আবিদদের কাজের বুয়া মারা গেছে। চৈত্রের ঘামঝরা এক দুপুরে জ্বরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে চোখ বন্ধ করল। সেই যে চোখ বন্ধ করল, আর চোখ খুলবার নাম নেই। ঘুমানোর এক মুহূর্ত আগে সে আবিদের হাত ধরে বলেছিল, বাপজান আমার পোলা রহিমরে দেইখা রাখিস। ওরে বাপের কাছে না পৌঁছাইয়া যেন বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিস না।
আবিদের বাড়ির সকলেরই ধারণা ছিল কুজের বুয়া সালেহা কথাগুলো জ্বরের ঘোরে বলেই ঘুমিয়েছে। কিন্তু সে ঘুমোয়নি! ঘুমের স্তর পেরিয়ে আরো একধাপ নেমে সে মরে গেল। বিকালের মধ্যে লাশ দাফন হয়ে গেল সরকারী কবরস্থানে। আবিদরা যখন সালেহার কবরের উপরে শেষ মাঠির দলাটা দিচ্ছে তখনও রহিম একটা ললিপপ মুখে ঠেসে গুনগুন করে ছড়া কাটছে। এইটুকু ছেলের মনে মা মৃত্যুর শঙ্কা ঢুকানোর সাহস না ছিল আবিদের, না ছিল আবিদের পরিবারের। সালেহার মৃত্যুর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবিদদের বাড়িতে নতুন কাজের বুয়া আনা হলো। এই পৃথিবী প্রস্থান সহ্য করে না। কারো প্রস্থান ঘটলে পৃথিবী নতুন কারো আগমন ঘটায়। এই একসপ্তাহে রহিম তার মায়ের কথা বলেছে মাত্র সাতবার। প্রতিদিন রাতে খেতে বসবার আগে সে চারিদিকে মিটমিট করে তাঁকিয়ে বলে, আমার মা কই? গালে তুলে খাইয়ে দেবে না?
আবিদ ঠাণ্ডা গলায় জবাব দেয়, তোমার মা ঘুমাচ্ছে। তাকে ডাকা যাবে নাতো রহিম বাবু! আবিদের কথায় রহিম বোধহয় খুশি হয়। এই চার বছরের জীবনে সে তার মাকে কখনো নিদ্রায় যেতে দেখেনি। সকালে রহিম ঘুম থেকে উঠে দেখতো তার মা থালাবাসন ঘষছে, আর রাতে ঘুমানোর আগে মাকে গল্প বলতে শুনতো। তার মনে হয়তো বহুবার প্রশ্ন জেগেছে, মা কি ঘুমায়? কখন ঘুমায়? আমি তো দেখি না। এসব কারণে আবিদের মুখে মায়ের ঘুমানোর কথায় সে খুশি হয়! সঙ্গে আশ্বস্ত! নতুন বুয়ার নাম কমলা। এই ধরণের নাম সাধারণত সিনেমায় ব্যবহার হয়। কিন্তু বাস্তবে কেন এমন নাম ব্যবহার করেছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে আবিদের মনে। কৌতূহল মেটাতে একবার জানতেও চেয়েছে, এটা কি তোমার আসল নাম?
কমলা বুয়ার খাসা জবাব। বুকের ওড়নাটা টেনে গলার কাছে নিয়ে বলে, ভাইসাব বুয়ার কাজডা হইলো অভিনয়ের মতো। সিনেমায় অধিকাংশ নাইকাগো যেমনি ওর্জিনাল নাম থাকতে নেই, তেমনি বুয়াগোও ওর্জিনাল নাম থাকতে নেই। আমার ওর্জিনাল নাম হইলো গিয়া, চম্পা। শুধু আপ্নেরে কইছি। আপনি যেন কাউরে কইয়েন না। আবিদ যতবারই কমলা বুয়ার সাথে কথা বলেছে, ততবারই লক্ষ্য করেছে সে তার বুকের ওড়না টেনে গলায় তুলে আনে। অন্য নারীরা সচরাচর বুক ঢাকতে ব্যস্ত হলেও, ছদ্মবেশী কমলা যেন বুক আগলা করতে বড্ড ব্যস্ততা দেখায়! কমলার কপালে একটা কাটার দাগ। আবিদ কথা বলার ফাঁকেই মনে মনে গুনে নেয়, তিনটা সেলাই পড়েছিল।
কমলার থাকার জন্য সালেহা বুয়ার ঘরে জায়গা দেওয়া হয়েছে। থাকার আগে কমলা সব ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে নিয়েছে। সালেহার ব্যবহৃত জিনিসগুলো একটা বস্তাবন্ধী করে রাখা হয়েছে। কমলা বুয়ার ঘরের শোভা নষ্ট করছে এই বস্তা। সে এক দু’বার যে এগুলো ফেলে আসার চেষ্টা করেনি তা না! কিন্তু আবিদের তাতে ঘোর আপত্তি। সালেহার শেষ কথাটা পূরণ করতে এই বস্তাবন্ধী জিনিসপত্রগুলো তার কাজে লেগে যেতে পারে। রহিমকে তার বাবার হাতে পৌঁছে দিতেই হবে।
সালেহা বুয়ার ছেলে রহিমের বয়স চার পেরিয়ে পাঁচের সংখ্যায় ঠেকেছে। এই গোটা একটা বছরের মধ্যে সে তার মায়ের ঘুমের খোঁজ নিয়েছে হাতেগোনা কয়েকবার। প্রতিবার মুখের ভাব এমন থাকে যেন মায়ের খোঁজ নেওয়ার থেকে তার ঘুমের খোঁজ নেওয়ার গুরুত্বটাই বেশি। এই একটা বছরে যে শুধু রহিমের বয়স এক বেড়েছে তা নয়! এরই মধ্যে কমলা বুয়ারও প্রস্থান ঘটেছে। ছদ্মবেশী কমলা নিজে মাত্র প্রস্থান নেয়নি, সঙ্গে ঘর থেকে কিছু কমদামি বস্তুরও প্রস্থান ঘটিয়ে পালিয়েছে। চুরি হওয়া বস্তুর মধ্যে আছে দু’টো হাতঘড়ি, কিছু বাসন আর সালেহা বুয়ার ব্যবহৃত জিনিস রাখা সেই বস্তাটা। একটা বুয়ার কখনো ঘরের উচ্চদামী বস্তু নিয়ে পালানোর সাহস হয় না। যেটা প্রমাণ করেছে কমলা বুয়া নামধারী চম্পা। যদিও এখন আবিদের মনে হয় তার কাছে বাতলানো ‘চম্পা’ নামটাও তার প্রকৃত নাম নয়। কারণ অভিনেতা-নেত্রীদের যে নাম থাকতে নেই।
ছদ্মবেশী কমলা বুয়াকে দেখা গেল মফস্বলের কোণে একটা একতলা বাড়িতে। আবিদ তাকে দেখেনি, বা খুঁজে বের করেনি। বুয়াকে দেখলাম আমি নিজে। এই গল্পে আমার চরিত্র এইটুকুই; একজন বুয়াকে খুঁজে বের করা। আমার মনে হচ্ছে আমি আমার চরিত্রের মান রেখেছি। কয়েকমাস আগে আবিদদের বাড়ি থেকে কমলা বুয়া চুরি করে চম্পট দেয়। ভাগ্য ভালো একদিন বুয়াকে দেখেছিলাম ওদের বাড়িতে। আমি দেরি না করে আমার চরিত্রের ইতি টানতে আবিদের কাছে কমলা বুয়ার ঠিকানা পৌঁছে দিই। সব গল্পের শেষ জানতে কোনো না কোনো চরিত্রের ইতি টানতে হয়, এই গল্পের সেই চরিত্রটা আমি। মফস্বলের যে বাড়িটাতে কমলা এসে উঠেছে সে বাড়ির কর্তার চরিত্র সুবিধার নয়। এজন্য আবিদের বেলায় যে কাজটা করেছে, এখানে তার বিপরীত করতে হচ্ছে। ওড়নাটা এখন আর গলায় ওঠে না। তার নির্দিষ্ট স্থানে থেকে বুক ঢেকে রাখে।
সে যতদিন এসেছে বুয়া হিসাবে, ততদিনের সংখ্যার চেয়ে বেশিবারই বাড়ির কর্তাকে বলা হয়ে গেছে, আমার ওর্জিনাল নাম কমলা না, ওর্জিনাল নাম হইল সখিনা। শুধু আপ্নেরেই কইলাম, কাউরে যেন কইয়েন না।
আবিদের কমলাকে খুঁজে বের করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সালেহা বুয়ার বস্তা ফিরে পাওয়া। যে বস্তার কোনো এক কোণে হয়তো রহিমের বাবার ঠিকানা লুকিয়ে থাকতে পারে। রহিমকে কয়েকবার তার বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেও কোনো আশার বাণী খুঁজে পায়নি আবিদ। সালেহা বুয়া তাদের বাড়িতে কাজ করেছে প্রায় চার বছর। তার ছেলে রহিম হওয়ার কয়েকদিন আগেই এসে কাজ নিলো। তারপর কাটালো আরো কয়েকবছর। এতদিনে তার স্বামীর যে পরিচয় মিলেছে তা হলো, রহিমের বাপ। আবিদের মায়ের সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা বলেছে তার সম্পর্কে সালেহা। ‘আমার রহিমের বাপ বড্ড ভালো মানুষ ছিলো গো আফা,’ এমন ধরণের কথা সবসময় উঠে এসেছে। কিন্তু তার নাম, ঠিকানা কিছুই উঠে আসেনি। আবিদ কমলার সন্ধান পেল সন্ধ্যে নাগাদ। খুঁজ বেগ পেতে হয়েছে বাড়িটা। যদিও আমাকে ফোন দিলে খুব সহজেই বের করতে পারতো! কিন্তু আমার যে এই গল্পে দ্বিতীয় কোনো চরিত্র নেই।
কমলা বুয়া আবিদের পায়ের ওপর পড়ে আছে। ‘ভাইজান আমারে মাফ কইরা দ্যান, আর জীবনে চুরি করমু না’
‘তোমাকে আমি চুরির জন্য ধরতে আসিনি কমলা। সালেহার ওই বস্তা আমার চাই। আমি টাকা দিয়ে কিনে নেবো।’
কমলার উপরে বোধহয় অবাকত্ব ভর করে। এত সামান্য কিছুর জন্য যে আমি তাকে খুঁজে বের করবো তা সে ভাবতে পারেনি। অথচ তার জানার অবকাশ নেই, সামান্য কিছুর মধ্যেও কখনো অসামান্য কিছু থাকে! হতে পারে তা কারো পিতৃপরিচয়ও! গোটা কয়েকদিন পার হয়ে গেছে। আবিদ এরই মধ্যে একবার নিকটবর্তী বাংলা মিডিয়ামে মৃত সালেহা বুয়ার ছেলে রহিমকে নিয়ে গিয়েছিল ভর্তি করাতে। কিন্তু বাবার পরিচয়টা না বসাতে পেরে তাদের নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। এতদিনে হয়তো ‘রহিমের বাপ’কে খুঁজে পাওয়া যেতো যদি কমলা সালেহার বস্তাটা ফিরিয়ে দিতো। কিন্তু কমলাও আশার কিছু দেখাতে পারিনি। কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিল, ভাইজান এ্যাক্কেরে হাচা কতা! ওই বস্তায় লেপ কম্বল ছাড়া কিচ্ছু আছিল না। আমি তা পুড়াই ফেলছি।
আবিদের ঘরের আলমারিতে রঙ চটেছে। বাড়ির কাছেই খুব ভালো মিস্ত্রী এসেছে। তাদের হাতের জাদুর প্রশংসা মানুষের মুখ থেকে আবিদের কানেও এসে ছড়িয়েছে। আবিদ সেই সুনামেই ভর দিয়ে আলমারি রঙ করতে পাঠাবে। সব প্রয়োজনীয় কাগজ বের করা হচ্ছে আলমারি থেকে। আবিদ বহুদিন পর তার কাগজগুলোতে চোখও বুলিয়ে নিচ্ছে এক মুহূর্ত করে। কিন্তু একটা কাগজে চোখ আটকায়! মুহূর্তের সীমা বেড়ে কয়েক মুহূর্তে দাঁড়ায়। কাগজের উপরে বড় বড় করে নিকষ কালো ফন্টে লেখা, নিমতলী আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরপর সারি সারি করে লাইন! ছাত্রের নাম, পিতার নাম, মাতার নাম!
হয়তো কখনো রহিমকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিল সালেহা বুয়া। আবিদ পড়ে নেয় চোখের পলকে। ছাত্র রহিম আর মাতার নাম সালেহা বেগম ঠিক থাকলেও পিতার নাম দেখে পুলকিত হয় আবিদ। পিতার নাম ছাড়া ছাড়া অক্ষরে লেখা, ‘আ সা দু জ্জা মা ন।’ আবিদের মনে তখন তাপদাহ। চৈত্রের সেই দুপুরের মতোই, যে দুপুরে সালেহা বেগম মারা গেছে। আবিদের চোখে জল, বিষাদের। ‘ও ভাইজান কান্দেন ক্যান?’ কান্নার কারণ জানতে প্রশ্ন করে রহিম। কখন ছোট্ট রহিম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি সে। আবিদ আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় তার মাথায়। এই রহিম যে তারই ভাই! আসাদুজ্জামান আবিদের বাবা। সালেহা বুয়া এ বাড়িতে কাজ করতে আসার মাস সাতেক আগেই তিনি গত হয়েছেন, হৃদরোগে।
আবিদের সামনে অঙ্ক ভাসে। যে অঙ্কের শেষ লাইনটা আবিদ এতদিন খুঁজেছে, তা এখন তার হাতে; আলমারিতে পাওয়া কাগজটা। অঙ্কের সমাধান সে শেষ করেছে। সালেহা বুয়া তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। যার স্বীকারোক্তি কখনোই সালেহা করে যাননি। আবিদের চোখ আবার নোনাজলে ঝাপসা হয়। তার পেছনের কারণটা বিষাদ, এতদিনে খুঁজতে থাকা কিছু পাওয়া, নীরবে কিছু সওয়া, নাকি অন্যকিছু? প্রশ্নের জবাব ধরার আগেই রহিম আবার বলে ওঠে, ‘ও ভাইজান কান্দেন ক্যান?
গল্পের বিষয়:
গল্প