ফুলে ফুলে সাজানো বাসর ঘরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে আঁখি। শ্বশুরবাড়ি দুরে থাকায় এতো রাতে যাওয়া হয়নি। বর যাত্রীরা সবাই রয়ে গেছে। বাহিরে বিয়ের নানারকম গান বাজছে।
-আঁখির ভাবী এসে টিপ্পনী কেটে বলে কি গো ননদিনী কেমন লাগছে অপেক্ষা করতে?
-আখি জবাব দেয় আমার বয়ে গেছে অপেক্ষা করতে, তোমার শুধু ফাজলামো।
-হাসেন ভাবী ওদিকে তোমার বর যে উসখুস করছে এখানে আসার জন্য।
-লজ্জায় লাল হয়ে যায় আঁখি, যাও তুমি আসলেই একটা ইয়ে । হয়েছে হয়েছে ঢং করতে হবেনা, এখনি বর চলে আসবে রেডি হয়ে নাও বলেই চলে যায় ভাবী লিলি বেগম।
-ভাবীর কথায় নিজে নিজেই লজ্জাবতীর মতো কুঁকড়ে যায় আঁখি।কিশোরী এই মেয়েটি বিয়ে করতে না চাইলেও পরিবারের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ে সে। গ্রামের মেয়েরা একটু বড় হলেই চারিদিকে বিয়ের গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। তাইতো আজকের এই আয়োজন। ঘটকের সাথে ছেলের মা এসেছে মেয়ে দেখতে। ভাবী যখন আঁখিকে বলতে গেলো বিয়ের কথা, কিছুতেই যাবেনা ও পাত্র পক্ষের সামনে।
– আমি বিয়ে করবো না ভাবী পড়াশুনা করবো।
-লিলি অনেক বুঝিয়ে ওকে নিয়ে যায় ছেলের মায়ের সামনে।
আঁখি অনেক লক্ষী এবং পরিবারের বাধ্য মেয়ে। ভাবীকে অনেক ভালোবাসে। লিলিও ওকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে।ছেলের মা যখন পছন্দ করে আংটি পড়িয়ে দেয় সে প্রতিবাদ করতে পারেনা কারণ, লিলি ওকে চুপ থাকতে বলেছে।
পরদিন আঁখির বাবা পাত্রের ঘরবাড়ি দেখে আসেন। ইঞ্জিনিয়ার সুদর্শন পাত্র কিছুতেই হাতছাড়া করলেন না। আদরের মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রই পেয়েছেন।লিলি ছেলের একটা ফটো এনে বলে দেখ আঁখি কি সুন্দর দেখতে তাইনা? গাল ফুলিয়ে থাকে আঁখি না দেখবো না যাও তুমি। ওকে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে লিলি বলে মেয়েদের একদিন না একদিন শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়রে পাগলী। তখন ঐ ঘরটাই সব থেকে আপন এবং ঐ মানুষটাই সব থেকে কাছের। এবার দেখ তোর সাথে বেশ মানাবে ওকে, তবে ইঞ্জিনিয়াররা বউয়ের খেয়াল কম রাখে বলেই হাসে লিলি। আমার পরীর মতো ননদিনীর খবর নিশ্চয়ই রাখবে। তার দুদিন পরেই বিয়ে হয়ে গেলো।
বাসরঘরে বসে পুরনো কথা মনে পড়ছে। আজ বাসর রাত ভাবতেই আঁখির কেমন লজ্জা করছে।চেনা নেই জানা নেই তার জন্য বসে আছে নির্জন ঘরে। দরজার বাইরে ঘরে ঢোকা নিয়ে হট্টগোল হচ্ছে। এক সময় হট্রগোল থেমে গেলো।দরজা খোলার শব্দে চমকে আরও জরসড় হয়ে পড়েছে। লিলি, বর এবং বরের দুলাভাই এসেছে এক সাথে। লিলি আঁখির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে অপেক্ষা শেষ এবার বরকে সামলাও।আঁখির হাত নিয়ে ওর বরের হাতে তুলে দিলো লিলি। তারপর বললো, ভাই নজরুল, আজ থেকে ওর সব দায়িত্ব তোমার দেখে রেখো।নজরুল আঁখির বরের নাম।নজরুলের দুলাভাইও কম যায়না। আঁখির পাশে গিয়ে বললো, আমার শ্যালকটাকে ভালোমতো আঁচলে বেধেঁ রেখো। সারাদিন অনেক ধকল গেছে এবার তোমারা বিশ্রাম নাও কথা বলেই কানে কানে কিছু বলে দরজা লক করে চলে যায় লিলি এবং দুলাভাই।
ঘরে নিরবতা বিরাজ করছে। নিরবতা ভেংগে কথা বলে নজরুল দেখো আমি মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলিনি।আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে? লজ্জায় কথা বলতে পারেনা আঁখি। বললে না পছন্দ কিনা? মাথা নেড়ে জানায় পছন্দ হয়েছে। অনুমতি নিয়ে ঘোমটা খোলে আঁখির রুপে মুদ্ধ হয়ে যায় নজরুল। চোখ বন্ধ করে থাকে আঁখি।স্বপ্ন্বের মতো কেটে যায় ওদের বাসর রাত। পরদিন সকালে ভেজা চুল আচড়াচ্ছিলো ড্রেসিং আয়নার সামনে। নজরুল ঘুম ভেংগে দেখছিলো ওকে। নেমে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বউকে।চমকে পেছন ফিরে আঁখি। নজরুল অবাক হয়ে তাকায় আঁখির দিকে হাতটা শিথিল হয়ে আসে। আঁখির চোখ ট্যাড়া। নজরুল থুতনি উঁচু করে ভাল করে দেখে তাইতো দুটো চোখই ট্যারা। কেউতো বলেনি বউ ট্যাড়া ওর মাথায় যেনো আকাশ ভেংগে পড়লো না এটা মেনে নেওয়া যায়না।
দুলাভাইয়ের কাছে সব ঘটনা খোলে বলে। ঘটক বলেনিতো মেয়ে ট্যারা তাহলে আমরা কেনো ভুক্তভুগী হবো। দুলাভাই নজরুলকে সান্তনা দিয়ে বলে ভাবিস না দেখি কি করা যায়? আঁখির কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে সত্যিই ট্যারা।ব্যাপারটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে চাকুরীর দোহাই দিয়ে বউ না নিয়ে চলে যায়। দুদিন পরই ঘটক এসে জানায় ট্যারা মেয়ে নিবেনা।প্রতারক পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। আঁখিদের পরিবার নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং নজরুলের পরিবারের নিকট সবিনয়ে ক্ষমা চায়। তারপরও নজরুল ক্ষমা করেনা। ছয়মাস অপেক্ষা করে আঁখি একদিন পালিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়।
শ্বাশুড়ি কিছুতেই ওকে ঘরে উঠতে দেয়না। নজরুলের মা পরীর মতো রুপবতী। নজরুল মাকে খুব ভালোবাসতো ওর মা আঁখিকে মেনে নিলে নজরুল আঁখিকে গ্রহন করতো।নজরুলের মা যখন আঁখিকে ঘরে তুলে নেয়নি, আঁখি তখন বাহিরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলো। পাশের বাড়ির এক মহিলা দয়া পরবশ হয়ে বলে দেয় পাশের গ্রামের চেয়ারম্যান নজরুলের মামা সেখানে যেতে ।মামা শ্বশুর চেয়ারম্যান ন্যায়পরায়ন ভালো মানুষ।বিয়েতে চেয়ারম্যান সাহেব যাননি।চেয়ারম্যান সাহেবের চার মেয়ে। আঁখির ভেজা চোখ দেখেই বুঝতে পারেন মেয়েটির দুঃখ। এই মেয়েটিকে নিজের কন্যার মতো যত্নে বাড়িতে তুলে নিলেন।
নজরুলের মাকে ডেকে এনে বুঝালেন যেনো আঁখিকে ঘরে তুলে নেয়। নজরুলের মা কিছুতেই ভাইয়ের কথা রাখলেন না। নজরুল আসেনি। আঁখি পায়ে ধরে শ্বাশুড়ির কাছে ক্ষমা চাইলো তবুও নিঠুর শ্বাশুড়ির মন গলাতে পারেনি।চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী আঁখিকে অনেক আদর করতো। আঁখির কান্না দেখে নিজেও কান্না করতো চুপিচুপি। ননদকে কিছুতেই বুঝাতে পারলেন না। একমাস পর চেয়ারম্যান সাহেব আঁখির বাবা ভাইকে খবর দিয়ে ওদের হাতে তুলে দেয়।এর আগেই ওর বাবা ভাই ভাবী অনেক বুঝিয়েছে আঁখিকে যাতে নজরুলকে ভুলে যায়।জীবনের প্রথম আঁখি বাবা ভাইয়ের অবাধ্য হয়ে বাড়ি ছাড়ে।আঁখির জন্য চেয়ারম্যান বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ কান্না করে।জীবনের প্রথম পুরুষ যাকে সবকিছু সঁপে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। তাই কিছুতেই নজরুলকে ভুলতে পারেনি আঁখি।তালাকনামা হাতে পেয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে অনিয়ম করে নিজের উপর। কারও সাথে কথা বলেনা একেবারে চুপচাপ। একসময় আস্তে আস্তে মানসিক রোগী হয়ে যায়।
বিঃদ্রঃ কিছুদিন পর নজরুল আবার বিয়ে করে ওর তিনটি মেয়ে হয়। দুটি মেয়ে Abnormal। নজরুলের বউ শ্বাশুড়িকে একেবারেই সহ্য করতে পারতো না। বউটি বুঝতে চাইতো না এই মায়ের জন্যই তার এ বাড়ির বউ হয়ে আসা। খুব খারাপ ছিলো নজরুলের পরের বউটি। শ্বাশুড়ি কে সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে যায়। নজরুল এখন একা থাকে মাকে নিয়ে।এটা কি প্রকৃতির প্রতিশোধ???
গল্পের বিষয়:
গল্প