মাধু বাসন্তী

মাধু বাসন্তী

অবশেষে আমি এক আকাশ নি-িদ্র অন্ধকার পান করতে থাকি আকণ্ঠ। টের পেতে থাকি, আমার বুক বেয়ে নামছে তরল আগুন। অতৃপ্তির উদ্গিরণে ঢেঁকুর তুলতে থাকি অনবরত। অসুখের নিস্তেজ আরামবোধে আমি নেতিয়ে পড়ি। আমার পাকস্থলী ফুটো হয়ে হয়ে অস্থিমজ্জা তন্ত্রীতে শুরু করছে তুমুল আন্দোলন! আমার মাথার খুব কাছে কোথাও বাজতে থাকে ঝনঝন শব্দ। আমি প্রস্তুত হই। এই বুঝি মৃত্যু এলো। আমি আমার সর্বস্ব নিয়ে অপেক্ষা করি সেই অন্তিম সময়ের। আমার ইতিহাস মানবিক বৈকল্যের। হাহাকার নামক অনুভবের কাছে আমি কতকাল পরাজিত, কতকাল আমি শিহরিত হই না পবিত্র সুখে। আমার চারপাশ শৃঙ্খলিত, আমার মাথার ওপর ঢেকে রাখা যে-আকাশ তা ঘর নামক আদিম গুহা হয়ে আমায় গিলে নিয়েছে, চিবিয়েছে, কামড়েছে। সেই পীড়ন অথবা চর্ব্যচূষ্যে দিনে দিনে আমি নিজের কাছেই হয়ে উঠেছি রসহীন ছোবড়ামাত্র! আজ আমি মরবই। আমার আত্মপ্ররোচিত সহস্র আত্মাভিমান আমায় সাহস দিয়েছে। সংসার নামক অপ্রয়োজনীয় আদিম অসভ্য বন্ধনে আমার অসুখ করেছে। আর না। আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে যে-রমণী সে যদি উপুড় হয়ে একটু নড়ে ওঠে তবে সেখান থেকেই ঝুরঝুর করে পড়বে আমার ব্যর্থতার আমলনামা। আমার অতৃপ্ত, অসংযত মনে তাকে আমার মনে হয় বিরোধহীন বিরোধীপক্ষ। তাকে প্রণয়ী হিসেবে নেয়নি মন, সে এক উপেক্ষা – এ-ভাবনায় সুখ। সর্বোপরি সে আমার এক বুকবিমুখ, এক সমুদ্র অপ্রেমের দহনবিষ। মরণের এই প্রাক্-মুহূর্তে আমি অস্ফুট চোখে দেখি তাকে। আমার কর্তৃক অস্বীকৃত এই তো মনোহর সুন্দরী, অভিযোগহীন নীরবতা কেমন অসীম সমর্পণ নিয়ে শুয়ে আছে আমার বিছানায় আমার পাশেই। আমি তাকে ঘৃণা করতে করতে আজ নিজেকে মৃত্যুদ- দিলাম। আগামীর সূর্য সে একাই দেখুক। জানি না, আমার কালকের সকালটা কেমন হবে? কেমন হবে ভোর, কেমন হবে দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদ! অন্ধকারে কান পাতি শেষবারের মতো, উৎসুক আবেগে শুনতে চাই নিঃস্ব হওয়ার পূর্বাভাস, পৃথিবীর শেষ কোলাহল তবে এমন! আচ্ছা, কেউ কি কাঁদছে আমার সমূহ বিচ্ছেদ-সম্ভাবনায়? হয়তো! ওই যে দূরে শোনা যাচ্ছে একটা পাগলা কুকুরের কুঁইকুঁই কান্নার শব্দ। সে নিশ্চয়ই আমার আত্মীয়? আহা কাঁদুক পাগলটা। বোবা রমণীর কান্নার চেয়েও তার কান্না অধিক কোমল, সহনশীল, আমার
তৃপ্তি হয়। আমার ভেতরের পশুটা তেতে ওঠে রাগে। নয়ন কাঁদে না কেন? কেন সে এত নিঃসার! ওর ঘুমন্ত মুখ কেন এত বেশি নির্দোষ! ওকে যখন সঙ্গমহীন হিংস্রতায় আঁচড়াই-কামড়াই তখনো ও এমন। বেশি মারলে গোঙায়! মুখ দিয়ে পড়ে লালা, ওর নরম গাল ভেসে যায় লালে, চোখের কোণে চিকচিক করে রক্তজবা ফুল। ওর কান্নায় আমার সুখ হয়, লালে ভরে যায় চারপাশ। রক্ত লাল, আলতা লাল, বাসন্তী লাল! আমি চোখ ফেরাই। নয়ন এখন পালটে যাবে মুহূর্তেই। যে-মুখ বিস্মৃত হতে চাই সে-মুখেই ওর ছদ্মবেশ পড়ে। ওই যে লাল। এই কাপড়ের পুঁটলিতে জমে থাকা মানুষটার ক্রমাগত লাল হয়ে যাওয়া দেখব না বলেই মৃত্যু চাই। এই মৃত্যুচক্রে নয়ন বহুরূপী। ওর হেলানো মাথা, ছেঁড়া শাড়ির আলুথালু বেশ, হাঁটু পর্যন্ত সাদা চামড়া আমায় প্ররোচিত করে অন্য কোনো রূপ ধরে। পা থেকে দেখতে দেখতে মুখের ওই লাল অংশটায় গিয়ে আমি আটকে যাই অবধারিতভাবে। আমার গা ঝিমঝিম করে, মাথা হয় ফাঁকা, লাল বিভ্রান্তিতে আমার পুরো শরীর হয় আস্ত হাঙর। যেন কতকাল ক্ষুধার্ত এই জলজপ্রাণ। আমি কাতর হই, আমি উন্মাদ হই, বাঘের ক্ষিপ্রতায় করাল গ্রাসে কাটি তার চামড়া!
এভাবে আর কত, এ যে ফাঁকি! আমার সুন্দরহীন জীবনে নয়ন মহামারির মতো বাড়িয়ে তুলছে ভ্রান্তির অসুখ। সমস্ত সকাল-দুপুর বা সন্ধ্যায় যে নেই সেই অসুখ হয়ে ক্লান্ত করে তোলে রাতে। আমি এ-অসুখ চাই না। আমার মধুসুখ সঞ্চয়ী পরানি নামের পরানসুখ আমায় ছেড়ে গিয়েছে সেই কোনকালে, সে-সত্য আমি বিস্মৃত হতে চাইলেও পারি না, বেভুলে নয়ন চলে আসে পরানি হয়ে। অথচ আমি জানি আমার প্রেম, আমার সাধনা একমুখীন, বহুমুখীর পাপ এ-জন্মে নয়। দারবিশ মিজান উদ্দিন বাউল আমাকে শিখিয়েছিলেন শিল্পীর সুখ বলতে একক প্রেম, মনোসংযোগ, আবেগের শুদ্ধাচার। ভোগের সুখ আর সাধনার সুখ এক নয়। সাধনার জীবনে প্রেম হয় রাগে; আলাপে আলাপে। এখানে প্রলোভনে নারী আসবে শতরূপে কামনায়, ঘোর অথবা মৃত্যু হয়ে। নারী প্রেম হলেই সুর – সামান্য ভুলে পতন। মনে রাখতে হবে সুরের জগতে মাংসাশী সুখের অপর নামই মৃত্যু। সাবধান! আমি সাবধান হতে পারিনি! সর্বনাশ হয়েছে আমার! পাকা সুরসাধকের মতো নারীশরীর ছেঁকে তুলে আনতে পারি না বিশুদ্ধ প্রেম। নিজের অসহ্য তৃষ্ণায় বলি হয়ে তাল ভুলে সেই কবেই বেতাল হয়েছি আমি, আর তার পতন চলছে এখনো। দারবিশ বলেছিল, সম্ভোগে সুখ চাই তো নাও কিন্তু তার কাছে বশীভূত হওয়াই মোহ, অভিশপ্ত হয় আত্মা। কথা সত্য। আমার অভিশাপে আমার নিজের আত্মা আজ নিস্তেজ। মায়ার কাঠি আর বাজে না সুরে। আত্মবিচ্ছিন্ন অতৃপ্তি নিয়ে অর্থহীন চিৎকারে আমার বাঁশি কাঁদে দশদিক। আত্মার সেই গলিত শব নিয়ে আমি বসবাস করছি ভুল ঠিকানায়, নয়নের সঙ্গে। এভাবে কত আর বেঁচে থাকা যায়!
তখন কত ছিল বয়স আমার? নিউস্টার অপেরায় রাগ-ভূপালি বাজাতাম। প্রতি শো শেষে অধিকারীবাবু জোর করে দর্শককে শোনাতে বাধ্য করতো আমার বাঁশির হংসধ্বনি, বেহাগ অথবা শিবমঞ্জুরি। সমঝদার কেউ না থাকলেও সময় কেটে যেত বেশ। চটুলের মাঝেও কেউ কেউ বুঝত সে-রাগের আলাপ। যেমনটা বাইরে, তেমনটা ভেতরে। প্রণয় বোঝার প্রথম সময়টাতেই আমি উড়ছিলাম অন্য কারো সুরের দমকা হাওয়ায়। ভেতর ঘরের সাজঘরে সাজ নষ্ট হচ্ছিল যার সেও তো এক সুর। আলতাপরানি – তার নাম দিয়েছিলাম আমি মাধু বাসন্তী! মঞ্চমাতানো মাতাল চোখের সে-নটসম্রাজ্ঞী আমায় আলস্য প্রেমে জাগিয়েছিল আমার প্রথম যৌবন, আমার শুদ্ধ আবেগ। আমি তাকে ভালোবাসতাম।

কেন তুমি এমন করে বাজাও শালুক?
মাধু বাসন্তী খুঁজি পরান।
সে বুঝি হয়নি তোমার?
হয়, আবার হয় না। দারবিশ বলেছিলেন ডুবে যেতে, ডুবতে গিয়েও পারি না যে পরানি!
কেন পারো না?
ক্ষত হওয়া অঙ্গার শরীরে পবিত্র প্রেমের পুরোপুরি ধরতে পারি না, শুধু জানি, মাধু বাসন্তী আমার আরাধ্য।
বাসন্তী সে যদি চায়?
হয় না, মল্লার আর বেহাগে আটকে যায় কোথাও। বাসন্তী অলীক, নিঃশঙ্ক হয় না অন্তর, আমার শরীর জুড়ে ব্যথার সুর, কোন রাগে বাজবে মাধু!
আলতা রঙে সাজাই যদি?
তরল রং, ভয় হয় সে যদি না টেকে?
রক্ত রং হলে টিকবে?
তবু ভয়; আমি অপয়া। সব রং গাঢ় থেকে আসে, তারপর তরল তরল ফিকে। তা আবার আলতা! তার তো দোসর অনেক! হাত পেতে আছে পা পেতে আছে কত কেউ!
তোমার হাত নেই পা নেই।
আছে, তবে আগে থেকেই তা রক্তরঙে রঙিন, প্রেম যদি হয় পবিত্র স্পর্শে তবে অশুচি করি কেমন করে?
ফিরিয়ে দিয়ো না, সামনে পথ।
হুঁ অন্ধকার, গাঢ় অন্ধকার পথ।
কোন শৈশবে নাকি আমার নাম ছিল তারু। পরানি আসার আগে অনাথ আশ্রমের ছেঁড়া কাঁথায় পৌষের শীতবাতাসে ফুঁপিয়ে কাঁদা সে আমি কৈশোরেও ছিলাম তারু। মধ্যরাতে দারবিশ নিজাম বাউলের সাধনসঙ্গী। বাউল আমার হাতে সুর মেশাত, পায়ে সুর মেশাত, বুক-পিঠ বেয়ে গলা পর্যন্ত সে-সুর উঠে আসতে আসতে শিশ্নে আটকে থাকত বহুক্ষণ। বাউলের হাতের তীব্র প্রেষণে আমি অজ্ঞান হতাম। নিউ অপেরায় বাঁশি বাজাতে বাজাতে তেহাইতে গিয়ে যেমন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া তেমনটা নয়। আলতাপরানিকে আমার বলা হয়নি আমার সেসব অজ্ঞানতার ইতিহাস। অপেরার জীবন ঘোরের জীবন, রঙের জীবন। সেখানে আমার শৈশব মৃত, কৈশোর মৃত, মৃত আশ্রমের তারু, ওখানে আমি গভীর প্রেমে একটু একটু করে সাহস সঞ্চয় করে বেঁচে উঠতে চাইছিলাম এক অন্য আমি হয়ে। পরানির মমতায় মায়াময় এক প্রেমিক পুরুষ হয়ে। আমার সুখ ছিল, সে-সুখে বাজাতাম রাতভর। সুরের দেবতার ক্ষমাহীন অত্যাচারে আমার কণ্ঠ ফুটো হয়ে বেরিয়ে আসত রাগ, লাল হয়ে যেত সাদা উত্তরীয় থান। চাপ চাপ দলা রক্ত! কণ্ঠের ওঠানামায় বিরামহীন ক্ষয়ে ক্ষয়ে আমার কণ্ঠ যখন হয়েছিল নিঃস্ব! তখন রাতশেষে গালিচাকোণে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতাম ব্যথায়! কাঁদতাম না, অপেক্ষা করতাম কারো। আলতাপরানি আসত মাঝরাতে, তুলে নিত ঘরে। নরম কাপড় ভিজিয়ে মাথায় চেপে রাখত অনেকক্ষণ। যষ্টিমধুর ডাল ছেঁচে গরমজলে তুলে দিত ঠোঁটে। গলনালি বেয়ে নেমে যাওয়া সে-তরল স্রোত ছিল আমার মৃতসঞ্জীবনী। পরানির হৃদয়ের উষ্ণতা, শরীরের উত্তাপ বাষ্পীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত আমার ভেতর-বাইরে। শরীরের চারপাশে। ঠিক তখুনি কোথাও বাজত বাসন্তী, আমি শুনতাম। পদ্মডাঁটার মতো জল টলমলে পরানির চোখ। আজ এই মৃত্যুমুহূর্তে আমি জানি, সেই চোখেই আমি বেঁচেছিলাম জীবনের অনন্ত সময়। বিস্মৃতির সেই সংক্ষিপ্ত সুখশেষে, হাজার রূপকথার রাত মিথ্যে করে পরানি একদিন হারিয়ে যায় নিঃশব্দে। এরপর আমার আর প্রেমিক হওয়া হয়ে ওঠেনি।
পরানি নিখোঁজ হওয়ার পর আমি দল ছেড়েছিলাম, কী লাভ ঘোরহীন জীবনে খররৌদ্র সয়ে! সম্ভোগতৃষ্ণায় জোড় বাঁধি অন্য কোথাও। আমার লোভী মন ধরতে না পারা সে বাসন্তীসুর পেতে চেয়েছি তবু। আমি ভুলে গিয়েছিলাম সাধনায় যা সুখ-সম্ভোগে তা অসুখ। পরানিকে ভুলতে চেয়েছি নয়নসুখে। অপেরায় পরানির চরিত্রটার নাম ছিল কমলা। চুলে বিনুনি করত, ঠোঁটে দিত টকটকা রঙিন লাল। সাদা গালে কী যেন লাগাত ঘষে ঘষে। তার দু-গাল হয়ে উঠত টকটকে! আমার মনে হতো রাক্ষসী রূপের মাদক-নেশাও বুঝি এমন হয় না। শোর মাঝে পরানি পানি খেত গপাগপ। পাগলাপানি। লাল চোখে খিস্তি করে বাড়িয়ে দিত মধ্যরাতের চাঁদোয়া মানুষের অশ্লীলসুখ। আমিও জমে গিয়েছিলাম সেই সুখে। সেই পরানি হারিয়ে গেল কোথায়! পরানি নেই তো সুখ নেই। না শ্লীল না অশ্লীল, পরানি নেই তো সুর নেই। পালটে গেল আমার জীবন! গার্হস্থ্যজীবনে সব আছে শুধু ছটফটে মনের মুক্তি নেই। পরানি কেন পালিয়ে ছিল কেউ জানে না। খুঁজে পায়নি কেউ। আচ্ছা ও কি মৃত, কে মেরেছিল আমার মাধুকে, আমার বাসন্তীকে। অধিকারীবাবু, নাকি আমি নিজে? পরানি একরাত খুব করে প্রেম চেয়েছিল আমার কাছে, মনে আছে খুব, আমার অনুত্থিত পুরুষাঙ্গ তাকে ভোগে চায়নি অথচ সে-ই ছিল আমার একমাত্র কাম্য। এখনো নয়ন কাঁদলে তার চোখ লাল হয়ে যায় ঠিক সে-রাতের পরানির মতো। আমার ভালো লাগে খুব, মনে হয় এই তো সেই লাল মায়া, আমার আলতাপরানি। লালে সুখ, লালে অসুখ। লালেই পরানির ধুতুরার বিষ!

আলতাপরানি আমায় শালুক ডাকত। মিজান দারবিশের তারু, পরানির শালুক মৃত শরীর নিয়ে নয়নের চারপাশে ঘুরে বেড়াত অনেক আগে থেকেই। আজ মরে যাবে নয়নের সেই মৃত দোসর। আহা আমার সুখ হয়, নিজ চোখে দেখতে পাই কেরোসিনের কুপির নীলচে আলোর নিচে পড়ে আছে আমার সেই লজ্জিত অনুতপ্ত মøান মৃতমুখ। পায়ের কাছে ঘুমন্ত রাজকুমারী সহচরী নয়ন। আচ্ছা, মানুষ কি একের অধিক ভালোবাসতে পারে? আলতাপরানি হারিয়ে গেলে আমিই তো তাকে এনেছিলাম এ-ঘরে! তাকে কী ভালোবেসেছিলাম! হায় আমার অকস্মাৎ কর্মের দায়, আমার পোড়খাওয়া আত্মার পরিণত শোক নয়ন, তুমি তো জানলে না ছটফটে পাখির শেকল পরার অসুখ। নয়ন পাশ ফেরে একবার। এরপর নিঃসার পড়ে রয় প্রতিরাতের মতোই অনন্তকাল। আমার মনে হয় সেও মৃত! এই জীবিত অথবা মৃত কে আমার আপন? নয়ন কথা বলতে পারে না। মাঝে মাঝে আমার এ-ইচ্ছেও হতো যদি ওর কথার জাদু সময়-অসময় আমায় ছুঁয়ে দিত আকস্মিক! কেমন হতো? ও নিঃশব্দ বলেই কি আমার এত যন্ত্রণা! ওর শরীর নিংড়ে কী চাই আমি? শব্দ, সুর, পরানি, না মাধু বাসন্তী – এও কী হয়! আমি তাকিয়ে থাকি গাঢ় অনুভবে ওর চোখের দিকে, ওর ঠোঁট কি নড়ছে একটু! সন্দেহ হয়। মেয়েটা বড় বেশি নিঃশব্দ, হাঁটায়-চলায়, ওঠায়-বসায় শীতল। এমনকি কাঁদতেও জানে না। জোড় বাঁধার সময় শুধু ঘাড় নেড়েছিল, ব্যস। আমি আমার অনন্তযাত্রার প্রাক্কালে আবার ময়নাতদন্ত করি নয়নের। ওর গালের ডানপাশটা অনেক বেশি লাল দেখাচ্ছে, সিঁদুর আর জবার মাঝামাঝি কেমন একটা লাল। গালের এই লালটা দেখার জন্যই ওকে আমি অযথা আঘাত করি যখন-তখন, এসব দিনক্ষণহীন, উপলক্ষবিহীন আঘাতে ইদানীং আমার হাত পেকেছে বেশ। বাঁশি ছেড়েছি, ছেড়েছি শালুক নাম, এখন আর আমার দায় কীসে, আমি এখন পরিপূর্ণ দানব, শুধু জাবর কেটে খাই মাংস। মেয়েটা যদি একটু কাঁদত তাহলে কি এমন হতো? নয়ন, বিচ্ছিরি নয়ন! সময় সময় অপার্থিব এক দুঃখীমুখ নিয়ে শুধু চেয়ে থাকে আমার দিকে অস্ফুট। আমার ঘৃণা হতো ওর সুন্দর মুখ দেখে। মনে হতো পৃথিবীর সকল দুঃখী মানুষের চেহারা এক, তবু সে-মুখপরানির মুখ নয়।

পরানিকে ওর বাবা বেচে দিয়েছিল সাড়ে চার বছর বয়সে। ঘা সয়ে সয়ে ও আগুন হয়ে উঠেছিল, নয়নের মতো নির্বাক বরফপি- নয়। ওর মুখ কেমন সুখী সুখী, ঠোঁট আহ্লাদী, অসহ্যরকম সুন্দর! ঈশ্বর বড় কৌশলী, প্রেম নামক অস্বচ্ছ আবরণে কখনো কখনো এত সুন্দরের মাঝেও আমাদের বেছে নিতে হয় নির্মম প্রেমহীন জীবন! আমার সহ্য হয়নি সে-জীবন। মানুষের বিমুখ অন্তরে অযথাই তিনি পুঁতে রাখেন হিংস্রতার বিষ! আমাদের এই নতজানু দাম্পত্য জীবনে ঈশ্বর এক রহস্যময় ভুল চাল চেলেছিলেন। ভেবেছিলেন জুড়ে দিলেই প্রেম হয় কিনা দেখি, হয়নি আমার। ঈশ্বরের রোখ চেপে গেল। সেই শুরু তার সঙ্গে আমার হারজিতের খেলা, তিনিও শোধ নিলেন, কুটিল কারসাজিতে পরানিতে আটকে রেখেছেন আমার সব। আমি আর প্রেমে নেই, অপ্রেমের অসুখ বড় ভয়ংকর! আচ্ছা এখন তো আমি মরে গেছি, নয়নকে ভালোবেসে যদি হারিয়ে দিই তাকে, কেমন হয়?

আমি বুঝতে পারছি, মৃত্যুর পর আমার চিন্তাগুলো ঠিকপথে এগোচ্ছে না। পরানির জন্য আমার যে জনম জনমের তৃষ্ণা তা চলতে শুরু করেছে অন্যদিকে। নয়ন, এই তো সে পাশেই শুয়ে, আহা চাঁদের আলোয় কী নরম মুখ! বিষের ছোঁয়ায় বহুযুগ পর হুট করে আমার শরীরে তাকে ভেবেই বান ডেকে যায়। যদিও আমি জানি, আজ আমার শরীর মৃত তবু মৃত্যুও একটু একটু করে সুখকর অনুভবযোগ্য হয়ে উঠছে আমার কাছে! বিষের প্রভাবে আমার ব্যথার পাহাড়ে নামছে ধস! বাধা ডিঙিয়ে আমার অবচেতন হাত জড়িয়ে রাখতে চাইছে নয়নের মুখ। বুকের কাছেই তো ছিল সে, আমি হাত বাড়াই, খুঁজি সে-মুখ। ওর বালিশের পাশে রাখা দু-তিনটে কাঁচা পেয়ারা উঠে আসে হাতে, হাট থেকে এনেছিলাম আজ। পেয়ারার অসমান বুকে কালশিটে দাগ, ভিড়ের মাঝে কেউ একজন হয়তো বসিয়েছে নখের আঁচড়! ঠিক আমার মতো কেউ। কোমলে আঁচড় কেটে যারা সংগ্রহ করে অন্ধসুখ তাদের কেউ। আমি ছুঁয়ে যাই তাকে, এভাবে প্রলম্বিত মুখস্পর্শে কী যেন হয়, শুক্লা দ্বাদশীর রাতে আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া গলিত জোছনার আলো আমায় জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে, লেপ্টে যায় সুখ। ষোড়শীর ব্যথাতুর চোখে মায়া আমার ভালো লাগতে শুরু করছে। ঠিক নেশায় চূর হয়ে পড়ে থাকার মতো, আমি দেখি, আবার দেখি, বারবার দেখি। মৃত অথবা পুনর্জীবিত এই আমি সে স্নিগ্ধ আলোয় অনুভব করি, তিরতির করে কাঁপছে নয়নের ঠোঁট! শব্দহীনের নিঃসার প্রেমে আমি আকুল হই, আমার ঠোঁট কেমন করে, কণ্ঠে জাগে উসখুস, কেমন লাগবে এই প্রণয়ীর অচেনা সুর! আশ্চর্য আমি নয়নের কাছে যেতে যেতে দেখি এই মনোবিকলনে কী যেন হয়ে যায় ব্রহ্মা-ে। স্রষ্টা স্বয়ং ছুটে আসেন ব্যস্ত হয়ে। হা হা হা করে হাসেন কিছুক্ষণ! নয়নের প্রতি আমার সকল অযাচিত অবহেলা আর অর্থহীন অত্যাচারের শাস্তির আয়োজন শুরু হয় চারপাশে। মহাবিশ্বে শুরু হয় প্রলয়নৃত্য। বাতাস কু-লিত শলাকায় ভর করে এলোমেলো ছুটতে থাকে আলোআঁধারিতে বন্যবেগে। দলছুট মেঘের উদ্দাম প্রলয়শেষে মনে হয় আমার ঘরের ছাদটা নেই। নয়নের মাথার শিথানটাও নেই। একটুকরা ফুসফুসীয় বাতাস লাখ লাখ কোটিগুণ হয়ে ঝড় হয়ে যায় বাতাসে। আমি আবার আঁধার হাতড়াই। নয়নের হাত খুঁজি, পা খুঁজি। পাই না। খুঁজে যাই, খুঁজেই যাই। উলটোদিকে কোথাও কিছু হয়, আমি ঝুপ করে পড়ে যাই মাটিতে। আহ্ ব্যথা! হঠাৎ আলোর ঝলকানি!

চোখ কচলে দেখি বড় একটা বাগান, ঘাসে নিড়ানি দেওয়া আলগা মাটিতে ছোট ছোট ঘাসফুল! তার ওপরে লম্বা একটা ছায়া গাছ, কত হবে দৈর্ঘ্য? বুকসমান, গায়ে তার পাঁচ-সাতটা ফুল! রং কালো অথবা বেগুনি? দিনের আলোতেও স্পষ্ট নয়।

আমার সামনে মু-িত মস্তকের এক বামুন। তার পেছনের এটাকে কী বলে? টিকি? কপালে তিলক! আমি ভেবে পাই না এটা কি স্বর্গ, নাকি নরক? নিশ্চয়ই নরক হবে। পুণ্যে অধিকার নেই আমার। জন্মসূত্রে আমি কোন ধর্মের ছিলাম মনে নেই, অন্ধকার আমায় ঘিরে ধরে, আমার ভয় হয়; তলিয়ে যাওয়ার ভয়, আমি দেখতে পাই আমার দিকে ধাওয়া করে আসছে একদল হিংস্র দানব, তাদের চোখ জ্বলছে। তাদের চোখের সেই ঠিকরেপড়া আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই সবকয়টা জন্তুর মুখে আমার আদল। নিজের ভয়ংকর রূপ দেখে আমি চিৎকার করি, গোঁ-গোঁ করি, ভয়ে ব্যাকুল হয়ে ডাকি – নয়ন! নয়ন!

আমার ডাক শুনে নয়ন আসে না। ভারী পায়ে সেই লোকটাই এগিয়ে আসে। আমার পা বেয়ে কিলবিল করে উঠছে শীতল সরীসৃপ! তবু ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে তার হাত ধরে আগাই বাগানের কাছে, সেখানে অজস্র নয়নতারা গাছ। লোকটা একটা গাছের ডাল ধরিয়ে দেয় হাতে। আমার পা কামড়ে ধরা জন্তুগুলো সরে যায়। এই পাতা, ক্ষয়ে যাওয়া বিবর্ণ ডালই তবে আমার অস্ত্র। আমি সাদা ফুলগুলো খুঁজি, পাই না, সব কালো হয়ে গেছে, কোনোটা খয়েরি হয়ে আছে কোনোটা বেগুনি! ফুলহাতে দাঁড়িয়ে থাকি বিমূঢ়। কানে আসছে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠের আওয়াজ – ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্। ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহষ্মি দিবাকরম! সূর্যমন্ত্র! অথচ কতকাল আমি সকাল দেখি না, নেশায় চূর হয়ে কাটাই দুপুর অবধি। লোকটার উচ্চারিত মন্ত্রে লাল নয়; কালো হতে শুরু করেছে পুবের আকাশ, একসময় আমার চোখ বসে যায় আঁধারে। আমি হাত উলটে চোখের পাতা ঢাকি। হাত থেকে একটা কালো ফুল গড়িয়ে পড়ে পায়ের পাতায়, সাদা হয়ে যায়। পবিত্র সে-ফুল তুলে নিই মাথায়। গন্ধ নেই ফুলটার গায়, স্নিগ্ধ দুঃখী ফুল! আমার হাতের নরম স্পর্শে ফুলটা নড়ে ওঠে, অনুভব করি আঙুলে পানির স্পর্শ। ফুলেরাও কাঁদে? আমি বুঝে যাই এ ফুল নয় শুধু – অভিমানী নয়ন! সেই রূপকথার গল্পের মতো রূপ পালটেছে। পরানি হতে হতে ক্লান্ত হয়ে আজ সে অন্যরূপে। এই তার নিঃশব্দ প্রতিবাদ। আমি প্রতিজ্ঞ হই এক্ষুনি তুলব সব ফুল। আর নয় আলতাপরানির ছল। প্রেম সে একমুখীই থাক, না বাজুক মাধু বাসন্তী, আজ তবে অভিমানঘরে কিছু একটা হোক। বিদ্রোহ চলুক দুজনের। আমি নয়নতারার আরো আরো গাছ খুঁজি, সব ফুল আমার! সেই আলো-অন্ধকারে আমি ছুটতে থাকি দিগি¦দিক। পথে পথে দেখতে পাই সেই খনখনে বুড়োর দানবহাত কিলবিল করছে অপরাপর নয়নতারার ডালে, নয়নতারার হাত ছিঁড়ছে, পা ছিঁড়ছে, বুকের মাঝখান থেকে খুবলে দিচ্ছে মাংস। আজ আমার ব্যথা হয়। মন কাঁদে। হায় আমার নয়ন, কথা-বলতে-না-পারা ফুল।
ছিঁড়বেন না, দোহাই ছিঁড়বেন না! নয়নতারা নিরীহ ফুল! লোকটা তেড়ে আসে, ‘রে স্বার্থপর পাষ-, তুই যখন মারিস এই বোবা মেয়েকে তখন তার গায়ে লাগে না?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাই। তাই তো! কেন আমি এমন? নাহ্, আর করব না এমন। এরপর আমি অন্যরকম হবো। একবার বেঁচে উঠি আমি ফের, অথবা আরেকটা জনম পাক নয়ন, সেবার খুব ভালোবাসাবাসি হবে দুজনের। ভাবতে ভাবতেই চেয়ে দেখি সম্মুখের নয়নতারা গাছটা উধাও! একটা জবাগাছ সেখানে! ঘোমটাপরা একটা মেয়ে মল বাজিয়ে বাগান জুড়ে হাঁটছে ফুলের মতো, তার সিঁথি জুড়ে ল্যাপ্টানো সিঁদুর। কাঁটাঝোপ সরিয়ে সে-মেয়েটা এসে দাঁড়ায় ঘৃতকুমারীর নিচে। আমার চেনা লাগে খুব, কে এই মেয়ে? অদৃশ্য রহস্যময় কোনো রাতে এর কণ্ঠেই কি ছিল কমলা সুন্দরীর গান! হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। যাক, আমি এই অন্ধকারে এই মৃতবৎ আলো-আঁধারি তরঙ্গে আর কোনো সংশয়ে জড়াব না। আজ যদি আমি হেরে যাই তবে জিতে যাবে ঈশ্বর, যাক। ওই আলতাপরানি আজীবন না-হওয়া প্রেম হয়েই বাজাবে বেহাগ। চাই না আমি, চাই না। আমি চোখ ফেরাই, এই কমলাসুন্দরী, আলতাপরানি তুমি আমার সুর নও, না হয় আমি এত হিংস্র কেমন করে হই। নয়নের শরীর জুড়ে কালশিটে দাগ। তুমি মায়াবিনী, তুমি অহংকারী। তুমি আমার নও। আমি ব্যাকুল হয়ে নয়নতারার ঝোপটা খুঁজে যাই।

পালটে যায় দৃশ্যপট, পুরো বাগান জুড়ে এখন এলাচ, নিম, লতাগুল্ম, হরীতকী, বহেড়া। কোথায় নয়নতারা। আমার ব্যাকুলতায় হাজার হাজার গাছ রাক্ষুসীমুখ হয়ে ধেয়ে আসছে আমার চারপাশে। লজ্জাবতী, দারুচিনি, কালোমেঘ। তেলাকুচি পাতার পেছন থেকে নয়নতারা। নয়নতারাকে ধরতে ছুটে আসে আবার সেই পুরনো বুড়ো – বুঝলে বাপু, দাঁত ব্যথা হলে পেয়ারার ডাল, অজীর্ণ হলে নিমছাল!
আমি হাঁপাই, আমার চারপাশে এত রকম ঔষধি গাছ কেন, তবে কি আমার চিকিৎসা চলছে? কে এই বুড়ো? দারবিশ মিজানউদ্দিন বাউল? এখানে আমি কি শালুক, না তারু? বুড়ো কবিরাজ কাজ করছে। আনাগোনায় একজন এলো অ্যাকজিমা রোগ নিয়ে, বহুমূত্র রোগেও ত্রাহিমধুসূদন অবস্থা তার! তার কাপড়ে গড়িয়ে পড়ছে কিছু। আমি চেয়ে দেখি ওই যুবক আমি। আমার সারাশরীরে ফুটিফুটি ঘা, শিশ্ন চেপে ধরি, যদি তরল পানি গড়িয়ে পড়ে যায় কোথাও! বুড়ো দাওয়াই দেয় – রাতে ঘুমানোর আগে নয়নতারা ফুল সিদ্ধ করে মিছরির যোগে খেতে হবে অমাবস্যায়। মিছরি পাওয়া যাবে গন্ধবণিক বাসুর দোকানে। হায়! আমার হৃদয় কাঁপে শঙ্কায়, নয়ন বাসু বণিকের অতি আদরের ছোটবোন। ওর বাবা ছিলেন ডাকসাইটে বনেদি ডাকাত!

আমি অস্থির হয়ে বাগানটা খুঁজি। বুড়ো কবিরাজ আমাকে কী যেন খাইয়ে দিয়েছে, ঝিমুনি ভাব কমছে না, অবসন্ন শ্রান্ত শরীর নিয়ে তবু আমি উঠি। সারি সারি বৃক্ষ স্থাণুর মতো অনড়। অনন্ত নক্ষত্রকাল সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক অসীম নিঃসঙ্গতায়। সেখানে শুধু সাপের হিসহিস, গরিলার গর্জন! আমাকে কামড়ে দিতে ছুটে আসছে তারা! তারা অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক জন্তু। আমার কিছু একটা করা প্রয়োজন, আমার শিরদাঁড়া শক্ত হয়। এটা স্বর্গই হোক বা নরক – এ আমার কাম্য নয়; আমি পালাতে চাই এখান থেকে।

ঝোপ থেকে তুলে নিই লাঠি, একের পর এক গোড়াসুদ্ধ তুলে নিই লতাগুল্ম, ধ্বংস করে দিই সব। আমার অস্থির এলোপাতাড়ি আক্রমণে সব গাছের শ্বাস পড়ে একসঙ্গে, হাহাকার করে ওঠে ডালপাতা, ফুলফল। আমি শুধু নয়নতারা গাছটাকে চাই। গাছেদের দীর্ঘশ্বাস, পশুদের গর্জন সব এক হয়ে যায় অপেরার সুর। রাগ ভূপালি। বীভৎস চিৎকার। আমি এসব শব্দ থেকে বাঁচতে এলোপাতাড়ি ছুটে যাই এদিক-সেদিক। হাঁপরের শব্দ হয় বুকে, আকাশে সূর্য যায় ডুবে! গাছেদের দীর্ঘশ্বাস জোর থেকে আরো জোরে বয়, উফ্! পৃথিবী শব্দহীন হয় না কেন! উন্মত্ত আমি জোরসে আঁকড়ে ধরি একটা দেবদারু গাছের গোড়া। গাছের নিচে বিশাল খাদ চলে গেছে পাতাল অবধি। মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে আমি উপলব্ধি করি – শব্দের অত্যাচারে মৃত্যু হতে পারে কোনো সুরসাধকের, তেমনি প্রেমহীন সঙ্গমে মরে যেতে পারে কোনো শিল্পী। এ অনুভব নিয়ে আমি তাকাই খাদে, আকস্মিক গর্জন থেমে যায়, নিঃশব্দ পৃথিবীর নিজস্ব সুর হঠাৎ শ্রবণসীমায় অনুরাগে ছড়িয়ে পড়ে। চিনতে পারি, এই রাগের নাম মাধুবাসন্তী! আলতাপরানি নয়। আমি পরিতৃপ্ত হই, আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি অসীম সাহসে মৃত্যুকূপে। নিচে ঝাঁকে ঝাঁকে মশাল নিয়ে এগিয়ে আসছে বন্য হায়েনা অথবা শিকারি কবিরাজের দল। গাছের নিচে দাঁড়ায়, আমার বুকের হাঁপরে ঢোল বাজে দ্রিম দ্রিম দ্রিম! প্রচ- উত্তাপে ক্ষিপ্রতায় আমি ছিটকে পড়ি, পড়তে পড়তে পাহাড়-নদী-সাগর পেরিয়ে যাই। কলকলকল ঝরনার শব্দে শীতল হয় আমার অনুভূতি, ভুলে যাই পেছনের তিক্ততা। ঘামে ভিজে যায় শরীর, নেয়ে উঠি সঙ্গমজলে। আমি ধপ করে পড়ে যাই খাদের শেষ ধাপে। ক্লান্ত অনুভব। জানালা দিয়ে আলো আসে। ওমা! আমি বেঁচে আছি, মরিনি একটুকুও! নয়ন কোথায়? এই তো আমার বুকের কাছেই, বিবস্ত্র। আমি কি তাকে কাছে টেনেছিলাম, কাল রাতে তাকে ভেবেই কী …, হতে পারে, আজ তার শরীরে কোনো হিংস্রতার চিহ্ন নেই, চোখে আলো পড়তেই নয়ন হাসে লাজুক চোখে। এই মেয়ে এমন করে হেসেছিল কবে আর, সেই প্রথম দেখায় হয়তো! আমি বিভ্রান্ত হই। তবে কি এই নিঃশব্দ রমণীই আমার বাঁশি, হায় সুর! এত কাছে অথচ কোন ভুলে বাজাতে পারিনি এতদিন তাকে!

কাছে কোথাও বাজছে প্রভাতি রাগ নট ভৈরব। মুহূর্তেই পালটে গিয়ে হয় বাসন্তী। কে বাজায়! বিচ্ছেদেও এত প্রেম! আমার ভালো লাগে সব। কতকাল পর পরম সুখে অপলক চেয়ে আছে আমার মাধু বাসন্তী, তার মুখ আমার দিকে, আমি দেখি তাকে –
নয়ন সরসী যেন ভরেছে জলে
কত কী রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে!
আচ্ছা, গতকাল রাতে আমি কী খেয়েছিলাম? ধুতুরার বিষ, নাকি সিদ্ধি? দুটো তো পাশাপাশিই রাখে মেয়েটা। পাগলি নয়ন!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত