কয়েক মাস ধরেই বদরুল্লাহর আঁধারপ্রীতি জন্মেছিল। সেই প্রেমে সাড়া দিয়েই হয়তো ভাগের অটোরিকশা থেকে নেমে তাঁর বাসা পর্যন্ত হেঁটে আসার পথে অর্ধেকের কাছাকাছি সরকারি আলোকস্তম্ভ নষ্ট। কাজেই একবার রাস্তার এপার আরেকবার ওপার করে অন্ধকার বাতির নিচ দিয়েই হাঁটেন তিনি। আঁধারপ্রেমিক হওয়ার কারণেই হোক আর সামাজিক বাস্তবতার খাতিরেই হোক, জৈষ্ঠ্যের এক স্যাঁতসেঁতে-অস্বস্তিকর রাতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়লেন। দিনের বেলাতেও সচরাচর যা হয়
না – বিপদের মুহূর্তে হঠাৎ বাঁশির ফুঁ এবং দৌড়ে আসা যুগপৎ একাধিক মানুষের পদশব্দ এবং কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। ফলে ছিনতাইকারীরা শুধু তাঁর মোবাইল ফোনটা নিয়ে দৌড় দিলো আর পদশব্দ অন্যপথে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠকাস করে একটা শব্দ হলো। গুলির শব্দ ঠকাস করে হয় কি না বদরুল্লাহর মনে পড়ল না। একাত্তরে চোদ্দো বছর বয়সে শোনা হাজার অস্ত্রের ঝাঁকবাঁধা গুলির শব্দের সঙ্গে শব্দবিরল রাতের একটি নিঃসঙ্গ ঠকাসকে তিনি মেলাতে পারলেন না। যথেষ্ট ভয় পেলেন। এত বছরের ঢাকা শহরে দুবার পকেটমার হয়েছে তাঁর। কিন্তু সামনাসামনি অস্ত্রহাতে অকারণ শত্রুকে দেখেননি কখনো। বুক ধড়ফড় করছিল, কাঁপতে কাঁপতে বাসার দিকে পা বাড়াতেই রাস্তার ওপারের বাতিস্তম্ভের নিচে কালো-চকচকে কিছু একটা নজরে পড়ে তাঁর। ভীত পায়ের ধমনিগুলো পর্যন্ত তাঁকে বাসার নিরাপদ আশ্রয়ে টানা সত্তে¡ও নিজের মোবাইল ফোনের রং তাঁকে রাস্তা পার করিয়ে নেয়। রাস্তা পার হয়ে সরকারি আলোকস্তম্ভের আলোয় একটি কালো-ছোট অস্ত্র পড়ে থাকতে দেখলেন – পিস্তল অথবা রিভলভার। নাম ছাড়া দুটোর তফাৎ জানা নেই তাঁর। তবে তিনি জানলেন, রং কালো হলে বা চকচক করলেই মোবাইল হয় না। তিনি বরাবর বাসার দিকে হাঁটা ধরলেন। ঘোরের ভেতর আপেক্ষিক সময় গণনা ভুলে গিয়েছিলেন, হঠাৎ সেই অস্থির পদশব্দ আর কুকুরের ডাক আবার ফিরে আসতে লাগল, সঙ্গে ঘনঘন বাঁশির ডাক। বদরুল্লাহ ফিরে এলেন। কাক-কানা হয়ে চোখ প্রায় বুঁজে অস্ত্রটা তুলে পকেটে ভরে বাসায় ফিরলেন। এখনো কাঁপছেন, তবে এখন আর ভয় করছে না।
বদরুল্লাহ গত বিশ বছরের মধ্যে প্রথম অভ্যাস ভঙ্গ করে প্যান্ট পরেই গোসলখানায় ঢুকে ঘর্মাক্ত দেহে পকেট থেকে অস্ত্রটা বের করলেন। এ-বস্তু তিনি কোনোদিন হাতে নেননি, ছোট অথচ ওজনদার। এই দ্বিতীয়বার মুক্তিযুদ্ধে না-যাওয়ার জন্য তাঁর আফসোস হলো। প্রথমবার আফসোস হয়েছিল যখন তাঁর ছেলে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেল না। মনে হয়েছিল, যদি যুদ্ধে যেতেন, অথবা কোনোরকমে যদি সনদটা জোগাড় করতেন, তাহলে ছেলেটা কোটায় ভর্তি হতে পারত। তখন যদি গুলি চালানো শিখে নিতেন, আজ অবলীলায় এই অস্ত্র চালাতে পারতেন। তাঁর জীবনে তখনই ছিল গুলি চালানো শেখার একমাত্র বৈধ সময়। উত্তেজনাময় সাবধানতায় তাঁর গলা শুকিয়ে এলে কল ছেড়ে ব্যাকটেরিয়াসমৃদ্ধ পানিই খানিকটা গিলে ফেললেন। বহুদিন পর মনে হচ্ছে যৌবনের উত্তাপ ফিরে আসছে শরীরে এবং তাঁর পাকস্থলী সবকিছুই হজম করে শুদ্ধ করতে সমর্থ। প্রথমত, তিনি অবৈধ-নিষিদ্ধ অধিকারীরূপে ভীত হলেন। দ্বিতীয়ত, নিষিদ্ধ বস্তুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেন। তৃতীয়ত, যার ভয়ে খানিক আগে তটস্থ ছিলেন, সেটাই এখন তাঁর করতলগত হওয়ায় বিস্মিত হলেন। চতুর্থত, অস্ত্রে গুলি আছে কি না ভেবে চিন্তিত হলেন। পঞ্চমত, জিনিসটা খেলনা কি না ভেবে সন্দিহান হলেন। ষষ্ঠত, অল্পবয়সী কয়েকটা ছোকরা খেলনা দেখিয়ে তাঁকে ভয় দেখাতে পেরেছে ভেবে লজ্জিত হলেন এবং সপ্তমত, লজ্জা ঢাকতে প্যান্ট খুলে বাথরুমের আয়নাটা ঢেকে দিলেন। নগ্নগায়ে অন্তর্বাস পরে অস্ত্র উঁচিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তাঁর লজ্জা বিলুপ্ত হলে প্যান্টটা কাঁধে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। চকচকে তালু, ঘামে নুয়ে পড়া ভুরু, তোবড়া কপোল, খানিক ঝুলে পড়া গলা, পাকা চুল বুক আর ভেসে ওঠা ফ্যাকাসে পেট নিয়ে দাঁড়ানো প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বদরুল্লাহ গুলি করার ভঙ্গিতে অস্ত্র উঁচু করতেই তাঁর প্রথম গুলিটা নিজেকেই করা সমীচীন মনে হলো। নিজেকে ভুরু নাচালেন আর সঙ্গে সঙ্গেই গুলি থাকা-না-থাকার সন্দেহটা ফিরে এলো। ঝরনাটা ছেড়ে একপাশে সরে গিয়ে অস্ত্রের এটা-ওটা ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। একাত্তরের হাজার গুলির বীভৎস শব্দ এই ঝরনার জলতরঙ্গ ঢাকতে পারবে না। তবে যদি কিছুক্ষণ আগের ‘ঠকাস’ শব্দ হয়, তবে সহজে কেউ শুনবে না। কালো একটা বোতাম যে অস্ত্রের রঙের সঙ্গে ছদ্মাবরণ নিয়ে ছিল, সেটা তাঁর চোখে পড়েনি। সেখানে চাপ লাগতেই ‘ঠকাস’ করে আবারো শব্দ হলো। বদরুল্লাহ প্রায় লাফিয়ে উঠে ঝরনার নিচে চলে গেলেন, তাৎক্ষণিক চমক কেটে যাওয়ার পর অস্ত্রের ম্যাগাজিনটা চোখে পড়ে তাঁর। আরেকটু হলেই কমোডের ভেতর পড়ছিল। ম্যাগাজিনটা তুলে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মেরে মোটামুটি দুটি গুলির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। ম্যাগাজিনটা আবার যথাস্থানে বসিয়ে নানান ভঙ্গিমায় অস্ত্রসজ্জিত নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলেন তিনি। আয়নার দিকে তাক করে ভাবলেন, অভাবনীয় গতির গুলির আঘাতে কাচ ভাঙার শব্দ কেমন হয়! গুলির নিনাদ আর কাচের ঝংকার – কে কাকে আচ্ছাদিত করে? নিজের মাথায় ঠেকিয়ে ভাবলেন – আয়নার প্রতিবিম্বে হোক আর নিজেকে হোক, গুলি চালালেই আয়না অদৃশ্য হবে। এই ভালো, খান্দানি সমাপ্তি। নাকি শৌখিন! আপেক্ষিক সময়ের কাছে আজো পরাজিত হলেন, কারণ রীতা দরজা ধাক্কা দিয়ে জানালো যে, আধঘণ্টা হয়ে গেছে তিনি গোসলখানায় অবস্থান করছেন। অস্ত্রটা কোথায় রাখবেন সেটা চট করেই মাথায় চলে এলো। তাঁর অফিসব্যাগই একমাত্র জায়গা যেখানে কেউ হাত দেয় না। অফিসে তিনি ঠিক কী করেন সেটা জানার আগ্রহই সবার সবচেয়ে কম।অস্থির একটা ঘুমের শেষে সকালবেলা সবকিছুই তাঁর অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হতে থাকে। আজন্মকাল তিনি যেন একটা অস্ত্র সঙ্গে নিয়েই ঘুরছেন। প্রকৃতপক্ষে অস্ত্রটির কথা তাঁর মনে আছে কি না সেটাও বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ তিনি মোটামুটি অপেক্ষাকৃত খোশমেজাজেই চাকরিস্থলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন এবং স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করেন যে, ইউটিউব দেখে তিনি ‘মিলিটারি টাক-ইন’শিখেছেন, যার ফলে ঢোলা শার্টও নিখুঁতভাবে প্যান্টের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়া তাঁর জন্য এখন ডালভাত। অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটে এবং ঘটনাটা দিনকয়েক স্থায়ী হয়। হঠাৎই বর্তমান অর্থবছরে তিনি জানতে পারেন যে, তাঁর আয়কর হিসাবে গণ্ডগোল হয়েছে এবং তাঁর কাছে সরকারের চব্বিশ হাজার তিনশো চার টাকা বাহাত্তর পয়সা পাওনা হয়েছে। সেই চক্করে অস্ত্রটির কথা তিনি বেমালুম বিস্মৃত হন। যে-জিনিসটি সেই রাতে স্নানাগারে তাঁকে সাত পাকে বেঁধে ফেলেছিল, সেটার কথা তাঁর একেবারেই মনে পড়ে না। অস্ত্রের ভারে ব্যাগের ফিতেটি যে তাঁর কাঁধে আরেকটু চেপে বসে জামার রং ফিকেকরণকে ত্বরান্বিত করছে, তাঁর সেটা খেয়ালই হয় না। ফলে তিনি বরাবরের মতো জীবনযাপন করতে থাকেন। কিন্তু রাতে শুতে যাওয়ার পর দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার অভ্যস্ত পুনরাবৃত্তি তাঁকে নবীন অস্ত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। মেয়ের বিয়ের চিন্তা, ছেলের চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়নের খরচ, দু-পয়সা সঞ্চয়ের অপূর্ণ অভিলাষ, জমির কিস্তি, ঘরে চাল-ডাল-তেল-নুনের চক্রাকার অভাবসহ অন্তহীন চিন্তা।
দুদিন পরের রাত। যখন ভেবেছেন যে রীতা প্রায় ঘুমিয়ে গেছে, তখনই রীতা বলে ওঠে, ‘কিছু ভাবলে?’
‘হ্যাঁ ভাবছি।’
‘লোনটা নিয়ে ফেললেই হয়। এখনো ভাবার কী আছে?’
‘আচ্ছা, আমাদের পরিবারটা তো একটা আদর্শ পরিবার, তাই না?’
‘মানে কী?’
‘আমরা দুইজন, দুইটা ছেলেমেয়ে। মাথার ওপরে ছাদ আছে, বাসাভাড়া দিতে পারি, সুইচ চাপলে আলো জ্বলে, ফ্যান ঘোরে, কল ঘোরালে পানি পড়ে, রান্নার আগুন জ্বলে, রাতের অন্ধকারে ঘুম আসে, সকালের আলোয় ঘুম ভাঙে, আত্মীয়রা আসে, আমরাও যাই, বছরে একবার গ্রামের বাড়ি যাওয়া পড়ে। তাহলে শান্তি নাই কেন? আসলে আমাদের চিন্তাটা কীসের?’
অন্ধকারে রীতার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, ‘ভাবের কথা বলে লাভ আছে? আর এসব তো তোমার কাছে আগে শুনি নাই।’
সদ্যপ্রাপ্ত অস্ত্রের সশস্ত্র অবদানের কথা চেপে যান বদরুল্লাহ, ‘আমি কি অতীত থেকে কোনো অভিশাপ ঘাড়ে করে তোমাদের কাছে নিয়ে আসলাম? নাকি ভবিষ্যৎ এসে অতীতকে আছর করল? এই অস্থিরতা আসল কোত্থেকে?’
এবার রীতাও খানিকটা ভাবের কথায় মজেন, ‘শুধু তুমি কেন? অভিশাপ থাকলে আমার ওপরও আছে। তোমার গলায় ঝুলে আছি, কিন্তু গিলতে দিচ্ছি না।’
ভদ্রতাসূচক সৌজন্যের দিকে বদরুল্লাহ আজ আর ঘেঁষেন না, ‘যেখান থেকেই আসুক, এর জন্ম আমাদের ঘরে না। বাইরে কোথাও।’
‘বাইরেই হবে। আমি তো ছেলেমেয়ের ভালোর কথা ভেবে কোথাও ছাড় দেই নাই। নিজের ব্যাপারে অনেক ছাড় দিয়েছি। মাস্টার্স পাশ করেও বড় কোনো চাকরির চেষ্টা করি নাই। বাসার কাছের কিন্ডারগার্টেনে সাত হাজার টাকার চাকরি করে ওদেরকে স্কুলে আনা-নেয়া করেছি। চেষ্টার ত্রুটি রাখি নাই। তাহলে কেন ছেলেটা কোথাও সুযোগ পাচ্ছে না? মেয়েটা বরং ক্যামনে যেন একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছে।’
‘ঘর থেকে আমরা বাইরে যাই, জুতায় করে ধুলা নিয়ে আসি, সেই ধুলা সারাঘরে ছড়িয়ে যায়। সাথে দুশ্চিন্তাও।’
‘আমার বাপ সকালে উঠে ঘরের মাটি পায়ে নিয়ে ক্ষেতে যেত, আবার ক্ষেতের মাটি নিয়ে ঘরে ঢুকত। ঘরের লেপা মাটিতে পায়ের ছাপ পড়ত বাপের। সেই মাটিও সারাঘরে ছড়াতো। সঙ্গে ছড়াতো ঘুম। গ্রামের চেয়ারম্যান, মহাজন, পঞ্চায়েত, প্রতিবেশী সবাই বাপের কাছে কমবেশি টাকা পেত। কিন্তু ঘরে ঢুকলে বাপ সব ভুলে যেত।’
এই কথায় সাড়া না দিয়ে বদরুল্লাহ বলেন, ‘ধুলা সহজে দেখা যায় না, কিন্তু অ্যালার্জি হয়।’
এই কথায় সাড়া না দিয়ে রীতা বলেন, ‘মাটিমাখা পায়ে কী ঘুমটা ঘুমাতো আমার বাপ! আর আমার ঘুম নাই।’
বদরুল্লাহর রীতাকে বলতে ইচ্ছে করল, ‘চলো আমরা একটা আনন্দের জীবন বেছে নিই। প্রতি বিকেলে আমরা একটি পরিবার ছাদে বসে আড্ডা দেব। সাধারণ খাবার খাব। আমার ছেলের উচ্চশিক্ষিত হওয়ার দরকার নেই, উচ্চশিক্ষায় টেনশন বাড়ে। মেয়েকে সেধে বিয়ে দেব না। মানুষ চড়ুই পাখি না যে ছানার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হতে হবে – অবশ্য জীবন চড়ুইয়ের মতো হলেও মন্দ হতো না। সমস্যা হলো, মানুষ চড়ুই হতে পারে না, কিন্তু চড়ুইয়ের মতো অনেক কিছু তাকে করতে হয়। সন্তানের সঙ্গে বিচ্ছেদ তার একটা। চড়ুইয়ের কাছে এই বিচ্ছেদ স্বাভাবিক। মানুষের কাছে কষ্টকর। আমরা প্রতিদিন রাতে খাবার পর সিনেমা দেখব – ভূতের ছবি। সস্তা যত ভূতের ছবি আছে একটা একটা করে দেখতে থাকব। গভীর ইতিহাস, জীবনবোধ দরকার নাই; মাঝে মাঝে নিরাপদে চমকে ওঠাই যথেষ্ট। আমাদের ভবিষ্যৎ নাই, আমাদের আমরা যেন থাকি। আমাদের মাঝখানে ভবিষ্যৎ না আসে।’
বদরুল্লাহ বলতে পারেন না। দৈবক্রমে অস্ত্র কুড়িয়ে পেয়ে অস্ত্রকে বিস্মৃত হওয়ার আগে বদরুল্লাহর মাথায়ও এসব কথা কোনোদিন আসেনি। হয়তো রীতাও কখনো এরকম কথা ভাবেননি।
পাশাপাশি শুয়ে বদরুল্লাহ ধুলা আর রীতা মাটির কথা ভাবতে থাকেন। নির্জলা শুকনো মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে বাতাসে উড়লে ধুলা হয়, সে আর মাটি থাকে না। ধুলামাটি এক হওয়ার ইতিহাস বিরল। এক না হলেও উভয়েরই ক্লান্তি আসে। ঘুমের ঘোরে কোথায় যেন ‘ঠকাস’ করে শব্দ হয় আর চট করে ছিনতাইয়ের মুহূর্তটি বদরুল্লাহর চোখের অন্দরমহলের পর্দায় ফিরে আসে। তাঁর ব্যাগে থাকা অস্ত্রটা তাঁর দিকেই তাক করে কেউ বলছে, ‘দে, দিয়ে দে।’ অস্ত্রের নলটা তাঁর নাকের কাছে স্থির হলে অস্ত্রধারীর চেহারাটা অস্ত্রের আড়ালে ঢাকা পড়ে। শুধু শোনা যায় তার ভীতকণ্ঠ।
স্বপ্নের বদরুল্লাহর গায়ে কোনো কাপড় নেই। আছে শুধু পকেট। গায়ের চামড়া ছিলে বানানো জামা আর প্যান্টের শুকনো পকেট হাতড়ে তিনি ভীতকণ্ঠে বললেন, ‘কী দেব?’
আগ্নেয়াস্ত্রের নল আবার কেঁপে ওঠে, ‘যা আছে দে। সব দে।’
‘সব তো দিতে পারব না, যা আছে দিতে পারব।’
বদরুল্লাহর খুব শান্তির ঘুম হলো আর পরের সারাদিন তাঁর মনে হতে লাগল তিনি যা আছে দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সব দেননি।
তবে একদিন চাকরিস্থল তাঁকে বাধ্য করল আগ্নেয়াস্ত্রের কথা মনে করতে। কোনো একটি নতুন শাখা খোলার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি দরকার ছিল। কোম্পানি অনেকদিন ধরেই সেই চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বদরুল্লাহসহ তাঁর অধিকাংশ সহকর্মীই মনেপ্রাণে চাচ্ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেন অনুমতি না দেয়। ঢাকা শহরের হিসাবে কমপক্ষে সাড়ে তিন ঘণ্টা দূরত্বের সেই শাখায় পালাক্রমে ‘অডিট’ করতে হবে চাকুরেদেরই এবং সেটাকে তাঁদের নিয়মিত কর্ম হিসেবেই ধরা হবে, অধিকর্ম নয়। সুতরাং এতে কর্মীদের কোনো লাভ নেই, দেশের কী লাভ হবে সে-চিন্তা করার সময় বা ইচ্ছে তাঁরা অনেক আগেই ভুলেছেন। কোম্পানি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিল অনুমোদন পাওয়ার জন্য। কর্মীদের প্রার্থনা আর মালিকপক্ষের মন্ত্রণালয়ে ধরনা – এই দুয়ের মধ্যে মালিকপক্ষ জিতে গেল। কাজেই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করে বৃহৎ আয়োজনে নতুন শাখা উদ্বোধনের দিন ধার্য করা হলো এবং হাততালি দেওয়ার জন্য কর্মীরাও উপস্থিত হতে লাগল। মন্ত্রী স্বয়ং এলে বদরুল্লাহর রক্তচাপ এক বেলাতেই এতটা বাড়ত না, কারণ ব্যাগ নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই। নিরাপত্তাকর্মীরা হয় তাঁর ব্যাগ রেখে দিত, অথবা ব্যাগসহ তাঁকে ভাগিয়ে দিত। এদিকে এই ব্যাগটা কাঁধে ঝোলানো বদরুল্লাহর কাছে জীবনযাপনের মতোই। কোথাও যাওয়ার সময় এটি আপনাআপনিই তাঁর কাঁধে উঠে পড়ে।
তিনি জানতেন আজ নতুন শাখার উদ্বোধন। তিনি জানতেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসবেন। তিনি জানতেন আজ নতুন শাখার বাইরে কড়া পাহারা বসবে। তিনি জানতেন ধাতব-শনাক্তকরণ যন্ত্র হাতে কয়েক স্তরে প্রহরী থাকবে। সর্বোপরি তিনি জানতেন তাঁর ব্যাগে তাঁরই কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্র আছে। তারপরেও নতুন শাখার সামনে পৌঁছে অপেক্ষমাণ সারিতে দাঁড়িয়ে সুবৃহৎ নিরাপত্তাব্যবস্থা লক্ষ করার পর তাঁর খেয়াল হলো ব্যাগটা তাঁর কাঁধে নির্বিকারভাবে ঝুলছে এবং ব্যাগের ভেতরে অস্ত্রের ওজন তিনি আলাদা করে অনুভব করতে পারলেন। মূল শাখা হলে পরিচিত চায়ের দোকানে ব্যাগটা রেখে আসতে পারতেন কিন্তু এখানে তেমন কেউ নেই। কাজেই অস্ত্রসমর্পণকারী অপরাধীর মতোই তিনি সরকারি নিরাপত্তাকর্মীর দিকে সারিবদ্ধভাবে এগোতে লাগলেন। রক্ষী শুরুতে তাঁর গলায় ঝোলানো কোম্পানির পরিচয়পত্রের দিকে তাকালো, এতে হয়তো-বা সন্দেহ কিছুটা প্রশমিত হলো। তারপর প্রথমে তাঁর শরীরে ধাতব-শনাক্তকরী যন্ত্রটি আলতো করে বুলিয়ে দিতেই যন্ত্রে আপত্তিকর শব্দ হলে বদরুল্লাহ পকেট থেকে তাঁর চাবিটা বের করলেন। রক্ষী সেটা আবার তাঁর পকেটে পুরে দিয়ে বদরুল্লাহর ব্যাগের দিকে যন্ত্র তাক করল। ব্যাগের গায়ে যন্ত্র বোলানোর পুরো সময়টা বদরুল্লাহর মাথায় ঘুরছিল, ‘ব্যাংক কি লোনটা স্যাংকশন করল? লোন শোধ করতে হলে প্রতি মাসে তাঁর বেতন থেকে কত টাকা কাটা যাবে? সেক্ষেত্রে সংসারে কী কী খরচ কমাতে হবে?’ এবার রক্ষী তাঁর ব্যাগ খুলে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারার এক পর্যায়ে ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বদরুল্লাহর দুপুরের খাবারের ডিব্বাটা বের করে সেটা খুলতে শুরু করল। আজ সবাইকে কর্তৃপক্ষের খরচে দুপুরে খাবার দেওয়া হবে। কাজেই বদরুল্লাহ খাবারের ডিব্বা নিয়ে কেন ঘুরছেন সে সন্দেহ অবাস্তব নয়। ডিব্বা ব্যাগে ভরে আরো কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে বদরুল্লাহকে ভেতরে যাওয়ার ইশারা দিলো রক্ষী। হতভম্ব বদরুল্লাহ ব্যাগসহ দর্শকসারিতে আসন গ্রহণ করলেন। পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে কী হচ্ছে কিছুই তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। চেয়ারম্যান যখন তাঁর প্রতিষ্ঠানের শূন্য থেকে শীর্ষে ওঠার ইতিহাস বয়ান করছেন, বদরুল্লাহ তখন নদীভাঙা মানুষের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল বাঁচানোর মতো ব্যাগটা দুই হাতে বুকের সঙ্গে চেপে মুখ শক্ত করে বসে আছেন, দৃষ্টি নিচের দিকে। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর যখন কোম্পানির উদ্দেশ্য ও দর্শন ব্যাখ্যা করছেন, বদরুল্লাহ তখন প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে ধাতব চাবি শক্ত করে ধরে রেখেছেন। প্রধান অতিথি যখন সরকারের অবদান ও কোম্পানির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করছেন, বদরুল্লাহ তখন ব্যাগের চেইন ইঞ্চি পাঁচেক খুলে ডানহাতটা ভেতরে ঢুকিয়ে অস্ত্রের অস্তিত্ব নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন। বস্তুত, নিরাপত্তাকর্মী তাঁর ব্যাগ ঘেঁটে অস্ত্র শনাক্ত করতে না-পারাতে তিনি যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁর মুখের দিকে তাকালে আপাত-অপমানিতও মনে হতে পারে।
সুতরাং তিনি চুরি করলেন। কারণ অস্ত্রের অকৃত্রিমতা নিশ্চিত হওয়া তাঁর অবধারিত মনে হলো আর অস্ত্রের অস্তিত্ব থাকা তাঁর জন্য অপরিহার্য। পরদিন কোম্পানির গুদামঘর থেকে তিনি একটি মেটাল ডিটেক্টর গোপনে ব্যাগে ভরে ফেললেন। রীতা নাক ডাকা শুরু করার পর তিনি বিছানা ছেড়ে পাশের ঘরে গেলেন, তাঁর রাতজাগা হতাশ-জোয়ান ছেলে তাঁকে দেখে ফেলল। সামান্য বিস্মিত হলেও সে কিছু বলল না। পাশের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে ব্যাগ থেকে অস্ত্র আর ধাতব-শনাক্তকারী যন্ত্র বের করে অস্ত্রের গায়ে বারবার বোলাতে লাগলেন। যন্ত্র নিশ্চুপ। অস্ত্র নির্বিকার। শোবার ঘর থেকে ঘুমের মধ্যে রীতা কেশে উঠলে অস্ত্রটা ঢুকে গেল ব্যাগে আর মেটাল ডিটেক্টর চলে গেল বিছানার নিচে। শৌচাগারফেরত সংসারী মানুষের মতো তিনি আবার শুয়ে পড়লেন স্ত্রীর পাশে। ‘প্লাস্টিক-ডিটেক্টর’ বাজারে থাকা দরকার ছিল বলে তাঁর মনে হলো। তিনি একটা নকল অস্ত্র নিয়ে ঘুরছেন কি না ভাবতে লাগলেন। রীতার নিশ্বাস আবার ভারী হয়ে এলে বদরুল্লাহ পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষ হিসেবে ঘুমিয়ে গেলেন। সকালে উঠেই পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে একটা পরিষ্কার সিদ্ধান্ত পেলেন। অত্যন্ত মনোযোগসহকারে অফিসে দায়িত্ব সম্পাদন করে ছুটির পর বেশকিছু বড় খেলনার দোকান ঘুরলেন এবং স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্রটা নকল। তিনি আবিষ্কার করলেন, এখন একেবারে সত্যি অস্ত্রের মতো খেলনা পাওয়া যায়। তাতে ম্যাগাজিন থাকে। ম্যাগাজিনে গুলিও থাকে। দোকানিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার নাতির জন্য নিচ্ছি তো, সে আবার সত্যি গুলির মতো গুলি না হলে নেবে না। সত্যি গুলির মতো দেখতে তো?’ দোকানি তাঁকে আশ্বস্ত করল যে, এগুলো দেখতে একেবারে সত্যি গুলির মতো। পার্থক্য দুটা, এতে মানুষ মরে না, আর সত্যি অস্ত্রের মতো ভয় ধরানো শব্দও হয় না। তবে চোখে লাগলে চোখ থাকতে অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আরেকটু ঘুরতেই ঠিক তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্রের মতোই একটি খেলনা কাচের ওপাশে সাজানো দেখে সঙ্গে সঙ্গে খেলনার দোকান ত্যাগ করলেন। আবারো স্নানাগারের লজ্জা ফিরে এলো। তাঁর ছেলের চেয়েও অল্পবয়সী কয়েকটা ছেলে প্লাস্টিক দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে ধাতব আতঙ্ক আদায় করে নিয়েছে। তিনি রাতে স্ত্রীর ঘুমের জন্য মনে মনে অস্থির হলেন। রীতার গভীর নাক ডাকার শব্দেই পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ইশারা পাবেন বলে তাঁর বিশ্বাস। যে-অস্ত্রের কথা তাঁর মনেই পড়ত না, এখন সেটা অবিস্মৃত হয়ে উঠেছে।
বিশ্বাসে সিদ্ধান্ত মিলল এবং বদরুল্লাহ রাতভর স্ত্রীর নাকডাকা শুনলেন। নকল অস্ত্র রাখার চেয়ে ফেলে দেওয়া সম্মানজনক এবং নকল অস্ত্র রাখার চেয়ে খেলনা অস্ত্র রাখা ভালো বিবেচনা করে তিনি অস্ত্র গোপনে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্ত তাঁকে কিছুদিনের জন্য গোয়েন্দা কাহিনির বা চলচ্চিত্রের একজন উত্তেজনাময় খলচরিত্রে রূপান্তর করল। খুব সন্তর্পণে তিনি অস্ত্রের আগাপাশতলা মুছে মুছে আঙুলের ছাপ বিলুপ্ত করতে থাকলে যে কারোই সন্দেহ হবে যে অস্ত্রটি আসল না নকল সে-ব্যাপারে তিনি এখনো সন্দিহান। তবে সেটা সহজ হলো না একেবারেই। এক হাতে রুমাল নিয়ে একদিকে মুছলে অন্যদিকে অন্য হাতের ছাপ পড়ে যায়। সুতরাং তাঁকে একজোড়া দস্তানা কিনতে হলো। প্রতিদিন ময়লার বালতি তাঁকেই ডাস্টবিনে ফেলে আসতে হতো, এই কাজটা তিনি ঘৃণা করতেন। এবার এই আবর্জনাই তাঁর কাছে অস্ত্রমুক্তির পথ হয়ে এলো। ময়লার স্তূপে অস্ত্রটা ডুবিয়ে নিজের এলাকা ছেড়ে তিন ওয়ার্ড পার হয়ে এক ডাস্টবিনে ভোরবেলা তিনি ময়লার বালতি খালি করে দিয়ে নিজের এলাকায় ফিরে একটা খবরের কাগজ কিনে বাসায় ঢুকলেন। বারো নাম্বার পৃষ্ঠার ছোট্ট খবর – নদীর তলদেশে দুমাস আগে ফেলে দেওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী গ্রেফতার। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় অফিসে বেরোনোর আগে বদরুল্লাহ রীতাকে বললেন, ‘আজ ফিরতে রাত হবে।’
অত্যন্ত মনোযোগসহকারে অফিসের দায়িত্ব শেষ করে নয় ঘণ্টা আগে অস্ত্র ফেলে দেওয়া আবর্জনার স্তূপের পাশে দ্বিধান্বিতচিত্তে ঘুরঘুর করতে থাকলেন বদরুল্লাহ। প্রথমেই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো, যে-ময়লার মধ্যে তিনি অস্ত্র ডুবিয়েছিলেন, সেটা এতক্ষণে সিটি করপোরেশনের গাড়িতে চড়েছে। পাশাপাশি তিনি নিশ্চিত হলেন যে, ডাস্টবিনে চুম্বক লাগানো আছে, ফলে অত্র এলাকার সব মানুষ এই ডাস্টবিনের পাশ দিয়েই যাতায়াত করছে। রাত এগারোটায়ও চুম্বকের আকর্ষণ কমল না। শেষে ডাস্টবিনের ত্রিসীমানায় বসা সমস্ত শরীর চুলকাতে থাকা এক অর্ধনগ্ন পাগলের শরণাপন্ন হলেন, ‘নাম কি তোমার?’
পাগল তাঁকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে আপাদমস্তক চুলকাতে থাকল।
‘টাকা নিবা? একশ? পাঁচশো?’
পাগল তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল নির্মোহ চোখে।
‘ভাত খাবা?’
পাগল নির্বিকার।
‘সিগারেট?’
পাগল হাসে।
‘ওই ময়লার মধ্যে আমার নাতির একটা খেলনা হারায়ে গেছে। খেলনা পিস্তল। আইনা দাও, পাঁচটা সিগারেট পাবা।’
পাগল ডাস্টবিনে নামল, চারপাশের মানুষ ফিরেও তাকায়নি। অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃশ্যের দিকে মানুষ কমই তাকায়।
সুতরাং বদরুল্লাহকে আবারো রীতার নাক ডাকার অপেক্ষা করতে হলো। রীতা নাক ডাকলেন বটে, তবে বদরুল্লাহ অপেক্ষা করতে পারলেন না। তাঁর ঘুম এতই প্রকট হয়ে উঠল, রীতাই বরং বদরুল্লাহর গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনে গেলেন। সপ্তাহ-দেড়েক এভাবে চলার পর কর্মস্থল বদরুল্লাহর ঘুম কেড়ে নিলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত খুব দ্রুতই চলে এলো। বিভাগীয় উচ্চপদস্থ সকলকে ডেকে এক গম্ভীর মিটিংয়ে বসলেন। বদরুল্লাহর মনোযোগ তখন অস্ত্রের আসল-নকলে। উচ্চপদস্থ শুরু করলেন, ‘খুব সংক্ষিপ্ত মিটিংয়ের জন্য আপনাদের ডেকেছি। অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, মানে কারো কারো মনে হতে পারে, আমি অনেক কাজ আপনাদের ওপর চাপিয়ে দিই এবং নিজে কাজ কম করি …’
কেউ বলে উঠল, ‘না, না স্যার …’
হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিলেন উচ্চপদস্থ, ‘শেষ করি? কারো কারো হয়তো এ-ও মনে হতে পারে, আমি ছুটি বেশি নিই। কাজেই বলব, আমি আপনাদের বয়স আর সময় পার করে এসেছি। আপনাদের এখনো শেখার সময়। ভবিষ্যতে যাতে আপনারা কোথাও না ঠেকেন, এজন্যই আমি কাজ দিই। আর আমি বস হিসেবে আপনাদের ডমিনেট করার জন্য কাজ দিই না। সহকর্মী বা বন্ধু মনে করেই দিই। তবু অনেকের যখন এরকম মনে হচ্ছে, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ উচ্চপদস্থ একটু নড়েচড়ে বসলে সকলেরই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে ওঠে, ‘আমি এখন থেকে নয়টা থেকে ছয়টা পর্যন্ত অফিসে থাকব এবং নিজেই অধিকাংশ কাজ করব। আমি দেখাতে চাই যে এই বয়সেও সম্ভব।’
সবাই চোখাচোখি করল এবং কেউ বলে উঠল, ‘স্যার, আমরা একেবারেই সেরকম কিছু মনে করি না।’
উচ্চপদস্থ হাসি হাসি মুখে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘সবার কথা তো বলিনি, বলেছি কেউ কেউ মনে করে, হয়তো মনে করে। সবার কাজই কমে আসবে। কেউ কেউ হয়তো আন্ডারলোড হয়ে যাবে।’
সংক্ষিপ্ত মিটিং শেষ হলো আর সমপদস্থদের মধ্যে গুনগুন শুরু হয়ে গেল, ‘স্যারের মতলব কী?’
‘আগে বলেন, স্যারের কানে কথা লাগাইছে কে?’
‘আমি জানি না তো।’
‘আমিও না।’
‘আমার দিকে কেন তাকাইতাছেন? আমি ক্যান কিছু বলব?’
‘সত্যি বলতে আমরা তো এরকম কোনো আলোচনা করিই নাই।’
‘আমার মনে হয়, সেইদিন যে আমরা ওয়ার্কলোড নিয়ে কথা বলতেছিলাম, সেই কথাই কেউ স্যারের কাছে উলটাপালটা লাগাইছে।’
‘হুম, ঠিকমতো ডেসক্রাইব করতে পারে নাই।’
‘স্যারের কাছে চলেন, মাফ চাই গিয়া।’
‘আন্দাজে না বুঝে কী মাফ চাবো?’
‘গিয়া বলব যে, স্যার কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা করে দেন। আমরা এরকম কিছু বুঝে বলি নাই।’
‘তাতে কচু হবে। স্যার বলবে কিছু বলেন নাই তো মাফ চান কেন?’
‘আচ্ছা, এমন ও তো হইতে পারে যে, চেয়ারম্যানই স্যাররে কিছু বলছে।’
‘নাহ, তাইলে স্যার আমাদের নিয়া মিটিংয়ে বসবে কেন? আমাদেরকে জানানোর কী দরকার?’
‘স্যার হঠাৎ কাজের বেগ বাড়ায়ে দিলে সন্দেহ হবে না আমাদের? সেইটা যাতে না হয় সেইজন্য।’
‘বদরুল্লাহ ভাই, আপনি চুপ ক্যান? আপনিই কিছু বলেন নাই তো? আমি বলতেছি না যে আপনার কোনো ইল-ইন্টেনশন ছিল। হয়তো ঠিকমতো ডিসক্রাইব করতে পারেন নাই। আমরা তো মাঝে মাঝে স্যাররে নিয়া কথা বলিই। সব অফিসেই বলে। কথা বলেন, বদরুল্লাহ ভাই।’
‘আমি জানি না। আমি খালি জানি, চাকরি না থাকলেও মানুষের বেঁচে থাকার সুযোগ থাকা দরকার। একজন মানুষ যদি কোনো কাজই না করে, তবু তার খেয়ে-পরে বাঁচার অধিকার আছে।’
‘একটা বিষয় খেয়াল করছেন? স্যার কিন্তু বলছে কেউ কেউ নাকি আন্ডারলোড থাকবে।’
‘মানে কী? কাজ না থাকলে বেতন দেবে?’
‘বেতন! আমার তো মনে হয় কারো কারো চাকরি নিয়া টানাটানি পড়ে কি না।’
চাকরি যাওয়ার কথায় বদরুল্লাহর মনোযোগ অস্ত্র থেকে কিছুক্ষণের জন্য ফিরে এলো। সে-রাতেই তিনি রীতার নাকডাকা আবার শুনতে পেলেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, অস্ত্রটা আসল কি না, সেটা জানতে হলে তাঁকে অন্তত একবার ঘোড়াকল চাপতে হবে। একবার অন্তত গুলি করে দেখতে হবে, সত্যিকার অস্ত্রের মতো শব্দ হয় কি না আর সেই গুলি যেখানে আঘাত করবে সেখানে যথেষ্ট ক্ষতস্থান সৃষ্টি হয় কি না।
পরদিন চাকরিস্থলে গিয়ে বদরুল্লাহ তাঁর চামড়া দিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতা উপলব্ধি করলেন – সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলছে, তবে আড়চোখে তাকাচ্ছে। সবই ঠিকঠাক মনে হলেও বদরুল্লাহর অন্তরাত্মা বলছে সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলছে। বদরুল্লাহর কাছে দুটো সম্ভাব্য কারণ মনে হলো – এক, তাঁর চাকরি চলে যাচ্ছে এবং দুই, চাকরি যাওয়ার আতঙ্ক সৃষ্টির পেছনে সবাই তাঁকে দায়ী মনে করছে। নিরাপদে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে একটি গুলি ছোড়ার মতো নির্জন জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে তিনি ভাবলেন। গতকালও ভেবেছিলেন দুদিন ছুটি নিয়ে গ্রামে যাবেন এবং অনেক দূরে কোনো ফসল কাটা মাঠে গিয়ে গুলি করে অস্ত্রের আসল-নকল নিশ্চিত করবেন। কিন্তু চাকরিস্থলের এই পরিবেশে হঠাৎ ছুটি নিলে তাঁকে নিয়ে সন্দেহই প্রবল হবে এবং চাকরি থাকার শেষ সম্ভাবনা যদি কিছু থাকে, সেটা ফুরিয়ে যাবে।
বাসায় ফেরার পথে অনাকাঙ্ক্ষিত-স্বাভাবিক রাজনৈতিক মিছিলের কারণে রিকশা জ্যামে আটকে গেলে তিনি এর আগেও বহুবার উচ্চারিত কথাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বলে ওঠেন, ‘কী যে হয় ঢাকার রাস্তায়! শান্তিতে কোথাও যাওয়ার কোনো উপায় নাই।’ রিকশাচালকের মধ্যেও বেশ অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়। তার লুঙ্গির গেরোয় বেঁধে রাখা মোবাইল কয়েকবার কম্পনসহ বেজে উঠলে তার কথোপকথনে বোঝা যায় যে চুক্তির রিকশা গ্যারেজে জমা দেওয়ার সময় আসন্ন এবং ক্রয়সূত্রে রিকশার মালিক যানজটের মতো অবধারিত অজুহাতও শুনতে রাজি নয়। মালিকের ওপর কোনো ক্ষোভ রিকশাচালকের ভেতর দেখা গেল না। সে যাবতীয় দোষ চাপালো মিছিলকারীদের ওপর এবং বদরুল্লাহর দিকে পেছন ফিরে বলল, ‘আমার যদি একটা পিস্তল থাকতো না ভাই, সবগুলারে ব্রাশফায়ার কইরা দিতাম।’
অস্ত্রবিষয়ক কথাবার্তায় আগ্রহী হলেন বদরুল্লাহ, ‘আপনি গুলি করতে পারেন? ক্যামনে শিখলেন?’
‘থাকলে তো শিখ্যা লইতাম ভাই। আপনেরে নগদে রিকশা থেইকা নামায়া দিতাম। রিকশার সিটে পা তুইলা বইসা গান গাইতাম আর ব্রাশফায়ার।’
‘ভাই, আমি যদ্দূর জানি, পিস্তল দিয়া ব্রাশফায়ার করা যায় না।’
‘যায়’, ক্ষুব্ধ রিকশাচালকের উত্তর, ‘গুলি একরকমই করণ যায়, ব্রাশফায়ার।’
‘কিন্তু গুলি করা শিখতেন কোন জায়গায়? গুলির যে শব্দ!’
রিকশাচালক সামনে আঙুল তুলে বলল, ‘ওরা ক্যামনে শেখে? ওগো শব্দ অয় না? নাকি শব্দ অইলেও দরা খায় না?’
লুঙ্গির গেরো আবার কেঁপে উঠলে কথোপকথন স্থগিত হয়।
খুব আটপৌরে এবং সম্ভবত স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরবর্তী সংক্ষিপ্ত ঘটনাগুলো ঘটল। শুধু অস্ত্রের গুলি ছোড়ার ক্ষমতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দূরগ্রামে গা ঢাকা দেওয়ার ব্যাপারে এক আদিম আলসেমি ভর করল বদরুল্লাহর সম্পূর্ণ অস্তিত্বে। অস্ত্র তিনি সঙ্গে নিয়েই ঘুরতে লাগলেন; কিন্তু নিশ্চিন্তে-নিরাপদে অস্ত্রের অস্তিত্ব কিংবা অকৃত্রিমতা পরীক্ষা করার মতো নির্জন অবস্থানের কোনো অনুমান করতে পারলেন না। ক্রমশ তাঁর মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হতে লাগল। চাকরিস্থলের নিঃসীম জটিলতা অথবা চাকরি থাকা-না-থাকার অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে তাঁর ঘিলু একটি কথাই মন্থন করতে লাগল – একবার অন্তত যথাযথ লক্ষ্যে ঘোড়াকল চাপতে হবে। একবার গুলি করে দেখতে হবে। গুলি ছুটুক বা না বেরোক, ট্রিগার টানলেই যেন তিনি নিশ্চিন্ত হন, শুধু লক্ষ্য ঠিক থাকলেই হয়। চাকরিস্থলে টানলে কেমন হয়? আতঙ্কিত-বিকৃত-ভয়ে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত দু-চারজন সহকর্মী মারা যাক, কিংবা পরোক্ষভাবে চাকরি খাওয়ার হুমকিদাতা উচ্চপদস্থ চমক খেয়ে কোমায় চলে যাক। নাকি কোনো মিছিলে? মরুক দু-চারটে ক্যাডার, যারা বুঝে না-বুঝে তাঁর পথ আটকেছে বারবার। এক গুলিতে পথের সব ধুলো উড়িয়ে দিতে পারলে হয়তো ভালো হতো, পথের ধুলোর সঙ্গেই তো দুশ্চিন্তা ঢোকে সংসারে। না হয় কোনো ব্যাংকে যাওয়া যাক, এক লকার টাকা চলে আসলেই তাঁর সংসারের সব দুশ্চিন্তার অবসান হয়। অথবা যে-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে তাঁর ছেলে মনমরা হয়ে আছে, তার প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া যাক। তাকে প্রধান বানিয়েছে কে? তাকেই সরানো দরকার আসলে। কোন ছেলে তাঁর মেয়ের প্রেমে পড়েছে? এভাবে তাঁর উদ্দাম চিন্তা সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির শাখা-প্রশাখায় লাফাতে লাগল। কিন্তু শিকড় রয়ে গেল অচ্ছুত। এই অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার কী হতে পারে? কোথায় গুলি করলে সমাধান হবে? কোথায় আঘাত করলে দুঃখের কারণগুলো উপড়ে পড়বে? কিছুদিন পর একটা পর্যায় এলো, যখন বদরুল্লাহর আছে স্থান-কাল-পাত্রের চেয়ে কর্ম বড় হয়ে উঠল। কোথায়-কীভাবে-কেন বিস্মৃত হলেন, গুলি করাটাই জীবনের একমাত্র অপরিহার্য কাজ হয়ে উঠল। একবার আঙুল দিয়ে ট্রিগার টানলেই বুঝি তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হবেন।
অবশেষে ঢাকা মহানগরীর কৃত্রিম দাবদাহে পোড়া কোনো এক গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরে খানিকক্ষণ ডান হাত পকেটে দিয়ে ভিআইপি এলাকায় হন্তদন্ত হয়ে ঘোরার পর হাত বের করে নব্বই ডিগ্রি কোণ বরাবর আকাশে গুলি করে তিনি অস্ত্রচালনা শিখলেন এবং মহড়ার গুলি বের করে দেওয়া মাত্র অস্ত্রটি দিনের আলোয় প্রকটভাবে সবার কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠল। প্রচণ্ড শব্দে চারদিক কেঁপে উঠলে মানুষ-যানবাহন-পক্ষিকুল স্তব্ধ হয়ে গেল। কয়েক লহমার সেই স্তব্ধতা বদরুল্লাহর কাছে খুব উপভোগ্য হলো। তারপরেই চারদিকে যে ধরনের হইচই করে মানুষ ছোটাছুটি শুরু করল, সেটাকে বদরুল্লাহর কাছে হাহাকার ছাড়া কিছু মনে হলো না। তদ্দণ্ডে তিনি গ্রেফতার হলেন এবং ভিআইপি এলাকার প্রটোকল বাহিনী একটি গুলিসমেত অস্ত্র উদ্ধার করল। হাত পিছমোড়া করে ঘাড় ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘কেউ কি মরেছে, ভাই? মাননীয় সরকার কি আমাকে শেষ গুলিটা করার সুযোগ দেবে? আমি তো গুলি করা শিখছিলাম, গুলি তো করি নাই।’ ঘাড়ের ওপর চাপ আরেকটু বাড়ল। মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার আফসোস এবার অপরাধবোধে রূপ নিল।
নিজ কর্মস্থলের মেটাল ডিটেক্টর চুরির অপরাধে তাঁকে বরখাস্ত করা হলো এবং একই মর্মে মামলা হলো। যে নিজেই একটি অবৈধ অস্ত্র বয়ে বেড়াচ্ছে, সে মেটাল ডিটেক্টর কেন চুরি করবে – কেউই খতিয়ে দেখল না। মামলা চালানোর জন্য তার অবশ্য প্রয়োজনও নেই।