দুপুরবেলার এই সময়টা তোজাম্মেলের কাছে একেবারে আপদের মতো ঠেকে। একে তো পেটের ভিতর তীব্র খিদার মোচড় – অন্যদিকে কাস্টমারের ভিড় – এই দুই সামলে সোজা হতে না হতেই লু হাওয়ার প্রকোপ তাকে একেবারে কাহিল করে ফেলে। চামড়া চিড়বিড়ানো চোতমাসের গরম উড়ে এলে তোজাম্মেলের হাঁসফাঁস ধরে যায়। তা চোতের ভাঁপেতাপে হাঁসফাঁস ধরলেই কি আর খিদায় পেট জ্বলে গেলেই-বা কি? ‘ইব্রাহীম মটরসে’র মহাজন ইব্রাহীম মিয়ার এসবের কুনুদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। তার সামনে কিছু বলারও উপায় নাই। ঘড়ির কাঁটা তিনের ঘর পেরিয়ে যাওয়ার পরই একটা বনরুটি তোজাম্মেলের বরাতে জোটে। মহাজনের মনমেজাজ শরিফ থাকলে বনরুটির সঙ্গে একটা চিনিচাম্পা কলা। নাও বাপধন, এই-ই খাও। খাইয়াদাইয়া মনদেল দিয়া ভি কাইজকাম কর।
তোজাম্মেল তাই করে। চোখকান বন্ধ করে কাজই করে সে। অবশ্য কাজ না-করে করবেই-বা কী? কাস্টমারের ভিড় উপেক্ষা করে এয়ারকম্প্রেসরের লম্বা পাইপটা হাত থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও ফেলার উপায় তার নাই। মহাজনের বাজখাঁই গলা খানিক পরপরই চড়ে ওঠে –
‘অই তোজা, তোজাম্মেল – নবাবের পুত, হাওয়া দিতে গিয়া নিজেই হাওয়া হইয়া যাইছ না ফির!’
এরকম হলেই হয়তো ভালো হতো। হাওয়া হয়ে যেতে পারলে এই জালিম মহাজনের হাত থেকে নিস্তার পেত। তোজাম্মেল না হয় হাওয়া হয়ে নিস্তার পেত, কিন্তু মা আমজেলা খাতুনের তখন কী হতো? তিন হাজার টাকার ঘরভাড়ার বন্দোবস্ত কীভাবে করত আমজেলা খাতুন? এই চিন্তাতেই তোজাম্মেল আর হাওয়া হয়ে উঠতে পারে না। তোজাম্মেল হাওয়া না হলেও মহাজনের কর্কশ স্বর হাওয়ায় বাড়ি মারে –
‘অই তোজা, নবাবের পুত, চাক্কায় হাওয়া চেতাইয়া ভি ভইরা কিন্তুক চেক কইরা দিছ কইলাম।’
কীসব বেতালা কথাবার্তা যে বলে মহাজন! তোজাম্মেল চেক না করে দিলেও কাস্টমার তার পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেবে। বুঝে নেয়।
তোজাম্মেলের মাঝেসাঝে ইচ্ছে করে মহাজনের মুখের ওপর ঠাসঠাস দুই কথা শুনিয়ে দিতে –
‘কাস্টমার কি হাওয়া ছাড়াই চাক্কা চালায়ে দেবানে? আফনে তাগো এরহম ভাবেন কিমুনে?’
তোজাম্মেল নিজেকে সামাল দেয়। মহাজন বলে কথা! তার মুখের ওপর কথা বললে এক্ষুনি চাকরি নট হয়ে যেতে পারে। ফলে মহাজনকে তোজাম্মেল এ-কথাও বলতে পারে না যে, দশ টেকার বদলে কাস্টমার পারলে একশ টেকার হাওয়া ভইরা নিবার চায়।
আরে মহাজন কি আর কাস্টমারের এমন খাসলত জানে না? জানে। জানে। সবই সে জানে। সব জেনেবুঝেও চোটপাট দেখায় কি না তোজাম্মেলের ওপর!
‘অই নবাবের পুত, এই খরখইরা দুইফরকালে ঝিম্যাছ ক্যারে? কাস্টমার যে রইদের মইদ্যে রিছকা লইয়া লাইন দিছে চোহে ভি দেহছ না?’
তোজাম্মেল কত আর দেখবে? কত আর হাওয়া ভরে দেবে রিকশা-গাড়ির চাকায়? তীব্র গরমে তার দুই চক্ষু ঘুমে বুজে আসতে চাইছে। কিন্তু মহাজনের জোর ধমকানিতে সামান্য লেগে-আসা-চোখ মুহূর্তই খুলে যাচ্ছে।
পাইপের সুইচ অফ করে তোজাম্মেল দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ যেন রিকশা-গাড়ির মিছিল লেগেছে!
মাথার ওপরের সূর্য একেবারে জ্বলন্ত কয়লার গনগনা আগুন যেন! ঝকমকা আসমান থেকে রুপালি আলোর রেখা তেরছা ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর। অদূরেই একটা বট নাকি অশ্বত্থ সেই আলোর তলায় নির্ভেজাল দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রুপালি ইলিশের মতো উজ্জ্বল আলোতে বটের পাতাদের রং কেমন ফিকে দেখায়। সেই ফিকে-সবুজ পাতাদের আড়ালে একজোড়া ঘুঘু ঘুমভাবে ঢুলছে। অথবা প্রকট আলসেমিতে নিজেদের ঘাড়মাথা পালকের মাঝে গুঁজে দিয়েছে। গ্রীষ্মের এইরকম দাবদাহের দুপুর ডানা মেললে তোজাম্মেলের দেহে সহসা বলেশ্বরের ঢেউ ছলকে পড়ে। তখন সে চাক্কা থেকে পাইপ বের করতে ভুলে যায়। মহাজনের ধমকধামক উপেক্ষা করে তার মন উড়ে চলে যায়। উড়তে উড়তে আছড়ে পরে চরদুয়ানির ফসলি জমিনের আইলে। অথবা তোজাম্মেল গিয়ে পড়ে কি না নদীর পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া কাঁচাপাকা রাস্তার শেষপ্রান্তে। যে-রাস্তার ওপর এক বুড়ো বটগাছ বারো মাস নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে। যার পেটের ভিতর মস্তপানা এক খোঁড়ল। জোর দেয়া এলেই বটের হাড়-মাংস-কোমর একাকার হয়ে যাবে।
তোজাম্মেলের সঙ্গে ওই বুড়ো বটের খায়-খাতির হয়েছিল এইরকমই লু-ঝরা কোনো এক গনগনা দুপুরে। বাপ মইজুদ্দির সাইকেলের রিজেক্ট চাকাটা যখন সে বাগে পেয়েছিল। তারের আংটায় পেঁচিয়ে সামান্য হাওয়া-চুপসানো চাক্কাটা গড়িয়ে দিয়ে তোজাম্মেল ছুটেছিল দিগ্বিদিক।
কড়া রোদ্দুর মাথায় নিয়ে অনেকটা পথ ছুটেছিল সে। ছুটতে ছুটতে ছায়া পেয়েছিল ওই বটের কাছে। আহা! কী শান্তি! কী শান্তি! তোজাম্মেলের ছোট দেহটার প্রাণ তখন যাই-যাই করছে। কোথায় তার সাইকেলের চাক্কার গাড়ি আর কোথায়ই-বা আংটা? সব ফেলেটেলে বটের ছায়ার তলায় সে চিৎপটাং। আর তার শখের গাড়ি তখন গড়িয়ে গড়িয়ে বলেশ্বরের জল ছুঁয়েছে!
খানিক বাদে তোজাম্মেলও ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। বলেশ্বর নদীতে সে ডুব দেয় আর ভেসে ওঠে। ভেসে উঠে আবার ডুব দেয়। ইশ্! তোজাম্মেল নিজেও যদি এখন নদী হয়ে যেতে পারত! গরম-ঘাম সবই দূরীভূত হয়ে যেত নিমিষে। তোজাম্মেল মনের সাধ মিটিয়ে সাঁতার কাটে জলে। আর তার পরনের মলিন গেঞ্জি তখন বটের ডালে ওড়ে। বটের লাল-লাল ফলগুলির মাঝে মাথা বাড়িয়ে লাল পতাকার মতো পতপত করে ওড়ে।
সেদিন বলেশ্বরের জলে বহুক্ষণ ঝাঁপাঝাঁপি করে উঠে এসেছিল তোজাম্মেল। বটের ছায়া ততক্ষণে আরো কিছু বালক-বালিকা জোগাড় করে ফেলেছে। তাদের চক্ষু তোজাম্মেলের চাক্কাগাড়ির ওপর। যা তখনো নির্জীব শুয়ে আছে নদীর কিনারে। ঢেউয়ের ধাক্কায় একবার ভেসে উঠছে। পরক্ষণেই ডুবে যাচ্ছে।
বালক-বালিকাদের লোভী দৃষ্টি চকচক করছে ওই ভাসাডোবার খেলায়। আর তোজাম্মেল তখন কি না আনমনে তাকিয়ে আছে নদীর অন্য তীরে। দূরের সবুজ-বনানীর প্রায় অস্পষ্ট বৃক্ষরাজির দিকে! হররোজ যেখানে মইজুদ্দি ট্রলারে করে পৌঁছায়। তখন তার সাইকেল বটগাছের গুঁড়িতে তালাচাবিতে আটকা পড়ে থাকে।
ওই বনের ভিতরে নাকি বহু নদী আর খাল রয়েছে ছড়িয়ে-বিছিয়ে। মইজুদ্দি যায় ওইসব নদী-খালে জাল ফেলে পোনা ধরতে। চরদুয়ানির লোকেরা মাছ মারাকে বলে ‘পোনাধরা’।
তা পোনা ধরে মইজুদ্দি বনের ভিতরই হিসাবনিকাশ চুকিয়ে আসে। অর্থাৎ মাছ ধরে সুন্দরবনের ভিতরেই বেচা-বিক্রি সেরে সে বাড়ি ফেরে।
তোজাম্মেলের দৃষ্টি বলেশ্বর নদীর ঢেউ, জলে ডুবে থাকা চাক্কার গাড়ি ফেলে দ্রুত ওই বনের মাঝে পৌঁছাতে চায়। হয়তো বাপ মইজুদ্দিকে তালাশ করে সে। মইজুদ্দির দেখা পেলে বাপ-পুত মিলে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা যেত!
মইজুদ্দির সাইকেলে চড়তে তোজাম্মেলের বড় ভালো লাগে। বাপজান তারে বড় যত্ন করে সাইকেলের সামনে বসায়। তারপর বাপজান সিটে বসে এত জোরে প্যাডেল মারে যে, তোজাম্মেলের মনে হয় সে যেন উড়ে চলছে। তোজাম্মেলের যেন এক্ষুনি দুটো ডানা গজিয়েছে। সেই ডানায় ভর করে আসমানের বহু উঁচাতে চিলের মতো উড়ে চলছে সে। তার সঙ্গে সঙ্গে বাপজানও উড়ে চলছে। তার বাপজান যেন বড় চিল। আর সে বাচ্চা চিল। বাপ আর ছেলে মিলে মেঘের ভিতর দিয়ে শাঁ- শাঁ করে উড়ে চলছে। মেঘেদের স্পর্শ লেগে তাদের ডানার পালক ক্রমে ভিজে উঠছে। মেঘভাসা আসমানে ডানায় হিম মেখে উড়ে যাচ্ছে দুজন!
দুই
ডানায় মেঘের হিম মেখে বেশিদিন চিলের মতো ওড়াউড়ি করা হলো না তোজাম্মেলের। তার ডানা দুইটা সহসা কাটা পড়ে গেল। বাপজানের সাইকেলেও আর চড়া হলো না। আগের মতোই সাইকেলটা তালা মারা রইল বটগাছের গুঁড়ির সঙ্গে। কিন্তু বাপজান কিনা নিরুদ্দেশ হয়ে গেল! চরদুয়ানিতে মানুষ নিরুদ্দেশ হওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। বলেশ্বর পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকলে অনেকেই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সবাই পোনা ধরতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়, এমন নয়। কেউ গোলপাতার ঘেরে গিয়ে নিরুদ্দেশ। কেউ বা চাক ভেঙে মধু আনতে গিয়ে। হেতালপাতা কাটতে গিয়েও অনেকেই ফিরে আসে না আর!
মইজুদ্দি পোনা ধরতে গিয়ে জাল আর খালুইসহ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মইজুদ্দির আগে রহিম শেখ। রহিম শেখ অবশ্য পোনা ধরতে যায় নাই, গিয়েছিল গোলপাতার ঘেরে। গোলপাতা দিয়ে চালের ছাউনি দিলে মজবুত হয় ঘর। দেয়া এলেই উড়ে যায় না চালা। ফলে গোলপাতার চাহিদা ব্যাপক। সেই গোলপাতা কাটতে গিয়ে দা-দড়িসহ নিখোঁজ হলো রহিম শেখ। হারিয়ে গেল বনের গহিনে! অথচ নিখোঁজ হওয়ার আগেরদিনও তাকে নৌকা বোঝাই করে গোলপাতা নিয়ে ফিরতে দেখা গেছে। এইসব নিখোঁজ-বেত্তান্তর আগেপাছে যা-ই থাকুক না কেন চরদুয়ানির লোকেরা কোনোভাবেই বাঘের নাম উচ্চারণ করতে চায় না। তারা ইশারা-ইঙ্গিতে বলাবলি করে –
‘রহিম শ্যাখরে হা-য়ে নিয়া গেছে!’
‘হা-য়ে একবার নেয় যারে তারে আর ফিরত পায় ক্যামনে?’
মইজুদ্দি নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন থেকে আমজেলা খাতুন বটগাছের ছায়ায় বসে রইলো। তার চোখের সম্মুখে বলেশ্বরের ঢেউ ফুলে উঠলো। ঢেউয়েরা ভেঙে ভেঙে পড়লো। ভাঙা ঢেউ জলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু মইজুদ্দির কোনো সংবাদ এলো না। চার-পাঁচটা এন্দাগেন্দা নিয়ে আমজেলা খাতুন ক্রমে দিশেহারা। তবু মনে তার সুপ্ত আশা –
‘তোজাম্মেলের বাপজানের হবর পাওয়া যাইতে হারে!’
যে যা-ই বলুক আমজেলা খাতুনের মনের ভিতর অন্য গল্প। অন্য কথা। অন্য আশা।
‘বনের বিতর পথ বুল কর্যা হেয় নি অন্য কুনু পথত চইল্যা গেছে! পথ ঠিক পাইলে হীরা আইতেও হারে।’
আমজেলা খাতুন মনের ভুলেও ভাবতে পারে না যে, মইজুদ্দি হা-য়ের পেটে চলে গেছে!
বটগাছের ছায়ায় বসে অপলকে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল আমজেলা খাতুন। তাকিয়ে তাকিয়েই বুঝল, রহিম শেখের বিধবা বউ লালবুরু এসে বসেছে তার পাশে।
লালবুরু তাকে ধীরেসুস্থে বলল –
‘আ লো আমজেলা, আর কিয়ের আশায় বইয়া থাহস তুই? ওই বন অইলো রাক্ষুসী। বনবিবি যারে একবার শাপ দেয় তারে কি আর ফিরত দেয়নি?’
লালবুরুর কথা শুনে আমজেলা একেবার কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠে ফের ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে। যেন সে লালবুরুর বলা কোনো কথাই শুনতে পায় নাই।
লালবুরুকেই বলল নাকি নিজেকেই –
‘ওই বনের মইদ্যে আমিও একদিন হান্দামু।’
লালবুরু তাকে কুনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বলল –
‘আ লো যাইবি যা, কে তরে মানা কইরছে? সাহস থাকলে যা, গিয়া দেইখ্যা আয় নিজের চোহেই।’
আমজেলার সাহস নাই। আমজেলা নিজেও জানে তার সাহস নাই! সে কোনোদিনই ওই বনের ভিতর ঢুকতে পারবে না! ওই দূর বনের রহস্য আমজেলা খাতুন কোনোদিন ভেদ করতে পারবে না। বিটি-ছাওয়াল বলে বনবিবিও তাকে একদমই রেয়াত করবে না।
বনবিবির নাম করে শিন্নি দিয়ে চরদুয়ানির দুই-একজন বিটি-ছাওয়াল অবশ্য সুন্দরবনে আসা-যাওয়া করে। মোসলেম ফরাজির লাশ পাওয়ার পরে তার মেয়ে আনোয়ারা ওই বনে পোনা ধরতে শুরু করেছিল। মোসলেম ফরাজির লাশ এতটাই বীভৎস ছিল যে, ভাবলেই আমজেলা খাতুন আজো শিউরে ওঠে! ফরাজির ঘাড়ে-পিঠে কোনো মাংস ছিল না! পেটের নাড়িভুঁড়িও ছিল না, ‘হা’ সব সাবাড় করে ফেলেছিল। বাপের এরকম মৃত্যু দেখার পরও আনোয়ারাকে ওই বনে যেতে হয়েছিল। ছোট ভাইবোনদের মলিন চেহারা তাকে একপ্রকার জোর করেই যেন ওই বনে ঠেলে দিয়েছিল। অবশ্য যাওয়ার আগে বনবিবির বটতলায় সে মানতের শিন্নি রাখতে ভোলে নাই।
আমজেলা খাতুনের শিন্নি মানত করার মতো আর্থিক অবস্থা আর ছিল না। ফলে মাসছয়েক একপেট-আধপেট খেয়ে বিষখালী নদী পাড়ি দিতে হলো তাকে। এমভি সপ্তবর্ণার ডেকে বসে চোখ মুছতে মুছতে দুই-একবার পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করল। হয়তো তখনো মনে ক্ষীণ আশা, বনের মইদ্যে পথ হারানো মইজুদ্দি ফিরা আইতেও পারে! কিন্তু কোথায় মইজুদ্দি আর কোথায় কী?
লঞ্চ ঘাট ছেড়ে মাঝনদীতে এসে পড়ল। আমজেলার মনে তখনো মইজুদ্দির চিন্তা। আলোহীন ডেকের ওপর দুই হাতে বাচ্চাদের আগলাতে আগলাতে তার মন ফের উদাস হলো –
মানুষডা কই যে হারায়া গেইল! বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে হেইডাও কেউ কইতে হারে না!
আমজেলা খাতুনের অশ্রুভেজা চক্ষের সামনেই আসমানে চাঁদ উঁকি দিলো। চাঁদের আলো গড়িয়ে নামল চরাচরে। সে-আলোয় ডেকের আবছা অন্ধকার সামান্য হালকা হয়ে উঠল।
দীর্ঘদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বে আমজেলা খাতুন নিজের মনেই একবার ভাবল –
এই একডা কিসিম বটে! হগ্গলেই হগ্গলরে ছাইড়া যায়। কেউ হারায়া যায়। কেউ লুকায়া পড়ে, কেউ-বা পলায়া যায় – কিন্তু আসমানের চান আর তারা কাউরে ছাইড়া যায় না। তারা বুঝি ছাইড়া যাইতে পারেও না। তারা মানুগো লগে লগে আডে। এক দ্যাশ থিহা অন্য দ্যাশে আইড্যা যায়।তিন
‘ইব্রাহীম মটরসে’র কাজটা ছেলেকে জুটিয়ে দিয়েছিল আমজেলা খাতুনই। এমভি সপ্তবর্ণার ডেক থেকে নেমে চাচাতো ভাই আবদুর রশিদের কাছে একেবারে ধরনা দিয়ে পড়েছিল সে। আবদুর রশিদ দেখল অবস্থা বেগতিক! এই বিধবা বোনকে সে নিজের সংসারে ঠাঁই দিতে পারবে না। এমনকি হপ্তাখানেকের জন্যও এত্তগুলা পেটের বন্দোবস্ত করা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। ফলে তড়িঘড়ি সে অন্য মতলব আটল। আপদ ঝাড়ার চিন্তা করে আমজেলা খাতুনকে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে দিলো। ঘর তো ভাড়া নিয়ে দিলো কিন্তু ঘরভাড়া আসবে কোত্থেকে?
ঢাকা শহরের বাও-বাতাসে খামোকাই টাকা ওড়ে না। যদিও ওড়ে তা কব্জা করতে বুদ্ধি লাগে। কারসাজি লাগে। এই শহরের অলিতে-গলিতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে এই জ্ঞান আবদুর রহিমের হয়েছে।
‘ইব্রাহীম মটরসে’র মালিকের সঙ্গে খায়-খাতির থাকাতে এইসব বিষয়ে সে আরো পোক্ত হয়েছে। কারণ ইব্রাহীম মিয়া শেয়ালের চাইতেও ধূর্ত। ইব্রাহীম মিয়ার কুটিল বুদ্ধির সঙ্গে মিশ খেয়েছে হিসেবি চিন্তা। ফলে সিএনজির চাক্কায় হাওয়া নিতে এসে আবদুর রশিদ কত কি-ই যে জানে আর বোঝে! বোঝে আর দেখে – সেসবের ইয়ত্তা নাই!
তা ইব্রাহীম মিয়ার দোকানেই তোজাম্মেলকে কাজে ঢুকিয়ে দিলো আবদুর রশিদ। বিধবা বোনের এতটুকু উপকার না-করলে কেমন দেখায়? তিন হাজার টাকায় মাস-মাইনের সঙ্গে একবেলা খোরাকি। অবশ্য তোজাম্মেলের আগে রতন ছেলেটা চার হাজার টাকা মাইনে নিত। মাইনে না-হয় কমবেশ দেওয়া গেল; কিন্তু রতনের খোরাকি নিয়ে বড় ঝামেলায় পড়েছিল ইব্রাহীম মিয়া। রতনের পেডে আছিল জন্মের খিদা। একডা মাঝারি সাইজের বনরুটি দুই কামড়েই সে পেটে চালান করে দিত। খিদার জ্বালায় একদিন কিনা মহাজনকে যা-তা বলে দিলো। রতনের কারবারে ইব্রাহীম মিয়া একেবারে তব্দা মেরে গেল! হালায় কয় কী? কত্তবড় ছাহছ!
ইব্রাহীম মিয়ার হিসাব হলো, চার হাজার টাকা মাইনে নেওয়ার পর এত খিদা পেটে থাকার কথা না। থাকা উচিতও না।
তর যুদি এতই খিদা লাগবার লাগে নিজের বাড়িত গিয়া ঘি মাহাইয়া গরম ভাত খাবি ভি হালা।
রতন চলে গেল। আদতে সে খিদার জ্বালাতেই চলে গেল। খোরাকি দিতে চেয়ে শুধুমাত্র একটা বনরুটি আর চিনিচাম্পা কলায় রোজই পেট ভরাবে নাকি?
রতনের বেয়াদবির কথা মনে পড়লে ইব্রাহীম মিয়ার নিভিয়ে রাখা রাগটা ফাত করে জ্বলে ওঠে! বিরাশি ওজনের থাপ্পড়টা মারতে না-পারার দুঃখ তাকে একেবারে ঘায়েল করে ফেলে।
হালায় নবাবের পুত! প্যাট ভইরা খাইবার ভি চাইবি, ফির প্যাট ভইরা টেকাটুকাও নিবি – মাগার এইহানে কি তর সুমুন্দির বাপে দুকান দিছে? ছব তো পাইবি না এইহানে। হয় প্যাট ভইরা খানা খাইবি নয় টেকাটুকা নিবি। দুই নাওয়ে পাড়া দিয়া খাড়া ভি থাকবার চায়, হালায় কিমুন জাওরা?
রতনকে এসবের কিছুই বলতে পারে নাই ইব্রাহীম মিয়া। চতুর পোলা – কিছু বলার আগেই সে চম্পট দিয়েছে!
তোজাম্মেলকে দেখে বেশ খুশিই হলো ইব্রাহীম মিয়া।
মায়নাও এক হাজার টেকা ভি কম। দেহি এই চিড়িয়াডারে বশ মানান যায় নাহি!
কিন্তু দিনকয়েক বাদেই কি না ইব্রাহীম মিয়ার চান্দি রাগে একেবারে গরম হয়ে উঠল। আবদুর রশিদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে সে তোজাম্মেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
‘কি একডারে কামে দিয়া গেল রশিদ মিয়া! এক বউরে ছাইড়া দিলাম চাউল চাবাইনের ডরে, আরেক বউ আইস্যা দেহি তুষ-কুড়া হুইদ্দা ভি গিলে! এই হালায় দেহি আরেক নবাবের পুত! খালি ঝিম ভি পারবার লাগছে! ওই তোজা, এত ঝিম পারস ক্যারে তুই? তুই কি ডিম পাড়া কুরকা নাহি যে হারাদিন ডিমে তাও ভি দিবার লাগছোছ?’
এদিকে রতনের মতোই তোজাম্মেলেরও পেটভর্তি খিদা! দুপুর গড়িয়ে নামার আগেই খিদা তাকে প্রচণ্ড কাবু করে ফেলে!
তোজাম্মেলও বুঝে উঠতে পারে না, এত খিদা তার ক্যান লাগে? ক্যান লাগে তার এত খিদা?
বলেশ্বর নদীর সেই লিলুয়া-বাতাস কি ধেয়ে আসে এই পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে?
বলেশ্বর নদীর কথা স্মরণ হলে তোজাম্মেলের ঝিমুনি আরো বেড়ে যায়। ঝিমাতে ঝিমাতেই টের পায় তার পেটের ভেতরে মোচড় দিচ্ছে খিদা। একটা মাত্র বনরুটি আর চিনিচাম্পা কলায় এ-খিদা তো মিটে যাওয়ার কথা না।
প্রচণ্ড লু হাওয়ায় দেহ কাহিল করে তুললে তোজাম্মেল ক্ষীণস্বরে বলে –
মহাজন, আইজ বড় খিদা লাগছে, জব্বর খিদা লাগছে!
ইব্রাহীম মিয়ার কিনা তখুনি রতনের কথা মনে পড়ে যায়। রতনের সেই বেয়াদবি –
হালা, বাঙ্গ মাইরা গেলি গা! একবার ধরতে পারলে টেংরি ছুটাইয়া দিতাম এক্করে!
এখনো তিনটা বাজতে আরো এক ঘণ্টা বাকি। এত আগে তোজাম্মেলের মুখে খিদার সংবাদ শুনে ইব্রাহীম মিয়ার মেজাজ একেবারে টং হয়ে ওঠে!
‘ওই নবাবের পুত, আইজ কয়ডা চাক্কাতে হাওয়া ভরছোছ? কাম না কইরাই তোর পেড ভি খালি হইয়া যায়?’
তোজাম্মেল বলার চেষ্টা করে –
এমুন ভাঁপের দিনে বিহানের খাওন হবরেই হজম অইয়া যায় গো, মহাজন।
তোজাম্মেলের কিছুই বলা হয় না। চৈত্রের তীব্র দাবদাহ ততক্ষণে ইব্রাহীম মিয়ার মগজে ঢুকে পড়েছে। ইব্রাহীম মিয়া তোজাম্মেলের দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে।
‘নবাবের পুত, হাওয়া দেওনের কামে আইয়া তর ক্যামনে এমুন খিদা লাগে? আইজ হাওয়া দিয়াই তর প্যাড ভইরা দিমু। তুই এক্করে মোটরগাড়ির চাক্কার লাহান ফুইল্যা উঠবি আর গড়গড়াইয়া চলন ভি শুরু করবি!’
এয়ারকম্প্রেসরের পাইপটা টেনে এনে তোজাম্মেলের পায়ুপথে একপ্রকার জোরজবরদস্তিতেই ঢুকিয়ে দেয় ইব্রাহীম মিয়া। ঢুকিয়ে দিয়েই সুইচ অন করে দেয় সে। ভয়ে, আতঙ্কে আর কষ্টে তোজাম্মেল জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে!
‘আমারে ছাইড়া দেন মহাজন, আমি আর খাওন চাইমু না। কুনুদিন খাওন চাইমু না …’
কিন্তু কে শোনে কার কথা? তোজাম্মেলের খালি পেটে হাওয়া ঢুকতে ঢুকতে ক্রমে ফুলে ওঠে। ফুলতে ফুলতে একসময় জলে ভেসে থাকা কলসির পাছার রূপ পায়।
ইব্রাহীম মিয়া ক্রূর হাসিতে ভেঙে পড়তে পড়তে বলে –
‘আইজ তরে হাওয়া খিলায়াই রাহুম।’
বাতাসের চাপে তোজাম্মেলের ছোট্ট দেহটা ততক্ষণে গোলাকৃতি হতে শুরু করেছে। গোলাকার বলের দুদিকে সহসা যেন দুটা ডানা গজিয়ে ওঠে আর তোজাম্মেল সেই ডানায় ভর করে উড়তে শুরু করে। উড়তে উড়তে সে ‘ইব্রাহীম মটরস’ থেকে বেরিয়ে পড়ে।
বটের ডালে বাড়ি খেতে খেতে তোজাম্মেল চট করে একপাশে সরে যায়। ক্রমে সে আরো ওপরে উড়ে যায়। উড়তে উড়তে একেবারে মেঘের রাজ্যে ঢুকে পড়ে। তোজাম্মেল তাকিয়ে দেখে তার ঠিক পাশাপাশি বাপজান উড়ে চলেছে। মইজুদ্দি আর সে মেঘেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে চলেছে!
‘বাপজান কহন আইলো? আইজ সে এত্ত জোরে উড়তাছে ক্যান? আইজ কি হেয় সাইকেলে তিনডা চাক্কা লাগাইয়া আনছে?’
বাতাস এত জোরে বইছে যে, তোজাম্মেলের দম আটকে আসে। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দে তার ফের ঝিমুনিভাব ধরে যায়। তোজাম্মেল প্রাণপণ চেষ্টা চালায় চোখদুটি খুলে রাখতে, কিন্তু পারে না। বহুক্ষণ বাদে তোজাম্মেল চোখ খুললে দেখে, বলেশ্বর নদীর ওপর দিয়ে শাঁ-শাঁ করে উড়ে চলছে সে। নিচে ঢেউয়ের মৃদুমন্দ গতি। হয়তো বহতা নদীর জল দেখেই তোজাম্মেলের হঠাৎ প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়ে যায়। এখুনি আকণ্ঠ জল পান না-করলে যেন তার বুকের ছাতি ফেটে যাবে! ফলে তোজাম্মেল দ্রুতগতিতে নিচের দিকে নামতে শুরু করে। হয়তো কিছুক্ষণ পরেই নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে। এইরকম প্রবল তৃষ্ণা বলেশ্বরের জল ছাড়া আর অন্য কোনো জলে মিটাতে পারবে না তোজাম্মেল … !