বাবা হো হো করে হেসে বললেন— তোর মায়ের মুখে কী যেন হয়েছে। কথা বলতে পারে না। বিয়ের পর থেকে আমাকে অত্যাচার করার ফল ভোগ করছে! হা হা হা! আমি কোনোদিন দেখিনি মা বাবাকে অত্যাচার করেছেন। বাবা আরেকটা বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। মা সে কাজটা করতে দেননি। থানা পুলিশ করে ছেড়াবেড়া ( আউলা-ঝাউলা অর্থে, কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় ছেড়াবেড়া) করে রেখেছিলেন। যে কারণে বাবা আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেননি। এটাই তাঁর কাছে অত্যাচার মনে হয়! আমি জিজ্ঞেস করলাম— বাবা, মা আপনাকে কী অত্যাচারটা করেছে শুনি?
‘ অমা তুই জানিস না? তোর মা তো পাগল! তাছাড়া আমার কথা বাদ দে। তোর যে এত বয়স হয়ে গেছে। তোকে বিয়ে করাচ্ছে? কত করে বলি ছেলের বয়স হয়েছে বিয়ে করাও। না সে করাবে না। ছেলের না কি বয়স হয়নি। এটা তোর সাথে অন্যায় করা হচ্ছে না? ‘ মার ধারণা আমি বিয়ে করলে। বউ এসে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবে! এই ভয়ে আর বিয়ে করাচ্ছেন না। মাথা থেকে গাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। কক্সবাজার থেকে ঢাকা। লম্বা একটা সময় বাসে থাকতে হয়। শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে মা কিছু একটা বলতে চেয়েও পারলেন না। দেখে কী যে খারাপ লাগল। মা কথা বলতে পারছেন না। এটা দেখতে আমার অনেক কষ্ট হবে জানতাম। এত কষ্ট হবে জানতাম না। চোখ ভিজে গেল অশ্রুধারায়।
মা জননীর বয়স হলেও মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেননি। এখনো এক প্যাকেট মিষ্টি একারই লাগে। বাবা খান না। বাবাকে ডাক্তার বলেছিল মিষ্টি খেলে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাবেন। এ কথা শুনে বাবা আর মিষ্টি ধারেকাছে যান না। কোনোভাবে বুড়ো হয়ে গেলে বিপদ! আরেকটা বিয়ে করা যাবে না। মা খাটের মাঝে সোজা হয়ে শুয়ে আছেন। গায়ে কাঁথা দেয়া। মার পা ছুঁয়ে সালাম করে বললাম— মিষ্টি এনেছি মা। এবার বাবার জন্য কিছুই আনিনি। বেতনের সব টাকায় শুধু মিষ্টিই এনেছি। বাইরে গাড়ি ভর্তি মিষ্টি। মা বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন— এত মিষ্টি আনলি কেন? নষ্ট হয়ে যাবে তো। আমি বললাম— নষ্ট হবে না। এখন তো আমাদের ফ্রিজ আছে। বাবা ঘরে ঢোকেননি। বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর গলা খাঁকারি দিচ্ছেন। বাবার ডাকে সাড়া দিলাম।
‘ আমার জন্য কী আনলি এবার? প্যান্ট? ‘
‘ প্যান্ট পরার বয়স আছে আপনার? আপনি পরবেন লুঙ্গি পাঞ্জাবি। ‘
‘ তোরা শিক্ষিত হলি, স্মার্ট আর হলি না। প্যান্ট পরার কোনো বয়স আছে না কি? ‘
‘ আছে, দাড়ি চুল পেঁকে গেলে প্যান্ট পরা যায় না! ‘
‘ রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে চিনিস না? তাঁকে সারাক্ষণই টিভিতে দেখি শার্ট প্যান্ট পরে আছে। তাঁর চেয়ে বেশি বয়স আমার হয়েছে? ‘
‘ এত যুক্তি দিয়ে লাভ নাই বাবা। আপনার জন্য এবার কিছুই আনিনি। ‘
‘ জানতাম, তা গাড়ি ভর্তি শুধু মিষ্টি না অন্য কিছুও আছে? সিগারেট টিগারেট? ‘
‘ এ জাতীয়ও কিছু নাই! ‘
বাবা মুখটা বেজার করে বললেন— বড় হলি, ভদ্রতা আর শিখলি না। বাবার মুখের উপর না! ‘ একটু পর বাড়িতে কেউ একজন এল শুনলাম। কে এলো বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন— একটা সুন্দরী মেয়ে আসে তোর মার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে।
‘ মার সাথে কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখাসাক্ষাৎ করবে কেন? ‘
‘ ঐ মেয়ে হাসপাতালের নার্স। প্রতিদিন এসে শরীরের তাপমাত্রা টাপমাত্রা দেখে যায়। আমার মনে হয় তোর মার দিন শেষ! আমি এতদিন পর স্বাধীন হব। ভাবতেই কত ভালো লাগে! ‘ বাবার খুশির সীমা নেই!
মা যত তাড়াতাড়ি বিদায় হয় তত তাড়াতাড়ি তিনি আরেকটা বিয়ে করতে পারবেন। মার সাথে কোনোদিনও বাবা পেরে ওঠেনি। এর একটাই কারণ। মা লেখাপড়া জানা মেয়ে। কিছুদিন একজন আইনজীবীর সাথে কাজ করেছেন। ওখান থেকে থানা পুলিশ মামলা মুকদ্দমা খুব ভালো বুঝেন। নাহলে কবেই বাবা আরেকটা বিয়ে করে ফেলতেন। আমি শোবার ঘরে যেতেই মেয়েটা বলল— আপনি কে? এই ঘরে কী?
‘ আমি? ‘
‘ জি আপনি, আপনি কে? ‘
‘ আমি মহসিন। উনার ছেলে। ‘ মেয়েটা আমার কথা বিশ্বাস করল না বোধহয়।
‘ মার অবস্থা কেমন? ‘
‘ অবস্থা বেশি ভালো না! যে কোনো সময় একটা কিছু হয়ে যেতে পারে! ‘
‘ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন তাহলে? ‘
‘ আপনার বাবা দিচ্ছেন না। বলছেন বাড়ির বউ বাড়িতে মরবে।
হাসপাতালে না! ‘দেখলাম মা হাসপাতালের কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন। নিজেই হাসপাতালে যেতে চাচ্ছেন না। মার হাসপাতালভীতি আছে। ডাক্তার বাড়িতে নিয়ে আসবেন। তবু হাসপাতালে যাবেন না। বাবা আমাকে আবার ডেকে বললেন— এই মেয়ে কি তোর বয়সে ছোটো?
‘ কোন মেয়ে? ‘
‘ আরে নার্স মেয়েটা। ‘
‘ ছোটোই তো লাগছে। ‘
‘ বয়সে ছোটো মেয়েকে তুই মা ডাকতে পারবি? না পারলে আন্টি ডাকিস। আমেরিকায় বাচ্চারা স্টেপ মমকে আন্টি ডাকে। স্টেপ মম মানে বুঝিস তো? সৎ মা। ‘
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। বিয়ের প্রথম দিকে না কি বাবা খুব বউ পাগল ছিলেন। মার কাছ থেকে দূরে যেতেন না। তারপর হঠাৎই বউয়ের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়ে গেল। তখন থেকেই আরেকটা বিয়ে করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।‘ মা মারা গেলে আমি আর এ বাড়িতে আসব না। কাউকে আন্টি ডাকারও প্রয়োজন পড়বে না। ‘ বাবা কথাটা শুনে রেগে গেলেন। ‘ এ বাড়িতে আসবি না মানে কী? এ বাড়ি কি আমার? এ বাড়ি তো তোর। এটা তোর দাদার বাড়ি। জন্মসূত্রে আমার হয়েছে। জন্মসূত্রে আবার তোর হয়েছে। নিজের বাড়িতে আসবি না মানে? ‘ ‘ আসব না মানে আসব না। আমার বাড়িঘর দরকার নেই। আপনি বিয়ে করে বউ সন্তান নিয়ে থাকবেন। আমি কক্সবাজারেই কোনোরকম খেয়েপড়ে বেঁচে থাকব। ‘
‘ তুই আমার সাথে বেয়াদবি করছিস মহসিন? তুই করছিস আমার সাথে বেয়াদবি? আরে তোর মা তোকে কোলে নিত না। ঝগড়া করে আমার কাছে ফেলে রেখে বাপের বাড়ি চলে যেত। আমি তোর প্রস্রাব পায়খানা পরিষ্কার করেছি। রাতে ঘুমাতে দিতি না। আমি ঘুমালেই কান্না করতি। তোকে সারারাত বুকে নিয়ে বসে থাকতাম। সেই তুই আমার সাথে বেয়াদবি করছিস? ‘ বলেই বাবা বুকে হাত দিয়ে পড়ে গেলেন! পড়েই অজ্ঞান। আমি বাবা বাবা করে চিৎকার করলাম। ভেতর থেকে মেয়েটা বেরিয়ে এল।
‘ কী হয়েছে উনার? ‘
‘ মনে হয় হার্ট অ্যাটাক! হাসপাতালে নিয়ে চলুন তাড়াতাড়ি। ‘ আমার চিৎকার শুনে মা বেরিয়ে আসলেন। এসে বললেন— কীরে, কী হলো তোর বাবার? আমি কিছুক্ষণের জন্য বুঝতে পারলাম না কান্না করব না হাসব। আতঙ্কে বা ভয়ে মানুষের কঠিন রোগ হয়। আবার সেই একই কারণে কঠিন রোগ সেরেও যায়।
‘ মা, তুমি কথা বলতে পারছ? ‘
‘ কথা বলতে না পারার কী আছে? আমি অভিনয় করছিলাম দেখতে যে আমি অসুস্থ হলে তোর বাবা কী করে। আমাকে নিয়ে পড়ে না কি বিয়ে করার চিন্তা নিয়েই থাকে! আর তুই কী বলেছিস তোর বাবাকে? আমাকে এত কথা বলে, এত দুঃখ দেয়। তাও মনে আঘাত দিয়ে কিছু বলি না। আর তুই? ‘
‘ আমি তো কঠিন কিছু বলি নাই মা! বলেছি তুমি মারা গেলে আমি আর এই বাড়িতে আসব না! এটা কি কঠিন কথা? ‘
‘ কঠিন কথাই তো! এত বড় একটা কথা তুই উনাকে বলতে পারলি? এখন কী হবে? এখন যদি মারা যায়? তোকে আমি ছাড়ব না! ‘
মেয়েটা মাথায় হাত দিয়ে বলল— আপনারা এভাবে কথা চালাচালি করতে থাকলে উনি এখনই মারা যাবেন। আগে হাসপাতালে নিয়ে চলুন। আমরা তাই করলাম। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। মার কী কান্নাকাটি! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে দোয়া করছেন। দোয়া কেরাত করছেন। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছেন হাসপাতালেই। মার দোয়া কাজে লাগল। ডাক্তার দুদিন পর ডাক্তার বললেন— প্যাশেন্টের কিছুটা জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা দেখা করতে পারেন। মা এই কথা বলে দৌড়ে বাবার কেবিনে যাবেন না উড়ে যাবেন বুঝতে পারলেন না। কেবিনে ঢুকেই বাবার বুকে মাথা রেখে কান্না করতে লাগলেন। চিৎকার করে কান্না! মানুষজন জড়ো হয়ে গেল। হাসপাতালে কেউ কারো কান্না শুনে না। কিন্তু মার কান্না শুনল। বাবা কী বলতে চেয়েও পারলেন না। মুখে জড়িয়ে গেল কথা। ডাক্তার আবার এসে মাকে বাইরে নিয়ে বললেন— হার্টের রুগির সামনে কান্নাকাটি করা যায় না! তাহলে প্যাশেন্ট আর ভালো হয় না। অবস্থা খারাপের দিকে যায়!
‘ অমা! উনার তো কোনোদিনও হার্টের অসুখ ছিল না! এখন কোত্থেকে হলো হার্টের অসুখ? ‘
‘ অসুখ হতে এক সেকেন্ড সময় লাগে না। ‘ মা কী করবে বুঝে উঠতে পারেন না। বাবার সামনে গেলেই কান্না শুরু করে দেন। আমার সাথে চারদিন পর কথা বললেন— মহসিন, তোর বাবা কি মারা যাবে?
‘ না, হার্ট অ্যাটাক করলেই মানুষ মারা যায় না! ‘
‘ তুই এত পাষাণ মহসিন! আগে জানতাম না! ‘
‘ আমার ভুল হয়ে গেছে মা। আর বাবাকে কিছু বলব না। ‘
জ্ঞান ফিরলেও ডাক্তার বাবাকে রিলিজ দেন না। এই নিয়ে মার আরও চিন্তা! একে তো তিনি হাসপাতাল একদম পছন্দ করেন না। এখানে সুস্থ মানুষই না কি অসুস্থ হয় বেশি। তার উপর বাবার হচ্ছে না রিলিজ। বাবার হাসপাতালে এক সপ্তাহ হলো। নার্স মেয়েটা বাবার রুম থেকে মুখ কালো করে বেরিয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম— কী হয়েছে? ‘ উনি তো বলছেন আরেকটা বিয়ে করবেন! আরেকটা বিয়ে করলেই না কি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার মার কাছে অনুমতি চেয়েছেন! ‘
অন্য সময় হলে মা বলতেন— স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্বামী আরেকটি বিয়ে করা আইনত অপরাধ। সে অপরাধে জেল কাটতে হয়! বাবা এই কথা শুনে দমে যেতেন। কিন্তু মা এবার বলল— বিয়ে করলে সুস্থ হয়ে যাবে তো? ‘ হওয়ার কথা। তখন মনে আনন্দ পাবেন। মনের আনন্দই এই রোগের একমাত্র ওষুধ। ‘ মা রাজি হয়ে গেলেন। নিজে গেলেন বাবার কাছে। ‘ আপনাকে আরেকটা বিয়ে করার অনুমতি দিলাম। আর আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার মুখের কিছুই হয়নি। আমি অভিনয় করেছিলাম। আপনার প্রতিক্রিয়া দেখতে। ‘ এ বলে মা বের হয়ে এলেন। চোখে পানি। বাবা যেন সুস্থই হয়ে গেলেন।বাড়িতে এলেন। বিয়ের আগে আমাকে নিয়ে গেলেন শাড়ি কিনতে।
‘ মহসিন। ‘
‘ হুঁ। ‘
‘ ঐ নার্স মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে। আমি ওকে বলেছি। সে বিয়েতে রাজি। ‘
‘ ভালো, বিয়ে করেন। এই বয়সে অনেকেই বিয়ে করেন। এটা তেমন কিছু না। ‘
‘ আমি আমার কথা বলছি না। তোর কথা বলছি। আমি যেন সুস্থ হয়ে ওঠি। এ জন্য তোর মা আরেকটা বিয়ে করারও অনুমতি দিয়ে দিল। অথচ আমি তোর মাকে কত কষ্ট দিয়েছি। আমি মানুষ না মহসিন। পশু শ্রেণির কেউ। ‘
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি আবার বললেন— মহসিন, আমি কিন্তু ওই নার্স মেয়েটার জন্য শাড়ি কিনতে আসিনি। তোর মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছি। ওই মেয়েকে শাড়ি কিনে দিবি তুই। ওটা তোর দায়িত্ব। বাবা হিসেবে মাঝেমধ্যে আমি দিতে পারি। তবে ওই মেয়ের দেখাশোনা করার আমার দায়িত্ব না। তোর মার দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমার। ‘ আমি এবারও কিছু বলতে পারলাম না। কয়েকটা শাড়ি কিনে আমরা বাড়ি এলাম। এসে দেখি মা বাড়িতে নেই। মা বাড়িতে নেই মানে নানু বাড়িতে গেছেন। আর কোথাও তিনি যান না। বাবা বললেন— কী যন্ত্রণা দেখ। শ্বশুরবাড়িতে গেলে এখন তোর মামারা মারধর শুরু করে দেবে!
‘ ফোন করো, তাহলেই তো হয়। ‘
‘ না, ফোন করব না। মেয়ে মানুষ একা একা স্বামীর বাড়ি আসবে কেন? ‘
‘ মা নানুবাড়ি গেলে তো একাই আসেন। ‘
‘ তুই বাড়িতে থাক। আমি তোর মাকে আনতে যাচ্ছি। ‘
‘ মামারা যদি মারধর শুরু করে দেয়? ‘
‘ তার আগেই আমি ওদের পায়ে পড়ে যাব। যা অপরাধ করেছি! ‘
বাবা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন গাড়িগুলো নিয়ে। বাবা যেতে যেতেই নার্স মেয়েটা এল। তাঁকে আজকে বেশি সুন্দর লাগছে! বিয়ের কথা উঠতেই মেয়েদের রূপ কয়েক দফা বেড়ে যায়।
‘ বাড়িতে কেউ নাই মনে হচ্ছে? ‘
‘ জি, কেউ নাই। ‘
‘ আপনার নাম মহসিন? ‘
‘ জি, মহসিন। ‘
‘ কক্সবাজারে থাকেন? ‘
‘ জি না। কক্সবাজারে চাকরি করি। সেই সূত্রে থাকতে হয়। থাকা আর চাকরি করা এক না। ‘
‘ আপনি কি সবসময় জি জি করেন? ‘
‘ জি। সবসময় জি জি করি। ‘
‘ সবসময় জি জি করা মানুষ অসহ্যকর হয়। ‘
‘ আমাকে অসহ্যকর লাগছে? ‘
‘ কিছুটা লাগছে। ‘
‘ তাহলে তো সর্বনাশ! আমাকে সারাজীবন সহ্য করতে হবে না? ‘
‘ আমি কেন আপনাকে সহ্য করতে যাব? ‘
‘ সহ্য করবেন না? ‘
‘ অবশ্যই না। আমার টাকা পাওনা আছে। টাকাটা নিয়েই চলে যাব। এই বাড়িতে আমার ডিউটি শেষ! ‘
বাবা কি আমার সাথে তাহলে মিথ্যা বললেন? আমি আরো হবু স্ত্রী ভেবে মেয়েটার সাথে ফ্লার্টিং শুরু করে দিলাম!
‘ কত টাকা আপনার পাওনা? ‘
‘ দশ হাজার! আমার জন্য নার্সিং করাটা খুব সোজা। কিন্তু আমি করেছি অভিনয়। অভিনয় হলো কঠিন কাজ। কঠিন কাজটা আমাকে অনেক দিন করতে হয়েছে। তাই দশ হাজার। ‘
‘ আপনি বসেন। মা এলে দিয়ে দেবেন আপনার টাকা। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
মেয়েটা বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেল। টাকাটা মনে হয় খুব জরুরী দরকার। এজন্য যেতে পারছে না।
‘ বিরক্ত লাগছে আপনার? ‘
‘ লাগছে, কিন্তু করার তো কিছু নাই। ‘
‘ করার অনেক কিছুই আছে। আমরা মিথ্যা কথার একটা খেলা খেলতে পারি। যেমন এখন থেকে টানা পাঁচ মিনিট মিথ্যা কথা বলব। যে বেশি মিথ্যা কথা বলবে সে হবে বিজয়ী। ‘
‘ বিজয়ীর পুরস্কার কী? ‘
‘ এক কাপ চা! মিথ্যা কথার পুরস্কার এর বেশি কিছু হওয়া ঠিক না। ‘
মেয়েটা এই কথা শুনে হাসল। জেনেশুনে হাসল না মন থেকে হাসল বুঝলাম না। মেয়েরা নকল হাসি দেয়ায় পারদর্শী। সবচেয়ে বেশি নকল হাসি দিতে পারে ছেলেদের সামনে। ওই হাসি দেখে ছেলের অর্ধেক রাতের ঘুম হাওয়া।
আমারও তাই হবে কি না বুঝতে পারছি না। উঠোনে রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দ। দুজনে বেরিয়ে গেলাম। মা বাবা দুজনে রিকশায় বসে আছে। মার গায়ে নতুন শাড়ি। বাবার গায়ে নতুন পাঞ্জাবি। একেবারে দুলহান দুলহা। মা আমাদের দেখে লজ্জায় মুখ কোথায় লুকাবেন বুঝতে পারছেন না! বাবা বললেন— মহসিন তুই এই মেয়েকে নিয়ে বাড়ির বাইরে থেকে ঘুরে আয় কিছুক্ষণের জন্য!
‘ কেন? ‘
‘ আর বলিস না। মেয়ে মানুষের কল্পনাশক্তি কত যে শক্ত। বিয়ের সময় তোর মাকে না কি কেউ কোলে করে বাড়িতে ঢুকায়নি। আজকে আমাকে সেজন্য কোলে করে বাড়িতে ঢোকাতে হবে! তাছাড়া না কি রিকশা থেকেই নামবে না! ‘
বাবার কথা সত্য। সেটা মার নীরবতা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
আমি বাইরে চলে এলাম। সঙ্গে নার্স মেয়েটাও। মেয়েটার নাম জিনিয়া। নামটা বিদেশি বিদেশি লাগে। তবু ঠিক আছে। আজকাল মেয়েদের নাম যা তা হয়। ভারতের এক গায়িকার নাম আস্তা গিল! মানুষের নাম কেন আস্তা গিল হবে? সে কি মুরগীর রেজালা না তেল আলুর শিঙাড়া যে আস্তা গিলবে? গেটের কাছে এসে দুজনে দাঁড়াতেই জিনিয়া বলল— আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে উস্টা খেয়ে পড়বেন! জিনিয়ার বলতে দেরি হলো, মাকে নিয়ে বাবার উস্টা খেয়ে পড়তে দেরি হলো না! দুজনেরই মনে হয় কোমরটা গেছে!
গল্পের বিষয়:
গল্প