আজ অমাবস্যা। সমস্ত আলো শিকার করে নিয়ে গেছে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। রাত এখানে নির্জন, অচঞ্চল। স্থলচর আমরা কয়জন এখন জলের কাছাকাছি। গাঙচরা বিলে জয়নাল ভাই, উসমান আর আবেদ আলীর সঙ্গে মাছ মারা কিস্তি নাওয়ের গলুইয়ে বসে ওদের নিরলস কর্মকাণ্ড দেখি। এরা মাছ ধরার সময় কথা কয় না। যেন ধ্যানরত মুনিঋষি! বর্ষার শুরু কেবল। আজ সারাদিন মনের সুখে বৃষ্টি হয়েছে। আবেদ আলীর ভাষ্য, তাজা পানির গন্ধে মাছের নিশা ধরে! নয়া পানিতে ঝাঁকঝাঁক নবজাতক নিয়ে ভ্রমণরত শোল জননীর ওপর জয়নাল ভাইয়ের নির্দয় কোঁচের নিশানা ফসকায় না। বৈঠাতে উসমান। বড় জ্যাঠার ছেলে। আবেদ আলীর কাজ কেবল টর্চ মারা। ও আমাদের বছুরে কামলা হলেও সম্পর্কটা প্রায় ইয়ারদোস্তের মতো। অপ্রাসঙ্গিক আলোয় উসমানের ঘাড় শিকারি বকের মতো একটুখানি বাঁকতে দেখি কেবল। বিলম্বিত বর্ষায় পানি এখনো কোমরসমান হয়নি। নৌকার তলে আউশের চারা। মাঝে মাঝে অস্পষ্ট ক্রিচ্স্স্ শব্দ হয় কী হয় না! শোল বড় তেজিলা মাছ! কোঁচ থেকে তুলে এর বন্দোবস্তু করতে এরা বিরতি নেয়। টর্চ টিপতে টিপতে আবেদ আলীর পেট ফোলা তর্জনী চেপ্টে গেছে। অনেকক্ষণ পর শুক্লপক্ষ স্বমেজাজে ফিরে যায়। অন্ধকারে উসমান পকেট থেকে বেনসন বের করে। বয়সে আমার চেয়ে মাসছয়েকের বড়। যদিও এইসব ছোট-বড় আমরা মানি না। উপহার হিসেবে ওকে আমিই দিয়েছি। লাইটারে আগুনের জোগান দিতে না দিতেই নিবিড় অন্ধকার নেমে আসে। আঠালো এ-অন্ধকারকে আরো মজবুত করে তোলে বিদ্যুতের অনুপস্থিতি। পল্লীবিদ্যুৎ থাকলেও প্রায়ই অদৃশ্য এখানে! কাছেই বিলের পাশঘেঁষা পাকা রাস্তা। এবার বর্ষা শিডিউল ট্রেন মিস করেছে। লাস্ট ট্রিপের লোকাল ধরে আসছে বোধ হয়! আষাঢ়ের আজ সাত। হাওরের পানি এখনো কোমর ছাড়ায়নি! কালো বোরখাপরা নিপাট অন্ধকার ফুটো করে দেয় বিলের পাশের পাকা রাস্তায় দৌড়ে আসা একটা ট্রাক। হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো মসৃণ আঁধার ফালা ফালা করে তুললে আমাদের পলাতক ছায়ারা কিছুক্ষণের জন্য ফিরে আসে। কায়ার ঘেরটোপে বন্দি আমরা আবার ভুস করে জেগে উঠি। তবে বেশিক্ষণ সঙ্গ দেয় না পিছলে যাওয়া ভৌতিক আলো। বাহনটি অদৃশ্য হতেই রাত তার আগের অবয়বে ফেরে। বৈচিত্র্যহীন অন্ধকার কিন্তু রাতপাখির নিঃসঙ্গ রোদন, পোকার ডাক, বিলে ঘাই দেওয়া মাছের সংলাপ, গাছগাছালিতে জড়ানো-মড়ানো লতাপাতার বনজ গন্ধের ওপর খবরদারি করতে পারে না। নাওয়ের তলানির সঙ্গে ঘষা খাওয়া পানির টলল্ টলল্ শ্রুতিমধুর গান শুনতে শুনতে মন বেভুলা হয় দূর অতীতে। কিছু আব্বার মুখে শোনা, কিছু আমার শৈশবে দেখা।
জলো বিল, নিরলস বয়ে চলা কংসঘেঁষা নদীর গলাগলি ধরা আমার বাপ-দাদার গ্রাম চিরাং। দাদা জাহাবক্স তালুকদারের বেশুমার জোত-জমি। বিশাল সয়-সম্পত্তির মালিক হলেও দাদা কি তার ছেলেরা ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে থাকত না। ধুম কাজের দিনে বাড়ির কায়-কামলার সঙ্গে তারাও খাটত সমানতালে। রোয়া লাগানো, জমিতে লাঙল দেওয়া এসব কায়িক শ্রমে আলসেমি ছিল না কোনো। আব্বাদের ছয় ভাই-তিন বোনের মধ্যে একজনেরই মন ছিল উচাটন! আব্বার সবচেয়ে ছোট ভাই চানফর আলী গাথক, নিজেই গান বানায়, নিজেই গায়। গানের দলের সঙ্গে কোথায়-কোথায় ঘুরে বেড়ায়! সুনামগঞ্জ, নিকলি, মিঠামইন, খালিয়াজুড়ি! বাড়ি ফিরলে হাটবার ছাড়া সেও হাওরে চাষের জমিনে পড়ে থাকে। মনফর জ্যাঠার ঝোঁক ব্যবসায়। বাজারে জ্যাঠার থান কাপড়ের বড় দোকান। বাড়ির লাগোয়া বিছানে আবার আনাজপাতির চাষ করত। এটা ছিল তার হাউস! এদের সবার প্রাণভোমরা যেন মাটির অতলে গোঁজা! এত বড় বাড়ির মধ্যে খালি আব্বারই লেখাপড়ার শখ জাগে। হ্যাঁ, এ-বাড়ির রেসালামতে এইটারে শখই বলা লাগে! ধান, সরিষা-তিসি, আলু-মরিচের আবাদ করার ইচ্ছা পিছলে কেমনে কেমনে যে আমার আব্বার ইশ্কুুলে যাওয়ার মন লাগে! সেটা বোধহয় দাদার বাড়িতে লজিং থাকা প্রাইমারি স্কুলের ইসমাইল স্যারের সুবাদে। লজিং মাস্টারের বাড়ি ২০-৩০ মাইল উজানে। সেদিনের হিসাবে এই পথের দূরত্ব অনেক বেশি বইকি! নাই রাস্তাঘাট, নাই যানবাহন। বর্ষাকালে নাও-নৌকাই ভরসা। লজিং মাস্টার নিয়া আমার কিচ্ছা না, কিচ্ছা আব্বারে নিয়া। চৌদ্দগুষ্টির মধ্যে পড়ালেখা না থাকলে কী, আব্বা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তেলেসমাতি দেখানো শুরু করেন; শুধু ক্লাসে প্রথম হয়ে না, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করে (পঞ্চম) তালুকদার বাড়ির মধ্যে একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটান। আব্বা আরো লেখাপড়া করার জন্য টাউনে পাড়ি জমান। বাপের টাকা-পয়সার অভাব নাই আর পুত্রের ধৈর্যের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, এমএ শেষ করে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। অনার্স পড়ার সময়ই আব্বার শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। গাঁয়ের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আম্মাও গ্রাম ভালোবাসেন। আব্বা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বদলির চাকরি। আগের মতো হুটহাট বাড়ি যাওয়া কমে যায়। তবে বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুলের দীর্ঘ ছুটিতে গ্রামে যাওয়া ছিল আমাদের জন্য উৎসব।
সড়ক উঁচু করে এর মধ্যে রাস্তাঘাট হয়েছে। তবু ভাটির দেশ বলে কথা! বাড়ি অবধি গাড়ি যায় না। চৈতার হাওরের কাছে নেমে বাড়ি যাওয়ার বাকিটা পথ হাঁটতে হয়। পথে ফসলি মাঠেই দেখা হয়ে যায় জ্যাঠা-কাকাদের সঙ্গে। ওদের পরিশ্রমী পিঠের নানামাত্রিক ঘামের রেখা আমার শিশুহৃদয়ে গভীর হয়ে দেবে থাকে। সেসব তরল জলকণা আমার বুকে সযতনে লিখে দেয় ‘ভূমিপুত্র’ শব্দটি। বাড়ির দিনগুলো খড়ের গাদায় লুটোপুটি করে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরে, গাছের ফল-পাকুর খেয়ে ব্যাখ্যাতীত আনন্দে ফুড়–ত করে শেষ হয়ে যেত! দিন তো পায়ে পায়ে হাঁটে না, দৌড়ায়! বড় হওয়ার পর গ্রামপ্রীতি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। নগরের চটকদার জীবন গ্রামের সবুজ আকর্ষণ কেড়ে নেওয়ায় ঘোর তৎপর হয়ে ওঠে। আম্মাও শহরে গোছানো সংসারের ছককাটা ফ্রেমে ঢুকে পড়েন। ঢাকা একরকম আমাদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। ইস্ত্রি করা মসৃণ আভিজাত্য ধানক্ষেতের ইঁদুরের মতো ঢুকে পড়ে আমাদের গৃহস্থঘরে। কেবল আমার বোধের কোথায় যেন মাটির নেশা রয়ে যায়! টবের অনুর্বর মৃত্তিকায় নানা জাতের গাছ লাগাই। অচেনা লাল মাটিতে অভিমানী গাছ বাড়ে না। বিরক্ত হয়ে হাল ছাড়ি।
ভাইজান উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা উড়াল দেয়; বড় আপাও বিয়ের পর কানাডা পাড়ি জমায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিওর অ্যাগ্রিকালচারে ভর্তি হই। ব্রহ্মপুত্র নদ, বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে থাকা চারপাশের দৃশ্যমান গ্রামগুলো আমার ভেতরের ভূমিপুত্রকে খুঁচিয়ে তোলে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ক্যাম্পাসের জমিতে হালচাষ করতে করতে আমার পিঠেও পূর্বপুরুষের মতো শ্রমক্লান্ত ঘাম জমে। ওদের আদলে তর্জনীর পেট দিয়ে কপালের ঘাম ঝরাই। ক্লান্তির সঙ্গে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ বোধ করি। ফসলের জমি তৈরি, আবাদের সঠিক পদ্ধতি, পর্যাপ্ত ফসল ফলানোর থিওরি খুব নতুন লাগে না আমার কাছে। বেশি ফলনের জন্য সারি বেঁধে ধানের চারা লাগানো, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের জন্য মাটিকে মিহি তুলতুলে করে তোলা, পানির জোগান দেওয়া চাচা-জ্যাঠাদের কাছে দেখা এসব শৈশবের পাঠ আমার। এখন বাসে ময়মনসিংহ থেকে বাড়ি যাওয়া যেন এক দৌড়ের পথ। যোগাযোগের নড়বড়ে সাঁকোটা মেরামতে তৎপর হই। সত্যি বলতে কী, দাদা-দাদি মারা যাওয়ার পর আব্বাও গাঁয়ে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে …। উসমানের শিকারি চোখ ঘুরতে আসা এক বেভুলা কালা বাউশের পিঠ কচাৎ শব্দে গেঁথে নিলে আমার স্মৃতিভ্রমণে আবেদ আলীর উল্লাস ঢুকে পড়ে। বিড়ি টানার উছিলায় সবাই গালগল্পে মাতি।
– তাইলে তুমি ঠিক করছো বিদেশ চইলাই যাইবা? আবেদ আলী সকাল থেকে এ নিয়ে ছয়-সাতবারের মতো জিজ্ঞেস করেছে কথাটা। যতবার আমি জানাই – হ্যাঁ, চইলাই যাইতাছি; ততবার হতাশায় ওর লম্বা থুঁতনি আরো লম্বা হয়ে যায়। ফজরের আজানের আগে আগে বাড়ি ফিরি আমরা। ঘুমের ওজনে কেউ কারো দিকে তাকাতে পারি না।
এক আজানে ঘুমিয়ে আরেক আজানে ঘুম থেকে জেগে দেখি দিন ঝলমল করছে। ক্ষিধায় পেট জ্বলছে। সকাল থেকে পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। জেঠি ভাত বেড়ে আমাকে ডাকে – এলা খাইতো আয়া ফরো, বহুত মাছ ধরা অইছে! আমি হাত ধুতে ধুতে জানতে চাই জয়নাল, উসমান আর আবেদ আলী খেয়েছে কি না। – হেরা এক গড়ান ঘুমানি শেষ কইরা কুমবালা উঠ্যা রায়ের বাজারো গেছে গা! জেঠির কথায় মনে পড়ে, আরে আজকে না হাটবার!
হাটবার আমার একটা পছন্দের দিন। আশপাশের পুরা এলাকার পরিষ্কার একটা নকশা পাওয়া যায় হাটে গেলে। রায়ের বাজারের হাট অনেক বড় হাট! কত জিনিস বেচাকেনা হয়! শুধু কী কেনাবেচা! গায়েন আর কবিয়ালরাও আসে। আসে কিচ্ছাগাথকের দল। আরো কত রকমের পসরা বসে! মিঠাইয়ের দোকানই বসে নানা কিসিমের। গজা, তিলের খাজা, আঙুর ভাজা, তিলুয়া। আর রসগোল্লা, কালোজাম, ছানার মিষ্টির কথা বাদই থাক। বিশাল মাছের আড়ত দেখার মতো। সেই মোহনগঞ্জ, ইটনা, মিটামইন থেকে জাউল্লারা মাছ নিয়ে আসে। ভাত খেতে খেতে খেয়াল করি জেঠি আঁচলে চোখ মুছছে। আমি এ-অশ্রুর কারণ জানি তাই আর জিজ্ঞেস করি না। বরং খেয়ে অন্যদিন যেখানে বসে আরো একটু গল্প করি; বরং আজ হাত ধোয়া শেষ করেই উঠে ছাদে চলে যাই।
এও এক গপ্পো, আব্বা নিয়মিত না এলেও বাড়িতে পাকা তিনতলা বিল্ডিং তুলে রেখেছে। তাঁর উপসচিব হওয়ার গরিমা এখানে এভাবে টানিয়ে রেখেছেন তিনি। আগে আমাদের বাড়িটাকে তালুকদারবাড়ি নামে চিনত সবাই, এখন ডাকে তিনতলা বাড়ি। ইটের প্রাণহীন কাঠামো বংশের পরিচয় ওপরে নেওয়ার পাঁয়তারা জুড়েছে। অনিয়মিত হলেও বেশ আগে থেকেই এখানে কারেন্ট চলে এসেছে। ফলে সবুজের বিস্তারে একখণ্ড নগরের অপ্রাসঙ্গিক জবরদস্তি! আমি বাড়িটাকে দূর থেকে লক্ষ করেছি। গ্রামের সবুজের মাঝখানে কেমন বেমানান লাগে।
ছাদে দাঁড়িয়ে প্রিয় বেনসন ধরাই। সড়ক ধরে যাওয়া লোকজন দেখি। বেশিরভাগের গন্তব্য হাট। মাথায় আনাজ-তরকারি, হাতে ঝোলানো হাঁসটা, মুরগিটা। হাটে বেচবে। এ-দৃশ্যও অচিরে লোপ পাবে। ভাটির রিমোট এলাকা হলে কী! দালাল আর ফড়িয়াদের লম্বা হাত এখান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে এরা এলাকার সেরা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যায় শহরের পেটমোটা লোভীদের জন্য। যাদের বিন্দুমাত্র মায়া নাই, ভালোবাসা নাই আপ্রাণ ভুলে যাওয়া গাঁয়ের মাটি ও মানুষের প্রতি। বর্ষার আকাশে মেঘের খঞ্জনি বেজে ওঠে। মেঘের সাঁজোয়া বাহিনী দলবল নিয়ে নামার পাঁয়তারা করছে। বিকেল মোহময় হয়ে উঠলে আমার যুবক-হৃদয়ে আয়েশার স্মৃতি উজিয়ে ওঠে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দ্বিতীয় বর্ষ থেকে মধুর আনন্দে প্রেমের গাঁটছড়া বাঁধি আমরা। কথা হয় পাশ করার পর গ্রামে থাকব। স্বপ্নে নয়, বাস্তবের মৃত্তিকায়। ফাইনালের পর কথা না-রেখে আয়েশা উড়াল দিলো জাপান। বুক টনটন করলেও একরোখার মতো আমি রোজ তাকে ভুলে যেতে থাকি। কিন্তু প্রেম ভোলা সহজ কথা! একটা হুলোড়ে আমোদে রাস্তায় তাকাই। সামনের সড়কে হইহই করে ফিরছে হাটুরের দল। তাদের কয়েকজনের হাতে মানুষ সমান বিশাল এক বোয়াল। মাছটা দেখার মতো বটে। ওদের দলে ভিড়ে যায় কৌতূহলী আমুদে লোকজন। দূরে দেখা যায় চানফর চাচার গাথক দলটাকে। ওরা হাটবার এলে বিনে পয়সায় গান ফেরি করে। ঠোঁটে বহন করে নিয়ে আসা সুরকে প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে অপার আনন্দে মাতে গায়েনরা।– তাইলে তুমি ঠিক করছো বিদেশ চইলাই যাইবা? আবেদ আলী সকাল থেকে এ নিয়ে ছয়-সাতবারের মতো জিজ্ঞেস করেছে কথাটা। যতবার আমি জানাই – হ্যাঁ, চইলাই যাইতাছি; ততবার হতাশায় ওর লম্বা থুঁতনি আরো লম্বা হয়ে যায়। ফজরের আজানের আগে আগে বাড়ি ফিরি আমরা। ঘুমের ওজনে কেউ কারো দিকে তাকাতে পারি না।
এক আজানে ঘুমিয়ে আরেক আজানে ঘুম থেকে জেগে দেখি দিন ঝলমল করছে। ক্ষিধায় পেট জ্বলছে। সকাল থেকে পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। জেঠি ভাত বেড়ে আমাকে ডাকে – এলা খাইতো আয়া ফরো, বহুত মাছ ধরা অইছে! আমি হাত ধুতে ধুতে জানতে চাই জয়নাল, উসমান আর আবেদ আলী খেয়েছে কি না। – হেরা এক গড়ান ঘুমানি শেষ কইরা কুমবালা উঠ্যা রায়ের বাজারো গেছে গা! জেঠির কথায় মনে পড়ে, আরে আজকে না হাটবার!
হাটবার আমার একটা পছন্দের দিন। আশপাশের পুরা এলাকার পরিষ্কার একটা নকশা পাওয়া যায় হাটে গেলে। রায়ের বাজারের হাট অনেক বড় হাট! কত জিনিস বেচাকেনা হয়! শুধু কী কেনাবেচা! গায়েন আর কবিয়ালরাও আসে। আসে কিচ্ছাগাথকের দল। আরো কত রকমের পসরা বসে! মিঠাইয়ের দোকানই বসে নানা কিসিমের। গজা, তিলের খাজা, আঙুর ভাজা, তিলুয়া। আর রসগোল্লা, কালোজাম, ছানার মিষ্টির কথা বাদই থাক। বিশাল মাছের আড়ত দেখার মতো। সেই মোহনগঞ্জ, ইটনা, মিটামইন থেকে জাউল্লারা মাছ নিয়ে আসে। ভাত খেতে খেতে খেয়াল করি জেঠি আঁচলে চোখ মুছছে। আমি এ-অশ্রুর কারণ জানি তাই আর জিজ্ঞেস করি না। বরং খেয়ে অন্যদিন যেখানে বসে আরো একটু গল্প করি; বরং আজ হাত ধোয়া শেষ করেই উঠে ছাদে চলে যাই।
এও এক গপ্পো, আব্বা নিয়মিত না এলেও বাড়িতে পাকা তিনতলা বিল্ডিং তুলে রেখেছে। তাঁর উপসচিব হওয়ার গরিমা এখানে এভাবে টানিয়ে রেখেছেন তিনি। আগে আমাদের বাড়িটাকে তালুকদারবাড়ি নামে চিনত সবাই, এখন ডাকে তিনতলা বাড়ি। ইটের প্রাণহীন কাঠামো বংশের পরিচয় ওপরে নেওয়ার পাঁয়তারা জুড়েছে। অনিয়মিত হলেও বেশ আগে থেকেই এখানে কারেন্ট চলে এসেছে। ফলে সবুজের বিস্তারে একখণ্ড নগরের অপ্রাসঙ্গিক জবরদস্তি! আমি বাড়িটাকে দূর থেকে লক্ষ করেছি। গ্রামের সবুজের মাঝখানে কেমন বেমানান লাগে।
ছাদে দাঁড়িয়ে প্রিয় বেনসন ধরাই। সড়ক ধরে যাওয়া লোকজন দেখি। বেশিরভাগের গন্তব্য হাট। মাথায় আনাজ-তরকারি, হাতে ঝোলানো হাঁসটা, মুরগিটা। হাটে বেচবে। এ-দৃশ্যও অচিরে লোপ পাবে। ভাটির রিমোট এলাকা হলে কী! দালাল আর ফড়িয়াদের লম্বা হাত এখান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে এরা এলাকার সেরা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যায় শহরের পেটমোটা লোভীদের জন্য। যাদের বিন্দুমাত্র মায়া নাই, ভালোবাসা নাই আপ্রাণ ভুলে যাওয়া গাঁয়ের মাটি ও মানুষের প্রতি। বর্ষার আকাশে মেঘের খঞ্জনি বেজে ওঠে। মেঘের সাঁজোয়া বাহিনী দলবল নিয়ে নামার পাঁয়তারা করছে। বিকেল মোহময় হয়ে উঠলে আমার যুবক-হৃদয়ে আয়েশার স্মৃতি উজিয়ে ওঠে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দ্বিতীয় বর্ষ থেকে মধুর আনন্দে প্রেমের গাঁটছড়া বাঁধি আমরা। কথা হয় পাশ করার পর গ্রামে থাকব। স্বপ্নে নয়, বাস্তবের মৃত্তিকায়। ফাইনালের পর কথা না-রেখে আয়েশা উড়াল দিলো জাপান। বুক টনটন করলেও একরোখার মতো আমি রোজ তাকে ভুলে যেতে থাকি। কিন্তু প্রেম ভোলা সহজ কথা! একটা হুলোড়ে আমোদে রাস্তায় তাকাই। সামনের সড়কে হইহই করে ফিরছে হাটুরের দল। তাদের কয়েকজনের হাতে মানুষ সমান বিশাল এক বোয়াল। মাছটা দেখার মতো বটে। ওদের দলে ভিড়ে যায় কৌতূহলী আমুদে লোকজন। দূরে দেখা যায় চানফর চাচার গাথক দলটাকে। ওরা হাটবার এলে বিনে পয়সায় গান ফেরি করে। ঠোঁটে বহন করে নিয়ে আসা সুরকে প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে অপার আনন্দে মাতে গায়েনরা।