পঁচিশ বছর পর আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছি। উদ্দেশ্য ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুলে আমাদের ব্যাচের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। শুধু এজন্যেই দেশে ফেরা। বাবা-মা কেউ আর বেঁচে নেই। ভাইবোনরাও পৃথিবীর নানান দেশে ছড়ানো-ছিটানো। স্কুলজীবনের বান্ধবী শেফালী সবাইকে ধরেবেঁধে এক করাচ্ছে। শেফালী এ-বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিল। মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক বলে হয়তো মনস্তত্ত্ব বুঝে বুঝে বান্ধবীদের এক করতে পেরেছে। আসলে বয়সটা এমন এক জায়গায় এসে ঠেকেছে যে ভুলতেই বসেছিলাম এখনো দেশ থেকে কেউ আমাকে ডাকতে পারে। তাও আবার স্কুলের বান্ধবী। স্কুলজীবন মানে হৃদয়ের এককোণে সাজানো সংবেদনশীল স্মৃতির ঝাঁপি – যার দরজা খুললে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ে গৃহকাতরতা। মনের পর্দায় ভুস করে ভেসে ওঠে ষোলো বছরের এই আমি কানের দুপাশে দুটো বেণি ঝুলিয়ে শেফালী, লিলি আর ডালিয়ার সঙ্গে গল্প করতে করতে খিলখিল করে হাসছি। দেশ তখন রাজনীতির উত্তুঙ্গ। সত্তরের নির্বাচন হবে হবে করছে। সেদিকে অবশ্য আমাদের তেমন কোনো খেয়াল নেই। আমরা তখন সুফিয়াকে নিয়ে কানাকানি করছি। সে বিয়ের পরে প্রথম স্কুলে এসেছে। এক-দু বছর আগে থেকেই আমাদের ক্লাসের মেয়েদের বিয়ে হতে শুরু করেছে। আমাদের কাছে ওরা কিছুটা পরিহাসের পাত্রী, কারণ আমরা জানি যে ওদের মতো আমাদের এত হুট করে বিয়ে হবে না। আমরা ভালো ছাত্রী। একদিন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাব। আর আমাদের মধ্যে লতা তো নিশ্চিত চিকিৎসক হচ্ছে। সে আমাদের ক্লাসে প্রথম হতো। শুধু কী তাই! পুরো স্কুল তাকে সুচিত্রা সেন হিসেবে চিনত। আর শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলতেন বেগম রোকেয়া। কিছুটা অহংকার তো লতার থাকতেই পারে। ক্লাসে আমাদের চারজন ছাড়া লতা আর কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলত না। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের চারজনের নামই ফুলের নামে – শেফালী, লিলি, ডালিয়া আর আমি রোজী। অবশ্য আমার রোজী নামটাকে একটু কেটেছেঁটে রোজ করে ফুল বানিয়ে নিতাম। আর আমাদের সব ফুলের একটাই পাতা – সে হলো আমাদের অতি গর্বের লতা। আমরা সবাই লতার বান্ধবী – স্কুলে থাকতে এ-পরিচয়ও আমাদের কিছুটা অহংকারী করে তুলত।
দুই
পঁচিশ বছর অনেক লম্বা সময়। রাস্তাঘাট জনাকীর্ণ, গাড়ির কাফেলায় স্থবির। দিগন্তরেখা অদৃশ্য, কোথাও নেই কোনো শূন্যস্থানের বিরতি। সুউচ্চ দালানকোঠায় নগরী ঊর্ধ্বমুখী, ভরকেন্দ্র হেলে পড়েছে, আর বদলে যাওয়ার গল্প অগণিত। পঞ্চাশ বছর আগের সেই কিশোরীরা এখন দাদি-নানির দলে। আমাদের প্রথম স্টেশন শেফালীর বাড়ি – সেই চার ফুল। আর আমাদের পাতা?
শেষ পর্যন্ত আমিই প্রশ্নটা উত্থাপন করলাম, ‘লতা এখন কই রে?’
লিলি খুব আস্তে করে বললো, ‘তুই কিছু শুনিসনি?’
বললাম, ‘শুনেছিলাম । কিন্তু এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওইরকম মেয়ের জন্য এরকম একটা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল! শেফালী তুই ভালো বলতে পারবি। বলতো কেন এমন হলো?’
শেফালী এখন উত্তরদাত্রী, ‘আমি আমার চাকরিজীবনে এরকম কেস আরো অনেক দেখেছি। অনেক মেয়েরই বিয়ের পরের জীবনটা একটা অভিশাপের মতো হয়ে দাঁড়ায়।’
ডালিয়া ওর আর লতার স্বামীর কথা উল্লেখ করে বললো, ‘হাসান কিন্তু আলি সাহেবের কথা সবসময় ভালো বলতো।’
‘সবার এত এত শ্রেষ্ঠ বাবা-মা থাকার পরও পৃথিবীতে এত ঝঞ্ঝাট বাধে কেন? বান্ধবী হিসেবে আমি তোদের কাছে যেরকম আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছে কিন্তু সেরকম ছিলাম না। আমার স্বামী এবং কাজের বুয়া আমাকে সম্পূর্ণ দুটো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে। একবার আমার এক ছাত্রী লতার কেসটা স্টাডি করেছিল। মানবমন বড়ই বিচিত্র। স্বপ্নভঙ্গ, মানসিক নির্যাতন অনেকেই সহ্য করতে পারে না।’
এবার আমি মন্তব্য করলাম, ‘তাহলে ওর স্বামীটাই খারাপ ছিল?’
‘দুটো ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা দুটো ভিন্ন মানুষ এক ভাষায় কথা বললেও তাদের মনের ভাষা এক থাকে না। দাম্পত্যজীবনে এই মনের ভাষা বোঝার জন্য দুজনকে একটা ব্রিজ তৈরি করতে হয়। সেই ব্রিজটা যখন ভেঙে পড়ে তখন শুধু দাম্পত্যই নয়, অনেকাংশে তা একটা মানুষকেও শেষ করে দিতে পারে।’
লিলি বললো, ‘শুনেছি ছেলেমেয়েরাও ওর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত?’ আসলে সংসারের সুর প্রথম থেকেই কেটে গেলে তা হয়ে যায় তার-ছেঁড়া-সেতারের মতো। ঠিক সময়ে মেরামত করার কোনো কারিগর না থাকলে সে-সুর আর কখনো তালে-লয়ে ফেরে না। আমাদের সময় তো অনেক পুরনো। এখনো তো দেখি মেয়েদের শক্তপোক্ত সহানুভূতিশীল বাবা না থাকলে তাদের অনেক ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। একবার গর্তে পড়ে গেলে আর উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পায় না।’
আমি খুব অবাক হয়েই প্রশ্ন করলাম, ‘লতার তো আব্বা ছিল। আর কী সুন্দর বাড়িতে থাকত ওরা!’ ওর নানা বেঁচে থাকতে তো লতার ছিল মোমের পুতুলের মতো জীবন। আমরা সেই লতাকে দেখেছিলাম। নানা মারা যাওয়ার পর ওদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। আর লতার নিজের পারিবারিক জীবনের ক্রাইসিস মেটানোর সময়টাতে কেউ ওর পাশে ছিল না। পুতুল মেয়েটা জানত না সাঁতার, কিন্তু একবারে গিয়ে পড়ল সমুদ্রে। মেয়েদের আসলে এত তোলা তোলা করে মানুষ করতে নেই।
আমরা সবাই খুব অসহায় বোধ করতে লাগলাম। কেন লতা একবার ঝরে গিয়ে আবার নতুন করে প্রস্ফুটিত হলো না?
তিন
আমাদের পঞ্চাশ বছরের পুনর্মিলনী একসময় তার সমাপ্তির পর্দা টানে। পরদিন আমরা রওনা দিই আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। শেফালী অনেক কষ্ট করে সেই ব্যবস্থা করেছে। লতার স্বামী অনেক আগেই মারা গেছে, ছেলেমেয়েরাও বিদেশে। বলতে গেলে এখন আর কেউই ওর তেমন একটা খোঁজখবর রাখে না। অবশেষে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম। আমার বুকটা একটু কেঁপে উঠল। এত বছর পর লতাকে কেমন দেখব? অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে পঁয়ষট্টি বছরের জীবন এখন অনেক পোক্ত। তারপরও সামনের সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। সেখানে লেখা আছে ‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল, হেমায়েতপুর’।