এই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন। এত কষ্ট করে এসেছেন। কেন এসেছেন? এতদিন পরে কেন এসেছেন?
এখন এসে আপনারা কী আর দেখবেন?
মুক্তিযুদ্ধের সেসব আঘাত তো আমরা এখন সামলে উঠেছি। অতীত এখন আমাদের কাছে একটা দুঃস্বপ্ন বই আর কিছু নয়।
দেশের স্বাধীনতার পরপর আরো কত কিছুর আঘাত আমাদের সহ্য করতে হয়েছে। রাজাকারদের দাপট দেখতে হয়েছে। আমাদের বঙ্গবন্ধুকে হত্যাও করেছে এইসব রাজাকার। হ্যাঁ, দেশ স্বাধীনের পরেও এই দেশে রাজাকাররা বহালতবিয়তে বহুদিন ছিল, এখনো আছে, তবে আগের মতো বিষদাঁত হয়তো আর নেই।
আমার নাম শ্রী বিমলকান্তি গুহ। আমি একজন সাধারণ মানুষ। দেখতেই পাচ্ছেন, বাঁশখালি থানার নাপোড়া গ্রামে আমার নিবাস। এখন আমার অবস্থা ভালো। কিন্তু তখন সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য করেই আমার দিন চলত। তবু আমার সংসার ছিল সুখের। স্ত্রী, একটি মাত্র শিশু পুত্রসন্তান ও আদরের ভাগ্নিকে নিয়ে ছিল আমার সংসার। ভাগ্নিটি সে-সময় ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল।
একাত্তর সালে আমাদের দেশে শুরু হলো স্বাধীনতাযুদ্ধ। এরকম যে হবে সেটা আমরা গ্রামবাসী আগেই ধারণা করেছিলাম। কারণ সত্তরের নির্বাচনের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন না, তখন থেকেই আমাদের দেশের মানুষের ভেতর একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। আমি গ্রামেগঞ্জে ঘুরতাম। সেখানে দেখতাম যেখানেই দুই থেকে তিনজন মানুষ জটলা করছে, সেখানেই এই নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে। সকলের ভেতরেই একটা উত্তেজনা – কখন কী হয়। আমাদের বাড়িতে কোনো টেলিভিশন ছিল না। আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতে ছিল টেলিভিশন। সেই টেলিভিশন বাঁশের টংয়ের ওপরে টাঙানো থাকত। গ্রামের মানুষ সেখানে গিয়ে রাতের খবর শুনত। সেখান থেকে একদিন শুনতে পেলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সব আলোচনা শেষ হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।
তারপর তো চলে এলো ২৫শে মার্চ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে চলে গেল তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে। দেশজুড়ে শুরু হলো পাকমিলিটারির তাণ্ডব।
আমাদের তখন মনে হলো আমরা এক কাণ্ডারিহীন নৌকায় চড়ে রওনা হলাম বুঝি অনির্দিষ্টের দিকে।
দেশের যে-কোনো গভীর সংকটে আমরা যারা সংখ্যালঘু, আমাদের ক্ষয়ক্ষতির ভয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিজের জন্মভূমিকে মনে হয় তখন অচেনা। ভারত ভাগের এই হলো মূল বিষবৃক্ষ। বিপদে মানুষ মাতৃভূমিকে বুকে জড়িয়ে ধরে, আমরা তখন মাতৃভূমি ত্যাগ করার জন্যে হন্যে হয়ে উঠি।
এই হলো আমাদের জীবনের চরম সত্য।
তো এবার একটু অন্য প্রকারের মনের ভাব হলো। মনে হলো, দেশের এই সংকটে যখন হিন্দু-মুসলিম সব সমান, তখন আর দেশ ত্যাগ করে কী হবে। সকলের সঙ্গে থেকে যাই দেশে। তাছাড়া আমার সংসারে আমি এবং আমার স্ত্রী ছাড়াও আছে আমার শিশুসন্তান ও আমার বোনের মেয়ে বাসন্তী রাণী। মুক্তিযুদ্ধকালেই বাসন্তী ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে, আমার স্ত্রী ছেলেবেলা থেকে যাকে লালনপালন করতেন।
তখন ভাবলাম, এতসব লটবহর নিয়ে আমরা কোথায় যাবো? আমার মতো অনেকেই এইরকম চিন্তা করেছিলেন বিধায় আমরা অনেক ঘর হিন্দু পরিবার নাপোড়া গ্রামে থেকে গিয়েছিলাম।
তো এরপর শুরু হলো পাকবাহিনীর অত্যাচার। আর তার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় দালাল ও রাজাকারদের তাণ্ডব। তার অল্প কয়েকদিন পরেই শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ। আমরা আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার মতো সাহস বুকে নেই, তবে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা দেশের কোনো মানুষের চেয়ে কম নয়। আগে তো মাতৃভূমিকে ভালোবাসি কি না এ-প্রশ্ন মনেও কোনোদিন ওঠেনি, এখন যেন বারবার করে দেশকে ভালোবাসার কথাই মনে ওঠে। ‘মা গো, তোর বদনখানি মলিন হলে আমি আঁখি নয়নজলে ভাসি’র মতন।
গভীররাতে গ্রামের সকলে যখন ঘুমোবার চেষ্টা করে, আমি তখন বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কী বিশাল আকাশে অর্ধেক একটা চাঁদ ভেসে আছে। আমি সাধারণ একজন ব্যবসায়ী মানুষ, কোনো কবি বা লেখক নই, তবু আমার সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে হয় যেন চাঁদ আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ভয় পাসনে, বিমল। ভয় নেই।
কিন্তু তবু আমার ভয় লাগে । আমার মনে হয়, এখনো পালাবার সময় আছে। এখনো। এরপর আর সময় থাকবে না। পালাতে হলে এখনো স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে পালানো যাবে। পরে আর যাবে না। কিন্তু এ-খবরও আমাদের কাছে আসে। সকলেই পালাতে পারেনি। অনেকেই পারেনি। অনেকেই পথে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছে। আর তাদের টেনে নিয়ে গেছে নিকটস্থ মিলিটারি ক্যাম্পে। তারা সব আমাদের মতো মানুষ। নিম্নবিত্ত। গরিব।
দেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন মাঝপথে, ঘনঘন আমরা বিজয়ের সংবাদ পাচ্ছি, আমাদের মনের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আর অল্পদিন কষ্ট করলেই আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু আশেপাশের রাজাকার, বিহারি আর পাকিস্তানি দালালদের ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি, এমন সময়, সেদিন ছিল ৯ই অক্টোবর, খবর পেলাম, মিলিটারিরা আমাদের নাপোড়া গ্রামে আসছে। এ-খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রামে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কোথায় যাই, কী করি। আমাদের বাড়ির অদূরে যে জঙ্গল আছে, তার পেছনেই পাহাড়। আমরা কয়েক ঘর হিন্দু-মুসলিম তড়িঘড়ি সেই জঙ্গলের দিকে রওনা হলাম, সেখান থেকে পাহাড়ে চলে গেলাম।
সারাদিন আমরা পাহাড়ে বসে থাকলাম। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে বসে থাকলাম। কিন্তু মিলিটারির দেখা পেলাম না। একজন তখন বলল, হয়তো ওরা আর এদিকে আসবে না। চলো, আমরা বাড়ি ফিরে যাই।
তো তার কথা শুনে আমরা বিকাল ঘন হলে বাড়ি ফিরে এলাম।
সেদিন ফিরে আসাটা যে বোকামি হয়েছিল, পরদিন ভোরবেলায় টের পেলাম।
১০ই অক্টোবর ভোর পাঁচটায়, আমরা তখনো ঘুমে, কিন্তু ভোরের আজান কানে শুনতে পেয়েছি, এমন সময় জঙ্গলের পুবদিক থেকে পাকমিলিটারি আমাদের নাপোড়া গ্রামে আক্রমণ চালাল।
এত আকস্মিক সেই আক্রমণ ছিল যে আমরা গ্রামবাসী একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমাদের গ্রামবাসীর অধিকাংশই আর এদিন পালাবার অবকাশ পেল না। পাকমিলিটারি নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে লাগল। ছেলে-বুড়ো-বাচ্চা-পোয়াতি-মহিলা সকলেই সেই গুলির মুখে নির্বিচারে মারা পড়ল। এখন এতদিন পরে এসব কথা কেন আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আমি বুঝি না। তবু আপনাদের অনুরোধে বলি, যেহেতু আপনারা কেউ এসবের সাক্ষী নন, কিন্তু আমি সাক্ষী, তাই আপনাদের অনুরোধে বলি, যখন পাক-পশুর দল আমাদের মতো নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর এভাবে নির্লজ্জের মতো আক্রমণ শুরু করল, আমি প্রাণ হাতে করে পরিবারপরিজন সঙ্গে করে জঙ্গলের পশ্চিম দিকে পালাতে লাগলাম। মাঝপথ পর্যন্ত যেতেও পারিনি এমন সময় একটা গুলি এসে আমার হাতের ব্যাগের মধ্যে পড়ল, যে-ব্যাগে কিছু খাবার রাখা ছিল, সে-ব্যাগটা ছিটকে আমার হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। ঠিক এই সময় আমার চোখের সামনে একজন মহিলা ছোট্ট একটি দুধের বাচ্চা নিয়ে জঙ্গল পার হচ্ছিল, সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর বাচ্চাটি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। আমার তো সেদিকে তাকাবার মতো সময় নেই। আমার চোখের সামনে তখন আরো তিনজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় যেন আগে থেকেই পড়ে আছে। এই সময়ে আমার স্ত্রী-পুত্র-বোনের মেয়ে কে কোথায় ছিটকে পড়ল জানি না, আমি কোনোরকমে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পাগাড়ে চলে গেলাম। সেখান থেকে ফিরে তাকিয়ে যে-দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার প্রাণ যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। দেখলাম আমার প্রাণপ্রিয় গ্রামটিতে ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠছে, রাজাকাররা বিকট চিৎকার করতে করতে লুটপাট করছে, মানুষের কাতরানি, আর্তনাদ খুব ক্ষীণ হয়ে কানে আসছে।
সব দেখেশুনে আমার হাত-পা অবশ হয়ে গেল।
এখন কোথায় খুঁজে পাবো আমার স্ত্রী, আমার সন্তান, কোথায়-বা খুঁজে পাবো আমার আদরের ভাগ্নিটিকে।
সে এবার ম্যাট্রিক পাশ করেছে সেকেন্ড ডিভিশনে। তার খুব শখ সে বিএ পাশ করে গ্রামে শিক্ষকতা করবে।
নাকি সকলেই গুলি খেয়ে জঙ্গলেই মরে পড়ে আছে।
আমি পাগলের মতো পাহাড়ের এদিকে-ওদিকে ঘুরপাক খেতে লাগলাম। যার সঙ্গেই দেখা হয়, তারই মুখে শুধু হাহাকার শুনি। আমার মতো অনেকেই পাহাড়ে এসে পালিয়ে আছে। তাদের অনেকেই এরই মধ্যে মা-বাবা-ভাই হারিয়েছে। কেউ কেউ পথেই গুলি খেয়ে মারা গেছে। অনেক লোক এরই মধ্যে পাহাড়ে একত্রিত হয়েছে। আমিও তাদের সঙ্গে। কান্নাকাটির ভেতরেও অনেকে খোঁজ করে চলেছে আত্মীয়স্বজনের। আমিও তাদের সঙ্গে মিলে আমার স্ত্রী, বাচ্চা ও ভাগ্নিকে খুঁজে চলেছি। কিন্তু কোথাও তাদের পেলাম না। ভয়ে, দুশ্চিন্তায় আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসতে লাগল। কিছু যেন আর অনুভব করতে পারছি না, এমনি মনে হতে লাগল।
আমার অবস্থা দেখে অনেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে লাগল, বিমল, মন খারাপ করো না। হয়তো তারা পাহাড়ের অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে।
গ্রামবাসীদের কথাই সত্যি প্রমাণিত হলো। তিনদিন অনেক খোঁজাখুঁজির পর রেজাকাঠা নামে এক জায়গায় আমার পরিবারের সঙ্গে আমি মিলিত হলাম। তাদের চোখে দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। দুদিন তারা কিছু খায়নি শুনে আমি পাগলের মতো খাবার খুঁজতে লাগলাম। তারাও আমাকে দেখে কাঁদতে লাগল।
এরপর তাদের সঙ্গে নিয়ে আমি আবার গ্রামে ফিরে এলাম।
এখন আপনারা আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, কেন আমি আবার সেই গ্রামে ফিরে এলাম? কোন সাহসে ফিরে এলাম?
কিন্তু মাগো, আমরা আর কোথায় যাবো? কোথায় বা যেতে পারতাম। পাহাড়ে তো আমাদের খাওয়া মিলবে না। সেখানে যারা থাকে তারা তো নিজেরাই কত গরিব। সেখানে আমরা কী করে থাকবো? কোথায় বা থাকবো? আর কতদিন বা থাকবো?
তো যাক, ভাবলাম, একবার যখন অত্যাচার করে চলে গেছে তখন আর অন্তত কিছুদিন এই নাপোড়া গ্রামে আসবে না। এর ভেতরে নিশ্চয় কোনো একটা ব্যবস্থা করতে পারবো।
স্ত্রী-পরিবারসহ বাড়ি ফিরে দেখি তখনো গ্রামে কিছু লোক আছে। তাদের মুখে নৃশংস সব বর্ণনা শুনে আমার স্ত্রী ফিট হয়ে পড়ে গেল। আমি কাঁদতে লাগলাম। শুনলাম, আমার পাশের বাড়ির পাঁচজনকে বর্বর পাক সৈন্যরা মেরে ফেলেছে। আরো অনেক লোক মারা গেছে। কিন্তু কে কীভাবে মারা পড়েছে এখনো ঠিক করে কেউ বলতে পারছে না। জীবন এবং মৃত্যু যেন এখন একরকম হয়ে গেছে সকলের কাছে। এই জীবন, এই মৃত্যু। লক্ষ করলাম, গ্রামবাসী যারা বেঁচে আছে সকলেই যেন ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়ে বসে আছে।
এরকম কিছুক্ষণ সময় গেলে হঠাৎ যেন আমার চমক ভাঙলো। ভেবেছিলাম পাক সৈন্য বুঝি গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
কিন্তু না। আমার ধারণা ভুল।
আমি যখন বাজারের দিকে আসছিলাম অন্য সকলের খোঁজখবর নিতে, তখন দেখি কয়েকজন পাকসেনা আমাদের গ্রামের জনাব একরাম মিয়া, তার ভাই দানু মিয়া ও মোক্তার আহমেদকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে বাজারের এক জায়গায় রাজাকারদের পাহারায় রেখে আবার গ্রামের ভেতরে ঢুকছে।
দেখে তো আমার মাথায় বাজ। হায়, হায়, এখন কী হবে?
আমি খুব দ্রুত আমার বাড়ির দিকে চলতে লাগলাম। বাড়ির কাছকাছি এসে দেখি আমার স্ত্রী বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি চোখ ইশারায় তাকে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বললাম। সে আমার ইশারা বুঝে দ্রুতপায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
এরপর যেন চোখের নিমেষে শয়তান পাকবাহিনী, ভগবান তাদের মাথায় বজ্রাঘাত করুক, এমনকি কবরেও যেন তারা শান্তি না পায়, তারা আমার বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে ঢুকে মারপিট শুরু করে দিলো।
আমার ভাগ্নি বাসন্তী রাণী এবার আর পালাতে পারল না। সে একাত্তর সালে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। তার খুব ইচ্ছা ছিল সে বিএ পাশ করে গ্রামে শিক্ষকতা করবে। সে রোজ বাজারে গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে আসত। সে বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসত।
সে দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন দেখত।
কিন্তু ভগবান তার সে-স্বপ্ন পূরণ করলেন না।
আমার ভাগ্নি বাসন্তী রাণী খুব বেলিফুল ভালোবাসত। তার স্মরণে, এই যে দেখুন, আমার বাড়ির চারপাশে বেলিফুল গাছ লাগিয়ে রেখেছি। বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ায় আপনার নিশ্চয় বেলির ঘ্রাণ পাচ্ছেন।
মনে করবেন, এই ঘ্রাণের সঙ্গে আমার ভাগ্নির স্মৃতি জড়িত।
পাকসেনা বাসন্তীর ঘরে ঢোকার অনেক আগেই বাসন্তী তার কাছে লুকিয়ে রাখা কীটনাশক বিষ পান করল। সে পাহাড়ে লুকিয়ে থাকার সময়ই তার মামি অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে বলে রেখেছিল, মামি, আমি কিন্তু কুত্তার বাচ্চাদের হাতে নিগৃহীত হবো না, এ-কথা তোমাকে আগেই বলে রাখছি।
খুব জেদি মেয়ে ছিল আমার এই ভাগ্নি।
সেদিন খুব রাতে ফিরে এসে তাকে আমরা মৃত পাই।
আপনারা যারা ঢাকা থেকে এসেছেন, তারা কি আমার এই ভাগ্নিটির কথা মনে রাখবেন? তার নাম ছিল বাসন্তী রাণী। আমি জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এরকম হাজার হাজার বাসন্তী রাণী মারা গেছে। তবু আমার ইচ্ছে, আমার এই ভাগ্নিটির নাম আপনারা মনে রাখুন। তার নাম ছিল বাসন্তী রাণী। তার ইচ্ছে ছিল, সে বিএ পাশ করে গ্রামে শিক্ষকতা করবে।