ছোট্ট জংশনটিতে গালিব ছাড়া আরো যারা নামল তাদের বেশিরভাগ শ্রমিক শ্রেণির। সম্ভবত আশেপাশে বড় কোনো ফ্যাক্টরি রয়েছে। জংশনটি খুব একটা বদলায়নি আর বদলালেও সেসব খেয়াল করে না গালিব। রিকশা না নিয়ে হেঁটে হনহন করে বাড়ির পথ ধরে। ছোট ছোট চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া যুবকদের কেউ কেউ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে গালিবের দিকে। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার গালিবের পরনে রেগুলার ফিট ফ্লোরাল শার্ট আর গ্র্যান্ডিং জিনস। হাশ পাপিশ ব্র্যান্ডের জুতার মচমচে শব্দ হয়তো তাদের চোখে গালিবকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। এদের কাউকে গালিব চিনতে পারল না, বা চেনার চেষ্টাও করল না। উনিশ বছর আগে কারো কারো জন্মই হয়তো হয়নি।
পিচের রাস্তা ছেড়ে গালিব যখন মাটির সরু পথটিতে নামে, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। আজ প্রবারণা পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় রাস্তাটিকে রুপালি ফিতের মতো দেখাচ্ছে। পথ কখনো বদলায় না বোধ হয়। ছোটবেলায় যখন এই পথটি ধরে স্কুলে গিয়েছে তখন যেমনটি ছিল এখনো তেমনই মনে হচ্ছে। আশেপাশে ঘরবাড়ির সংখ্যাটাই শুধু বেড়েছে।
জংশন থেকে সরকারবাড়ি বেশি দূরে নয়। তবুও অনেকটা সময়ে লেগে গেল। বহুকালের অনভ্যাসের ফলেই হয়তো। ফতেপুর গ্রামের একদম শেষ বাড়িটি সরকারবাড়ি। এ-গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি? অবাক লাগে গালিবের। ইকরাম চাচার বাড়িতে হালকা আলোর আভাস। গালিবের বুকের মধ্যে দ্রিমদ্রিম হাতুড়ির শব্দ বাজছে। সরকারবাড়ি এত সুনসান, এতটাই ভুতুড়ে? কেন? সেই কোলাহল কোথায়?
অজানা আশংকায় গালিবের হাত-পা অবশ হয়ে আসে। আগে কি ইকরাম চাচার বাড়িতে যাবে? চাচা, ফুফু কি বেঁচে আছেন? ইকরাম চাচা বাবার চাচাতো ভাই। তার সঙ্গে জামিলা ফুফুর বিয়ে হয়েছিল। গালিব শুনেছিল দাদি এই বিয়েতে একদম রাজি ছিলেন না। বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। দাদি বলতেন, ‘বিছনার ওপর বিছনা বিছাইছে আজমত।’ আজমত গালিবের বাবা। গালিব মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি করে বলত, টু ইন ওয়ান। যিনি চাচা তিনিই ফুফা।
সিদ্ধান্ত বদলায় গালিব। নাহ! চাচার বাড়ি নয়, আগে বাড়িতেই যাবে। এক পা এক পা করে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। সরকারবাড়ির আদল ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। আর ততই ওর হার্টবিট বাড়ছে। একসময় মনে হলো বৈঠকখানাটি হুট করেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তের জন্য ওর হার্টবিট থেমে আবার সচল হয়। বৈঠকখানায় ঢোকার রাস্তাতেই কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে গালিব। কেউ একজন আছে বৈঠকখানায়। কিন্তু কে?
এই বৈঠকখানা বাবার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। আর তার থেকেও প্রিয় পুরনো আমলের কাঠের তৈরি একখানা ইজিচেয়ার। সম্ভবত বাবার দাদার আমলের। সেই আলিশান ইজিচেয়ারে বসা মানুষটির দুই পা সামনে এগিয়ে রাখা। তিনি এক পায়ের ওপরে অন্য পা তুলে দিয়ে আয়েসে নাড়াচ্ছেন। চেয়ারটি দুলছে। দুই হাত দুই হাতলের ওপর। বৈঠকখানার দরজা নেই। ঘরে-বাইরে তুমুল বাতাস। বাতাসে সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবির দুই কোণ বাতাসে পতপত করে উড়ছে। মানুষটিকে নিয়ে গালিব ধন্দে পড়ে যায়। আবছা আলোয় মুখ স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। বাবা! নাকি ইকরাম ফুফা! দুজনের বয়স একই, স্বাস্থ্য-উচ্চতাও সমান। আপন চাচাতো ভাই বলে চেহারাতেও অনেক মিল। গালিব মানুষটির কাছে যেতে গিয়ে থামে। খুট করে একটা শব্দ হলো কোথাও। চেয়ারের দুলুনি থেমে গিয়েছে। চেয়ারটিতে বাবা বা ফুফা কেউ নেই।
বৈঠকখানা ছেড়ে নেমে আসে গালিব। ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ দেখে এখনো বোঝা যায় এককালের বনেদি বাড়ির পাঁচিলের সিংহদরজা এটি। গেটের দুপাশে বসে থাকা দু-সিংহের মাথা থেকে কোমর অবধি ভাঙা। দুজনের মাঝে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে শতছিদ্রযুক্ত দুপাল্লা টিন। ওরা বেশ কাছাকাছি অবস্থান করছে। গালিব মোবাইলের আলো ফেলে শব্দের উৎস খোঁজে। একটি পাল্লার গায়ে কাঠের হুড়কো খুলে লটকে আছে। বাতাসের তোড়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর ছুটে গিয়ে সেই হুড়কো তারই আশ্রয়দাতার গায়ে আঘাত করছে আর খট করে আওয়াজ তুলছে।
পাল্লাটি সরিয়ে ভেতরে ঢোকে গালিব। অমনি দুদ্দাড় করে ঠান্ডা হাওয়া চোখমুখে ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সামনেই উঁচুমতো ঢিবি। লতাগুল্মে ভরা। চাঁদের আলোয় কালচে দেখাচ্ছে জায়গাটা। দাদির ঘর ছিল না এখানে? বুকের মধ্যে শৈশব হারানোর কষ্ট কেমন দানা বাঁধতে থাকে। আটচালা টিনের চালের মাটির ঘর ছিল এটি। এই ঘরেই বাবা আর তিন ফুফুর জন্ম। ফর্সা টুকটুকে দাদির ঠোঁট সারাজীবন পানের রঙে রাঙা থাকত। আঁচলে চাবির গোছা! চাবির ঝনঝন শব্দে ছোট গালিব বুঝতে পারত আশেপাশেই কোথাও দাদি রয়েছেন। সেইসব চাবি অবশ্য কোনো কাজের ছিল না। দাদির ঘরের একমাত্র কাঠের সিন্দুক ছাড়া কখনো সেই চাবি দিয়ে দাদিকে কোনো তালা খুলতে দেখেনি। সিন্দুক ভরা থাকত লেপ-তোশক আর বালিশ। হাতের বাঁয়ে মূল ঘরের দিকে না গিয়ে হেঁচড়ে-পেঁচড়ে ভিটার ওপর উঠে দাঁড়ায় গালিব। পা দুটো রাজ্যের ঘাস আর লতাগুল্মে ডুবে যায়। একটু ভয়ও হয়, সাপ নেই তো! সামনে অবারিত আকাশ। দূরে, অনেক দূরে, ছোট ছোট তারার মতো ফুটকি ফুটকি আলো জ্বলছে। শ্যামনগর গ্রাম। মাঝে বিশাল আয়তনের কাদার বিল। বারোমাস পানিতে ডুবে থাকে। তবু কেন যে এই নাম! এখনো চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে পানি। কিশোর গালিবের কত কত জোছনা রাতের সাক্ষী এই বিল!
দাদির ঘরটা পাঁচিলের কাজ করত। বিলের থেকে বাড়িকে আড়াল করে রেখেছিল। এখন কোনো আড়াল নেই বলে জলো হাওয়ারা তাণ্ডব করে ঢুকছে। ভিটের এক জায়গায় উবু হয়ে বসে গালিব মাটি স্পর্শ করে। এইখানে দাদির খাট ছিল। মায়ের বুকের দুধ ছাড়ার পর থেকে বেশ কয়েক বছর দাদির সঙ্গে এখানেই ঘুমাত গালিব। ভোরে ঘুম ভাঙতো হামান দিস্তার টুকটুক শব্দে। চোখ মেলার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে যেন টের পেয়ে যেতেন দাদি। এক চিমটে পানবাটা মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে বলতেন, ‘দাদা, পান খাইবা?’
উঠোনে নামে গালিব। উঠোন বলতে এখন ছোটখাটো জঙ্গল। ‘দাদাভাই আমাকে খুঁজো, টুকিইইইইই।’ মনে হলো নয় বছরের রুবা বাঁ বুক ঘেঁষে ছুটে গেল। কই নাহ, কেউ তো নেই। কী ভাবছে এসব?
আলো আর ছায়ায় চারপাশের সবকিছু রহস্যময়, উন্মনা। আত্মজিজ্ঞাসার চমৎকার এক পটভূমি যেন প্রকৃতি রচনা করে দিয়েছে। এই দিন, এই সময় কিছুই দেখার কথা ছিল না। একুশ বছরের গালিব আজ চল্লিশ বছরের সরকার গালিব হাসান। এই বাড়ি, এই উঠোনে কোনোদিনই ফেরার কথা ছিল না। তবু কেন যে ফিরে এলো! আসলেই কেন? গালিবের জানা নেই।
ডিসেম্বর মাসের কোনো এক মধ্যরাত ছিল সেটি। বাবা যে-রাতে বেত দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছিলেন গালিবকে। তারপর গুলি করার ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। নইলে গুলি করে মেরে ফেলব। যেদিন ফিরবি সেদিন তোর মায়ের মরা মুখ দেখিস।’ বাড়িতে একটা সেকেলে রাইফেল ছাড়া কোনো বন্দুক ছিল না। তবু কেন যে বাবা গুলির ভয় দেখিয়েছিলেন! আর শেষ পর্যন্ত মাকেই কেন ঢাল বানালেন?
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দুবার ফেল করে তৃতীয়বার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল গালিব। প্রস্তুতি নিচ্ছিল বললে ভুল হবে। বারবার পরীক্ষায় বসতে তাকে বাধ্য করা হচ্ছিল। পড়ালেখার প্রতি গালিবের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তবে পরীক্ষায় পাশ করার চেষ্টা যে করেনি সেটা নয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বহু রকমে চেষ্টা করেছে। নিজের জন্য নয়, অন্তত পাশটা করে বাবাকে খুশি করতে চেয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা বাবার মারের ভয় ছিল প্রচণ্ড।
ওর থেকে বেশি খারাপ অবস্থা ছিল মায়ের। আহ মা! গালিবের জীবনের সব থেকে নিরীহ শব্দটি ছিল মা! সবচেয়ে ভালোবাসার শব্দটিও মা! শ্যামলা বরণের ঘোমটা দেওয়া আজীবনের নতমস্তকমুখী এক ভীতু নারী। স্বামীর কথায় হ্যাঁ, সন্তানের কথায় হ্যাঁ, শাশুড়ির কথায় হ্যাঁ। জন্মনিয়ন্ত্রণ করা কবিরা গুনাহ। স্বামী-শাশুড়ি এই গুনাহ করবেন না, তাই বলতে গেলে প্রায় ফিবছর সন্তানের জন্ম দিয়ে গিয়েছেন। আল্লাহর মাল নয়খানা পুত্র-কন্যার গর্বিত জননী। যাকে পরিবারের কেউ কখনো তিল পরিমাণ দাম দেয়নি। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ মুখ টিপে বলতেন, বছর-বিয়ানি গাই। গাইয়ের সঙ্গে মায়ের কেন তুলনা করা হতো সে-সময় গালিব বুঝত না। তবে গণস্বাস্থ্যকর্মী মলুদা খালা প্রায় প্রতি মাসে ছাতা মাথায় করে বাড়িতে আসতেন আর দাদির গালাগাল খেয়ে ফিরে যেতেন, সেটা গালিব দেখেছে। প্রবল পরাক্রমশালী বাবার পাশে মা ছিলেন হতদরিদ্র প্রজার মতো। জমিদারের অত্যাচার ঘাড় গুঁজে সয়ে যাওয়াই যার কাজ। সন্তানেরা একটু বুঝতে শিখলে সেটা টের পেত। তাই তাদের কাছেও মা ছিলেন নিতান্ত দরকারি আসবাবগোছের। মায়ের খুশি-অখুশির কোনো মূল্যই ওদের পরিবারে ছিল না। সেই মা গালিবের ফল প্রকাশের দিন রোজা রাখতেন। ঘনঘন জায়নামাজের পাটি টেনে বসতেন। গালিবের রেজাল্ট ভালো করার জন্য যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি ছিল বাবার মার থেকে গালিবকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে।
মার খাওয়াটা যেন গালিবের ভাগ্যের সঙ্গে স্থায়ীভাবে জুড়ে গিয়েছিল। বিশেষ সুপারিশ ছাড়া ওপরের কোনো ক্লাসে প্রমোশন পেয়েছে বলে মনে পড়ে না গালিবের। এত পড়ার পর কেন যে পরীক্ষা হলে বসে সব গুলিয়ে ফেলত আজো বুঝতে পারে না। প্রতিবার ফল প্রকাশের পর বাবার হাতের বেত হিসহিস করে বাতাসে ফণা তুলত আর পরক্ষণে নেমে আসত গালিবের পিঠে। পিঠ কেটে কেটে দাগ বসে যেত। ধীরে ধীরে বাবা ওর কাছে একটা বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল। এমনও হয়েছে, রেজাল্টের আগের রাতে আল্লাহর কাছে হাত তুলে মোনাজাত করেছে, ‘হে খোদা, বাবাকে আজ রাতেই তুলে নাও।’
এই তো সামনেই বারান্দা লাগোয়া সারি সারি ছয়টি ঘর। প্রাণের স্পন্দন নেই। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, সারাবাড়ি ঘাস-জঙ্গলে বোঝাই অথচ গ্রিল আটা প্রশস্ত বারান্দা আগের মতোই ঝকঝকে তকতকে। তবে কি সকলে ঘরে আছে? কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন? গ্রিলের ফাঁক গলা রুপালি আলোর ফালি ফালি জ্যামিতিক রেখাগুলো আগের মতোই লুটাচ্ছে। গালিবের মনে হলো বারান্দা নয় চুলের মতো সরু পুলসিরাতের ঝুলন্ত সেতু। পার হতে গেলেই ছিঁড়ে পড়ে যাবে আর হারিয়ে যাবে গহিন অন্ধকারে।
গালিবের ঘর বারান্দার একদম শেষ মাথায় ছিল। এখন কে থাকে সে-ঘরে? রোকন, নাকি জামিল? নাকি কেউ না? বুকের ভেতর ঘূর্ণিঝড়ের আভাস। ফুসফুস জুড়ে বিশ বছরে জমে থাকা কথোপকথন। মা বাবা দাদি ঝুমা রুমা সুমা সকলে যেন একযোগে কথা বলতে চাইছে। কেমন আছিস? কোথায় ছিলি এতদিন? কেন এলি? নিষেধ করেছিলাম না? দাদাভাই আমার লাল ফিতা কই? উফ! তোরা থামবি একটু? এত্ত বছর পরে মাকে মনে পড়ল?
আশা আর আশংকা নিয়ে খুব সাবধানে, সন্তর্পণে বারান্দায় পা রাখে গালিব।
বাবার সম্পদ যত না ছিল তার থেকে কয়েকগুণ বেশি ছিল ঠাঁটবাট। বাবা ছিলেন রাখি মালের ব্যবসায়ী। ধান, চাল, পাট, আলু, পেঁয়াজ, রসুন। যখন যে সিজন আসত সেই সিজনের ফসল কম দামে কিনে গোলা ভরে রাখতেন। তারপর তক্কে তক্কে থাকতেন, দাম বাড়লেই বাজারে ছেড়ে দিতেন মাল। বাবার পুঁজি খুব বেশি ছিল না সম্ভবত। কারণ এতবড় সংসার! সারাবছর অভাব বত্রিশ দাঁত বের করে হাসত। পুরো ডিম খেয়েছে এরকম ঘটনা সংখ্যায় খুব কম বার ঘটেছে। বেশিরভাগ সময় ছয়টা ডিম কেটে বারো ভাগ করা হতো। মা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সুতো দিয়ে ডিমের মাঝখান দিয়ে ভাগ করতেন। স্কুল থেকে ফিরে ক্বচিৎ মিটসেফে সাজানো ভাতের প্লেটে আস্ত ডিম দেখলে গালিবের মুখ খুশিতে ঝকমক করে উঠত। রোকন তো চিৎকার করে বলেই ফেলত, ‘দাদাভাই, আজ আস্ত ডিইইইম!’ গালিবের চোখের সামনে ছয়টি সাজানো ভাতের থালা ভেসে ওঠে। তখন ওরা সাত ভাইবোন স্কুলে পড়ে। বাকি আলিফ, ঝুমা আর সুমা তখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। মা মিটসেফে দুপুরের খাবার বেড়ে সারি সারি সাজিয়ে রাখতেন। স্কুল থেকে ফেরার পর ভাইবোনদের হুড়োহুড়ি পড়ে যেত কে আগে মিটসেফের কাছে যাবে। মায়ের হাতের আন্দাজ সকলের জানা। কারো পাতে একটা ভাত কমবেশি হওয়ার উপায় নেই। তবুও শকুনের দৃষ্টিতে ওরা থালাগুলো মেপে নিত।
সংসারে খাবারের অভাব হলে কি হবে বাবার বড়লোকি চালে ঘাটতি ছিল না। ভোরে দামি ব্র্যান্ডের বিস্কিটের সঙ্গে কড়া লিকারের দুধ চা। বিকেলে ঝাল-মিষ্টি নাস্তা। দিনমান সিগারেট। পোশাকে ধোপদুরস্ত বাবাকে সাদা ছাড়া অন্য কোনো রঙের পাঞ্জাবি পরতে দেখেনি গালিব। পাতলা ফিনফিনে আদি ভয়েলের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বুকপকেটে সবুজ চামড়ার কাভারের ছোট্ট একটা নোটবুক থাকত। তার ভেতর পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট টাকার নোট। দশ, পাঁচ, এক টাকা। ঝুলপকেটে খুচরো পয়সা। পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা। তখন বোধহয় এক পয়সার চল উঠে গেছে। পাঁচ পয়সার চারকোণা লাঙল আঁকা কয়েন ছিল। বড় টাকার নোট বাবার পকেটে ক্বচিৎ পাওয়া যেত। বিশ বা পঞ্চাশ টাকার নোট কখনো কখনো নোটবুকটাতে পাওয়া গেলেও একশ টাকার নোট বোধহয় বাবা ট্রাঙ্কে রাখতেন। কিছুটা গোল শেপের ট্রাঙ্কটি ছিল কিশোর গালিবের কাছে গুপ্তধনের গুহা। বাবার যাবতীয় গোপন জিনিস থাকত সেই গুহায়। ট্রাঙ্কটিকে কখনো তালাবিহীন অবস্থায় দেখা হয়নি। বাবার কোমরে দুই প্যাঁচের কালো করে চাবি বাঁধা থাকত। ঘরের কোণে একটা চেয়ারের ওপর রাখা ছিল ট্রাঙ্কটি। প্রতিবার তালা খোলার সময় বাবাকে হাঁটু মুড়ে বসতে দেখেছে গালিব। তালা খোলার সময় কিছুটা দূরত্ব রেখে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু ভয়ে কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি।
ট্রাঙ্ক ধরার সাহস না থাকলেও দেওয়ালের র্যাকে ঝুলিয়ে রাখা বাবার পাঞ্জাবিতে গালিবের অবাধ বিচরণ ছিল। খুচরো পয়সায় পোষাত না। ফলে পাঞ্জাবির ঝুলপকেটের খুচরো পয়সায় লোভ ছিল না। যত আকর্ষণ ছিল বুকপকেটের সবুজ নোটবুকে। আর বিশ-পঞ্চাশ টাকা নেওয়ার সাহস তখনো সঞ্চয় করতে পারেনি। যদিও একসময় ভয় ভেঙে গিয়েছিল। গালিবের বেশি পছন্দ ছিল দশ টাকার নোট। সে-সময় দশ টাকায় মেলা জিনিস পাওয়া যেত। বাবার পকেট থেকে সে অভিনব কায়দায় টাকা সরাত। পাতার ফাঁকে রাখা টাকাটা নিয়ে প্রথমে নোটবুকের চামড়ার পেছনে লুকিয়ে রাখত। তারপর অপেক্ষা করত টাকার খোঁজ পড়ে কি না। কোনোদিন খোঁজ পড়েনি তবু এই সাবধানতা কেন সেটা অবশ্য এখনো ভেবে পায় না। দুদিন অপেক্ষার পর নিজের বইয়ের মলাটের ভেতর চালান করে দিত।
স্কুলের ছোট ক্লাসে পড়ার সময় চুরি করা টাকা দিয়ে কটকটি, চিট, চানাচুর ভাজা, কাচের বল – এসবেই খরচ হয়ে যেত। টিফিন টাইমে দত্তবাড়ির পুকুরঘাটে বসে একাই সব সাবাড় করে মুখ মুছে ভালো ছেলেটির মতো ক্লাসে গিয়ে বসত। কখনো কোনো বন্ধুকে ভাগ দেওয়া হয়নি। নয় ভাইবোনের সঙ্গে বড় হয়েছিল। কিন্তু ভাগের অভ্যাস কেন জানি রপ্ত হয়নি তখনো।
বারান্দায় এক পা রেখে থেমে যায় গালিব। কেউ এদিকেই এগিয়ে আসছে। হাতে টর্চ। টর্চের আলোর পেছনের মানুষটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে অবয়ব দেখে এতবছর পরেও গালিবের চিনতে ভুল হয় না। মঞ্জুরী!
মঞ্জুরী এখন গালিবের মুখোমুখি। ষোলো বছরের কিশোরী আজ পঁয়ত্রিশ বছরের পরিপূর্ণ যুবতী। মঞ্জুরীর এই রূপের কি বর্ণনা দেবে গালিব? ওকে দেখে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতা মনে পড়ে –
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা –
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলেঃ
দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সে আগুনে হায়।
চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার
চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জুরী। বিষণ্নতার মূর্ত প্রতীক যেন। কড়িসাদা মুখের ওপর থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে চাঁদের আলো। আধা আধা আলোতে চোখ দুটোর গভীরে নীলাভ অন্ধকার দেখতেও ভুল করে না গালিব। মঞ্জুরী এক উঠতি বয়সী যুবকের প্রিয় কিশোরী। প্রিয়তমা প্রেমিকা।
‘এসো।’
একটু কেঁপে গেল যেন মঞ্জুরীর কণ্ঠ। গালিব আশ্চর্য হয়। এত বছর পর দেখা। কিন্তু ওর ডাক শুনে মনে হলো প্রতিদিনই সে এই আহ্বান করে থাকে। তার মানে কি মঞ্জুরী …? নাহ সে কী করে সম্ভব!
লঘু পায়ে হাঁটছে মঞ্জুরী, পিছু পিছু এক পা এক পা করে গালিবও হাঁটে। হাতের ডানের রুমগুলো এক এক করে পার হতে থাকে। রুমা আর ঝুমার ঘর। রোকন, সুমনের ঘর। প্রতিটা ঘরই তালাবদ্ধ।
কারো বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে ভয় হচ্ছে গালিবের। কি জানি মঞ্জুরী হয়তো বুঝতে পারে। চুপিচুপি বলে, ‘কেউ নেই। রোকন সুমন রুবা আর রুমা দেশের বাইরে থাকে। শেষবার এসেছিল পাঁচ বছর আগে। যেবার মামা মারা যান। ঝুমা, ইকরা আলিফ, জামিল থাকে ঢাকায়। আগে মাঝেমধ্যে আসত এখন তেমন আসে না। কার কাছে আসবে?’
‘মা কার কাছে আছেন?’
‘তুমি যাবার এক মাস পরে মামি চলে গেছেন। খাওয়া-দাওয়া হাসিকান্না সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। পাথরের মতো বসে থাকতে থাকতে একদিন রাতে টুপ করে চলে গেলেন। তার প্রায় দুই বছর পর দাদি। দাদি শেষের দিকে গালিব গালিব বলে বুক চাপড়ে কাঁদতেন।’
গালিব বুকের বাঁ-পাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে। ব্যথাটা খুব বেড়েছে। চোখদুটো পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
‘মামি যে কয়দিন বেঁচে ছিলেন কেউ তার মুখ থেকে একটি কথাও বের করতে পারেনি। কোনো প্রশ্ন করলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। দেখ ঠিক ওই জায়গাটাতে বসে থাকতেন।’
মঞ্জুরী ঘুরে গেটের দিকে হাত নির্দেশ করে।
‘মামি যাবার পর মামাও আমূল বদলে গেল। আমরা কখনোই তার উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। এতে শাপে বর হয়েছিল বোধ হয়। মায়ের আদর আর বাবার কর্তব্য করে সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।’
কে কোথায় কতটা প্রতিষ্ঠিত সেসব কিছুই আর গালিবের শুনতে ইচ্ছে করে না। গালিব জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কেমন আছ? সংসার, বাচ্চাকাচ্চা?’
মঞ্জুরী মুহূর্তখানেক থেমে ঘুরে তাকায়। গালিবের মোবাইলের আলো ওর মুখে। এত ম্লান হাসি কেউ হাসতে পারে?
‘আমার কথা থাকুক। তোমার বউ, বাচ্চাদের কথা বলো। বাচ্চা কজন?’
‘আমার কেউ নেই।’
মনে হলো মঞ্জুরী আবার একটু থামল।
‘মামা বলেছিলেন একদিন গালিব ফিরে আসবেই। আমিও জানতাম তুমি আসবে। কিন্তু ফিরতে এত সময় লাগিয়ে দেবে বুঝিনি। কোথায় ছিলে? কেমন ছিলে?’
‘ছিলাম পৃথিবীর বুকেই। তবে এই দেশে নয়। ধাক্কা খেতে খেতে চলে গিয়েছিলাম দেশ ছেড়ে।’
‘এতকাল পরে ফিরে এলে কেন?’
‘ফিরতে চাইনি আমি। কিন্তু এখন কেন ফিরলাম আমি জানি না। একদিন মনে হলো বাড়িতে যেতে হবে আর কিছু ভাবিনি। টিকেট কেটে চলে এসেছি।’
‘কোন দেশে আছ? জানাওনি কিছু। কোনোদিন খোঁজ নেবার ইচ্ছে হয়নি?’
‘মালয়েশিয়া। প্রতিদিন ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।’
‘আবার ফিরে যাবে নাকি?’
‘জানি না। এখনো কিছু ঠিক করিনি।’
‘ও।’
‘তুমি কি একাই থাকো এখানে?’
‘নাহ। রাতে মারুফ এসে থাকে। রাব্বানী ভাইয়ের ছেলে।’
‘ইকরাম চাচা, ফুফু কেমন আছেন?’
‘তারা কেউ নেই।’
সব গল্পই হারানোর। সেটাই হওয়ার কথা ছিল। তবুও বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসগুলো আটকে থাকতে চাচ্ছে না।
হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার শেষ মাথায় গালিবের ঘরের সামনে চলে যায় ওরা। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে একমাত্র গালিবের একার একটি ঘর ছিল। বাকি সব দুই-তিনজনের এজমালি ঘর।
মঞ্জুরী ঘরে ঢুকে গিয়েছে। হারিকেনের স্বল্প আলোয় ঘরটি এক নজরে দেখে নেয় গালিব। উনিশ বছর আগে যেমনটি ছিল এখন ঠিক তেমনি আছে। সেই খাট, পড়ার টেবিল, কাঁঠাল কাঠের হলদেটে চেয়ার। সেইসময় এই ঘর ছিল ছন্নছাড়ার চূড়ান্ত রূপ। প্রচণ্ড রকমের অগোছালো। আর এখন পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। বিছানায় টানটান সাদা বেডকভার, টেবিলের বইগুলো বড় থেকে ছোট সিরিয়ালে রাখা। সাদা প্লাস্টারের মেঝে আয়নার মতো ঝকঝকে। এই ঘরেই কি মঞ্জুরী ঘুমায়?
গালিব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই ঘরের দরজা বন্ধ করে বাবা কতদিন গরুর মতো পিটিয়েছে। এত বছর আগের কথা অথচ মনে হতেই চোখ দুটো ধক্ করে জ্বলে ওঠে। বাবাকে সে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারেনি।
‘কই ভেতরে এসো। তোমার ঘরে এখন আমি ঘুমাই। দেখ সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। একটা জিনিসও এ-ঘরের বাইরে যায়নি।’
প্রচণ্ড দ্বিধার সঙ্গে ঘরে ঢোকে গালিব। টেবিলের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। সেবার ম্যাট্রিক পাশের জন্য এই বইগুলোই পড়ছিল। চাপা অভিমানে তোলপাড় করছে গালিবের ভেতরটা। পড়া মাথায় ঢুকত না সেটা কি গালিবের দোষ? চেষ্টার ত্রুটি তো করেনি কখনো। তবু বাবা কেন ওকে মারতে মারতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে ফেলেছিল? এরপর সে কোনোদিনই ম্যাট্রিক পাশ করেনি। তাতে কি কিছু আটকে আছে? আজ অনেক টাকা অনেক ক্ষমতার মালিক গালিব।
কিন্তু সেসব বই এতদিন পর্যন্ত রেখে দিয়েছে কেন? ড্রয়ারে কলম, পেনসিল, স্কেল, লাটিম। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এই লাটিম ঘুরানো ছিল গালিবের নেশার মতো। লাল রঙের কটের সুতাও রয়েছে। এতদিনে সুতা পচে গিয়েছে বোধহয়। সেটা পরখ করতে লাটিমে সুতা পেঁচিয়ে জোরে ছুড়ে মারে মেঝেতে।
লাটিমটি মেঝেতে পড়ে পিছলে ঘরের এক কোণে ছিটকে চলে যায়। কাছেই মঞ্জুরী দাঁড়িয়েছিল। অকস্মাৎ খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে ও। গালিব অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে। কি স্নিগ্ধ! কি মনোরম এই দৃশ্য! এ যেন মানুষ নয়, অজানা কোনো পর্বত থেকে নেমে আসা রিমঝিম ঝরনাধারা। ওর সঙ্গে ঘরের প্রতিটি বিন্দু হাসছে। কী যে হলো! আচমকা বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে মঞ্জুরী। গালিব দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওকে। বলিষ্ঠ এক পুরুষবুকে পেলব নারীবুক পিষ্ট হতে থাকে। মঞ্জুরীর হাতের নখ গালিবের পিঠে গভীর ক্ষত হয়ে বসে যাচ্ছে। গালিব মনে মনে আওড়ায়,
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আর্দ্র – কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
সময় থমকে যায়। গালিব খেয়াল করে বুকের শার্ট ভিজছে। কখন যেন ওর নিজের চোখ থেকেও একফোঁটা জল গড়িয়ে মঞ্জুরীর মাথায় পড়ে। আর্দ্র গলায় ডাকে, ‘মঞ্জুরী।’
আর তাতেই দুহাতে গালিবকে ঠেলে দুহাত পিছিয়ে যায় মঞ্জুরী। টলমল চোখে গালিবের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হয়েছে, এতদিন পর এসে চোখের পানি ফেলতে হবে না।’ বাচ্চাদের মতো অভিমানে ওর ঠোঁট ভেঙেচুরে যাচ্ছে। গালিব এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওকে থামিয়ে দেয়।
‘চলো, তোমার সব জিনিস বুঝিয়ে দিই।’
মঞ্জুরী গালিবকে আহ্বান করে হারিকেন হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গালিব যেন কলের পুতুল যার সুতা মঞ্জুরীর হাতে। কী বুঝিয়ে দিতে চায় ও। এসব কোনো জিনিসই ওর আর দরকার নেই। তবু মঞ্জুরীকে অনুসরণ করে গালিব।
বারান্দার মাঝামাঝি জায়গায় বাবার ঘর। গালিবের পা চলতে চায় না। মঞ্জুরী বাবার ঘরের তালা খুলছে।
ঘরের ভেতরটা জমাট অন্ধকার। কিন্তু গুমোট নয়। বোঝা যাচ্ছে নিয়মিত খোলা হয় এ-ঘর। বাবা-মায়ের খাট নিঃসঙ্গ সময়ের মতো স্থির। কিন্তু খাট পেরিয়ে ঘরের কোণের দিকে চোখ যেতে সমস্ত শরীরের রক্ত ডংকার তালে নাচতে থাকে। ‘বাবার ট্রাঙ্ক!’
কিছুটা গোলশেপের। টিনের। গালিবের শৈশবের গুপ্তধনের গুহা!
পুরো ঘর অন্ধকারে ঢাকা থাকলেও ওই জায়গাটা আলোকিত। পেছনে গোলাকার হ্যালো। এটা হয়তো গালিবের দেখার ভুল।
মঞ্জুরীর হাত গালিবের দিকে এগোনো। ওর হাতে ক্ষুদ্র একটা চাবি। ওর মুখ নড়ছে। কিন্তু গালিব কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। ও শুধু বাবার কণ্ঠের চিৎকার শুনছে, ‘শুয়োরের বাচ্চা, শেষ পর্যন্ত চুরি করতে শিখেছিস? ছোটলোকের জাত!’
সরু একটা লিকলিকে বেত গালিবের পিঠ কেটে বসে যাচ্ছে। গালিব ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চুরি নয় শ্রেফ কৌতূহল থেকে ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে ফেলেছিল। ভাঙতে চায়নি। একটু মোচড় দিতে পট করে ভেঙে যায়। কিন্তু ট্রাঙ্ক খুলে হতবাক হয়েছিল গালিব। এত টাকা? তাহলে ওদের সংসারে এত অভাব কেন? ডিম আধাটা খেতে হয় কেন? একধরনের হিংস্রতা কাজ করছিল গালিবের মধ্যে। খামচা দিয়ে টাকার কয়েকটা বান্ডিল উঠিয়ে এনেছিল। তারপর ঘরের পেছনে গিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছিল সেই টাকার বান্ডিল। কী কাজের জমানো ওই টাকা?
‘গালিব চাবি নাও। ট্রাঙ্কের তালা খোল। মামা বলে গিয়েছিলেন এই ট্রাঙ্কের তালা যেন আমি কখনো না খুলি। যদি কখনো ফিরে আসো। তোমাকে চাবি দিয়ে দিই।’
গালিব সংকোচের সঙ্গে চাবিটা হাতে নেয়। বাবার মতো করে উবু হয়ে বসে ট্রাঙ্কের সামনে। তালায় মরচে পড়ে গেছে। খুলছে না চাবি দিয়ে। গালিবের হাত কাঁপছে। কী আছে ট্রাঙ্কে?
‘গালিব, মামা আমাকে সবকথা বলে গিয়েছেন। ওই টাকা মামার ছিল না। রজব চাচা তার জমি বিক্রির সমস্ত টাকা মামার কাছে আমানত রেখেছিলেন। রেশমির বিয়ের সময় খরচ করবেন বলে।’
গালিবের হাত থেমে যায়। কপাল পিঠ দিয়ে ঘামের ঝরনাধারা বইছে। বাবা পেটাচ্ছিলেন আর বারবার বলছিলেন, ‘টাকাগুলো কোথায় রেখেছিস ফেরত দে। এই টাকা আমার না।’
গালিব ঘাড় ত্যাড়া করে বলেছিল, ‘দেবো না, পুড়িয়ে ফেলেছি।’
ধুর তালা খুলছে না কেন? সেদিনের মতো মোচড় দেয় গালিব আর সেদিনের মতোই পট করে তালাটা ভেঙে যায়।
‘সেই টাকা পরে মামা কিভাবে শোধ করেছেন জানো? আমার বাবার কাছে এই বাড়ি বিক্রি করে। আর তো কোনো উপায় ছিল না। বাবা আবার আমার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছেন। বাবাকে তো জানো। মামাকে কি পরিমাণ ভালোবাসতেন। জীবিত থাকাকালে কখনো এই বাড়ির ওপর দাবি করেননি।’
টাকা পুড়িয়ে ফেলার কথা শুনে বাবা যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি বিক্রি? ঝুঁকতে ঝুঁকতে গালিবের ঘাড় বুকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। পরাজিত সৈনিকের মতো। সে অবস্থাতে ট্রাঙ্কের ঢাকনা খোলে। দুরুদুরু বুকে তাকায় কী আছে দেখার জন্য। বাবার বুকপকেটের সবুজ নোটবুকটা ছাড়া কিছুই নেই সেখানে!
‘মামা না হয় রাগের মাথায় আসতে নিষেধ করেছিলেন তাই বলে তুমিও জিদ করে বসে থাকবে? মামির মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী গালিব, তুমি। তুমি চুরি করেছিলে, তুমিই অন্যায় করেছে। মামা নয়। আমার এত অপেক্ষা, মামার অনুতাপের সকাল দুপুর বিকেল সবই তোমার কারণে।’
গালিব নোটবুকটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নোটবুকের প্রতিটা পাতার ফাঁকে একটা করে দশ টাকার নোট। উদ্ভ্রান্তের মতো পাতা ওলটায় গালিব। সারাজীবন বাবার কাছে হেরেছে গালিব। আজো হেরে গেল।
মঞ্জুরী থেমে গিয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে প্রবলবেগে বাতাস ঢুকতে থাকে। বাতাসের ঘূর্ণির মধ্যে টাকার নোটগুলো ঘরময় উড়ছে। টাকা নয়, যেন প্রত্যেকটা নোট একেকটা চিরকুট! যেখানে বাবা ওর শৈশব লিখে রেখে গিয়েছেন। গালিব পাগলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে টাকাগুলো ধরতে চায় কিন্তু একটি টাকাও সে ধরতে পারে না।