অচিন ফুলের গন্ধ

‘তৃতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়া আমার মায়ের অকালমৃত্যু হইল। সেই সন্তানটিও ছিল পুত্র। অর্থাৎ আমার আর একটি ভাই। মাতৃগর্ভেই তাহার মৃত্যু হইয়া ছিল। জন্মিবার আগেই মৃত্যু। পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় আসিবার আগেই মৃত্যু। আমরা সকলে মিলিয়া খুবই শোক করিলাম। বাবাও করিলেন। তাহার পর সংসার ছাড়িয়া গেলেন। গ্রামের লোকে বলাবলি করিত, ফজল সংসার-বিলাবী হইয়াছে।
বাবার নাম ফজলুর রহমান। সবাই ফজল বলিয়া ডাকিত।

বাবা চাকুরি করিতেন আদমজী মিলে। ফোরম্যান না কি যেন তাঁহার পদ ছিল। স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ তাঁহার কাছে গিয়া পৌঁছিয়া ছিল টেলিগ্রাম মারফত। সংবাদ পাইয়া ছুটিয়া আসিলেন। স্ত্রী এবং মৃত সন্তানের জন্য শোক করিলেন। গ্রামে আসিয়া পৌঁছিতে তাঁহার কিছু বিলম্ব হইয়াছিল। ফলে আমার মা এবং ভাইয়ের দাফন সম্পন্ন হইয়া গিয়াছিল। বাবা গোরস্তানে গিয়া তাহাদের আত্মার উদ্দেশে মোনাজাত করিলেন, ক্রন্দন করিলেন। কয়েকদিন গৃহে কাটাইয়া কর্মস্থলে ফিরিয়া গেলেন। তাঁহার যে পাঁচ এবং সাত বৎসর বয়সের আরো দুইটি পুত্রসন্তান রহিয়াছে কোনো অজ্ঞাত কারণে তাহাদের দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। সেই সন্তান দুইটি দাদা-দাদির জিম্মায় বড় হইতে লাগিল। মাতৃহীন দুটি ভাই পিতা জীবিত থাকিতেও পিতৃহীন হইয়া গেল। পরে শুনিয়াছিলাম নারায়ণগঞ্জের ঐ দিককার বন্দর এলাকায় তিনি আর একটি বিবাহ করিয়াছেন। সেই স্ত্রী লইয়া সুখে সংসার করিতেছেন। আপন পিতামাতা আর দুইটি সন্তানের কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। এই লইয়া আমার দাদি একমাত্র পুত্রের উদ্দেশে প্রায়ই বেদম শাপ-শাপান্ত বর্ষণ করিতেন। দাদা গুরুগম্ভীর মানুষ। তিনি উদাস ভঙ্গিতে নারিকেলের হুঁকায় তামাক সেবন করিতেন।

আমার দুই ফুফুর বিবাহ হইয়াছিল বিক্রমপুর অঞ্চলেই। বর্ষাকালে বাপের বাড়িতে স্বামী-সন্তান লইয়া তাঁহারা নাইয়র আসিতেন। আমাদের দুই ভাইকে বুকে জড়াইয়া একমাত্র বড়ভাইটিকে তাহারা নিষ্ঠুর নির্দয় ইত্যাদি বলিয়া অভিশাপ দিতেন।’

এইটুকু পড়ে খাতাটা বন্ধ করলেন বাদল সাহেব। বুকমার্কার যতেœ রাখলেন যে-পাতা পড়ছিলেন, সেই পাতায়। খাতাটা চামড়ায় বাঁধানো। সহজে নষ্ট হবে না। কিন্তু পৃষ্ঠাগুলো নরম হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। ষাটের দশকের শেষ দিককার খাতা। এক কিশোর তার মনের কথাগুলো লিখে রেখেছিল। খাতাভর্তি যে লেখা তা নয়। মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠা। তাও দিন তারিখ লেখা নেই। পুরান ঢাকায় থাকার সময় খাতাটা বাঁধাই করে নিয়েছিলেন বাদল সাহেব। যতেœ রেখে দিয়েছেন। কোনো কোনো উদাস দিনে বের করে পড়েন।

আজ শেষ বিকেলে দোতলার বারান্দায় বসেছেন খাতাটা নিয়ে। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর মনে হলো, একটু চা খাওয়া দরকার। কাজের মেয়েটার নাম মিতু। তিনি মিতুকে ডাকলেন। মিতু, চা দে।
মিতু সাড়া দিলো না। এলো বাদল সাহেবের ছেলের বউ জিনিয়া। ডাকছেন বাবা?
মিতুকে ডাকছিলাম মা।
মিতু তো আম্মার সঙ্গে বাইরে গেল।
বাইরে কোথায়?
আম্মার বোধহয় কেনাকাটা আছে।
ও আচ্ছা।
আপনার কিছু লাগবে?
চা চাইছিলাম। বুয়াকে বলো সে দিয়ে যাবে।
আমিই নিয়ে আসছি, বাবা।
তুমি কষ্ট করবে?
জিনিয়া হাসল। আপনাকে এক মগ চা করে খাওয়াব তাতে আবার কষ্ট কী? এক্ষুনি আনছি।
ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।

জিনিয়া চলে যাওয়ার পর আবার খাতাটা খুললেন বাদল সাহেব। পড়তে লাগলেন।
‘আমি মায়ের জন্য খুবই কান্নাকাটি করিতাম। দাদা-দাদি আদর করিয়া নানান প্রকারের সান্ত¡না দিতেন। একটা পর্যায়ে তাঁহাদের সামনে কান্নাকাটি আর করিতাম না। আড়ালে করিতাম। আমার বড়ভাই বাদল আমাকে খুবই ভালোবাসে। সেও নানানভাবে সান্ত¡না দিত। আদর করিয়া এইদিক-ওইদিক লইয়া যাইত। দাদার সঙ্গে আমরা দুইটি ভাই প্রায়ই বাজারে যাই। যখন স্কুল বন্ধ থাকে তখন যাই। দাদা তাঁহার দুই আদরের দৌহিত্রকে উদরপূর্ণ করিয়া মিষ্টি খাওয়ান। গৌরাঙ্গ ময়রার রসগোল্লা অতি সুস্বাদু। বরুণফলের মতন আকৃতি একেকখানা রসগোল্লার। আমরা দুই ভাই উহা খুবই পছন্দ করি। তবে আমি কখনো চারখানার বেশি খাইতে পারি না। বড়ভাইকেও দাদা সম্বোধন করি। দাদা পাঁচ-ছয়খানা খাইতে পারে।

দ্বিতীয় বিবাহের কয়েক মাস পর বাবা একবার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। তাঁহার নাকি টাকার দরকার পড়িয়াছে। পৈতৃকসূত্রে পাইবেন এমন কিছু সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া টাকা লইয়া যাইবেন। শুনিয়া আমার দাদা-দাদি দুইজনেই এত ক্ষিপ্ত হইলেন, পুত্রের উপর শুধু হাত তুলিতে বাকি রাখিলেন। দাদা গুরুগম্ভীর মানুষ। তিনি শুধু একটা কথাই বলিলেন, তোমাকে আমি একটি ফুটাকড়িও দিব না। আমার সম্পত্তির ওপর তোমার কোনো অধিকার বলবৎ নাই। সম্পত্তি আমি আমার দুই দৌহিত্রকে দলিল করিয়া দিব। আর দাদি অবিশ্রান্তভাবে গালিগালাজ বর্ষণ করিলেন। বাবার জন্য আমার খুবই মায়া হইতেছিল। তবে তিনি আমাদের দুই ভাইকে একটি বারের জন্যও কাছে ডাকিলেন না, আদর করা তো দূরের কথা। শুধু একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আমরা কেমন আছি। কোনো পিতা এমন নির্দয় হইতে পারে ইহা আমার জানা ছিল না। আমাদের অপরাধ কী? কেন তিনি আমাদের দেখিতে পারেন না। মা বাঁচিয়া থাকিতে তো তাঁহার এইরূপ আচরণ ছিল না। তখন বাড়িতে আসিলে আমাদেরকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া আদর করিতেন।

দাদা-দাদির মারমুখী আচরণ দেখিয়া পরদিনই তিনি চলিয়া গেলেন। যাওয়ার আগে আপন দুইটি পুত্রের দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। সেইদিন হইতে আমরা যেন তাঁহার আরো বড় শত্রু হইয়া গেলাম। তাহার পর হইতে বাবা আর বাড়িতে আসেন না। না না, আর একবার আসিয়াছিলেন। সেই কথা বারান্তরে লিখিব।’

ট্রেতে করে দুমগ চা আর ভাজা কিছু চিপস নিয়ে এলো জিনিয়া। বাদল সাহেব খুশি হলেন। চায়ের সঙ্গে এই চিপসটা খেতে ভালো লাগবে। বিকেলের চা তিনি স্ত্রীর সঙ্গে খান। আজ নীলা বাড়িতে নেই। একা খেতে ভালো লাগত না। যদিও এই খাতার লেখাগুলো পড়তে পড়তে খেতেন। অন্যদিকে মন থাকত না। তারপরও জিনিয়া তাঁকে সঙ্গ দেবে বলে নিজের জন্য চা নিয়ে এসেছে। ভালোই হলো। পুত্রবধূর সঙ্গে বসে চা পান, টুকটাক গল্প। সময় কেটে যাবে।
তোমার জন্য চা এনে ভালো করেছ মা। বসো বসো।
জিনিয়া বসতে বসতে বলল, আপনি একা একা চা খাবেন, এজন্য আমারটাও নিয়ে এলাম।
বাদল সাহেব একটা চিপস মুখে দিলেন। চায়ে চুমুক দিলেন। রিয়াদ আসবে কখন?
আজ ফিরতে দেরি হবে। সন্ধ্যায় একটা মিটিং আছে।
বাইরে না অফিসে?
ওয়েস্টিনে।
ও আচ্ছা। কাদের সঙ্গে মিটিং?
কোন একটা চায়নিজ কোম্পানির সঙ্গে। বড় অর্ডার পাবে। সাত লাখ মেট্রিক টন।
খুব ভালো। ছেলেটাকে নিয়ে আমি খুব খুশি। ফ্যাক্টরিটা ভালো চালাচ্ছে। একটা পর্যায়ে আমি আর পারছিলাম না মা। বেশ কয়েকটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি হয়ে গেছে দেশে। ভালোও করছে তারা। সেক্টরটা বড় রকমের কমপিটিশানের মধ্যে পড়ে গেছে। আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে। সামলাতে পারছিলাম না। তুমি আর রিয়াদ এসে হাল ধরায় আমি এখন নিশ্চিন্ত। দেখছ না, অফিসে বলতে গেলে যাইই না। তুমি আর রিয়াদ ভালো চালাচ্ছ। আজ তুমি যে একটু আগে আগে ফিরলে?
টায়ার্ড লাগছিল বাবা।
ও আচ্ছা।
একটু নীরবতার পর জিনিয়া বলল, বাবা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
হ্যাঁ নিশ্চয়। করো।
আমরা দেশে এলাম আট মাস হলো। আগে দুবার দেখেছি, আজো দেখছি, আপনি এই খাতাটা নিয়ে খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। উদাস হয়ে থাকছেন। একদিন খাতাটা কোলে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনি কাঁদছিলেন। সেদিনও আম্মা বাড়িতে ছিলেন না। আমি দূর থেকে দেখেছি। খাতাটা কিসের? কী লেখা আছে এই খাতায়?
শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করোনি?
না।
রিয়াদকে করেছ?
না, ওকেও করিনি। ভেবেছি আপনাকেই করব।
ওরা জানে খাতাটা কার বা কী লেখা আছে এতে।

বাদল সাহেব আকাশের দিকে তাকালেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। খাতাটা আমার ছোটভাই কাজলের। ও মারা গেছে আটষট্টি সালে। তখন ক্লাস টেইনে পড়ত। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ি মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে। খুবই ইমোশনাল ছেলে ছিল কাজল। আমাকে যে কী ভালোবাসত, কী যে পাগল ছিল আমার জন্য! ভাই যে ভাইকে এত ভালোবাসতে পারে, কেউ ভাবতেও পারবে না। মা মারা যাওয়ার পর, বাবা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর দাদা-দাদিই আমাদের মা-বাবা। আর আমরা দুটি ভাই দুজনের ছায়া। সারাক্ষণ একসঙ্গে। একসঙ্গে খাওয়া ঘুমানো লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলা। নাইন-টেইনে ওঠার সময় থেকে কাজলকে দেখতাম প্রায়ই এই খাতাটায় টুকটাক লিখছে। ছুটিছাটার দিনে, উদাস দুপুরে খুবই মন দিয়ে লিখছে। কোনো কোনো রাতে হারিকেনের আলোয় লিখছে। তখন তো বলপয়েন্ট নেই। আমরা লিখতাম ফাউনটেন পেন দিয়ে। দাদা আমাদের পাইলট পেন কিনে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে সাড়ে চার না পাঁচ টাকা যেন দাম। আমরা দু-ভাই সেই কলমদুটো খুবই যতে রাখতাম। ওই কলম দিয়ে সহজে লিখতাম না। সবসময় লেখার জন্য ছিল প্রেসিডেন্ট কলম।

ডানহাতের মাঝের আঙুলটা দেখালেন বাদল সাহেব। এই আঙুলের মতন মোটা। কালি ধরত অনেক। দোয়াতের কালি ব্যবহার করতাম। জার্মানির পেলিক্যান ইন্ক। ঢাকার রয়্যাল স্টেশনারি সাপ্লাই হাউস থেকে আনিয়ে দিতেন দাদা। কলমে কালি ভরার ড্রপার ছিল। মা মারা গেছেন, বাবা থাকতেও নেই, তারপরও আমরা বড় হচ্ছিলাম রাজার হালে। দাদা কোথাও কোনো কিছুর কমতি রাখতেন না।
রিয়াদের মুখে কিছু কিছু আমি শুনেছি। বিয়ে দিয়েই তো আপনি আমাদের পড়তে পাঠিয়ে দিলেন কানাডায়। অবসর সময়ে আমরা দুজন আমাদের পরিবার, আপনাদের পরিবার নিয়ে কত গল্প করতাম। তখন রিয়াদ আমাকে বলেছে আপনার ছোট এক ভাই ছিল। ভাইকে খুবই ভালোবাসতেন আপনি। দাদার কথা, মানে আপনার বাবার কথাও বলেছে। তবে ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন লেগেছে। রহস্যটা আমি বুঝতেই পারিনি।
কোন রহস্যটা বুঝতে পারোনি মা?
স্ত্রী মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুটো ছেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তাদের দিকে তাকালেনই না। আরেকটা বিয়ে করে ছেলে দুটোকে শুধু পর করে দেওয়াই না, একদমই ভুলে গেলেন। মা-বাবাকে ভুলে গেলেন, দুই বোনের কথা ভুলে গেলেন। এমন হবে কেন? অল্প বয়সে স্ত্রী মারা গেলে অনেকেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এমনকি স্ত্রী বেঁচে থাকতেও করেন। কিন্তু বাচ্চাদের ফেলে দেবেন কেন? বাচ্চাদের ভুলে যাবেন কেন? তাদের অপরাধ কী?
পরে এই রহস্যটা আমরা উদ্ঘাটন করেছিলাম মা।
জিনিয়া চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থামল। তাই নাকি?
হ্যাঁ। রিয়াদ বোধহয় ঘটনাটা জানে না। ওকে আসলে বলা হয়নি। তোমার শাশুড়ি জানেন। তাকে বলেছি।

চায়ে চুমুক দিয়ে বাদল সাহেব বললেন, শুনতে চাইলে তোমাকেও বলতে পারি মা। সেইসব ফেলে আসা দিনের কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে। যখন বলি তখন মনে হয় সেই দিনে ফিরে গেছি। চোখের ওপর পরিষ্কার দেখতে পাই সব। দুঃখ-বেদনার দিন, কাজলের চলে যাওয়া …
আমি শুনতে চাই বাবা। আপনি বলুন।

মা বেঁচে থাকতেই আমার সৎমা, অর্থাৎ দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বাবার সম্পর্ক হয়েছিল। এইসব ঘটনা তো চাপা থাকে না। কোনো না কোনোভাবে কানে আসে। ভদ্রমহিলা ছিলেন বাবার এক কলিগ এবং বন্ধুর বোন। বন্ধুর সঙ্গে বাবা মাঝে মাঝে তাঁদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। আদমজী থেকে বন্দর কাছে। এই যাতায়াতের ফলেই সম্পর্কটা হয়েছিল। মা বেঁচে থাকতে চক্ষুলজ্জায় হোক বা যে-কোনো কারণেই হোক বিয়েটা বাবা করতে পারছিলেন না। মা মারা যাওয়ায় ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। আগে বাবা কখনো আমাদের দু-ভাইয়ের ব্যাপারে এতটা উদাস বা নিষ্ঠুর যা-ই বলি, ছিলেন না। আমাদের ভালোই বাসতেন। বাড়িতে এলে কত কী নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। সেই মহিলার কারণে আমাদের তিনি দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

একটু থেমে বাদল সাহেব বললেন, আমরা দুটি ভাই বাবার ধাঁচ পাইনি। আমরা পেয়েছিলাম দাদার ধাঁচ।

আলতো করে চায়ে চুমুক দিলেন বাদল সাহেব। যতই বড় হয়েছি ততই বাবার কথা ভেবে আমি অবাক হয়েছি। অমন হৃদয়বান মা-বাবার সন্তান হয়ে, অমন মায়াবী দুজন মানুষের সন্তান হয়ে এতটা নিষ্ঠুর এবং নির্দয় তিনি কেমন করে হয়েছিলেন! তখনকার দিনে দ্বিতীয় বিয়ে অনেকেই করতেন। দু-জায়গায় দুই সংসার, এমনকি একই বাড়িতে দুই স্ত্রী রাখতেন। কিন্তু সন্তানকে এইভাবে পর করে দিতে হবে কেন? বাবা আমাদের একেবারেই পর করে দিয়েছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পর টাকার জন্য এসেছিলেন। আদমজীর ওদিকে বাড়ি কিনবেন। তাঁর ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা নেবেন। দাদা পরিষ্কার মানা করে দিলেন। এসব ক্ষেত্রে মায়েরা সাধারণত নরম হন। ছেলের পক্ষ নেন। কিন্তু আমার দাদি! বাপরে বাপ! পারলে ওই বয়সী ছেলের গায়ে হাত তোলেন। পরিষ্কার বললেন, তোর মুখ যেন আমি আর না দেখি! আমাদের জায়গা-সম্পত্তি সবই দুই নাতিকে দিয়ে দেবো। তাই দিয়েছিলেন। কাজল তো মারাই গেল। জগন্নাথ থেকে বিকম পাশ করার পর দাদা গ্রামের অনেক জমি বিক্রি করে আমাকে বিজনেস করার টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকায় আমার আজ এই অবস্থা। সিমেন্টের ফ্যাক্টরি, গুলশানের বাড়ি। রাজার মতো জীবন।

চায়ে শেষ চুমুক দিলেন বাদল সাহেব।
জিনিয়া বলল, তারপর তিনি আর কোনোদিন বাড়িতে আসেননি?
কিছুদিন পর আর একবার এসেছিলেন। ওই জায়গা-জমির জন্যই, টাকার জন্যই। বোধহয় স্ত্রীর চাপেই এসেছিলেন। মানে যেমন করে হোক টাকা-পয়সা নিতে হবেই। সেবার বাবার দেখি একদম উলটো চেহারা। আমাদের দুই ভাইকে খুব আদর করতে লাগলেন। দাদা-দাদিকে খুবই তোয়াজ করতে লাগলেন। বোধহয় স্ত্রীই ওই কায়দাটা তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের জন্য অনেক খাবার-দাবার, জামা-কাপড়-খেলনা নিয়ে এসেছিলেন। দাদা-দাদি দুজনেই তাঁর চালাকিটা বুঝে গিয়েছিলেন। আগের জায়গা থেকে একচুলও নড়লেন না তাঁরা দুজন। এক শতাংশ জমিও বিক্রি করবেন না, একটা টাকাও দেবেন না। বাবা চেষ্টা করলেন আমাদের দুটি ভাইকে দিয়ে দাদা-দাদিকে ম্যানেজ করতে। ওইটুকু ছেলেদুটোকে দিয়ে। আমরা যেন দাদা-দাদিকে বলি, জমি বিক্রি করে বাবাকে টাকা দিয়ে দাও। আমার সবই মনে আছে। আমরা বলেছিলাম। দাদা খুবই শান্তভাবে বলেছিলেন, তোরা তো ছোট। তোরা বুঝবি না। আমি দেখছি। আর দাদি আগের চেয়েও বেশি রাগলেন। প্রকৃত অর্থে বাবাকে বাড়ি থেকে বেরই করে দিলেন। বাবা চোখ মুছতে মুছতে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে গেলেন। ওই দৃশ্য দেখে কাজল কাঁদতে লাগল। বাবাকে বকেছে। বাবা কাঁদছে। আমাকে শুধু বলে, ও দাদা, বাবা কী করেছে? বাবাকে বকেছে কেন?

বাদল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আহা কী নরম মনের ছেলে ছিল কাজল। এত এতদিনেও একটা মুহূর্তের জন্য কাজলকে আমি ভুলতে পারি না। চোখের সামনে দেখতে পাই ওর মুখটা।
তারপর তাঁর সঙ্গে আপনাদের আর কোনোদিন দেখা হয়নি?
খুবই অবিশ্বাস্য ঘটনা। দেখা হয়নি।
বলেন কী?
হ্যাঁ মা। তিনি আর কোনোদিন আসেননি। কাজল মারা গেল, দাদা-দাদি মারা গেলেন। তিনি আসেননি। কারণ তিনি জেনে গিয়েছিলেন জায়গা-সম্পত্তি সবই আমাকে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন দাদা। বিক্রিও হয়ে গেছে বেশিরভাগ জমি। এসে কোনো লাভ নেই।
বড় হয়ে আপনার কি বাবার কথা মনে হয়নি?
হয়েছে। কিন্তু কোনো আবেগ টের পাইনি। দাদাকেই আমার বাবা মনে হতো, দাদিকে মা। তাঁদের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলাম। কাজলের মৃত্যুতে যেমন দুঃখ পেয়েছিলাম, দাদা-দাদির মৃত্যুতেও তাই। কাজলের মৃত্যুতে অবশ্য দাদা-দাদিও বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আপন সন্তানের মৃত্যুর মতোই দুঃখ পেয়েছিলেন।

একটু থেমে বাদল সাহেব বললেন, আমি যখন ব্যবসা শুরু করেছি, সচ্ছল হয়ে উঠছি তখন শুনলাম বাবা স্ট্রোক করে বিছানায়। পঙ্গু হয়ে গেছেন। তবে তাঁর আর্থিক অবস্থা খারাপ না। কাঁচপুরের ওদিকে বড় বাড়ি করেছেন। ওই ঘরে দুই মেয়ে। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি ভাড়াও পান ভালোই। সচ্ছল অবস্থা। তবু আমাদের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমি তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়েছিলাম। টাকা পেয়ে তিনি নাকি খুব কেঁদেছিলেন। আমাকে দেখার জন্য নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। আমি যাইনি। কেন যাইনি, জানো? কাজলের জন্য। কাজল চলে যাওয়ার পর আমার শুধু মনে হতো, মা মারা গেছেন কিন্তু বাবা যদি ঠিক থাকতেন, আমাকে না হোক কাজলকে যদি ভালোবাসতেন তাহলে কাজল মারা যেত না। ও বড় ভালোবাসার কাঙাল ছিল। ও খুব আদর চাইত, মায়া-মমতা চাইত। দাদা-দাদি সেসবের কমতি রাখেননি। কিন্তু মা মা-ই, বাবা বাবা-ই। তাদের জায়গা কেউ পূরণ করতে পারে না। তবে আমার ভাইটি দু-হাতে আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখতো। আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না। আমার সঙ্গে ঘুমাত, আমার সঙ্গে খেত, পড়তে বসত, স্কুলে যেত। ক্লাস টেইনে পড়া ছেলে, তাও যেন বড় হয়নি। ছেলেবেলাটা যেন আটকে আছে শরীরে আর আচরণে। আমার গলার কাছে মুখটা রেখে, আমার হাতের তলা দিয়ে একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমাত। যেন এইভাবে না ধরলে ওকে একলা ঘরে রেখে আমি কোথাও চলে যাব।

বাদল সাহেব উদাস হলেন। আমি না, আমাকে একলা ঘরে রেখে কাজল চলে গেল। রিয়াদ যখন একটু বড় হলো, আমার সঙ্গে ঘুমায়। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে আমার মনে হতো, আরে ওই তো কাজল শুয়ে আছে আমার পাশে। আমি ওর গালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। ঠিক কাজলের জন্যও এমন করতাম। কয়েকদিন ধরে এসব কথা খুব মনে হয় মা। কত কতদিন চলে গেল জীবন থেকে। কবে ডাক আসবে, কবে চলে যাব …

আরে না। কী যে বলেন বাবা! আপনার এখনো সত্তরই পুরো হয়নি। আজকালকার দিনে এটা কোনো বয়সই না। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন বাহাত্তর বছর।
একটা ঘটনা বলি মা তোমাকে। কাজলের মৃত্যুর কয়েকদিন আগের ঘটনা। বর্ষাকাল। কলেজ বন্ধ। মুন্সিগঞ্জ থেকে আমি বাড়ি এসেছি। আহা রে, আমার কলেজে পড়তে যাওয়া নিয়ে কাজল যে কেমন করেছিল!

আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাদল সাহেব। আমাদের বাড়ি থেকে মুন্সিগঞ্জ বেশি দূরে না। দশ-বারো মাইল হবে। তখনকার দিনে তো রাস্তাঘাট উন্নত ছিল না। নৌকায় করে যেতে হতো। আমাদের খাল থেকে নৌকায় চড়লে ঘণ্টা চারেক লাগত মুন্সিগঞ্জ শহরে পৌঁছাতে। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। মাসে মাসে কিছু টাকা দিতে হবে। তারা আমাকে থাকা-খাওয়া দেবে। কিন্তু কাজলকে ছেড়ে আমি থাকব কেমন করে? কাজলইবা আমাকে ছেড়ে থাকবে কী করে?

ভর্তির দিন কাজল আমার সঙ্গে গেল। যে-বাড়িতে থাকব সেই বাড়িও দেখে এলো। সঙ্গে দাদা আছেন। আমার ছোট ফুফা আছেন। তারপর থেকেই শুরু হলো কাজলের কান্নাকাটি। রোজ রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। আমাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। আমি নিজেও কাঁদি। নানা রকমভাবে ভাইকে বুঝ দেই। প্রতি সপ্তাহে আমি চলে আসব। মাঝে মাঝে তুই গিয়ে আমার কাছে থাকবি। না, সে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে থাকবে না। দাদা-দাদিকে বলল, ওকেও মুন্সিগঞ্জের কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। আর নয়তো মুন্সিগঞ্জে একটা বাড়ি কিনে আমরা সবাই মুন্সিগঞ্জে চলে যাব। দাদার এত জায়গা-সম্পত্তি, এত ধান পাট তিল কাউন, কলাই মটর, এসব ফেলে কী করে যাবেন। দাদা-দাদিও নানাভাবে বোঝান। কাজল বোঝেই না। শুধু কাঁদে।

আমি যেদিন ব্যাগ-স্যুটকেস নিয়ে নৌকায় উঠলাম, সেই সময় যা হলো, ভাই ভাইয়ের জন্য এমন করতে পারে, কেউ বিশ্বাস করবে না। প্রথমে নৌকায় উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। কিছুতেই কান্না থামে না, কিছুতেই নৌকা থেকে নামে না। বেলা হয়ে যাচ্ছে। খালপারে দাদা-দাদি আছেন। বাড়ির লোকজন আছে, পড়শিরা আছে। ছোট ফুফা যাচ্ছেন আমাকে পৌঁছে দিতে, সবাই বোঝায়। কাজল কিছতেই বুঝতে চায় না। শেষ পর্যন্ত নামল নৌকা থেকে। খালপারে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। নৌকার ছই ধরে দাঁড়িয়ে আমিও কাঁদছি। নৌকা চলছে আর খালপার ধরে নৌকার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াচ্ছে কাজল। কাঁদছে আর বলছে, দাদা, আমারে তোর সঙ্গে নিয়ে যা। তোরে ছাড়া আমি থাকতে পারব না …

বাদল সাহেবের চোখদুটো ছলছল করে উঠল। এখনো সেই দৃশ্যটা আমি দেখতে পাই মা। পরিষ্কার দেখতে পাই। আমি নৌকা করে চলে যাচ্ছি, আমার ভাইটা নৌকার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াচ্ছে আর কাঁদছে …

একটু থেমে নিজেকে সামলালেন বাদল সাহেব। মায়ের মৃত্যুতে যেমন আঘাত কাজল পেয়েছিল, আমাকে ছেড়ে থাকতেও আঘাত তারচেয়ে কম পেল না। ভেতরটা তছনছ হয়ে গিয়েছিল ওর। ঠিকমতো খেত না, ঘুমাত না। পড়তে বসে একা একা কাঁদত। স্কুলে যাওয়ার সময় কাঁদত। হাতে-পায়ে বড় হয়েছে, আসলে একটা শিশু। মাতৃহীন শিশুর মতো অবস্থা কাজলের। দিন পনেরো পর বাড়ি এসে দেখি কাজল শুকিয়ে কেমন পোড়াকাঠ হয়ে গেছে। আহা রে, আমার এত সুন্দর ভাইটা! টকটকে ফর্সা গায়ের রং কাজলের। হালকা হলুদ একটা আভা ছিল গায়ের রঙে। চোখদুটো বড় বড়। কী যে মায়াবী মুখখানা। হাঁটাচলায় ধীর নরম ভঙ্গি। উদাসী রাজপুত্র। আমার সেই ভাইটি পোড়াকাঠ হয়ে গেছে। রাতের বেলা প্রায়ই নাকি জ্বর আসে। আমি যেদিন বাড়ি এলাম সেদিনও একটু একটু জ্বর। আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। কিন্তু কাঁদল না। বললাম, কী রে, জ্বর আসে কেন? জলধর ডাক্তার ওষুধ দেয়নি? বলল, দিয়েছে। ওই ওষুধে আমি ভালো হবো না। তুই না থাকলে জ্বর আমার থাকবেই। আমি যে কদিন বাড়িতে, কিসের জ্বর কিসের কী! দিব্যি সুস্থ।

জলধর ডাক্তার ছিলেন অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। যে-কোনো রোগী গেলেই প্রথমে বলতেন, তুই তো বাঁচবি না। রোগী দেখতে এসেও একই কথা। কিন্তু হাতযশ কাকে বলে। গ্রাম্য ডাক্তার। নাড়ি টিপে বলে দিতে পারতেন সমস্যাটা কী! জ্বর আছে কতটা। কাশির শব্দ শুনে বলে দিতে পারতেন সাধারণ কাশি না যক্ষ্মা। তখনকার দিনে যক্ষ্মা হতো খুব। কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়ায় ভর্তি ছিল গ্রামগুলো।

জিনিয়া মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে দুজন মানুষের কেউ তা টের পায়নি। এই বারান্দার সঙ্গের রুমে লাইট জ্বেলে দিয়ে গেল বুয়া। কিছুটা আলো এসে পড়ল বারান্দায়।
বারান্দার লাইট জ্বেলে দেব, বাবা?
না মা, দরকার নেই। আলো যেটুকু আছে তাতেই ভালো লাগছে।
বলুন বাবা, বলুন।

মাসকয়েক এভাবে কাটল, বুঝলে! আষাঢ় মাসের দিকে কলেজ কয়েকদিন বন্ধ ছিল। কী কারণে বন্ধ সেটা মনে নেই। আমি বাড়ি এসেছি। এর মধ্যে আরো কয়েকবার এসেছি। যখন আসি তখনই দেখি আমার ভাইটা আর আগের মতো নেই। কেমন বিষণœ দুঃখী হয়ে থাকে। আমি যে-কদিন বাড়ি থাকি সে-কদিন ফুরফুরে, তাজা। দু-ভাই এদিক-ওদিক যাই, আড্ডা দেই, মজা করি। খালপারে সবসময়ই থাকে আমাদের একটা ডিঙি নাও। সেই নাও বেয়ে মাইলখানেক দূরের বইলতলীর মাঠে যাই ফুটবল খেলা দেখতে, হাডুডু খেলা দেখতে। বিক্রমপুর অঞ্চলে হাডুডু খেলার দুটো অন্য নাম আছে। কোথাও কোথাও বলে ‘ধরাছি’ আবার কোথাও কোথাও বলে ‘কপাটি’। খালের দুপারে গাছপালা, ঝোপঝাড়। ফসলের মাঠ আছে কোথাও, মানুষের বাড়িঘর আছে। একদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। বেশ অন্ধকার। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। আমি নৌকা বাইছি, কাজল বসে আছে মাঝখানে। নির্জন গাছপালা ঘেরা, একেবারে বনভূমির মতো একটা জায়গা দিয়ে নৌকা বেয়ে যাচ্ছি আমি। খালের ওপর ঝুঁকে আছে বাঁশঝাড়, হিজল, বরুণগাছ, গাবগাছ, তেঁতুলগাছ। গা-ছমছমে পরিবেশ। হঠাৎ কাজল কী রকম ছটফট করে উঠল। দাদা, দাদা! গন্ধটা পাচ্ছিস? কিসের গন্ধ রে? কী ফুল? এরকম ফুলের গন্ধ তো কোনোদিন পাইনি …
আমি অবাক। কোথায় ফুলের গন্ধ?
তুই পাচ্ছিস না?
না তো! আমি তো কোনো গন্ধই পাচ্ছি না।
বলিস কী? এই তো আমি পাচ্ছি। ইস, কী রকম অদ্ভুত গন্ধ! আরে, গন্ধটা আরো বাড়ছে দাদা। আরো বাড়ছে!
কোথায়? আমি তো পাচ্ছি না।
কাজল চট করে আমার কাছে সরে এলো। এখনো গন্ধটা পাচ্ছি দাদা। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে।
কিসের ভয়? আমি আছি না!
কাজল আমার হাঁটুর কাছটা ধরে বসে রইল। বৈঠায় একটু ঘনঘন চাড় দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। কাজলই দাদা-দাদিকে বলল গন্ধের কথাটা। দুজনেই ভাবলেন নাতি ভয় পেয়েছে। দাদি দোয়া পড়ে কাজলের মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলেন।
জিনিয়ার মুখের দিকে তাকালেন বাদল সাহেব। গম্ভীর দুঃখের গলায় বললেন, তার কয়েকদিন পর কাজল মারা গেল।
জিনিয়া চমকালো। কথা বলতে পারল না।
বাদল সাহেব বললেন, আমাদের দুই ভাইয়ের ঘরটায় তখন কাজলের সঙ্গে থাকে বাড়ির বাঁধা কাজের লোক নওসের। কাজল থাকে খাটে, নওসের মেঝেতে। রাতদুপুরে নওসেরকে ডেকে তুলল কাজল। খুবই দিশাহারা গলায় বলল, এই নওসের, নওসের, গন্ধটা পাচ্ছো, গন্ধটা?
ঘুম ভাঙা নওসের হতভম্ব। কিসের গন্ধ? কোথায় গন্ধ? আমি তো কোনো গন্ধ পাই না।
অচেনা একটা ফুলের গন্ধ। দাদার সঙ্গে বইলতলী থেকে ফেরার সময় কয়েকদিন আগে পেয়েছিলাম। তুমি পাচ্ছো না কেন? আরে, গন্ধে তো ঘর ভরে গেছে! আমার ভয় করছে নওসের, আমার ভয় করছে। দাদা-দাদিকে ডাকো। মুন্সিগঞ্জে আমার ভাইকে খবর দাও। আমার ভয় করছে, খুব ভয় করছে। তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি …

দাদা-দাদি ছুটে এলেন। বাড়ির কাজের লোকজনরা ছুটে এলো। কাজলের চোখে ভয়, আতঙ্ক। কেমন দিশাহারা ভাব। একবার দাদাকে জড়িয়ে ধরে, একবার দাদিকে। তোমরা কেউ গন্ধটা পাচ্ছো না? আরে, এমন গন্ধ মানুষ না পায় কী করে? আমার ভয় করছে দাদা, খুব ভয় করছে। আমার ভাইকে খবর দাও। মুন্সিগঞ্জে লোক পাঠাও …

দাদা-দাদি দুজনেই জড়িয়ে ধরে আছেন কাজলকে। দুজনের মাঝখান থেকে আলগোছে চলে গেল আমার ভাইটি।

উদাস হলেন বাদল সাহেব। বিষণ হলেন। কিছুদিন ধরে কাজলের পাওয়া গন্ধটার কথা আমার মনে হয় মা। সেই গন্ধ আসলে মৃত্যুগন্ধ। মৃত্যু যার পিছু নেয় সে-ই শুধু গন্ধটা পায়। একেবারেই অচেনা গন্ধ। আমার ভাই মৃত্যুগন্ধ পেয়েছিল।

খাতাটা জিনিয়ার হাতে দিলেন বাদল সাহেব। এটা তোমার কাছে থাক, মা। ইচ্ছে হলে পড়ে দেখো।কয়েকদিন পরের ঘটনা।
গভীর রাতে দিশাহারা ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসলেন বাদল সাহেব। স্ত্রীকে ধাক্কা দিলেন। নীলা, নীলা। ওঠো তো! ওঠো।
নীলার ঘুম পাতলা। সঙ্গে সঙ্গেই উঠলেন। কী হয়েছে?
একটা গন্ধ পাচ্ছো, গন্ধ?
কিসের গন্ধ?
তুমি পাচ্ছো না? অচেনা একটা ফুলের গন্ধ! আরে ঘর ভরে গেছে গন্ধে! তুমি পাচ্ছো না কেন?
নীলা লাইট জ্বাললেন। নাক টানলেন। কোথায় কিসের গন্ধ!
তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?
বাদল সাহেবের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখে কী রকম ভয়-আতঙ্কের দৃষ্টি। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন আর নাক টানছেন। এই তো গন্ধটা আমি পাচ্ছি। এখন আরো তীব্র হয়েছে। ঘর ভরে গেছে, একদম ভরে গেছে। তুমি পাচ্ছো না কেন? নীলা, নীলা আমাকে ধরো। আমার ভয় করছে। আমার খুব ভয় করছে …

বুকে হাত দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন বাদল সাহেব। নীলার চিৎকারে রিয়াদ আর জিনিয়া ছুটে এলো। কাজের লোকজন ছুটে এলো। একজন ড্রাইভার বাড়িতেই থাকে। সে গাড়ি বের করল। ধরাধরি করে গাড়িতে তোলা হলো বাদল সাহেবকে। কালো রঙের পাজেরো জিপ ছুটে চলল এ্যাপোলো হসপিটালসের দিকে। ড্রাইভারের পাশের সিটে রিয়াদ। পিছনের সিটে নীলা আর জিনিয়ার কোলে অচেতন হয়ে আছেন বাদল সাহেব। নীলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে বলল, কিসের নাকি গন্ধ পাচ্ছে! আমাদের রুম নাকি গন্ধে ভরে গেছে। কিসের গন্ধ বুঝলাম না। আমি কোনো গন্ধ পাচ্ছিলাম না। হায় হায় এমন হলো কেন?

গন্ধের কথা শুনে যা বোঝার বুঝে গেল জিনিয়া। সে কোনো কথা বলল না।
ইমারজেন্সির ডাক্তাররা বললেন, হাসপাতালে আনার আগেই মারা গেছেন বাদল সাহেব।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত