তোমরা আমাকে খুব ভালোবাস। তোমাদের ভালোবাসায় আমি বড় হয়েছি। আমার মনে হয়েছে তোমরা আমার নতুন সূর্য। এই সূর্য আর কারো না। আমার একার।
নতুন সূর্য! বাহ্, বেশ গুছিয়ে কথা বলেছিস।
মেরী ওর মাথার ওপর হাত রেখে বলে, আমার মনে হচ্ছে তুই কবি হবে। ছোটবেলা থেকে তুই এভাবে কথা বলছিস।

রায়ান ওদের দিকে আঙুল তুলে বলে, দুজনকে নিয়ে একটা সূর্য। কেউ পাবে না এই সূর্যের রোদ।
জন আর মেরী আবার হা-হা করে হেসেছিল। হাসি থামলে রায়ান বলে, সূর্য কখনো কখনো জলপ্রপাত হয়। কখনো রোদ। কখনো পানি। দুটোই আমার জন্য খুব দরকার। শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো দরকার।
আবার ঘর মাতিয়ে হাসে দুজনে। মেরী বলে, আমরা এত হাসছি কেন জানিস?
না, জানি না। কেমন করে জানব।
তোর মা তোর জন্য একটা উপহার দিয়েছিল।
উপহার!
রায়ানের দুচোখ বিস্ফারিত হয়।
উপহার! কী উপহার?
তোর মায়ের সোনার কানের ফুল। নিজের কান থেকে খুলে দিয়েছিল। বলেছিল, ও বড় হলে এটা ওকে উপহার দেবেন।
কই দেখি? কানের ফুল তো আমার কানের ফুল হবে না।
হ্যাঁ, তুই কানে লাগাতে পারবি না। স্মৃতি হিসেবে রেখে দিবি। তোর বউকে উপহার দিয়ে বলবি –
না, আমি বিয়ে করব না। যুদ্ধশিশুকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। কারণ আমি কারো সঙ্গে মিথ্যা কথা বলতে পারব না। বিশেষ করে তার সঙ্গে যাকে আমি ভালোবাসব।
জন-মেরী আবার হা-হা করে হাসে। হাসি থামিয়ে মেরী বলে, তা হলে কানের ফুল আমার কাছেই থাকুক। দেখি ফুলের ব্যবহার করার সমাধান আসতে তোর কতদিন লাগে।
বেশি দিন লাগবে না। আই লাভ ইউ, বলার আগেই সমাধান হবে।
ওয়াও … ওয়াও … ওয়াও …
দুজনে একসঙ্গে সুরের মতো করে শব্দটি উচ্চারণ করে। রায়ান হাততালি দেয়। জন-মেরী বলেছে, ওর শৈশব-কৈশোর শেষ হয়েছে। ও আঠারো বছর বয়স পার করেছে।

ও হাততালি দিতে দিতে বলেছে, এখন থেকে আমার মাতৃভূমির জন্মের সঙ্গে আমারও জন্মের সালের মিল হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে আমার জন্ম, বাংলাদেশের বিজয় দিবসও ডিসেম্বর মাসে।
হা-হা-হা আবার তুমুল হাসি ছড়িয়ে যায় ঘরজুড়ে। জন আর মেরী তাকিয়ে থাকে পালক ছেলের দিকে। আনন্দে-উল্লাসে ও হাসছে। হাসি থামিয়ে জন বলে, তোমার জন্য আমাদের আর একটি গল্প আছে।
এ-গল্প শুনেও কি আমি দুঃখ পাব?
না, এ-গল্প শুনে তোমার গর্ব হবে।
হুর রে … । গর্ব … গর্ব। গর্ব নিয়ে আমি ঘরে থাকব না। আমি বাইরে গিয়ে ঘুরে আসি।
রায়ান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, আমি যুদ্ধশিশু। আমার গল্পে গর্ব আছে। গর্বের গল্প শুনতে আমি অপেক্ষা করব না। আজই শোনা দরকার।
এটা অনেক বড় গল্প। একদিনে শোনা শেষ হবে না। আমরা আমাদের সময় নিয়ে বলব।
আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা খুশিমনে আমাকে বলবে। তা হলে আমার আনন্দ দ্বিগুণ হবে। আমি আসছি।

রায়ান বাড়ির বাইরে চলে আসে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস টানে। ভাবে গর্ব করা ঘটনা শোনা হলে ওর যুদ্ধশিশু হওয়ার অপরাধ ঘুচে যাবে। ও তালি বাজিয়ে ফুটপাথে হাঁটতে থাকে। বুকের ভেতরে গর্ব শব্দ নায়েগ্রা জলপ্রপাত হয়ে গেছে। অনবরত প্রবল তোড়ে গড়াচ্ছে। ও দু-হাত তুলে শরীর দোলায়। নাচের ভঙ্গিতে খুশির জয়গান ওর প্রিয় অভ্যাস। একটু পরে ফুটপাতের এমাথা-ওমাথা দৌড়ে আসে। রাস্তায় গাড়ি আছে, কিন্তু ফুটপাথে কেউ নেই। নিজেকে বলে, এভাবে নিজের গর্বের সবটুকু পাওয়া আমার ভাগ্য। আমি ভাগ্যবান ছেলে। আমাকে কেউ যুদ্ধশিশু বললে আমি বলব আমি মানবশিশু। আমার দিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকিও না। আমি দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নের সঙ্গে মিশে আছি। আমার মাঝে আলাদা কিছু খুঁজতে যেও না। মনে রাখবে এসবই যুদ্ধের সত্য।

তখন দুজন লোক ওর দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা দূর থেকে দেখছি যে তুমি একা একা কথা বলছ।
আমি তো একা না। পুরো দেশ আছে আমার সঙ্গে।
বাব্বা, তুমি তো একটা সাবাস ছেলে। তোমার দেশ কোথায়?
এখন, আমি কানাডার নাগরিক। আমার দেশ বাংলাদেশ।
ওহ্, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। আমরা তোমাদের গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জানি। তোমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য তিনি একজন হীরার মানুষ। কারো সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে না। তোমাদের বাস্টার্ড লোকেরা তাঁর পরিবারসহ তাকে হত্যা করেছে।
হত্যা করেছে? তিনি বেঁচে নেই?
নেই, নেই!

দুজন লোক হাত নাড়াতে নাড়াতে চলে যায়। রায়ান দাঁড়িয়ে থেকে তাদের চলে যাওয়া দেখে। ওরা দুবার পেছন ফিরে তাকায়। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়ে। রায়ানও হাত নাড়ায়। এই দুজন মানুষ ওকে একটি বড় তথ্য দিয়েছে। বাবা-মাও হয়তো এই সোনার মানুষকে নিয়ে গর্বের গল্প ওকে বলবে। ঠিক তো? নিজেকে প্রশ্ন করে ও দমে যায় না। ভাবে এখনই বাড়ি ফেরা দরকার। বাবা-জনকে বলবে, আজ আমাকে আমার গর্বের গল্প বলো।

এতকিছু ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় রায়ান। গেট খুলে বাগানে ঢুকলে দৃশ্যপট বদলে যায়। মেরী-মায়ের নিজের হাতে যতœ করা গাছগুলো বিভিন্ন রঙে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মনে হয় প্রতিটি ফুলের মাঝে একটি চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। চেনা যায় না সে-চেহারা। ওর দেখা কোনো চেহারা নয়। কোনো কোনো ফুলে মধুর হাসি ছড়িয়ে থাকে। কোনো কোনো গাছের পাতায় একটি তর্জনী।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। দরজায় দাঁড়িয়ে জন-বাবা বলছে, ঘরে আয় সোনা। কী করছিস দাঁড়িয়ে?
ও দ্রুতপায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে মাথার ঝিমঝিম ভাব কেটে গেছে। ও হাসিমুখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আমাকে গল্পটা বলবে না?
বলব, আয় ঘরে আয়। তোর জন্য একটি ছবি খুঁজে বের করেছি।
কার কথা বলবে?
যার ছবি বের করেছি তার কথা। নে, এই যে দেখ। এই ছবিটা হাতে নিয়ে তোকে গল্পটা বলব বলে তোর কাছ থেকে আমরা সময় নিয়েছি।
দাও, দাও। আমার গর্ব দাও।
রায়ান নিচে বসে জন-বাবার হাঁটুর ওপর মাথা রেখে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। জন বলতে শুরু করে, তোমাকে গ্রেট লিডারের চেহারাটা বোঝানোর জন্য ছবি খুঁজে বের করেছি। মনোযোগ দিয়ে তাঁকে দেখো। তিনি বাঙালি জাতির গর্ব। নিজে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। কোটি কোটি মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করেছেন। তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে তোমার দেশ। আমরা তোমার মতো যুদ্ধশিশুদের বিদেশে এনে বড় করেছি। মানবিক অধিকারের মর্যাদায় তাদের মর্যাদা দিয়েছি। আজ তোমার হাতে তাঁর ছবি তুলে দিলাম।

ঠিক করেছ, ঠিক করেছ। আমি আমৃত্যু তাঁর ছবি বুকের পৃষ্ঠায় গেঁথে রাখব। তিনি আমার জীবনের নতুন আকাশ। তাঁকে ছুঁয়ে আকাশে সূর্য উঠবে, চাঁদ উঠবে। আমি মেরী-মাকেও এ-কথা বলব।
রায়ান দ্রুত জন-বাবার হাঁটুর ওপর চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
আমি আমার নতুন আকাশ দেখতে যাচ্ছি। এই আকাশ শুধুই আমার। শুধুই আমার। এই আকাশের পূর্ণিমা-অমাবস্যা কেউ পাবে না। কেউ না। আমার বুকের এই গাঁথুনি কেউ টেনে নিতে পারবে না। তিনি আমার মুজিব-আকাশ।

দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসে রায়ান। শুনতে পায় অদৃশ্য কণ্ঠস্বর, কেমন আছিস রে ছেলে?
ভালো আছি। তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ। আমি আমৃত্যু তোমাকে নিয়ে চলব। যেখানেই থাকি তুমি আমার বুকের গভীরে পূর্ণিমার আকাশ হয়ে থাকবে। তুমি আমার নতুন আকাশ। তুমি আমাকে আলো দেবে, মায়াবী অন্ধকার দেবে। আমার জীবন ধন্য হবে।

থেমে যায় কণ্ঠস্বর। রায়ান বাগানের গোলাপগাছের কাছে এসে দাঁড়ায়। সব ফুলের গন্ধে আমি তোমার মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। কোনো একটি ছোট পাপড়িও তোমার রঙের ছবি ভাসিয়ে রেখেছে তাদের দেয়ালে। তুমি আমার সামনে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ সবকিছু। অমাবস্যার রাতে তুমি আমার মায়াবী অন্ধকার। তোমার পায়ে আমার মাথা ঠেকিয়ে রাখব।
মেরী দরজায় এসে দাঁড়ায়।
রায়ান তোর জন্য পুডিং বানিয়েছি। আয় খাবি।
রায়ান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। মেরীর ডাকের উত্তর দেয় না। মেরী বুঝতে পারে ওর ভেতর কিছু একটা কাজ করছে। ওর সঙ্গে অদৃশ্য কারো এখন গভীর সম্পর্ক।
তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস?
রায়ান উদ্ভাসিত মুখে তাকিয়ে বলে, মুজিব-আকাশের সঙ্গে কথা বলছি। তোমরা আমাকে মুজিব-আকাশকে চিনিয়েছ। মেরী-মা, তোমাদের কাছে আমি ঋণী।
এসব কথা বলবি না। আয় পুডিং খাবি।
মুজিব-আকাশ কি খেতে ভালোবাসত?
আমি জানি না। তোর যা ভালোলাগবে সেটাই খাবে। আয়।
রায়ান দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।
ভেসে আসে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর – তুই যে-জীবন পেয়েছিস এটা তোর পুণ্যের জীবন। বাবা-মাকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখবি। নিজের দেশ, দেশের মানুষের কথা ভাববি।
একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পায় মুজিব-আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে আছে। সবখানে তার মুখচ্ছবি। গোলাপের সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। নিশ্বাস নিলে বুক ভরে যায়।
মেরী ওর হাত টেনে বলে, আয় সোনা। ঘরে চল।
আমি মুজিব-আকাশ দেখছি।
তোর জন্য ঘরেও মুজিব – আকাশ থাকবে। তুই যে তাঁকে বুকে নিয়েছিস।
রায়ান মেরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, মুজিব-আকাশে তোমরা আমার নতুন সূর্য। বাবা আমার নতুন চাঁদ। আমার মুজিব-আকাশে তোমরা চাঁদ-সূর্য। যাই জন-বাবাকে ডেকে আনি। তুমি এখানে দাঁড়াও মেরী-মা।
রায়ান ঘরে ঢোকার আগেই জন বেরিয়ে আসে।
তোমরা কী করছ বাইরে?
তুমি আমাকে যে-ছবি দিয়েছ সেই ছবি এখন আমার মুজিব-আকাশ। সেই আকাশে তোমরা আমার চাঁদ-সূর্য।
জন-মেরী প্রাণখোলা হাসি হাসে। দুজনের হাসিতে জলপ্রপাতের শব্দ পায় রায়ান। বুঝতে পারে এই জলপ্রপাত আনন্দের। এটা বুকে রেখে ও অনবরত মুজিব-আকাশ দেখবে। কোথাও তা হারাবে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত