সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম,খালা খিচুড়ির প্লেট আমার টেবিলে রেখে দিয়েছে। মৃদু হাসলাম,” খালা হয়তো জানেই না আজকে মাসের ষোল তারিখ “প্রত্যেক মাসের ষোল তারিখ থেকে আমার মিল বন্ধ হয়। বাবার টাকায় মাসের প্রথম পনের দিনের মিল খরচ হয়।পরের পনের দিন টাকা না থাকার কারনে আমার মিল বন্ধ থাকে। বাইরে খাওয়া দাওয়া করি। খিচুড়ির প্লেটটা নিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখলাম, খালা দুপুরের রান্নার জন্য মাছ কাটছে। বললাম খালা আজকে আমার মিল বন্ধ আন্টির বাসায় দাওয়াত আছে একটু পর যাব। খালা একটু হেসে বলল: একটু পর যাবেন সমস্যা নাই।দাওয়াত তো মনে হয় আফনারে দুপুরে দিছে তয় সকালের টা খাইয়্যা লন। হাসি দিয়ে বললাম খালা কাল রাতেই মিল বন্ধ করে দিয়েছি। খালা কিছু বলার আগেই প্লেটটা রেখে রুমে চলে আসলাম।
আমার তেত্রিশ শ দশ মডেলের মোবাইলটা অন করে দেখলাম নয়টা বাজে। আসলে মেসে আসার আগে আমার মা দুইটা মুরগি বিক্রি করে পাঁচশ টাকা দিয়ে শরীফ চাচার পুরনো মোবাইলটা কিনে দিয়েছিল। হাতে প্রথম মোবাইল পেয়ে আমি তো তীব্র উত্তেজনায় সেই রাতে ঘুমুতেই পারিনি।অঁজপাড়া গাঁয়েই ছেলে আমি।এস এস সি পরিক্ষায় ভাল রেজাল্ট করেছি তাই বাবা ভর্তি করে দিছে শহরের নাম করা কলেজে। মেসে থাকলে ছেলের সাথে যোগাযোগের জন্য যে মোবাইল কিনে দিয়েছিল সেই মোবাইল ই আমার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার চাইতে কোন অংশে কম ছিল না। যাক সে কথা। কাল বুদ্ধি করে দশটাকার ছোলা কিনেছিলাম।রুমের সম্বল বলতে ঐ টুকুই।সেখান থেকে কয়েকটা বাটিতে করে রাতে ভিজিয়েছি। এখন খাব।
বাড়িতে থাকতে দেখেছি বাবা খুব ভোরে মাঠে কাজ করতে যেত।এত সকালে বাসায় তেমন কিছুই থাকত না। মা আমার জন্যে ভাত রান্না করত দশটার আগে।খেয়ে স্কুলে যেতাম আমি। আর বাবা কাগজে করে একমুঠো চাল নিত।মাঠে কাজ করতে করতে ক্ষুধা লাগলে সেই চাল চিবিয়ে পানি খেতেন। ভাত খেতেন দুপুরে বাড়ি এসে। বাবার কাছে ব্রেকফাষ্ট মানেই ছিল কয়েকটা চাল আর পানি। বাবার কড়া নির্দেশ ছিল আমার প্রতি যেন সকালে খালি পেটে না থাকি।কিছু খেয়ে যেন পানি খাই। মেসে তো আমার কাছে চাল নেই তাই বুদ্ধি করে মাসের পনের তারিখে দশটাকার ছোলা কিনে রাখি। সকালে দুচারটা ভেজা ছোলা খেয়ে আমার খুব ভালোভাবেই চলে যায় ।
তাছাড়া পত্রিকায় দেখছিলাম: “ভেজা ছোলা সকালে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী” যাইহোক মেসে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।মেসের সব ছাত্ররা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কিন্তু খালা এসে দেখলে আবার বলবে এখনও যাওনি?”সকালের টা খেয়ে যাও” খালা আসার আগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে। ভাবলাম এখানে আমার এক দুঃসম্পর্কের মামা আছে।গেলে ভালোয় আদর যত্ন করে।আজকে গেলে অন্তত দুটো দিন কেটে যাবে।কারন মামা ভালো করেই জানে,আমাদের অবস্থা তাই খাওয়ানোর পর খাবার বেঁধে দেয়। ঐ মামাকে ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিলাম, মোবাইলটা আর অন হচ্ছে না। চার্জ শেষ,” সমস্যা ব্যাটারি তে চার্জ থাকে না নতুন একটা কিনতে হবে” বাবা কয়মাস আগে বলেছিল:বাজান ধান উঠলে তোরে একটা নতুন ফোন কিইন্যা দিমু। ধান আর উঠেনি।সর্বনাশা বন্যায় ধানের সাথে সাথে আমার মোবাইলটা ও তলিয়ে গেছে পানির নিচে।
চার্জ দিয়ে মোবাইল অন করে মামাকে ফোন দিলাম ফোন ধরল না। কোন উপায় না দেখে বাইরে বেরিয়ে পরলাম।হেঁটে হেঁটে পার্কে গেলাম। টুলের উপর বসে থেকে সময় কাটছে। বিকেল বেলা ক্ষুধায় পেট অধিক যন্ত্রণা শুরু করে দিল। পকেটে কালকের বাজারের রিকশাভাড়া ছিল। আসলে নিয়ম হল:বাজার করতে যেতে এবং আসতে রিকশা নিতে হয়।সবাই রিকশায় যায় । আমি হেঁটে গিয়েছি এবং হেঁটে এসেছি বাজার নিয়ে । ঐ সম্বল নিয়ে সামনে একটা খাবারের হোটেলে ঢুকলাম। খাবারের দাম হল: এক প্লেট ভাত দশটাকা,ডাল পাঁচ টাকা।মাছের সবজি পনের টাকা। আমি এক প্লেট ভাত আর ডালের অর্ডার করতেই হোটেলের মালিক বলল শুধু ভাল আর ডাল বিক্রি হয় না সাথে সবজি নিতে হবে।
একটা হাসি দিয়ে চলে আসলাম।আসলে আমার কাছে আছে মোট বিশ টাকা। পার্কে এসে বসছি এমন সময় এক পিচ্চি এসে বলল ভাইয়া বাদাম নেন।সারাদিন কিছু খাই নি।দশটাকার বাদাম কিনে চিবুতে থাকলাম। আশেপাশের ছেলে মেয়েরা দামি দামি বার্গার পিজ্জা খাচ্ছে ।আমি এসব খাই না আসলে খাওয়ার ইচ্ছে জাগলেও ভাবি আমার পেটে এসব সহ্য হবে না, হয়তো ডায়রিয়া বাধতে পারে। চিন্তার ছেদ ঘটল,এক ছোট ছেলের আওয়াজে।অনবড়ত বলেই চলছে ভাইজান কিছু দেন।ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি।বাসায় মা অসুস্থ । পকেটে হাত দিয়ে বাকি দশটাকা ছেলেটাকে দিয়ে দিলাম।মনের আনন্দে চলে গেল আর আল্লার কাছে দোয়া করল আমার জন্য ।
অনেক আনন্দ লাগল নিজের।আসলে দশটাকা দিয়ে হয়তো ওর তেমন উপকার হবে না।কিন্তু আমার তো দশটাকায় ছিল শেষ সম্বল।মুখের হাসিই বলে দেয় কত খুশি সে! এরাই আমার অনুপ্রেরণা।রোজ বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাই এদেরকে দেখেই।এত সংগ্রাম করে বাঁচার জন্য ।এদের কাছে আমার সংগ্রাম কিছুই না। আমার মতো পড়ালেখার সুযোগ পেলে দেশের জন্য ভালো কিছু করত। এদের দুঃখ কষ্ট আনন্দ সহজেই অনুভব করতে পারি। সন্ধ্যায় চলে আসলাম মেসে।অনেক পানি খেয়ে ক্ষুধাকে আপাতত দমিয়ে রেখেছি। এশার আজান দিলে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম।নামাজ শেষ করতেই মসজিদে ঘোষনা দিল: তাবারকের ব্যাবস্থা আছে দয়া করে কেউ উঠবেন না। ঘোষনা শুনে চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে আমার। খাওয়া শেষ করে সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতায় সেজদায় লুটিয়ে পরলাম।
মনে পড়ল আল্লাহর কথা “আমি রিজিকদাতা””প্রত্যেকজীবের রিজিকের ব্যাবস্থা আমি করি” মেসে এসে ভাবলাম: মানুষ মোহে পরে এত খারাপ কাজ করে অথচ একদিন সবকিছু ফেলে হারিয়ে যাবে অন্ধকার এক জগতে। বাবা তো আমাকে অর্ধেক টাকা দিতে পারে কিন্তু আমার চাইতে হাজার হাজার মেধাবী ছেলেরা আছে যারা টাকার অভাবে লেখাপড়ায় করতে পারে না। আমি তো অনেক ভাল আছি।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে ঘুমিয়ে পরলাম।
গল্পের বিষয়:
গল্প