রাত ১১টা। হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে দেখি সে আবার কল দিয়েছে। এ নিয়ে চতুর্থবার হলো।আমি কল ধরবো না।মোবাইলটা বিছানায় পাশে কাঠের টেবিলে রেখে দিলাম, ঘড়িটা রাখলাম টেবিলের ড্রয়ারে। ড্রয়ারে অনেককিছুই এলোমেলো ভাবে পরে আছে। শুধু গোছানো আছে একটা কয়েক বছরের পুরনো ডায়রী আর তার ভিতর একটা তার নষ্ট হতে থাকা ছবি।যা ছুঁয়ে দেখি না আমি, অধিকার নেই যে। আর এখন এতো বছর পর ইচ্ছে নেই তার আওয়াজ শুনে পুরনো মায়া বাড়ানোর। এক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল আমার ইচ্ছের তোয়াক্কা না করেই।সে একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে- ভালোবাসা খুব কাঁদায়।হৃদয় ভাঙ্গে, যন্ত্রণা দেয় তবে প্রাপ্তি দেয় না সর্বদা। ভাবনার ঘোর কাটল- সে আবার কল দিয়েছে। এইবার আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না- ফোনটা রিসিভ করলাম। অপর পাশ হতে চিরচেনা সেই কন্ঠ-
– মুহূর্ত?
আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এতো বছর পর তাঁর মুখে আমার নাম আবার শুনলাম।আমার কান্না বাদ মানছে না।এ কথা মিথ্যে যে পুরুষরা কাঁদতে জানে না। সবচেয়ে কাছের কিছু হৃদয়ের সীমানা ছাড়িয়ে দূর বহুদূর চলে যাওয়ার কষ্ট আমরাও চোখের জলে প্রকাশ করতে জানি তা হয়তো কোনো নারী কখনো উপলব্ধিই করতে পারবে না।অনেক কষ্টে নিজেকে কঠোর করে জবাব দিলাম-
– হুম?
– আমি স্নেহা। ঠান্ডা লেগেছে তোমার?
-কেনো কল করেছো? (আমি বললাম)
-তুমি কেমন আছো, জানতে? আমি আরো কঠোর কন্ঠে বললাম-
– ভালো থাকাটাই তো মানুষের জীবনে অজানা থাকে। অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ নেই। আমি আবার বললাম-
– আমি ভালোই আছি ঠিক সমুদ্রের মতো।তুমি কেমন আছো?
-খুব ভালো আছি, মুহূর্ত। তবে সমুদ্রের মতো আবার কেমন?
আমি এবার নিজেকে নরম করে বললাম- সমুদ্রের উপর যতো ঝড় আসুক কিংবা সে তার পুরো অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলুক তবুও সেই আগের মতোই থাকে।ভিতরে উত্তাল ঢেউ উপরে স্নিগ্ধ নিরবতা, যা শুধু আমরা উপভোগ করতে পারি তবে তার বিলীন হওয়াতে কারো কিছু যায় আসে না।সে তার ভাঙ্গনকেও নিজের ভিতর রেখে দেয় নিরবতায়, এমন।
সে কিছুটা চুপ থেকে বলল- এখন সব কথা প্রকাশ করতে শিখে গেছিস দেখছি।ভালোই তোহ! আমি বললাম-তোর স্বামী রাগ করবে না এভাবে কোনো পর- পুরুষের সাথে কথা বললে? সে পুরনো হয়ে বলল! তুই পর- পুরুষ হয়েছিস কিভাবে? আমাদের কি কখনো প্রেম ছিলো যে উনি রাগ করবে? আমি নিশ্চুপ। সত্যিই তো আমাদের কোনোদিন প্রেম ছিলো না। ভাবনা এতো হৃদয় কাঁদায় কেনো? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। স্নেহা এবার শান্ত গলায় বলল- “বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কিছু নেই” বলেই হাসতে শুরু করলো। এবার আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম- ভালোবাসা খুব কাঁদায়। হৃদয় ভাঙ্গে যন্ত্রণা দেয় তবে প্রাপ্তি দেয় না সর্বদা। কোনো আওয়াজ নেই অপর পাশে। আমি জানি সে কাঁদবে না। কঠিন গলায় সে বলল- আবেগে নিজেকে সিদ্ধ করি না আর। আমি হেসে বললাম- সেই পুরনো লাগছে তোকে, এতোক্ষণ নতুন লেগেছিলো।
– সে হাসলো। তাঁর হাসিটা সুন্দর তবে এখন দেখতে না পাওয়ায় আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে শুধু। এতো বছর পর কল দিলি যে? কোনো দরকার?
– ভালোবাসা বছরের পর বছর নতুন থাকে, মানুষ পুরনো হয় শুধু।( সে বলল) হয়তো দুজনের চোখেই পানি। কোথাও আজ ভালোবাসা নেই, কোথাও নেই আবেগ।
– আজ রাখি। (সে বলল) এমন ভাবে বলছিস যেনো আরও কখনো কথা হবে?
– আজ রাখি। (সে আবার বলল)
জবাব নেই আমার কাছে।আমি জানি না।এতো শান্ত গলায় সে কখনো কথা বলতে পারবে আমি ভাবিনি। আজ বুয়া আসে নাই।নিজেই কিছু রান্না করে খেতে হবে। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। গলা ধরে যাচ্ছে বার বার। আমি এমন পরিণতি চাইনি কখনো। একতরফা ভালোলাগা ছিলো আমার, শুধুই একতরফা।না কেনো চাওয়া, না কেনো ভালোবাসা পাওয়ার আশা। আজ অনেক বছর পর পুরনো নোংরা সেলফটার কাছে গিয়ে বসলাম। শুধু এখানেই ভার্সিটি লাইফের কিছু স্মৃতি জমিয়ে রেখেছিলাম। ধুলোবালি পড়ে নষ্ট হতে থাকা সেলফটা হতে খুঁজে একটা ছবি বের করলাম।আজ অনেক বছর পর আবার ওদের দেখতে ইচ্ছে করছে। ছবিতে সবাই ছিল শুধু আমি ছাড়া।এটাই রেখেছিলাম নিজের কাছে। তবে যত্নে রাখতে পারি নি।সবার সাথেই যোগাযোগ আছে অল্প স্বল্প।তবে তাঁর সাথেই ছিলো না শুধু যার সাথে সারাজীবন চাঁদ জ্যোৎস্না দেখার ইচ্ছে ছিল।
জীবনের বৃওটা খুব অদ্ভুত।একটা সময় পর ভালোবাসতে ছাড়া যায় হয়তো, তবে মায়া ছাড়া যায় না। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলা হয় নি কখনো। নিশ্চুপ প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমি।সে জবাব দেয় নি। হয়তো আরো কিছু শুনতে চেয়েছিলো।আমি সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারি নি।সে তোহ সব বুঝতো তবে শুধু আমার তার জন্য সীমাহীন ভালোবাসার নিরবতাকেই বুঝতে পারে নি। এতো বছর পর আমার হৃদয়ে আবেগ নেই, তার হৃদয়ে আর নেই ভালোবাসা।
গল্পের বিষয়:
গল্প